সরষেফুল শীতের মাঠকে অন্যরকম সৌন্দর্য দেয়। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের আড়ালে হারিয়ে যায় প্রকৃতির ক্ষুদ্র অনেক সুন্দর। কবি গুরু যেমনটি বলেছিলেন, পার্বতমালা, সিন্ধু দেখতে গিয়ে ধানের শীষের ওপর শিশিরকণার সৌন্দর্য আমাদের দেখা হয়ে ওঠে না। শীতে সরষে ফুলের আগুনলাগা সৌন্দর্যও তেমন। মাঠ-ঘাটের অনেক সুন্দরকে আড়াল করে দেয়। বিশেষ করে ঘাসফুল তার নির্মম শিকার।
বসন্তে প্রকৃতিরাজ সৌন্দের্যের পসরা সাজিয়ে বসে। তাতে আমরা চাই আর না চায় বুনোফুল ঠিক মেতে ওঠে তার আপন সৌন্দর্যে। কিন্তু শীতকালে বুনোফুলের দাপট নেই। মাঠজুড়ে সরষে ফুলের জয়কয়কার। তার আড়ালে কোথাকার কোন ক্ষুদে ঘাসফুল কীভাবে নিজেকে সাজাল, তা দেখার চোখ কোথায় আমাদের!
কিন্তু শৈশবের চোখটা বোধহয় অন্য রকম। যেসব ক্ষুদ্র ঘাসফুল এখন চোখ এড়িয়ে যায়, শৈশবের দিকে ফিরে তাকালে ঠিকই সেসবের রঙিন আবেশ অনুভব করতে পারি। আর একারণেই মাঠে জঙ্গলে আমার লতাগুল্ম অভিযানে ছোটদের সাথে নিই। যে সৌন্দর্য আমার চোখ এড়িয়ে যায়, ওরা ঠিক ঠিক সেগুলো খুঁজে বের করে খড়ের গাঁদায় সূঁচ খোঁজার মতো করে।
এবার শীতে নানাবাড়িতে গিয়েছিলাম। রসগুড়ের অভিযানে সাথে বুনো উদ্ভিদ পাওয়াটা ছিল বাড়তি পাওয়া।
আমার শৈশবের প্রায় অর্ধেকটা কেটেছে নানা বাড়িতে। তাই ইছাতীর স্রোতধোয়া আমাদের গ্রাম যেমন আপন। ভৈরবে পলিতে গড়ে ওঠা আমার নানার বাড়িটাও ঠিক ততটাই আপন। শৈশবকে খুঁজে ফিরতে, শীতের নতুন রসগুড়ের স্বাদ নিতে তাই এই ডিসেম্বরে নানা বাড়িতে যাওয়া।
ছোট তিন মামাতো ভাইকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম বন ধুঁধলের খোঁজে। সেখানকার কাজ শেষ করে সোজা সরষের ক্ষেতের হাতছানিতে স্মৃতিমেদুর মাঠে। মাঝে বনওকড়া আর পেটারির দেখা পেয়ে থামতে হলো। ফুলের ছবি নেওয়ার জন্য এরপর একটা মুসর খেত পেরুনোর সময় তিনভাইয়ের একজন ডেকে বলল, ‘ভাইয়া দেখেন, জোনাকি ফুল!’
‘জোনাকি ফুল!’ অবাক হলাম আমি। ছোটবেলায় কত দেখেছি। এখন আর তেমন দেখা যায় না। যাবেই বা কী করে? শীতেই বাড়িই থাকা হয় না। আর কত বছর এভাবে মাঠের ঝোপঝাড় তন্ন তন্ন করে খুঁজিনি। কাছে গিয়ে দেখি, সত্যিই জোনাকির মতো মসুরক্ষেত আলো করে রয়েছে নীল রঙের ছোট এক ফুল।
দারুণ ভালো লাগল ফুলটা দেখে। সেই কত বছর আগে শেষবার দেখেছি। এখন আর তেমন দেখা যায় না। আমাদের গাঁয়ে তো একেবারে নেই বলেই আমার ধারণা। আমার ধারণা ঠিক প্রমাণ পেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। সারা মাঠ খুঁজে গোঁটা পাঁচেক মাত্র মিলল।
ফুলটার ছবি নিতে গিয়ে পড়লাম মহা মুসিবতে। আমার ক্যামেরাটা বড্ড বেয়াড়া। মাঝে মাঝে খুব ঝামেলা করে। ম্যাক্রো মোডের অপশনটা আলাদা করা নেই। তাই ফোকাস করে ম্যাক্রো সেট করতে হয়। প্রখর রোদের কারণেই কিনা জানি না ম্যাক্রো ছবি তুলতেই পারছিলাম না। শেষমেষ পেছনে কলার পাতা ধরে ছবিটা তুললাম।
কিছু দূর গিয়ে আরও দুটোর দেখা মিলল। একটার গায়ে দুটো ফুল! ক্যামেরা এখানে একেবারে সুবোধ বালকের মতো আচরণ করল। একেবারে সোনায় সোহাগা!
জোনাকি ফুলের গাছ গুল্ম জাতীয় মৌসুুমি উদ্ভিদ। খুব ছোট। তাই ঘাসের কাতারে ফেলে মানুষ। আসলে ঘাস নয়। যেমন বাঁশ বৃক্ষ কিংবা গুল্ম নয়, ঘাস। তেমনি ছোট হলেও জোনাকি ফুল ঘাস নয়, গুল্ম। সাধারণত রবিফসলের মাঝে এদের দেখা মেলে। উঁচু, উর্বর জমিতে জন্মায়। ফসল ক্ষেতে জন্মায় বলে কৃষকের শত্রু। কৃষক নিড়িং চালিয়ে একে দমন করে ফেলে।
একারণে জোনাকি ফুল বিলুপ্তির পথে। দেখা এখন পাওয়া যায় না। কয়েকটা ভাগ্যবতী গাছ হয়তো এড়িয়ে যায়। তাদের বীজ থেকে যায় মাটির ভেতর। পরের বছর তারা গাছ হয়ে জেগে ওঠে।
জোনাকি ফুলের গাছ চার ইঞ্চি থেকে আধাফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কাণ্ড ও ডালপালা নরম, রসালো। অনেকটা মটরশুটির গাছের মতো। কাণ ও ডাল গোলাকার নয়। চারশিরা বাবের মতো। একটা গাছে দুই তিনটা মাত্র ডাল হয়।
পাতা হালকা সবুজ। মোটামুটি পুরু। রসালো। নরম। পাতা সরল। এক পত্রক। উপবৃত্তাকার। পাতার গোড়ার একটা করে ফুল ধরে।
মঞ্জরি এক পুষ্পক। ফুল গাঢ় নীল রঙের। পাঁচপাপড়ি বিশিষ্ট। ফুলের ব্যাস এক সেন্টিমিটার মাত্র। পাপড়ি পাতলা। ফুলের মাঝখানে দুই থেকে চারটি কিশোর থাকে।
ফল ছোটকালে দেখলেও কেমন এখন তা ভুলে গেছি। তবে গুগলে দেখলাম। ফল গোলাকার। ছোট। মটরদানার অর্ধেক। ভেতরে ৫-১০টা ছোট ছোট বীজ থাকে।
জোনাকি ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম: Anagallis arvensis .
কৃতজ্ঞতা : ড. সোমনাথ ভৌমিক, মাহবুবা সুলতানা
আগের পর্ব : রক্তকুচ
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কী সুন্দর ফুল!!!
-----
প্রথম প্যারা দু'বার হয়ে গেছে।
হেমন্তের এই ফুলটিকেই বুঝি জীবনানন্দ কত সূক্ষ্ম বেদনার সুতোয় গেঁথে তুলে এনেছিলেন তাঁর তির তির করে কেঁপে ওঠা শব্দের হাহাকারে,
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
হয়তো। কবিতাটার নাম বোধহয় “লাকেন বোসের জর্নাল”
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সুন্দর।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ধন্যবাদ, সাদিয়া আপু।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
সুন্দর লেখা ও ছবি।
"চার পাপড়ি বিশিষ্ট।" হুম! ছবিতে দেখছি পাঁচটা ... ভাইয়ার ক্যামেরা দেখি সত্যিই বড্ড বেয়াড়া। আর বৈজ্ঞানিক নাম মনে হয় Angiosperms নয় Anagallis arvensis হবে (Forma azurea)।
ধন্যবাদ। আজ সার্ভিসিং স্টোর থেকে খবর আসিল আমার ক্যামেরাটা চিরতরে ইন্তেকাল করিয়াছেন। উহার বেয়াড়াপনারও ইতি ঘটিল।
তবে ক্যামেরার চেয়ে আমার মনটা আরও বেয়াড়া, কিছুতেই বাগ মানাতে পারিনো। পাঁচ পাপড়িকে চোখে দেখেও চার পাপড়ি লেখে কেউ! আপনার শেষ েইনফরমেণটাও ঠিক। ভুলগুলো ঠিক করে দিলাম।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
প্রথম প্যারাটা দুবার এসেছে, ঠিক করে নিয়েন।
পোষ্টে
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ধন্যবাদ মাসুদ ভাই< সারসংক্ষেপ যোগ করা ছিল। টিক চিহ্ন তুলে দিলাম।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
আহা, কী দারুণ সব ছবি!
দারুণ সুন্দর ফুল!
ছোটবেলায় দেখেছি। এখন আর চোখে পড়ছে না।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
বন্ধু মাসুদ সজীবের কল্যানে সচলের সাথে পরিচয়, সেই কবে থেকেই আছি ও সচলের লেখা পড়ি, তাকে তো ধন্যবাদ দিলেও কম দেয়া হয় । আর রণি দা, আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হয় এত এত ফুলের সাথে , লতা গুল্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। গ্রামের ছেলে হলে কি হবে এত এত নাম মনেও রাখতে পারি না । ধন্যবাদ রনি ভাই।
বন্ধু মাসুদ সজীবের কল্যানে সচলের সাথে পরিচয়, সেই কবে থেকেই আছি ও সচলের লেখা পড়ি, তাকে তো ধন্যবাদ দিলেও কম দেয়া হয় । আর রণি দা, আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হয় এত এত ফুলের সাথে , লতা গুল্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। গ্রামের ছেলে হলে কি হবে এত এত নাম মনেও রাখতে পারি না । ধন্যবাদ রনি ভাই।
------------
রাধাকান্ত
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আপনাকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন