নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৪/২০১৫ - ৭:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

3

এবার বড়কর্তা দু'হাত উপরে তুলে হাতে তালি বাজাতে থাকলেন, যেন আকাশের কোনও প্রান্তে তাাঁর পোষা হাজার হাজার নীলকণ্ঠ পাখি হারিয়ে গেছে।
---নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

সবুজের পসরা নিয়ে আসে ঋতুরাজ। গাছে গাছে কচি পাতার জয়োৎসব। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বাংলার তরুলতা গুল্ম। ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা কীটপতঙ্গের দল ছুটে আসে। মোটুসিরা পাপড়ির পরতে পরতে লম্বা ঠোঁট সেধিয়ে চোষে মধু। ফুল আর পাখির এক আশ্চর্য যুগলবন্দি ঋতুরাজ বসন্তকে মহিমান্বিত করে।

বসন্ত শুধু সবুজে সবুজে সয়লাব হয়না প্রকৃতি। তাতে নানা রংয়ের আল্পনা আঁকে পাখিরা। পাখির ডানায় যেন দক্ষ শিল্পীর রং তুলির আঁচড়। বছরের অন্যভাগের চেয়ে বসন্তে পাখিদের পালকে পালকে রংয়ের খেলা অনেক বেশি। পালকের সৌন্দর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন কণ্ঠে^ও মধু ঢালে পাখিরা। অবশ্য যাদের চেহারা চোখে পড়ার মতো নয় তাদের সুর যেন মধুমাখা। বসন্ত বৌরি অবশ্য ব্যতিক্রম। রূপ সৌন্দর্যের সাথে সে গলাটাও পেয়েছে মূর্চ্ছনায় ভরা।
কিন্তু এতসব বৈচিত্র্য কেন এই বসন্তেই শুধু?
বাংলাদেশের সবচেয়ে উপযোগী আবহাওয়া এই বসন্তেই। তা যেমন মানুষের জন্য সত্যি, তেমনি পশুপাখি কীট পতঙ্গের জন্যও উপযোগী। বসন্তে শীতের শ্রীহারা বৃক্ষরাজি নতুন নতুন পত্র-পল্লবে শোভিত হয়। তাই এদেরকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে যেসব কীটপতঙ্গ তারাও বংশবিস্তারের জন্য বেছে নেয় ঋতুরাজকে। তাছাড়া এ সময় গাছে গাছে মুকুল ও ফুলের বাহার। মধুপায়ী কীট ও পাখিদের বংশবিস্তারও তাই এই ঋতুতে। এসব কীটপতঙ্গকে উপজীব্য করে যেসব পাখি প্রাণ ধারণ করে তাদের জন্য বসন্তই উপযুক্ত সময়। বছরের অন্যসময় পাখিরা স্বাভাবিকভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু বাসা বেঁধে ডিমে তা দেওয়া ও ছোট্ট ছানাদের দেখাশোনার জন্য সার্বক্ষণিক একটা পাখিকে বাসায় বসে থাকতে হয়। তাই স্বাভাবিক খাদ্য জোগাড়ে ভাঁটা পড়ে। তাই এ সময়টাই পাখিদের বাসা বাঁধার উপযুক্ত সময়। কারণ খাদ্যের যোগান পর্যাপ্ত। কম পরিশ্রমে নিজের ও ছানাদের জন্য সহজেই খাদ্য জোগাড় করা যায় বলে বসন্তকেই এদেশের বেশিরভাগ মেঠোপাখি নীড় বাঁধার জন্য উপযুক্ত মনে করে। কোকিল গোষ্ঠীর পাখিরা বাসা বাঁধে না। কাক-শালিকদের বাসায় ডিম পেড়ে পরের প্রজন্মের জন্য তাদের দায়িত্বের ইতি টানে। কিন্তু সেই প্রজন্মকে রক্ষা করে যারা তাদের বাসা বাঁধার সময়ই হলো পরনির্ভরশীল কোকিলদের প্রজননের উপযুক্ত সময়।
বলছিলাম পাখির কথা। কিন্তু এসে পড়ল কত কথা। আসলে বাংলার মেঠোপাখি নামে একটা সিরিজ খুলতে চাচ্ছি সচলায়তনে। তাই প্রথম লেখার একটা ভূমিকার দরকার ছিল। আসুন পাঠক, এবার আমরা ফিরে যাই সপ্তাহ দুয়েক পেছনে।
২৯ মার্চ। গ্রামে এসেছি বেশ কদিন হলো। রাতের ঘুম আর দিনে তিনবার খাওয়ার সময় বাদে একটা সপ্তাহ পুরোটাই কেটেছে মাঠে মাঠে। গাছপালা আর পাখির পেছনে ঘুরে ঘুরে। মেঠোপাখিদের অনেকেরই ক্লোজ ছবি নিতে পেরেছি। তাই আনন্দের সাথে সাথে আগ্রহটাও বাড়ছে দিন দিন।
আগের রাতে ঠিক করে রেখেছিলাম, সকালে উত্তর মাঠের দিকে সোজা হাঁটা দেব। যেসব পাখির ছবি তুলতে পারিনি তার কিছু কিছুর যদি হদিস মেলে... সাথে আমার চাচাতো ভাই সোহান আর খালাতো ভাই শাহেদ। একজনের বয়স ১৫ আরেকজনের ১৩। পাখি খুঁজতে গিয়ে সবসময় একজনকে না একজনকে সাথে রাখি। এতে দুটো সুবিধা। একজোড়া কান ও চোখের চেয়ে একাধিক জোড়া চোখ কানের সুবিধা পাওয়া যায়। শাহেদের ভেতর আমার পাগলামির নমুনা বেশ প্রভাব ফেলেছে। ও সারটা দিন পাখি, পোকা আর গাছপালা নিয়েই পড়ে থাকে। তাই পাখির ডাক শুনেই বলে দিতে পারে কোন গাছে কী পাখি ডাকছে।

পিসরাস্তা ছেড়ে নেমে পড়লাম উত্তর মাঠের দিকে। চৈত্রের ডঙ্কা দুপুরের আগমুহূর্ত। সৌর বিকিরণে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মাঠ। ফলে ভূমি সংলগ্ন বায়ুম-লের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণে। তা ফলে কেঁপে উঠছে ফসল ক্ষেতের ওপরের বায়ুম-ল। মেঠো পথে নামতেই পেলাম একজোড়া সুইচোরা পাখির দেখা। এরপর একটা মাছরাঙ্গা পাখি হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে গেল বহুদূর পর্যন্ত। ট্রাইপড সাথে থাকলে সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও কম নয়। এলাকায় এয়ারগান কাঁধে নিয়ে ঘোরাফেরা করা শয়তানের অভাব নেই। পাখিরাও সেটা বোঝে। মাঠে কত মানুষ কাজ করে, তাদের পরোয়া তেমন করে না। কিন্তু ট্রাইপডকে বন্দুক ভেবেই পালায় বলে মনে হয় আমার।

সামনে কিছুদূর এগুতেই অন্য ধরনের একটা পাখি উড়ে গেল দূরে একটা শিমুল গাছের দিকে। ওড়াটা অন্যরকম। শাহেদ-সোহানও দেখেছে। ওরাও চিনতে পারল না। ও পাখির আশা বাদ দিয়ে একটা আম বাগান লক্ষ করে এগুতে শুরু করলাম। হঠাৎ বাঁধা এলো সোহানের কাছ থেকে, ‘ভাইয়া কী পাখি দেখেন?’
চোখে পড়তে সময় লাগল, শাহেদ অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কলা পাতায় বসে আছে অদ্ভুত সুন্দর নীল রংয়ের পাখি। আগে কখনওই দেখিনি এ পাখি। ওরাও দেখেনি। ট্রাইপড নামিয়ে ক্যামেরা ফোকাস করতে করতে পাখি উড়ে গেল ক্রাক ক্রাক ডাকতে ডাকতে। আফসোসের অন্তত নেই! একেবারে অচেনা পাখি। আছিই বা আর কদিন! এর মধ্যে পাবো কিনা তার ভরসা কোথায়।

18
‘পাখিটাকে অনুসরণ করা যাক। আমার ধারণা খুব বেশি দূর এগোয়নি ওটা।’ বললাম আমি। ওদের দুজনকে নিয়ে সোজা পশ্চিমে হাঁটা দিলাম।
ওদিকে একটা মেহগনী বাগান। পাখি ওই বাগান পেরিয়ে যায়নি বলেই মনে হলো। খোঁড়া চষা জমিতে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর আবার সেই ক্র্যাক ক্র্যাক ডাক শুনতে পেলাম। অর্থাৎ আমার ধারণাই ঠিক।
ছায়া সুনিবিড় মেহগনী বাগান। আশ্চর্য! কয়েকটা শালিক ছাড়া অন্য পাখি নেই। পরের চার-পাঁচ দিন নিশ্চিত হয়েছিলাম মেঠো পাখিদের অধিকাংশই মেহগনী, ইউক্যালিপটাস, ইপিল-ইপিল ইত্যাদি গাছ এড়িয়ে চলে। তবে আমাদের এই নীলকণ্ঠ মহাশয় বহাল তবিয়তেই মেহগনী বাগানে বিচরণ করছে। চৈত্রের প্রচ- দাবদাহে ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে উঠেছি। শ্রান্ত দেহে তিনভাই বসে পড়লাম মেহগনীর বাগানের ছায়ায়। চারপাশে খোলা মাঠ। মুগ, গাঁদা ফুলের ক্ষেত। এখানে সেখানে সদ্য চারা গজানো পাটক্ষেত আছে। মাঝে মাঝে আম-কাঁঠালের বন। রোদের খরতাপ ভোলাতে যেন দখিণা বাতাসেরও অন্ত নেই। মুহূর্তেই চাঙ্গা হয়ে উঠলাম।

22
পাখিটার ক্র্যাক ক্র্যাক শব্দ তখনও এক নাগাড়ে শুনতে পাচ্ছি মেহগনির ঘন ডাল-পাতার আড়াল থেকে। একাধিক পাখির ডাক। একটা খুঁজতে এসে একজোড়া পেয়ে গেলাম বোধহয়। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ করে ওরা যেন আমাদের মনের কথা পড়ে ফেলল। সামনেই একটা মুগক্ষেত, তার ঠিক মাঝখানে একটা পটলক্ষেত। মাচা করা। পটলক্ষেতের ওপাশে চার পাঁচটা খেঁজুর গাছ। একটা নীল পাখি গিয়ে বসল খেঁজুর গাছে। ক্যামেরা ট্রাইপডে লাগানোই ছিল। ফোকাস করে দূর থেকে এক শট নিয়ে রাখলাম। বলা যায় না, যদি আর কোনও শট নিতে না পারি!

25
বলে রাখা দরকার, আমার ক্যামেরা মাত্র ৩০ এক্স জুমের ক্যাম্পাক্ট; ডিএসএল আর নয়। তাই ইচ্ছে করলেই বহুদূর থেকে ক্লোজআপ শট নিতে পারি না। দুটো শট নিলাম, মনোপুত হলো না। ট্রাইপড নিয়েই মুগ ক্ষেতের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম খেঁজুর গাছের পানে। কিন্তু এ পাখি বড্ড চঞ্চলমতি। একটা গিয়ে বসছে খেঁজুর গাছে, আরেকটা এসে তাকে জ্বালাতন করেছে। সে পাখিটা তখন উড়ে অন্য গাছে গিয়ে বসছে। ধারণা করলাম, শান্তটা স্ত্রী। আর ঝামেলা পাকানো পাখিটা পুরুষ। স্ত্রীটা উড়ে গিয়ে বসল আরেকটা গাছে। পুরুষটাও উড়ে গেল সেদিকে। এরপর কোথা থেকে উদয় হলো আরও দুটো পাখি। স্ত্রীটার মন যোগানোর খেলা শুরু হলো। সম্ভবত আগুন্তকদ্বয়ও পুরুষ। অর্থাৎ এক নারীকে ভোলাতে উঠেপড়ে লেগেছে তিন তিনজন পুরুষ!

16
একজন দেখলাম শাঁ করে ওপরে উঠে গেল জেট বিমানের মতো। কিছুদূর গিয়ে একটা মন ভোলানো ড্রাইভ। হঠাৎ করেই যেন বিমানটা ক্র্যাশ করল। ডানা ছড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল মাটির দিকে। দেখলে মনে হবে, একটা মৃত পাখি বুঝি পড়ছে ওপর থেক। হাবার মতো তাকিয়ে আছি সেদিকে, ছবি তুলব কী! তাছাড়া উড়ন্ত পাখির ছবি তোলা এ ক্যামেরার কম্ম নয়!
এরপর আরেক বার অবাক হবার পালা। পড়ন্ত পাখিটা ঠিক মাটি ছোঁয়ার আগ মুহূর্তে জীবন ফিরে ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে শাঁ করে উঠে গেল আকাশের দিকে। তারপর কয়েকটা ড্রাইভ দিয়ে উড়ে গিয়ে বসল স্ত্রী পাখিটার পাশে। বাকি দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর রাগ দেখে কে? তিনজনে তুমুল ঝগড়াঝাটি।

17
পুরো বিষয়টা ততক্ষণে বুঝে গেছি। তাই পাখিরা কখন কোন দিকে যাচ্ছে সেদিকে আমিও ছুটছি। চষা ক্ষেতে শুকনো ঢিল যেন নুড়িপাথর। তেমনি আগুন গরম। সেন্ডেল দুটো রেখে এসেছি মেহগনী বাগানে, ভাইদের জিম্মায়। কারণ সেন্ডেল পরে পাখি দেখা বেশ কঠিন, বিশেষ করে শুকনো মাটিতে ও পাতার ওপর দিয়ে চলতে গেলে শব্দ হয়। খালি পায়ে বেশ নিঃশব্দে চলাফেরা করা যায়। পা পুড়ছে, ঢিলের আঘাতে ব্যথা লাগছে। তাছাড়া এখানে ঢিলার ভেতর গা ঢাকা দিয়ে আছে কাটানটের শুকনো কাঁটা। বড্ড ভয়ংকর জিনিস। কিন্তু প্রকৃতির এই সুন্দর খেলার কাছে এতটুকু আঘাত একেবারেই তুচ্ছ। অন্তত তখন কিছুই টের পাইনি।
মিলিটারি অ্যাকশনে এগুচ্ছিলাম এতক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম এ পাখিরা মানুষকে অতটা পরোয়া করে না। মাঝে মাঝে উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসছে। মাঝে মাঝে দেখলাম একদল গো শালিক চেচামেচি করে ওদের পিছু ধাওয়া করছে। নীল পাখিগুলো বিরক্ত হচ্ছে। তবে ভয় পাচ্ছে না।

5
পাখিগুলোর হাবভাব ও চেহারা দেখে ভেবেছিলাম কাক বা বাজ গোষ্ঠীয় কোনও প্রজাতি। পরে ভুল ভাঙে। আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। বিভিন্ন পোজের ছবি। এক সাথে দুটোর ছবিও তুলতে পারলাম। কিন্তু আফসোস, এই সুন্দর পাখিটা এমনিতেই সুন্দর, কিন্তু ডানা মেললে এর রূপ যেন বেড়ে যায় শতগুণে। সেই ডানা মেলা ছবিই তুলতে পারিনি।
একসময় মনে হলো যথেষ্ট ছবি হয়েছে, এবার ফেরা যাক। তখনই পেলাম আসল ছবি। একটা মহানিম গাছে মোহনীয় ভঙ্গিতে বসে আছে একটা পাখি। খুব কাছ থেকে ছবি তেলার সুযোগও দিল পাখিটা।

