আমাকে অবাক করে দিয়ে মোস্তাফিজুর ঝুরি ধরে ঝুলে পড়ল বাঁদরের মতো । তারপর টারজানের মতো তর তর করে উঠে গেল ঝুরি বেয়ে প্রায় ৬০ ফুট উচুঁতে।তখনই খেয়াল করলাম, এটাই সবচেয়ে লম্বা ঝুরি। মাটি ছুঁতে খুব দেরি নেই এটার।
আমার আগের পোস্টের শিরোনাম ছিলপুরোনো দিনের গাঁয়ে। ওই গ্রামে এটা অদ্ভুত বটগাছ দেখেছিলাম, সেকথা ওই পোস্টেই উল্ল্যেখ করেছি। আজ থাকছে সেই বটগাছের সাতকাহন।
আগেরদিনই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাছটা দেখে এসেছি দত্তনগর কৃষিফার্মে গিয়ে। আকারে-প্রকারে ওর কাছে এটা নস্যি। কিন্তু সৌন্দর্যে অনেক অনেক বেশি এগিয়ে। ঝুরিগুলো নেমেছে গুঁড়ির খুব কাছ থেকে।
ফলে নিজে যতটুকু মোটা হয়েছে, ঝুরির দৌলতে তার তিনগুণ আকার পেয়েছে। আন্দাজ করলাম মোটা গাছটাকে বেড় করে দাঁড়াতে গোটা বিশেক লোক লাগবে। কত দিনে গাছ এত বড় হয়।
বটবৃক্ষের বাড়-বাড়ন্ত মোটেই শিরীষ বা কদম গাছের মতো নয়। অনেক ধীর প্রক্রিয়া। এ গাছের বয়স আড়াইশো-তিনশো বছর হলেও অবাক হবো না। এক ভদ্রলোককে পেয়ে গেলাম। মাঠে যাচ্ছিলেন কাস্তে হাতে। আমার চেহারা দেখেই চৌদ্দগুষ্ঠির পরিচয় উদ্ধার করে ফেলেছেন! আমি তো অবাক!
তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম গাছটার বয়সের কথা। গাঁয়ের লোকেরা বয়সের ব্যাপারে বড্ড উদার। কারও প্রথম সন্তানের বয়স যদি ত্রিশ হয়, তো তার বয়স নব্বই একশো বছর বানিয়ে ছাড়ে। তাই বয়সের প্রশ্নে শোনা কথাতে কয়েক বছর বিয়োগ করে হিসাব করি। কিন্তু গাছটার ব্যাপারে সেই উদারতা দেখলাম না। তিনি ৮৫ বছর বয়সী (২০ বছর বাদ দিলে ৬৫ তে দাঁড়ায়, কারণ লোকটার প্রথম সন্তানের বয়স ৩৫ এর বেশি নয়) এক লোকের কথার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বললেন, ওই বৃদ্ধ ছোটবেলা থেকেই গাছটাকে এমনই দেখে আসছেন। পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য তথ্য নয়। সেই হিসাবে গাছটার বয়স দুশো বছরের কম নয়। আমার ধারণা থেকে খুব বেশি বিচ্যুত নয়। লোকটা চলে গেলেও তার কাজে। আমরা গাছের দিকে নজর দিলাম।
গাছ তো নয় মহা দানব। বড় ঝুরিগুলোর একেকটা ৬০/৭০ ফুটের কম নয়।
সেই তুলনায় দত্তনগর কৃষিফার্মের বটগাছের ঝুরিগুলোর উচ্চতা এগুলোর অর্ধেকও হবে না।
বেশ কিছু ঝুরি এখনও মাটি ছোঁয়নি। এক জায়গায় পাশাপাশি জটলা পাঁকিয়ে এমন মোটা হয়েছে পঞ্চাশ বছরেও একটা নিম কিংবা সেগুন গাছ অত মোটা হয় না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মোস্তাফিজুর ঝুরি ধরে ঝুলে পড়ল বাঁদরের মতো ।
তারপর টারজানের মতো তর তর করে উঠে গেল ঝুরি বেয়ে প্রায় ৬০ ফুট উচুঁতে।
তখনই খেয়াল করলাম, এটাই সবচেয়ে লম্বা ঝুরি। মাটি ছুঁতে খুব দেরি নেই এটার। গাছের সব ডালপালা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। বেশ কিছু পরিত্যাক্ত পাখির বাসা রয়েছে। কাক আর শালিকই কেবল এমন ছন্নছাড়া বাসা বানায়। আমাদের এলাকায় কাকের বাস খুব কম, তুলনায় শালিকের সংখ্যা অগুনতি। অতএব এগুলো শালিকের বাসা বলেই অনুমান করলাম।
গাছ দেখা অসমোপ্ত রেখেই চলে গেলাম বর্ডারে। কাঁটাতার বর্ডারের কিছু ছবি তুরে ফিরে এলাম আবার বটতলায়। ঘণ্টা দুয়েক বসলাম। গাছ আগেই দেখেছি এখন আনুসাঙ্গিক বস্তুগুলি পর্যবেক্ষণ করার সময়।
বটগাছের একটা কাটাডাল খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে আছে।
‘এটা কাটা কেন, বুঝতে পারছো মোস্তাফিজ?’ বললাম আমি।
‘না, তো ভাই?’ ওর জবাব।
বললাম, ‘যে কাটার চেষ্টা করেছে, সে একটা ডাল কেটে দেখেছে পাবলিক প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। যদি কেউ কিছু না বলে, তবে একটা একটা করে ডাল কাটতে থাকবে। শেষে পুরো গাছটাই হাপিস করে দেবে!’
আমার ধারণা পুরোপুরি নির্ভুল নয়। কিন্তু নির্ভুলের কাছাকাছি। এ এলাকায় যিনি মাতবর ছিলেন তিনি মালিকের কাছ থেকে নাকি মাত্র বিশ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। গাছটার দাম দু’লাখের কম নয়। কাজেই কেন কিনেছিলেন নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়। কিন্তু গাছাটার একটা ডাল কাটা হয়েছিল মাত্র, সে রাতেই ওই নেতা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। সুতরাং বটগাছ নিয়ে মানুষের চিরকালীন কুসংস্কারটা ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। রাজ্যের জ্বিন-ভূত আর দত্যি দানোর বাস এসব বটগাছে। তাদের ভিটে মাটি চাটি করতে গেলে তারা ছাড়বে! মনে মনে বললাম, ‘জয় বাবা কুসংস্কার। এমনি করিয়া তুমি বেঁচে থাকো চিরকাল। গাছখোরেরা যেন দত্যি দানোর ডেরা ভাঙতে না পারে।’
অন্তত বছর দশেক গাছটা বেঁচে থাকার সনদ পেয়ে গেল। গাছের গায়ে একটা মৌচাক দেখলাম। এধরনের গাছকে দৈত্য-দানোর মতো মৌমাছিরাও ভীষণ পছন্দ করে।
গাছতলায় আরাম করে বসলাম। উপরে দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ল একটা শুকনো ডাল। তার গায়ে একটা কোটর। এসব কোটর আবার টিয়া পাখিদের ভীষণ পছন্দ। ভাবছিলাম টিয়ার বাসা কিনা। হঠাৎ বিদ্যুৎ বেগে একটা ধূসর পাখি কোটর থেকে বেরিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল।
আরও ঘণ্টাখানেক কাটল গাছটার নিচে বসে। গাছার এ পাশে আবার ইছামতী। আগে ভাবলাম ইছামতী আমাদের গ্রামটা হাঁসুলি বাঁকের মতো ঘিরে আছে। সেটা ঠিক। আবার এই গ্রামকেও সে হাঁসুলিকাঁকের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে। তাহলে দুটো বাঁক যোগ করলে দাঁড়ায় এক ‘s’ আকৃতি। ‘s’-এর একটা পেটের ভেতর আমাদের গ্রাম আরেকটার ভেতর মালো শ্রিনাথপুর।
এক পা দু-পা করে খাড়া পাড় ভেঙে ইছামতীর দিকে কয়েক পা নামলাম। ইচ্ছা নিচ থেকে গাছটার একটা শর্ট নেয়া, যাতে এর বিশালতা আকেরটু স্পষ্ট হয়।
মন্তব্য
আপনার লেখা পড়ে আর গাছটার ছবি দেখে অদ্ভুত এক খেয়াল জাগলো মনে। আমি যদি বাউল হতাম, তাইলে ঐ গাছটার নিচে বসে গান ধরতাম!
তাই নাকি আপনি গানও জানেন। বাহ্ দারুণ তো। আমার বাবাও গান জানে। একটা গান দেবেন নাকি এখানে প্লিজ।
ফাহিমা দিলশাদ
আচ্ছা গান শোন।
এটা তো জীবন কণ্ঠের গান। আমি আপনার কণ্ঠের গান শুনতে চেয়েছি। যাই হোক গানটা অনেক পুরনো কিন্তু হৃদয়ের গভীরের কিছু কথা বলে। আমার আব্বু আম্মু দুজনেরই গানটা ভালো লেগেছে। আপনার বদৌলতে ওরা নতুন একটা পুরনো দিনের গান খুঁজে পেল বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে বলেছে। অনেক ভালো থাকবেন।
ফাহিমা দিলশাদ
এই লক্ষ্মী মেয়েটার আব্বু-আম্মুকেও আমার শুভকামনা জানিও।
আমিতো গান গাইতে পারিনে। রাত জেগে জেগে এইসব গান শুনি।
আমারও একদিন আপনার সাথে গাঁয়ের পথে হাঁটার ইচ্ছা। আমি নিশ্চিত কোন না কোন নতুন জিনিষ দেখতে পারব। যাই হোক বটগাছের ছবিগুলো দেখে ভালো লাগল
ফাহিমা দিলশাদ
যথার্থ পর্যবেক্ষণ।
র্যাংগস ভবনের ফ্লাইওভারের এক প্রান্তে এক লোক রিক্সা মেরামত করার একটা বাকসো নিয়ে এসে বসে থাকতো। ছুটা রিক্সা মেরামত করতো। ক'দিন পর সে ঐখানের ফুটপাতে পলিথিন দিয়ে ছোট্ট একটা ছাউনি করলো। ছাউনিতে প্রথমে শুধু লোকটা বসতো। এরপর ছাউনিতে ২/১ টা মেরামতের রিক্সা রাখা শুরু করলো। সেদিন দেখলাম, টিনের ছাউনি দিয়ে দুটো ঘর তুলে একটা ঘরে রিক্সার গ্যারেজ বানিয়েছে সে। আর একটা ঘরে সে নিজে থাকে পরিবার নিয়ে। এখন কয়েকটি রিক্সার মালিক হয়ে গেছে সে।
এই রকম কিংবা এর থেকেও একটু বড় একটা বটগাছ আমার খালার বাড়ির গ্রামে আছে। সেই গাছের নামেই গ্রামের নাম- বটতলা। আপনার পোস্ট দেখে সেই গাছটির কথা মনে পড়ে গেল।
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
নতুন মন্তব্য করুন