কিছুদিন আগে একটা বই পড়ছিলাম। হুমায়ুন আজাদের ফুলের ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না। আহ কতদিন এমন নস্টালজিক লেখা পড়িনি। বইয়ের প্রতিটা পাতায় বিভূতিভষণের গন্ধ, দুরন্ত কৈশরের হাতছানি। সেইসাথে বুক টনটন করা ব্যাথা তো আছেই। হুমায়ুন আজাদের বাড়ি বিক্রমপুরের রাড়িখাল। বাংলা-সাহিত্য সংস্কৃতির লীলাভূমি এই বিক্রমপুর। তারচেয়ও বড় কথা এই রাড়িখালেই জন্মেছিলেন আমার ছেলেবেলার এক স্বপ্নপুরুষ স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। হুমায়ুন আজাদের লেখাতেও একই কথা। জগদীশ বাবু তার জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর হেয়ার স্টাইলে। হুমায়ুনের মাথাটা যেন জগদীশ বাবুর ফটোকপি।
বইটা পড়ছিলাম আর রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। বারবার সংকল্প করছিলাম যেতেই হবে একদিন, যেতই হবে। হুমায়ুন আজাদের বাড়ি আড়িয়ল বিলের পাশে। আড়িয়ল বিলের নামটা জানতাম। তার বুকে বিমানবন্দর তৈরি করতে গিয়ে জনরোষের মুখে পড়েছিলেন সরকার বাহাদুর। ফলে সে উদ্যোগ আর বাস্তবায়িত হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি। এত সুন্দর বিলের সৌন্দর্য দেখা আর হত না এ জীবনে।
১৭ নভেম্বর রাতে বইটা পড়ে শেষ করি। কাকতালীয়ভাবে ১৮ নভেম্বর বিকেলে আমাকে ফোন দিলেন সচল ম্যাক্সদা (Max Ether)। তিনি একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, ওনারা শুক্রবার আড়িয়ল বিলে ঘুরতে যেতে চান, আমি যাব কিনা জানতে চাইলেন। এক কথায় রাজি।
গাড়ি ম্যাক্সদার । সাথে ছিলেন ম্যাক্সদার দুই বন্ধু রোকন আর কাউসার ভাই। ১১ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে। এখান থেকেই শুরু আড়িয়ল বিল। হুমায়ুন আজাদের বইটিতে বহুবার এই শ্রীনগরের কথা উল্লেখ আছে। এখানে নেমেই অন্যরকম এক শিহরণ বয়ে গেলে। একইরকম শিহরণ অনুভব করেছিলাম ২০০০ সালে শিলইদহ কুঠিবাড়িতে, লালনের আখড়ায় আর ২০১০ সালে সাগরদাড়ীতে।
আড়িয়ল বাংলাদেশের বৃহত্তম বিলগুলোর একটি। আয়তনে তিনশ বর্গকিলোমিটার। শ্রীনগরেই রয়েছে বেশ কয়েকটি ঘাট। উত্তরের ঘাটের পাশেই একটা প্রাইমারি স্কুল। ম্যাক্সদার গাড়িটা ওখানে রেখে গেলাম দক্ষিণের ঘাটে। ওদিকেই নাকি নৌকা-ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। নৌকার চিন্তা পরে আগে মিষ্টিমুখ করা যাক। বিক্রমপুর এলাম আর মিষ্টি চেখে দেখব না! কিন্তু মিষ্টি মুখে দিয়ে হতাশ! ঢাকায় এরচেয়ে ঢের ঢের ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়। ভাগ্যকূলের মিষ্টি কেমন কে জানে!
ঘাটে অনেকগুলো নৌকা ভিড়ল। সবগুলোর মাঝিই বৃদ্ধ। কিন্তু তাদের মেজাজ একেবারে গোখরা সাপ। ভাড়ার কথা জানতে চাইলে চটেমটে একাকার। “আমরা রিজার্ভে চলি না। অন্য জায়গায় যান!’
অন্যজায়গায় কোথায়, প্রশ্ন করতই খেপে আগুন হয়ে উঠলেন চাচারা। ‘তা আমরা কি জানি। যান যান, মেলা বকিয়েন না! আমাদের কাজ আছে!’
তাই তো! কাজ তো তাদের আছেই। যাইহোক এরা চলে গেল, এলো আরেক দল, তাঁরাও বৃদ্ধ। তারাও রগচটা। বুঝলাম না আড়িয়ল বিলের এই মাঝিরা এমন রগচটা কেন।
দূরে একপাল ছৈঅলা নৌকা দেখা যায়। এই মাঝিদের কাছে অনুরোধ করলাম যেন তারা আমাদের ছৈঅলা নৌকার কাছে পৌঁছে দেয়। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ছৈঅলা নৌকায় ঘোরাই নিরাপদ। কিন্তু এই চাচারাও চটেমটে জবাব দিলেন, ওগুলো নাকি বেদে নৌকার বহর। ওরা আমাদের নেবে না।
বেদে নৌকা! অবাক হলাম। বেদেদের দেখেছি বহুবার। হাটে-বাজারে সাপ খেলা দেখিয়ে বেড়ায় কিন্তু বেদে নৌকার এমন বহর দেখিনি কখনও। ঢাকায়ও বেদেদের চোখে পড়ে আজও, কিন্তু এরা এখনও নৌকায় বাস করে এ ধারণা ছিল না। এখন ওই বেদে পল্লীই আড়িয়ল বিলের মূল আকর্ষণে পরিণত হল।
শেষশেষ একটা নৌকা পেলাম, একেবারে জলের দরে। মাঝি যথারীতি বৃদ্ধ। তবে আমাদের মাঝি আমজাদ চাচা আগের মাঝিদের চেয়ে একেবারে আলাদা। ছয়ঘণ্টার নৌকা ভ্রমণে একফোঁটা রাগ-ঝাঁঝের চিহ্ন দেখিনি তাঁর ভেতর।
প্রয়োজনমতো নাস্তা-পানি কিনে বারোটার দিকে নৌকায় চড়ে বসলাম। মাঝি নৌকা ছাড়ল। তরতর করে এগুতে থাকলে আড়িয়ল বিলের উদরের দিকে।
খুব কাছে চলে এলাম বেদে বহরের। মাঝিকে বললাম থামতে। বেদেদের সাথে দুটো কথা বলতে চাই।
বেদেরা নাকি এদেশীয় নয়। ওরা নাকি এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্যাচ্যের যাযাবর বেদুইনদের বংশধর এরা। আর “বেদুইন” শব্দ থেকেই নাকি “বেদে” শব্দের উদ্ভব। এই তথ্যটা পেলাম রঞ্জনা বিশ্বাসের “বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা” বই থেকে। এই তথ্যটা হয়তো পুরোপুরি সঠিক নয়, কারণ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ--তিন সম্প্রদায়ের বেদের অস্তিত্ব ছিল বাংলায়। লেখকও অবশ্যে এই তথ্যের সত্যতা দাবি করেননি। তিন জনৈক এক বেদেরে উদ্ধৃতি দিয়ে কথাগুলো লিখেছেন।
বেদেদের জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে বংলাসাহিত্যের কালজয়ী কাব্যাখ্যান ‘সোজন বাধিয়ার ঘাট”। এটা জসীমউদদীনের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তির একটা।
ও বাবু সেলাম বারে বার,
আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু,
বাড়ি পদ্মা পার।
মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা
পঙ্কি বেইচা খাই-
মোদের সুখের সীমা নাই,
সাপের মাথার মণি লয়ে মোরা
করি যে কারবার।
এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি মোরা
আরেক ঘাটে খাই,
মোদের বাড়ি ঘর নাই;
সব দুনিয়া বাড়ি মোদের
সকল মানুষ ভাই;
মোরা, সেই ভায়েরে তালাশ করি আজি
ফিরি দ্বারে দ্বারে;
বাবু সেলাম বারে বার।
এই গানটিও জসীমউদদীনের। ৯০দশকের শুরতে তোজাম্মেল হক বকুল বেদে উপকথা নিয়ে তৈরি করেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি “বেদের মেয়ে জোসনা” সেই ছবিতে জসীমউদদীনের এই গানের কথাগুলো কিছুটা ঘুরিয়ে ব্যবহার করেন বকুল।
একসময় সাপখেলা দেখানো, সাপের তাবিজ-কবচ বিক্রি, কবিরাজি চিকিৎসা করাই ছিল বেদেদের প্রধান পেশা। আজও ঢাকায় রাজপথে বেদে মেয়েদের দেখা যায় নানা ফন্দি-ফিকির করে তাবিজ-কবচ বিক্রির চেষ্টা করে। কেউ কিনতে চাই না। কেউ কেউ আবার এককাঠি সরেস। তাদের একহাতে থাকে তাবিজ আর একহাতে থাকে ছোট্ট একটা সাপ। তাবিজ কিনতে অস্বীকৃতি জানালে গায়ে সাপ ছুঁড়ে ভয় দেখায়।
তবে আড়িয়ল বিলের মামুন নামের এই বেদে বললেন অন্যকথা। তারা একসময় সাপখেলা দেখাতো, এখন আর ওতে পোষায় না। তাই এখন মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে আড়িয়লের বেদেরা।
মমুন বেদেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্থলে তাদের কোনও বসত-ভিটা আছে কিনা? জবাবে সে আলতো হেসে ‘না’ সূচক মাথা ঝাঁকিয়েছিল।
প্রিয় সচল, ওপরের ছবিটা থেকে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায় তাদের স্থলজ ঘরবাড়ির দরকার আছে কিনা। কি নেই বেদে নৌকার ভেতরে!
এক বেদেনী শিশুপুত্রকে গোসল করাচ্ছে। কন্যা শিশুটা নিজেই নেমে গেছে পানিতে।
চলছে নৌকার ছৈ মেরামতের কাজ।
স্ত্রী দুপুরের খাবার খাচ্ছে, স্বামী চিন্তামগ্ন।
নৌকাতেই জাল বুনছে এই বেদে।
নৌকাতেই বিশ্রাম।
একেক নৌকায় একেক দৃশ্য।
দৈনন্দিন জীবনের পর্দাটুকুতে একমাত্র ভরসা নৌকার নৌকার ছৈ।
বেদেরা ভীষণ সাহসী আর দু:সাহসীকতার শুরু শৈশবেই। কতই বা বয়স হবে এই বাচ্চাটার! একণই নিপুণ দক্ষতায় নৌকা বাইতে শিখেছে।
নৌকাতে রান্না-বাড়া, খাওয়া-দাওয়া হলেও সদাই-পাতি করার জন্য মাঝে মাঝে হাটে যেতে হয়। সন্ধ্যায় ফেরার পথে এই দুই হাটুরে বেদেনীর সাথে দেখা হয়ে গেল।
শেষ বারের মতো বেদে বহরে চোখ ও ক্যামেরা দুটোই ফোকাস করলাম।
মন্তব্য
বেদে এবং যেকোন ধরণের জিপসীরা স্থানীয় নয় - এইরকম বকাবাহ্যি পুরো পৃথিবীতেই মোটামুটি চালু আছে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
আজকাল তো বেদেদের নৌবহর দেখিই না। কালেভদ্রে আমিন বাজার ব্রীজের নিচে কিছু দেখা যায়। তবে স্থলবাসী দুটি দলের দেখা পেয়েছি। একদল খুলনা-মোংলা হাইওয়ের কাটাখালী ব্রীজের নিচে খাস জমিটে অনেক আগে ক্যানোপি খাটিয়ে বসবাস করতো। কালে কালে তারা সেখানে এখন বাঁশ-কাঠ-টিনের ঘর তুলেছে। শুরুতে এরা ঝাড়-ফুঁক বা টোটকা চিকিৎসা করলেও আসলে সেগুলোর প্রতি মানুষের আর তেমন বিশ্বাস নেই। তাই ওরা শ্রম বিক্রি সহ অন্যান্য পেশা ধরে এখন ভালোই করে খাচ্ছে। স্থানীয় জনগন ওদের প্রতি বেশ বন্ধুভাবাপন্ন তবে শুরুতে ওদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে স্থানীয়রা বেজায় ক্ষিপ্ত ছিলো। যে কারনে ওরা ইঁদুর, সাপ, শিয়াল, ইত্যাদি খাওয়া বাদ দিয়েছে বা লুকিয়ে খায়। আরেকটা দলের দেখা পেয়েছিলাম মোড়েলগঞ্জে- ওরা কোথা থেকে যেনো নতুন এসে খাস জমিতে বসত গেড়েছিলো। ওরা তখনও ঝাড়ফুঁকের ততপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তাতে সুবিধা না হলেও সিডর উপদ্রুত এলাকা হওয়ায় কিছু সাহায্য পেতো। তবে মোড়েল্গঞ্জের দলটার পুরুষগুলো ছিলো বেজায় আলসে আর মেয়েগুলো কর্মঠ।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
যারা স্থলে স্থলে ঘুরে বেড়ায়, এসব বেদেদের আমাদের এলাকায় বলে টোলফেলা।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ভালো লাগলো লেখাটা।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ, ভালো থাকুন।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
বিস্তারিত তথ্য এবং দারুণ সব ছবির জন্য ধন্যবাদ।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নতুন মন্তব্য করুন