বনে বাঁদাড়ে ঘুরে ঘুরে কত বুনো লতার সন্ধান পেয়েছি। পরম বন্ধুর মতো তাদের সাথে আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে। কত খেলেছি তাদের সাথে। কিন্তু নাম জানা হয়নি সেসব বন্ধুদের। আসলে এত কালের বন্ধু, এত আপন তারা-- তাদের সাথে কখনও বিচ্ছেদ হবে--একথা সুদূর কল্পনাতেও আসেনি কখনো। তাই নাম জানার প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু আজ যখন ঢাকা শহরের বদ্ধ গলিতে হাঁসফাস করি, একটু স্বচ্ছ বাতাসের জন্য মন আঁইটাঁই করে, তখন ফিরে যাই স্মৃতিমধুর ছেলেবেলায়। শৈশবের নাম না জানা সেসব বন্ধুদের কথা মনে আসে বার বার। তাদের ছবিকে সময়ের কুহেলিকা ভেদ করে বার বার স্বচ্ছ হবার প্রাণান্ত প্রয়াস অনুভব করি। তখন মনে হয়, কী ভুলই না করেছি এদের নাম না জেনে। এখন গ্রামে গেলেও সবার দেখা পাই না। বাংলার জল-হাওয়া ছেড়ে মহাকালের গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়েছে যারা, কোথায় পাব তাদের? যারাা আড়ালে-আবডালে লুুকিয়ে আছে, তাদেও খোঁজই বা করব কীভাবে, নাম যে জানি না! সেসব মেঠো ঘাসের ইতিহাস কে লিখবে, কে সাক্ষ্য দেবে তাদের গৌরবময় অতীতের?
গ্রাম ছেড়েছি বহুদিন। গ্রামের সাথে সমন্ধ ছেদ হয়নি আজও। মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। বনে-বাঁদাড়ে ঘুরি। ছবি তুলি বুনো লতা-পাতার। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব গাছপালার দেখা পেয়ে যাই, যার কথা একবারে বিস্মৃত হয়েছিলাম। তখন তাকে দেখে একলহমায় কত স্মৃতি এসে ভিড় করে। এবার বাড়ি গিয়ে পেয়ে গেলাম বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটার দেখা।
ময়নাকাঁটার সন্ধান এবার পেতামই না হয়তো। যেদিন ঢাকায় ফেরার কথা ওই দিন না ফিরে আরেকটা দিন বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বিচ্ছু বাহিনী নিয়ে বের হলাম কুমোর পাড়ার দিকে। মৃৎশিল্পীদের বহু স্মৃতি গেঁথে আছে মানসপটে। তাদের কিছু ছবি তুলে আমার ক্যামেরাটাকে সার্থক করতে চাই। তা বেশ কিছু মূল্যবান কিছু ছবিও তোলা হলো। এবার ফেরার পালা। খালের ধারে এসেই ফসল ক্ষেতের এক বেড়ায় চোখ আটকে গেল। বহু বহু বছর আগে দেখা অপরূপ মেঠোফুল আবার নতুন করে দেখা দিয়ে আমাকে থমকে যেতে বাধ্য করল। ছবি তুললাম। দেখলাম মনের সাধ মিটিয়ে। কিন্তু কী নাম এই ফুলের? চলতি পথের যে ক’জনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ নামটা বলতে পারল না। শেষে মুরব্বিগোছের এক ভদ্রলোক বললেন, ‘ময়নাকাটা।’
পেয়েছি! আর কিছু চায় না। এ যে বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটা। কত বন-বাঁদাড়ে এর খান তল্লাস করেছি, পায়নি। চিনিই না, তো পাব কীভাবে? যারা দেখেছেন, চেনেন, তাঁদের মুখে বর্ণনা শুনে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তবুও দেখা মেলেনি। আজ এভাবে অপ্রত্যাশিত দর্শনের কথা ভাবিইনি। ময়নাকাঁটা বাংলাদেশের সবজায়গায় ছিল কিনা জানা নেই। তবে আমাদের এলাকায় যে এর প্রাচুর্য ছিল তার সাক্ষ্য বিভূতিভূষণই দিয়েছেন।
গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। বহুবর্ষজীবি। বুনো উদ্ভিদ। মানুষ একে কাজে লাগতো ফসলের ক্ষেতের বেড়া তৈরিতে। বড় বড় মারাত্মক সব কাঁটার কারণে এর বেড়া হত দুর্ভেদ্য।
বনের মধ্যে কি একটি পাখি ময়নাকাটা গাছের ডালের আগায় বসিয়া পাতা নাচাইয়া ভারি চমৎকার শিস দিতেছিল।
--পথের পাঁচালী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ময়নাকাঁটা ঝোপ জাতীয় গুল্ম। কাণ্ডের একেবারে গোড়া থেকে ডালপালা ছেড়ে ঘন ঝোপ তৈরি করে। কাণ্ড ধূসর। গাছ ৪-৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
ময়নাকাঁটার পাতা ধূসর সবুজ রঙের। পাতা মসৃণ। খুব পাতলা নয়। পাতার দৈর্ঘ্য ২ থেকে আড়াই ইঞ্চি। প্রস্থ আধা ইঞ্চি। পাতা লম্বাটে।
প্রতিটা পাতার গোড়ায় ২-৩ টি করে ভয়ঙ্করদর্শন কাঁটা থাকে। কাঁটা ১ থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়। এই কাঁটাই মূলত একে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু এই কাঁটাই আজ ময়নাকাঁটাকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের দিকে তাকালে দেখা যাবে উদ্ভিদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। এর মূল কারণ মাঠে আজকাল গরু-ছাগলের উৎপাত অনেক কমে গেছে। তাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে ফসল ক্ষেতের বেড়া। সুতরাং কাঁটা জাতীয় গুল্মেরও কদর কমেছে চাষীর কাছে। এগুলো এখন উটকো ঝামেলা তাদের জন্য। সুতরাং দা চালিয়ে কাঁটাঝোপ উজাড় করতে বিন্দুমাত্র দয়া-মায়া দেখাচ্ছে না চাষী।
ময়নাকাঁটার ফুল হলুদ রঙের। পাঁচটা পাপড়ি থাকে। পাপড়ি পাতলা। ভারী সুন্দর দেখতে। পাপড়ির ভেতরে ৩-৪টি লম্বা হলুদ কিশোর থাকে। ফুল লম্বাটে। ব্যাস দেড় ইঞ্চির মতো। মঞ্চরি গুচ্ছাকৃতির। বহুপুষ্পক।
ময়নাকাঁটার ফল দেখতে বাসকের ফলের মতো। আরও সহজ করে বললে অনেকটা সরিষা ফুলের মতো। এর ভেতরে সরিষার বীজের মতো ছোট ছোট ১০-১৫টা বীজ থাকে। বীজ দ্বিবীজপত্রি।
বৈজ্ঞানিক নাম জানতাম না। তাই গোটাচারেক ছবি পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকের বৃক্ষকথা নামের গ্রপে। সেখানে জয় ফরিদ ভাই ও কোলকাতার অপর্নাদি ময়নাকাঁটার বৈজ্ঞানিক ও অনেকগুলো স্থানীয় নাম জানিয়ে কৃতার্থ করলেন।
ময়নাকাঁটার বৈজ্ঞানিক নাম:Barleria prionitis.
স্থানীয় নাম: হলু ঝাঁটি, ঝিণ্টি, বজ্রদন্তি, কুরান্তিকা, ভাইফোঁটা ফুল।
আগের পর্ব : বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩২ : তাল
মন্তব্য
এর ইংরেজি নামটাও বেশ চমৎকার "Porcupine flower"।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
হ্যাঁ, সবগুলো নামই সুন্দর, ফুলটার মতো।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সুন্দর ফুল আর ভয়ংকর কাঁটা - সমন্বয় বটে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
কোন এলাকার কথা বলছেন?
পেয়েছি! আর কিছু চায়>চাই না। এ যে বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটা। কত বন-বাঁদাড়ে>বনে-বাদাড়ে এর খান তল্লাস করেছি, পায়নি> পাইনি।
দয়া করে টাইপোগুলো ঠিক করুন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ, যে এলাকার কথা বলছি সেটা বিভূতিভূষণেরই এলাকা। বিভূতিভূষণের জীবদ্দশায় উত্তর চব্বিশ পরগনা ছিল যশোর জেলার ভেতরে। তখন ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল বনগাঁ মহাকুমা আর সদর নিয়ে যশোর জেলা। আমাদের মহেশপুর থানা তখন ছিল বনগাঁ মহাকুমার অধীনে। দেশভাগের সময় ইছামতীকে বিভক্তিরেখা করতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। মহেশপুর ইছামতীর এপারে। তাই একে পাকিস্তানের ভেতর ফেলা হল। স্বভাবতই মহাকুমা পরিবর্তনের দরকার হলো মহেশপুর থানার জন্য। একে তখন অন্তর্ভুক্ত করা হলো ঝিনাইদহ মহাকুমায়। কালক্রমে ঝিনাইদহ জেলা হল, আর আমরা পড়ে গেলাম সেই জেলার আওতায়।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন