পুরোনো দিনের গাঁয়ে

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/০৯/২০১৪ - ৫:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বর্ষাকাল। আকাশের মুখ গোমড়া সপ্তাহ দুয়েক ধরে। মেঘ-রোদের লুকোচুরি। তারমাঝেই বৃষ্টি। কখনও ইলশেগুঁড়ি কখনও কখনও মূষলধারে। খালে, বিলে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শিকার করতে। ভয় নেই, শিকার যাই হোক অস্ত্র কিন্তু বন্দুক নয়। কম্প্যাক্ট ক্যামেরা। তাতেই মোটামুটি কাজ চলে যাচ্ছে। মাঠে-ঘাটে ইদানীং একা চলতে পারি না। একজন সঙ্গী লাগে। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবকে সাথে নিই না। ওদের বয়স বেড়েছে। ওরা আমার পাগলামীতে সঙ্গ দেবে কেন! বয়স আমারও বেড়েছে। দেহেরটা। মনেরটা এখনও পড়ে রয়েছে সেই কৈশরে। তাই সঙ্গী হিসেবে কিশোরদের নেয়াটা বরং সুবিধা। সবকিছুতেই ওদের উৎসাহ। গাছপালা, ফুল-পাখিরদের নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যায়। কিছুর উত্তর দিতে পারি, বাকিগুলো ‘জানি না’ বলে এক কথায় হার স্বীকার করে নিই। বেশিরভাগ সময়ই আমাকে সঙ্গ দেয় হয় পারভেজ, নইলে শাহেদ। এরা আমার খালাতো ভাই। একদিন চাচাতো ভাই সজিবকেও নিয়েছিলাম, আরেকজন থাকে প্রায়ই। মোস্তাফিজুর। রক্তের সম্পর্ক নেই ওর সাথে। কিন্তু আত্মীক টান অনেক। ও কিন্তু কিশোর নয়। অনার্স ফাইনাল দেবে। আমার মতই ওর মধ্যে কিছুটা ছেলেমানুষি আছে। তাই আমাকে সঙ্গ দিতে ওর আপত্তি থাকে না।
৩০ জুলাই ২০১৪। সকাল ন’টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। মাঠে নয়। আমাদের গ্রামের সাথেই এক গ্রাম আছে। নাম মালো শ্রিনাথপুর। ইছামতীর ওপারে। এইখানেই আমার আকর্ষণ। আমাদের এলাকার পুরো সীমান্ত জুড়ে ইছামতী সীমান্তরেখা। তাই ইছামতীর ওপারের বাংলাদেশের কোনও গ্রাম থাকতে পারে--এই বিষয়টা এলাকার জন্য অদ্ভুত। তখনও ভাবিনি আরও কত বিস্ময়ের পসরা সাজিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে গ্রামটা।

বয়স প্রায় ত্রিশ হতে চলল। আজও কেন গ্রামটাতে পা দিইনি! একথা ভেবে অবাকই লাগছে। আমাদের গ্রামটা অনেক বড়। মাঝারি মানের শহর থেকেও বড়। কতখানি সেটা আন্দাজ করতে পারবেন একটা তথ্য দিলে। সাধারণত বাংলাদেশের প্রতিটা ইউনিয়নে নয়টা করে ওয়ার্ড আছে। নয়জন মেম্বার নয় ওয়ার্ডের মাথা। আমাদের ইউনিয়নেও নয়টা ওয়ার্ড। কিন্তু পাঁচটা ওয়ার্ড শুধু আমাদের গাঁয়েই। পাড়াভিত্তিক ওয়ার্ড নয়। রাস্তার এপার-ওপার সীমানা করা। যে গ্রামটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পাঁচজন মেম্বারকে হিমশিম খেতে হয়, তো চিন্তা করুন সেটা কত বড়! তাই কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি গেলে ইচ্ছে করলেও পুরো গ্রামটা ঘোরা হয় না। শ্রিনাথপুরের সাথে আমাদের গাঁয়ের যে পাড়ার সীমানা, ওখানে সর্বশেষ গেছি বছর ছয়েক আগে। কিন্তু তখন জানতাম না এখানে ইছামতীর ওপারের গ্রামটা ভারতের নয়।

মোটর সাইকেল চালাতে জানি না। আমার বাবাও জানেন না। তাই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবার হয়েও আমাদের মোটর সাইকেল নেই। শ্রীনাথপুর যেতে হলে দরকার সাইকেলের। আমার সাইকেলটা ঢাকায় আসার পর চুরি হয়ে গেছে। ছোটবোনটার সাইকেল আমার ওজনের ধকল সইতে পারবে না বলে ওতে হাত দিলাম না। মোস্তাফিজুর ওর সাইকেলটা আমাকে দিল। পারভেজ আর আমি এক সাইকেলে। মোস্তাফিজুর হালকা-পলকা ওজনহীন মানুষ। পারভেজের লেডিস সাইকেলটা অনায়াসে ওর ভার বইতে পারবে।
বৃষ্টির কথা আগেই বলেছি। তবু ছাতা নিতে মন চাইল না। বাড়তি ঝামেলা পোহাতে চাই না। তার বদলে নিলাম ছোট্ট একটা পলেথিন ব্যাগ। ক্যামেরা আর মোবাইলকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাবার জন্য। আমাদের গাঁয়ের ওই পাড়াটার নাম মাঠপাড়া। ওখানে এক অপরিচিত বাড়ির মহিলাদের জিম্মায় সাইকেল দুটো রাখতে হলো। কেননা নদী পার হতে হবে। ব্রিজ নেই। নৌকা আর বাঁশের সাঁকোই ওই গায়ের লোকদের মূল ভরসা। কিন্তু নদীতে এখন আর পানি জমে না। তাই সাঁকো পার হতে হবে।

মাঠপাড়ার চড়াই জুড়ে বাঁশবাগান। নানা গুল্ম-লতায় আচ্ছাদিত। বাঁশবাগান পেরিয়ে ইছামতীর কিনারে গিয়ে দেখি জনাচারেক ছেলে-মেয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। এই মরা নদীতে মাছ কোথায় ভেবে পেলাম না। মাছ পাক বা না পাক, ছবি নিতে তো আপত্তি নেই।

এরপর সেই বাঁশের সাঁকো। দুশো গজের ব্যবধানে দু-দুটো। কাছেরটাকেই বেছে নিলাম। কারণ ওপারের একটা মাঝারি আকৃতির বটগাছ হাজার বছরের পুরোনো বাংলার রূপ ধরে আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু সাঁকো বলতে যা আমার চোখে ভাসে, আমার নানার বাড়ির ভৈরব নদের সাঁকো কিংবা মুসলিম শ্রিনাথপুরের বাওড়ের ওপর যে চওড়া সাঁকো--এটা সেরকম নয়। মাত্র তিনটে বাঁশ আঁটি বাধা মতো বেঁধে রাখা। মাটি থেকে অসংখ্য খুঁটি খাড়া হয়ে কোনও রকমে বাঁশের আঁটিটাকে ইছামতীর বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে। মোস্তাফিজুর আর পারভেজ অনেকটা স্বচ্ছন্দ ছিল। আমি বরাবরই সাঁকো পারে আনাড়ী। আর এমন সাঁকো জীবনে পার হয়েছি কিনা মনে পড়ে না। তাছাড়া বাঁশগুলো নতুন নয়। অন্তত এবার নিয়ে দুটো বর্ষার ধকল সে সইছে। ভয়ে ছিলাম আমার ওজন ওটা বইতে পারবে কিনা। পারল, তবে কষ্টেসৃষ্টে, অল্পের জন্য ভেঙে পড়েনি।

ঘাটের ওপারে প্যাঁক কাদায় আটকে ছিল নৌকা একটা। নৌকা আজও কাজে লাগে কিনা বুঝলাম না। ছোটবেলা থেকেই দেখছি ইছামতী মৌসুমি নদী। শীত-গ্রীষ্মে শুকিয়ে খাল হয়ে যায়। বর্ষকালে টুইটুম্বুর। কিন্তু বছর পাঁচেক হলো নিয়মের ব্যতয় ঘটেছে। আমাদের প্রতিবেশীদের বদন্যতায় বর্ষা-শরতেও ইছামতী আর দুকুল ছাপায় না। তাই অলস নৌকাও প্যাঁক কাদার কামড়ে ক্ষয়ে নষ্ট হওয়ার কথা। মোস্তাফিজ আর পারভেজ নৌকায় উঠে বায়না করল, তাদের একটা ছবি নিতে হবে। অগত্যা ক্লিক...

ক্যামেরা ওদের দিক থেকে ফিরিয়ে নিতেই চোখে পড়ল কচুরিপানার বিরল হয়ে যাওয়া এক প্রতিনীধি নীল মুখে সাদা হাসি ফুটিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সুতরাং আবারও ক্লিক...

চড়াই ভেঙে প্রথমেই বট গাছটার সাথে সাক্ষাত হলো।

এরপাশেই একটা বাড়ি। একবিংশ শতাব্দীর নয় বোধহয়। পাটখড়ি বেড়া, চালও পাটখড়ি দিয়ে ছাওয়া।

এমন ঘর একবিংশ শতাব্দীতে দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। একটু এগোতেই ভুলটা ভাঙল। এটা আসল ঘর নয়। আসল ঘরটা মাটির। চাল টিনের। এটা একালের কাঁচাঘরের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে। আমরা ছোটবেলায় কাঁচাঘর বলতে বুঝতাম, মাটির ঘর, খড় বা গমের নাড়ার চাল। একটু ভদ্রস্থ ঘরগুলো টালি দিয়ে ছাওয়া। এখন দিন বদলে গেছে।

মূলঘরটা যা-ই হোক গোয়ালটা সেই আবহমান বাংলার।

পাশাপাশি আরেকটা বাড়ি। একটু অবস্থাপন্ন বলে মনে হলো, কারণ উঠনে ধানারাখা গোলাঘরও রয়েছে।

এরপর আশপাশে আর বাড়ি নেই। রাস্তা বলতে দু’পাশে ভেরেণ্ডার বেড়া, ভাঁট আশেওড়ার দঙ্গলে আচ্ছাদিত। মাঝখানে হাত দু’য়েক প্রশ্বস্ত গলিপথ। অন্ধকার অন্ধকার ভাব। একা চলতে যে কারও গা ছমছম করবে। কাদা ভেঙে ওই গলিপথে মিনিট দুই চলার পর পেলাম একটা ভগ্ন এক কোঠাবাড়ি। ঠিক কোঠা নয়, আধাকোঠা। বয়স হয়েছে অনেক। ছবি দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যায় নিশ্চয়ই। এটাই বোধহয় এই গাঁয়ের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি।

সব মিলিয়ে গাঁয়ে ২০/২৫ ঘর লোকের বাস। এক-দু’মিনিটের পথ দূরে দূরে একেকটা। মাঝে মাঝে ফসল ক্ষেত। বেশিরভাগই বুনো গুল্মলতায় ঠাসা পতিত জমি কিংবা বাঁশবন। সব মিলিয়ে জনসংখ্যা শ’দুয়েকও হবে না। উত্তরাধিকার সূত্রে সবাই মৎসজীবী ইছামতীকে ঘিরেই মাহকালের কোনও এক যুগে এদের জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছিল। পাশে অবশ্য একটা বাওড়ও আছে। কিন্তু তা নেতা-পাতি নেতাদের দখলে। ইছামতী মরে গেছে, কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে গায়ের লোকগুলো। পুরোনা পেশাটা অনেকেই ছাড়েনি। পরের পুকুরে বা বাওড়ে জাল দিয়ে মাছ ধরে দেয় টাকার বিনিময়ে। মাছের ভাগ শূন্য। মানিকের কুবের টাইপের লোক সবাই। ও হ্যাঁ, এতক্ষণ যে বাড়িগুলোর বর্ণনা দিলাম সবগুলোতেই কিন্তু সনাতন ধর্মের চিহ্ন স্পষ্ট। দু’য়েকটা ভূঁইফোঁড় মুসলমান আছে।
‘ভাইয়া ভালো আছেন?’
চোখ তুলে দেখি ওই জীর্ণ কোঠার দাওয়ায় সেলাই মেশিনে বসা এক মহিলা। সম্ভাষণটা সে-ই ছুঁড়ে দিয়েছে মোস্তাফিজের উদ্দেশ্যে। এই গাঁয়ে কেউ ওকে চিনবে একথা ভাবিইনি। পরে মোস্তাফিজ ব্যাখ্যা করল, মেয়েটা আমাদের গাঁয়ে কেনাপালের নাতনী। এ বাঁড়িতে বিয়ে হয়েছে। ওকে আমিও চিনি, কিন্তু বহুদিন না দেখায় হঠাৎ করে ঠাওর করতে কষ্ট হয়েছিল। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু জরুরি কাজের ছুঁতোয় নিস্তার পেলাম। মেয়েটা শেষে বলল, ‘বটগাছ দেখতে যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ,’ মোস্তাফিজের উত্তর।
‘মানে!’ আমি অবাক হলাম। ‘এখানে দেখার মতো বটগাছ আছে?’ ওই বাড়ি থেকে মাঠের পথ ধরতে ধরতে জিজ্ঞেস করলাম।
‘আছে!’ বেশ সুন্দর। অন্তত দত্তনগরের বটগাছের চেয়ে অদ্ভুত!’
‘কই, আগে বলোনি তো?’
‘সারপ্রাইজ।’
কিছুদূর এগোনোর পর সত্যিই অদ্ভুত একটা বটগাছ দেখলাম দূর থেকে।

‘ওয়াও! চলো, চলো দ্রুত চলো।’
আগেরদিনই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাছটা দেখে এসেছি দত্তনগর কৃষিফার্মে গিয়ে। আকারে-প্রকারে ওর কাছে এটা নস্যি। কিন্তু সৌন্দর্যে অনেক অনেক বেশি এগিয়ে।
(বটগাছ নিয়ে একটা আস্ত পোস্ট আসছে। তাই বটগাছরে ক্যাচাল এড়য়িে গেলাম)
গাছ দেখা অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলাম বর্ডারে। জন্ম থেকে দেখছি ইছামতী বর্ডার লাইন, তাই ডাঙা বর্ডার দেখতে কেমন থ্রিল অনুভব করলাম।
পাশাপাশি গ্রাম। মাঠের খেত-খামার পাশাপাশি। কিন্তু দেশভাগের খড়গ কারও হয়তো দুই বিঘা জমির এক বিঘা নিক্ষেপ করেছে ওপারে। সীমান্তে কাঁটাতার দিয়েছে ভারত তা প্রায় দেড়যুগ আগের কথা। কিন্তু কাঁটাতারের এপারেও তাদের জমি। আর ওই জমিতে পা দিলেই বিএসএফ বন্দুক বাগিয়ে গুলি করবে না, তার গ্যারান্টি নেই।
ওদের যেমন কাঁটাতার আমাদের তেমন সীমানা পিলার। তাই সীমানা পিলার আর কাঁটাতারের মাঝখানে যে দু-তিনশো গজ জমি নোমান্সল্যান্ডে। কিন্তু সেগুলোও যেন কোন্ সমঝোতায় ভাগ করে নিয়েছে দুই দেশ। চাষিরা সেসব জমিতে চাষও করে। আমাদের গাঁয়ে নদীই নোম্যান্সল্যাণ্ডের জমি বণ্টনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। তাই ভুলে কেউ ভারতের সীমানায় পা দিতে পারে না। কিন্তু এখানে ভুল করলেও বিপদ। মাঠে কাজ করা লোকজনকে জিজ্ঞেস করে নিলাম বাংলাদেশ সীমানা কোন্ পর্যন্ত।


নতুন লাগানো এই তুলোক্ষেতটা বাংলাদেশের। এর দু’পাশের আমবাগানটা ভারতের। তুলোক্ষেতটার ওপর দিয়ে নেমে গেলাম ভারতের সীমানায়। ইচ্ছে করেই ঝুঁকিটা নিলাম। অস্পষ্ট হলেও কাঁটাতারের একটা ছবি চাই। একটা ধানক্ষেতের ভেতর দাঁড়ালাম। সীমান্তে জন্ম-থেকে ওঠা। তাই বিএসএফ ভীতি তেমন নেই। তবুও অচেনা গাঁয়ে এসে ভারতের সীমানায় পা দিতে গায়ে যেন অনুভব করলাম শীতল একটা শিহরণ।


ক্যামেয়ার জুম সর্বোচ্চ তুলে চেষ্টা করলাম কাঁটাতারের ছবি তুলতে। উঠল, কিন্তু সেইসাথে দেখলাম কাঁটাতার ঘেঁষা বিএসএফ রোড দিয়ে দু’জন জওয়ান রাইফেল ঘাড়ে করে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেখেনি। হাঁফছেড়ে বাঁচলাম।

এই যুগল ভারতের। তাদের নিজেদের ক্ষেতেই কাজ করছিল। আমি পাশের ক্ষেত অথচ বংলাদেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে। তাদের ছবি নিলাম।

ধাতস্থ হতেই আরেকটা অনুভূতি কাজ করল মনে। আবেগের অনুভূতি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমাদের গাঁয়ে লেখক বলতে রবিঠাকুর, নজরুল, জসীমউদ্দীন, শরৎ আর মাইকেলকে চেনে। আর চেনে সুকান্তকে। কিন্তু যাকে সবচেয়ে বেশি চেনা উচিত ছিল সেই বিভূতিভূষনের নামটি পর্যন্ত কেউ জানে না। তবে যাকেই চিনুক, খুব কম লোকের বাড়িতে বইপত্র আছে। বারো চান্দের ফজিলতের পাশে যদি কারও টেবিলে কিছু থাকে তবে সে শরৎ-এর ‘দেবদাস’ আর বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’।

ছোটবেলা থেকেই তাই আমি বিভূতিবাবুকে না চিনলেও বিমলবাবুকে চিনতাম। এ গাঁয়ের সব লোকই তাঁকে চেনে। কারণ কাঁটাতারের ওপারের ওই ফতেপুর গ্রামটাতেই যে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু উইকিপিডিয়া এক্ষেত্রে আপনাকে ভুল পথে পরিচালিত করবে।

পুরোনো লোকেরা সবাই বিমলবাবুকে চিনতেন। চেনারই কথা। আশেপাশে বগুলা, রানাঘাট, জীবননগর, গাজনা, কিংবা দর্শনার বাজারগুলোর চেয়ে আমাদের গাঁয়ের হাটটা ফতেপুরের সবচেয়ে কাছে। দেশভাগের আগে ও গাঁয়ের লোকেরা সব এগাঁয়ে আসত হাট করতে। কৈশরে বিমলবাবুও নিশ্চয়ই আসতেন। তবে মৃত্যুর আগে তিনি সর্বশেষ আমাদের হাটে এসেছেন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা উৎযাপন উপলক্ষে। সাথে ছিলেন তাঁর দুই কন্যা। অতএব সে স্মৃতি কারও ভোলার নয়।
কাঁটাতার আর বর্ডারের কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম আবার বটতলায়। বটগাছটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ফেরার পালা। এক বাড়িতে দেখলাম একটা ছোট্ট কাঁঠাল গাছ। গোটা তিনেক কাঁঠাল ধরে আছে। কিন্তু এককটা কাঁঠাল আধমনের বেশি ওজন হবে। অতএব ক্লিক...

সামনে গোটা দুয়েক মুসলমান বাড়ি পড়ল। সেগুলো পেরিয়ে বাঁশবাগান। বাঁশবন পেরিয়ে আবার ইছামতী। এবার দ্বিতীয় সাঁকেটা ধরলাম। এটা প্রথমটার চেয়ে ঢের ভালো।

সাঁকো পার হতে গিয়ে পেলাম এক গাংশালিকের দেখা। আপনমনে বসে ছিল সাঁকোর ওপর।

কাছাকাছি হতেই ফুড়ুৎ। বসল গিয়ে ইছামতীর বুকে কচুরিপানার জটলায়।

এপারে এসে সাইকেল দুটো নিয়ে ঘরে ফেরা শুরু হলো। কিন্তু বারবার বৃষ্টি হানা দিয়ে আটকে দিচ্ছিল আমাদের। হালকা বৃষ্টি।


কিন্তু বাড়ির অনেকটা কাছে এসে শুরু হরোপ মুষলধারে বৃষ্টি। রাস্তাই পাশেই একটা দোকান ছিল। দোকানের মাচায় বসে বৃষ্টি দেখছিলাম তন্ময়ভাবে। পথের দুধারের জঙ্গল বৃষ্টিতে গা ধুয়ে কেমন ডগমগ করে উঠেছে। এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনভূতিতে ছেয়ে গেল মন। বৃষ্টির ঝমাঝম শব্দে মন উতালা হয়ে বার বার ফিরে যাচ্ছিল পুরোনো দিনের ওই গাঁয়ে।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক দিন পর এমন গ্রাম দেখলাম। কি যে ভালো লাগল! চলুক আজ সকাল থেকেই বাংলাদেশের জন্য মনটা যেন কেমন কেমন করছিল। আব্বুকেও দেখালাম। বেচারা নিজেও অনেকদিন গ্রাম দেখে না। যাক বাংলার মাটি, মানুষ, গ্রাম নিয়ে আরও অনেক সুন্দর সুন্দর পোস্ট আসুক এই প্রত্যাশা করছি।

ফাহিমা দিলশাদ

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, এবার আসবে আড়িয়ল বিলের ছবি। কিছুদিন বাদে বেদেদের জীবন। ভালো থাকবেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ। পোস্ট আসছে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

গান্ধর্বী এর ছবি

এত মায়াময় সব ছবি! চাকরির সুবাদে এখন প্রতিদিন গেঁয়োপথ পাড়ি দিতে হয়, তাই অনেকদিন পর গ্রামের মধুগন্ধী হাওয়ায় মন-শরীর জুড়োতে পারছি। ছবিগুলো দেখে সেই হাওয়া এসে হামলে পড়ল নাকেমুখে! বর্ণনাও চমৎকার হয়েছে ভাই।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার সাথে গাঁয়ের পথে পথে ঘুরলাম। বেশ লাগলো মাইরি!

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আমারও ভালো লাগছে পৌঢ়দা, আপনাকে পুরোনো দিনের গাঁয়ে ঘোরাতে পারে। ফেসবুকে সচলে আপনার মন্তব্য সবসময় আমাকে প্রেরণা যোগায়।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাহ! চমৎকার!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।