কৃষ্ণপক্ষের কালিগোলা অন্ধকার রাত। গা ছমছমে একটা ডাক ভেসে আসে সজনে গাছের জমে থাকা অন্ধকারের আড়াল থেকে। বড্ড ভয়ংকর সেই ডাক। গাঁয়ের লোকেরা বলে জমকুলি ডাকে। রক্ত হীম করা করুণ সুরে। কু-উ-উ কু-উ-উ রবে। এই জমকুলি আদৌ কী, তা বলতে পারে না কেউ, শুধু ভয় পেতেই জানে। লাইট জ্বালিয়ে সজনে গাছের মাথটা একবার দেখে আসে সে সাহসও নেই কারও। বলে, জমকুলি জম ডেকে আনে বাড়িতে। শয়তান এসে অমঙ্গলের বার্তা দিয়ে যায়। খুব শিঘ্রি সেই বাড়িতে কেউ অপঘাতে মরবে। আয়তাল কুরসি পড়ে জমকুলি তাড়ানোর চেষ্টা চলে। কাজ হয় না। অতএব জমকুলি গায়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম কওে আছে শত বছর ধরে। এক রাতে আবিষ্কৃত হলো জমকুলি রহস্য। শয়তান বা অপদেবতা নয়, সজনে গাছের ওই বাসিন্দা অতি নিরীহ নিমপেঁচা। দিনে তাঁদের ডাক খুব বেশি শোনা যা না। শুনলেও পিনপতন নিরবতায় যে গা ছমছমে আবহটা ছিল, দিনের আলোয় তার ছিটেফোঁটা থাকে না।
এতগাছ রেখে নিম পেঁচার আবাস কেন সজনে গাছে? সজনে গাছ বড় নরম। খুব সহজেই কোটর বানিয়ে তাতে বাস করা য়ায়। কিছুদিনের মধ্যে বড় বড় চোখের তুলতুলে ছানায় ভরে ওঠে কোটরগুলো। আমাদের দৃষ্টিও সেদিকে। পাখি ছোটদের বিশেষ প্রিয়। তার চেয়েও বেশি প্রিয় পাখির ছানা। যতদিন কোনও গাছে পাখির বাসা থাকে, ততদিন ওই গাছটাই থাকে লক্ষ্যবস্তু। প্রতিদিন একবার করে যাওয়াই চাই সেখানে। নিম পেঁচার সেই বাসার খোঁজেই সজনে গাছগুলোতে অবাধ বিচরণ ছিল আমাদের।
সজনে গাছ, ফুল, কুড়ি থেকে জব ডাঁটা থেকে শুকনো ফল-বীজ পর্যন্ত মনের গহীনে সাজানো আছে শতশত স্মৃতি। বিরাট বিরাট সব সজনে গাছ দেখেছি ছোটবেলায়। একেকটা বটগাছ যেন। রাস্তার ধারে এখানে সেখানে কত সজনে গাছ যে গাঁয়ে ছিল ইয়ত্তা নেই। বর্ষাদিনে রাস্তার পাশের সজনে গাছগুলো ছিল মহাবিরক্তিকর বস্তু। গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা কাদায় ভরে যায়। মাঝে মাঝে এমন খানাখন্দ সৃষ্টি করে পথে, সেখানকার গাছপালা ধরে লাফিয়ে ডিঙোতে হয় সেই সব খানাখন্দ। কিন্তু সজনে গাছ ধরে বা এর পাশ ঘেঁষে অসাবধানে তা করতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। বর্ষাকালে সজনে গাছের গায়ে আস্তানা গাড়ে এক ধরনের বিষাক্ত শুঁয়োপোকা। কোনো এক প্রজাতির প্রজাপতির বাচ্চা এরা। শরীরে কোনো মতে এদের সামান্য পরশ পেলেই হয়, জ্বলুনি, চুলকানির একশেষ হয়ে উঠবে। পরে ফুলে লাল হয়ে দাগড়া দাগড়া হয়ে উঠবে শরীরের সেই স্থান। গাছেরও কম ক্ষতি করে না এই পোকাগুলো। মানুষ বিরক্ত হয়ে পাটকাঠির মাথায় আগুন জ্বলে পুড়িয়ে ফেলত সেই পোকা। রক্ষা পেত গাছ, রেহায় পেত অসাবধানী মানুষও।
সজনে চিরহরিৎ বৃক্ষ বিরাটাকৃতির বৃক্ষ। বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় এদের দেখা মেলে। দ্রুত বর্ধনশীল। পূর্ণবয়স্ক সজনে গাছে ৬০-৭০ ফুট লম্বা হতে পারে।
সজনে গাছের কাণ্ড ধূসর রঙের। অমসৃণ, নরম। পূর্ণ বয়স্ক গাছের কাণ্ডের বেড় ৮-১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
কাণ্ড থেকে অনেক সময় ঘন জেলির মত তাল তাল আঠা বের হয়। বাদামী রংয়ের এই আঠা ছোটকালে আমাদের খেলাঘরে গরুর মাংস হিসেবে রান্না করতাম।
সজনে গাছের ডালপালা সাজানো গোছানো। কাণ্ডের মাথা থেকে অসংখ্য ডাল খাড়া ভাবে ওপরের দিকে উঠে যায়। প্রতিটা ডালে ছোট ছোট প্রশাখা থাকে। এই প্রশাখা থেকেই ফুল ও ডাঁটা বের হয়।
ডাঁটা খেয়ে শেষ হয়ে গেলে ডালগুলো গোঁড়া থেকে কেটে ফেলা হয়। পরের বসন্তে সেখান থেকে যেন নতুন খাড়া ডাল বের হয়। সেগুলো থেকে নতুন ফুল-ফল গজায়। অনেকেই মনে করে সজনে গাছের বংশ বিস্তার ঘটে অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমেও যেমন নতুন সজনে গাছ জন্মাতে পারে, তেমনি বীজ থেকেও নতুন চারা জন্মায়। কিন্তু অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে জন্মালে নতুন সজনে গাছ অনেক বেশি পুষ্ট ও ফলনশীল হয়। তাই প্রক্রিয়াই বেশি জনপ্রিয়।
একটা মজার কথা বলি। সজনের আবার দুটো শ্রেণী। একটা মৌসুমি, এটাকে গাঁয়ে সজনে নামেই চেনে। এই জাতের গাছ থেকে বছরে একবারই ডাঁটা পাওয়া যায়। আরেকটা জাতের নাম নজনে। নজনে গাছে সারা বছরই ফুল-ফল ধরে। মজার ব্যাপারটা হলো, গাঁয়ের লোকেরা মনে করে সজনে গাছের ডাল কেটে সেটা যদি সোজা করে লাগানো হয় তবে যে গাছটা জন্মায় সেটা সজনে গাছই হবে, কিন্তু উল্টো করে পুঁতলে, অর্থাৎ আগটা মাটিতে পুঁতলে যে নতুন গাছ জন্মায় সেটা হবে নজনে গাছ। কথাটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী জানিনে। তবে আমার দাদি ও মা’কে দেখেছি এভাবে সজনেকে নজনে গাছের রূপান্তর করতে।
সজনে পাতা হালকা সবুজ রঙের। ছোট ছোট ডিম্বাকৃতির পাতা। একেকটা পাতার দৈর্ঘ্য বড় জোর এক সেণ্টিমিটার। পাতা অত্যন্ত পাতলা ও নরম। সজনের পাতা অত্যন্ত সুস্বাদু শাক হিসেবে খায় মানুষ।
পাতা বহুপত্রক। একটা বোঁটায় অনেকগুলো শাখা বোঁটা থাকে। শাখা বোঁটায় আবার প্রশাখা বোঁটা থাকে। শাখা ও প্রশাখা বোঁটা মিলি ১০-১৫ টি পাতা থাকে।
ফাগুনের শুরু। এমনিতে প্রকৃতি শান্ত থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিম্নচাপের প্রভাবে শেষ বিকেলে দমকা হাওয়ার আকারে মৃদু ঝড় বয়ে যায়। সাথে ছিটে-ফোঁটা বৃষ্টি। পরদিন সকালে স্কুলে যাবার পথে কাঁচা রাস্তায় ধুলোর আস্তরণে দেখি ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির দাগ। বাতাসের তাণ্ডবে ঝরে পড়া সজনে কুড়িগুলো সকালের সোনালি আলোয় মুক্তোদানার মত ঝিকিয়ে ওঠে। সেই দৃশ্য এক অপার্থিব অনুভূতি জাগায় মনে।
সজনের ফুলে সাদা রঙের। গোল, চার-পাঁচটা সাদা-পুরু পাপড়ি থাকে। পাপড়ির ভেতরে থাকে হলুদ রঙের কিশোর। পাতার মত ফুলও ভাজি করে খাওয়া যায়।
সাধারণ ফাগুনের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত ফুল আসে। সজনের ডাঁটা হিসেবে যেটা বাজারে বিক্রি হয় সেটাই সজনের ফল।
ফল সবুজ রঙের। লম্বাটে। ১-২ ফুট লম্বা হয়। ফল সর্বোচ্চ দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত মোটা হতে পারে। ফলের ভেতর অদ্ভুত আকৃতির বীজ থাকে।
বীজে পাখা থাকে। শুকনো বীজ এই পাখায় ভর দিয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে তবে খুব কম বীজ থেকেই চারা হয়। বর্ষাকালে বীজ ও ডাল থেকে নতুন গাছ জন্মায়। সজনে গাছের
বৈজ্ঞানিক নাম: Mornga olefera lamk.
আগের পর্ব : বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২৯ : কাঁঠাল
মন্তব্য
আরও একটা অনবদ্য লেখা। আপনার টুকরো স্মৃতি লেখাটাকে অসাধারণ করে তুলেছে! করেছে মনোমুগ্ধকর!
বিষয়টি সত্যি কৌতুহলিদ্দপক। আমি এখনো অবাক হয়ে ভাবছি, কিভাবে নিজের পাখায় ভর করে উড়ে চলে দূর-দূরান্তে!
পুরো লেখাটি-ই প্রচন্ড উপভোগ করেছি। বাংলার তরু-লতা-গুল্ম সিরিজের একটি ক্লাসিক হয়ে থাকবে সযতনে সাজানো এই সজনে-পর্বটি!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ, একটু পুষ্ট ডাঁটা খাওয়ার সময় বীজগুলোর দিকে খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন এর পাখা কেমন হয়।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সজনে ডাটা দিয়ে ডাল আমার খুব প্রিয় !!! আহা, কতদিন খাইনা
সুন্দর লেখা
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
শুরুটা দারুণ হয়েছে, জমকুলি নামটা জানা ছিল না।
লেখা দারুণ, আজকেও সজনা খেয়েছি
facebook
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
দারুণ একটা লেখা। ছবিগুলোও খুব সুন্দর!
ধন্যবাদ, পৌঢ়দা, আপনাদের প্রেরণাই আমাকে উদ্দীপ্ত করে, লেখার ভরসা পাই।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সজনা একটা ফাডাফাডি জিনিস
আপনার এই পোস্টগুলা চমৎকার হয়।
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ, পীর সাব, আসলেই জিনিসডা ফাডাফাডি!
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সজনের আঠা পাটখড়ির ডগায় লাগিয়ে ফড়িং ধরার কেনোলজির কুনু বিবরণ দিলেন না যে?
----ইমরান ওয়াহিদ
ওটাও আসবে, জীবলি পর্বে। সজনের আঠার আঠাত্ব কম, তাই ওটা দিয়ে ও চেষ্টা করিনি। তবে জীবলির আঠা ভয়াবহ জিনিস, ওটা দিয়েই বরং ফড়িং ধরা সহজ ছিল।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ধন্যবাদ। মুগ ডালের সাথে সজনের ডাঁটা, আহ! কী স্বর্গীয় স্বাদ!
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
আপনার এই পর্বটি বেশ ভালো লেগেছে। সজনে ডাঁটা দিয়ে ডাল আমার একটি পছন্দের খাবার।
খুব ভালো লেখা।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
লেখায়
আম্রিকা আসা অবধি আর কোনদিন কচি সজনেডাঁটা খাওয়ার সুযোগ পাই নি!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খুবই দু:খের কথা! কী আর করা, মাঝে মাঝে দেশে বেড়িয়ে যান।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন