বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩৯ : প্যাটেঙ্গা

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৯/১১/২০১৪ - ৭:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


গায়ের মাঠে ঝোপঝাড়ের অভাব নেই। অভাব নেই ফসল ক্ষেতের। ফসল রক্ষার জন্য ক্ষেতটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়। ভেরেণ্ডকচাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তৈরি হয় আটোসাটো বেড়া। তবুও মাঝে মাঝে ফোঁকর থেকে যায়। সেটা সাময়িক। এক মাসের মধ্যেই নানা রকম বুনোলতা উঠে ঠাঁস বুনোটের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে কচার বেড়াটাকে। নানা জাতের বুনোলতা। বেশির ভগের নাম জানি না, কিন্তু চিনি সব। কুমারিলতা, গুলষ্ণ, প্যাটেঙ্গার মতো অতিপরিচিত লতা ও যোগ দেয় সেই বুনোলতার মিছিলে। যখন ফুলে-ফলে শোভিত হয় এসব বুনোলতা, তখন সেই মেঠো বেড়ার কাছে কোথায় লাগে বাহারী উদ্যানের সৌন্দর্য। বিশেষ করে প্যাটেঙ্গার সাদা সাদা ফুল, সবুজ ফলে যখন ছেয়ে যায় লতাগুলো, মন মাতাল করা সৌন্দর্যের অবতারণা হয় গাঁয়ের মাঠে মাঠে।


আমাদের ছেলেবেলাটাও ছিল প্যাটেঙ্গার সৌন্দর্যে রাঙানো। প্যাটেঙ্গার ফল দেখতে চিচিঙ্গার মতো। তাই আমাদের খেলাঘরে চিচিঙ্গার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতাম প্যাটেঙ্গার কাঁচা ফল। যদিও আকৃতিতে প্যাটেঙ্গা চিচিঙ্গার চেয়ে অনেক অনেক ছোট। তবুও সাদৃশ্য বলে কথা! আজ প্যাটেঙ্গার দেখা যখন পাই শৈশবের সোনাঝরা সেসব দিনের কথাই মনে আসে সবার আগে। কখনও কখনও লোকালয়েই পেয়ে যেতাম। ডোবা বা পুকুরের ধারে ঝোপের আগায়। কখনও কখনও ছুটতে হতো মাঠে। রাখালের সঙ্গ নিতাম। হাতে থাকত ছোট ঝোলা। সবুজের অলিগলি ঘুরে ঘুরে, বেড়ায় বেড়ায় তল্লাস করে ঝোলাভর্তি প্যাটেঙ্গা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আহা দেখতে কত্ত সবুজ, কেমন সজীব! গায়ে সাদা সাদা রেখাটা, সেটারও আলাদা একটা আবেদন ছিল। কিন্তু প্যাটেঙ্গার দৌড় ওই খেলা অবধিই। খাওয়া চলে না। ভীষণ তিতো যে! তা হোক! খেলাঘরের অতুল ঐশ্বর্য বলে কথা। ওগুলো নিয়ে তখন ভাই-বোনে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। বিকেল ভর তা নিয়ে খেলা। সন্ধ্যা হলেই প্যাটেঙ্গার আবেদন শেষ। কারণ ততক্ষণে সজীবতা হারিয়ে আমাদের হাতের কচলানিতে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে প্যাটেঙ্গার চেহারা।

সন্ধ্যা হয়। ঝপ করে অন্ধকার নামে আমাদের পৃথিবীতে। হাত-পা মুখ ধুয়ে পড়তে বসি। ভুলে যাই প্যাটেঙ্গার কথা। কিন্তু ভাত খাওয়ার সময় ফের মনে পড়ে। পড়তে বাধ্য করে প্যাটেঙ্গা। সারাদিন তাকে নিয়ে কচলেছি, সেটার প্রতিশোধ প্যাটেঙ্গা রেখে গেছে তার রসে সিক্ত করে। পানি পারেনি তার অস্বিত্ব বিলোপ করতে। তাই এক লোকমা ভাত যখন মুখে তুলি তেতো স্বাদে বেঁকে যায় ঠোঁট-মুখ। ‘ওয়াক থু’ করে ভাত ফেলে দিয়ে দৌড়তে হয় সাবানের খোঁজে।
প্যাটেঙ্গা মৌসুমি উদ্ভিদ। লতানো। বাংলাদেশের সব শুষ্ক এলাকায় এর দেখা মেলে। ফসল ক্ষেতের বেড়ায় বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া ঝোপঝাড়ের জটলায়। বুনোগাছের মাথায়। আর দেখা যায় মাঠের সবচেয়ে উর্বর স্থান উইঢিঁবিতে।


এই লেখায় ছবিগুলো ব্যবহার করেছি, এগুলো পেয়েছিলাম আমাদের গাঁয়ে উত্তর মাঠে। একবারে পিস রাস্তার ধারে। গিয়েছিলাম বুনো ঝুমকোলতার ছবি ওঠাতে। ওখানেই পেয়ে গেলাম এক দঙ্গল প্যাটেঙ্গা গাছ। মাটিতে শুয়ে আছে স্নিগ্ধ ভঙ্গিতে।


প্যাটেঙ্গা লতা জাতীয় মৌসুমি উদ্ভিদ। বাংলাদেশের বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রচুর দেখা যায়। লতানো উদ্ভিদ, তাই অন্য গাছকে আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে। মাটিতেও বেঁচে থাকতে পারে। এর লতা খুবই চিকন। আধা সেন্টিমিটারের মতো মোটা হয়। লতা-ডাল সবুজ রঙের। খুব নরম। রসালো। লতা অমসৃণ। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাদা রঙের শুঁঙ্গ থাকে লতার গায়ে। লতার গায়ে আধাফুট দূরে দূরে একটা করে গিঁঠ বা পব থাকে।


প্রতিটা গিঁঠ থেকে একটা পাতা ও একটা আকর্ষি থাকে। আকর্ষি দেখতে স্প্রিংয়ের মতো। সবুজ আকর্ষির সাহায্যে প্যাটেঙ্গা গাছ অন্য গাছকে আকড়ে ওপরে ওঠে।


পাতা দেখতে অনেকটা ঝিঙে কিংবা লাউয়ের পাতার মতো। হাতের পাঞ্জাকৃতির। পাতায় চারটা খাঁজ থাকে। পাতা হালকা-সবুজ রঙের। ব্যাস ৫-৬ ইঞ্চি। পাতা মসৃণ, কিন্তু উল্টোপিঠে শুঁঙ্গ আছে। বোঁটা দেড় থেকে ২ ইঞ্চি লম্বা। বোঁটাতেও শুঁঙ্গ থাকে।


প্যাটেঙ্গার ফুল দেখতে ভারি সুন্দর। সাদা রঙের। লম্বাটে। ফুলের গোড়াটা ফাঁপা নলের মতো। ফাঁপা অংশটা সবুজ রঙের। ফাঁপা অংশটার মাথায় চারটা পাপড়ি থাকে। পাপড়ি সাদা রঙের। পাপড়িগুলো আর দশটা সাধারণ ফুলের চেয়ে আলাদা। পাপড়িতে অসংখ্য সাদা সাদা তন্তু আছে। তন্তুগুলোর মাথার স্প্রিংয়ের মতো পেঁচানো।


এই তন্তুগুলোই প্যাটেঙ্গার ফুলকে আলাদা সোন্দর্য দিয়েছে। প্যাটেঙ্গার ব্যাস বা পাপড়ির এক প্রান্ত আরেক পাপড়ি প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি। মঞ্জুরি বহু পুষ্পক।


প্যাটেঙ্গার ফল দেখতে চিচিঙ্গার ক্ষুদ্র সংস্করণ। মোচাকৃতির। কিছুটা পটলের মতো। তবে ফলের পুচ্ছের দিক ছুঁঁচালো।


ফল ২-৩ ইঞ্চি লম্বা হয়। নরম। খোসা বেশ পুরু। ভেতরে জেলির মতো শাঁস আছে। শাসের ভেতর বিচি থাকে। বিচি শশার বিচির মতো। সাদা রঙের। কাঁচা ফল সবুজ রঙের। পুচ্ছ থেকে ছয়-সাতটা সাদা ডোরা থাকে। এছাড়া সবুজ অংশে তিলে স্পট থাকে। ফলের গায়েও শুঁঙ্গ আছে। ফল ভীষণ তেতো। ডাসা ফলের রং হলুদ। পাকা ফল টকটকে লাল। বর্ষাকালে প্যাটেঙ্গা গাছে ফুল ফল ধরে।
বৈজ্ঞানিক নাম : Trichosanthes cucumerina wild.

বিশেষ কৃতজ্ঞতা
আজহারুল ইসলাম খান
নাজমুল হুদা

আগের পর্ব : বাংলার তরু লতা গুল্ম- ৩৮ : শ্বেতদ্রোণ


মন্তব্য

তাহসিন রেজা এর ছবি

এটি বুনো চিচিঙ্গা নামেও পরিচিত। ফুলের ছবিগুলো খুব সুন্দর এসেছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এই সব পেঁচানো পেঁচানো তারের মতো জিনিসগুলো আমার খুবই পছন্দের হাসি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আমারও, খুব অবাক হয়ে যাই প্রকৃতির এমন ব্যাপারগুলো দেখে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রদীপ কুমার ব্যানার্জ্জী এর ছবি

ভাল লাগল। খুব সুন্দর উপস্থাপনা। নিখুঁত পর্যবেক্ষন। আপনার লেখনীর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।