8
ট্রাইপড গুঠিয়ে কাঁধে নিলাম। ফিরে এলাম সেই পিসরাস্তায়। তারপর আবার দেখা। ছোট্ট একটা মরা গাছে বসে আছে। ট্রাইপড পুরোপুরি গোটাইনি। শুধু ঠ্যাংগুলো সোজা করে ঘাড়ে নিয়েছিলাম। দ্রুত আবার বসালাম রাস্তার ওপর। ক্যামেরাও লাগানো ছিল তেপায়ার মাথায়। এবার পেলাম আরও ক্লোজ ছবি। নীলকণ্ঠের চিরায়ত ভঙ্গি যেটা সেটা ক্যাপচার করা গেল! পাখির পরিচয়টা তখনও জানতে পারিনি।

2
প্রকৃতিবিদ রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’ বইটা ছিল। ওখানে ছবি আছে তার সাথে মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম এটা সেই বিখ্যাত পাখি নীলকণ্ঠ। বইয়ে পাখিটাকে সুলভ শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে সুলভ মনে হয়নি কখনও। ত্রিশ বছরের জীবনে কোনও দিন একপলক দেখেছি বলে মনে হয় না। তবে ‘বাংলাদেশের পাখি’ বইয়ে একটা তথ্য পেলাম। একেকটা গ্রামে নাকি মাত্র একজোড়া করে থাকে। তথ্যটা যদি ঠিক হয়, তাহলে আমাদের গ্রামের জোড়া দেখে ফেললাম! সৌভাগ্য আর কাকে বলে।

19
আমাদের এলাকায় পাখিটার নাম ‘কাচ পাখি’। ভেবেছিলাম বাজ বারাক জাতীয় পাখি। হয়তো পাখির ডিম, ছানা খায়। পরে ইনাম ভাইয়ের (ইনাম আল হক) ‘পাখিদের সুখ দুখের কথা’ নিশ্চিত হলাম; নীলকণ্ঠ মোটেও কাক বা বাজ গোষ্ঠীর পাখি নয়। এমনকী কোকিল গোষ্ঠীরও নয়। বইটাতে একটা তথ্য পেলাম সাধারণত চৈত্র মাসে কেটে নেয়া গম ও ভূট্টা ক্ষেতে আগুন দেওয়া হয়। তখন ওসব ক্ষেত্রের পোকামাকড় আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছুটে পালায়। নীলকণ্ঠরা আগুনলাগা পাশে বসে থাকে সেসব পোকা খাওয়ার জন্য। তাহলে কী ক্ষেত্রে আগুন লাগানোর কারণেই নীলকণ্ঠের দেখা পেয়েছিলাম। কারণ আমাদের ওই মেহগনী বাগানের পাশেই সেদিন এক শুকনো গাঁদাফুলের ক্ষেতে আগুন দেওয়া হয়েছিল!
এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’ থেকেই পাখির বর্ণনাটা হুবহু তুলে দিলাম--

বাংলা নীলকণ্ঠ বাদামি বুক ও নীল ডানার পাখি (দৈর্ঘ্য ৩১ সেমি, ওজন ১৬৫ গ্রাম, ডানা ১৯ সেমি, ঠোঁট ৩.৫ সেমি, পা ২.৭ সেমি, লেজ ১৩ সেমি)। বসে থাকা অবস্থায় এর পিঠ লালচে বাদামি; ওড়ে গেলে ডানার নীল রঙ দেখা যায়; ডানায় পর্যায়ক্রমে ফ্যাকাসে নীল ও কালচে নীল পালক রয়েছে; গলাবন্ধ, ঘাড়ের পিছনের ভাগ, গলা ও বুক লালচে-বাদামি; কাঁধ-ঢাকনি ও ডানার গোড়ার পালক বাদামি জলপাই-সবুজ; তলপেট ও অবসারণী ফ্যাকাসে নীল এবং লেজ গাঢ় নীল। এর চোখ বাদামি; ঠোঁট বাদামি-কালো; পা ও পায়ের সঙ্গে সংযুক্ত অঙ্গ হলদে-বাদামি। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি অনুজ্জ্বল; কাঁধ-ঢাকনি মেটে বাদামি এবং গলা ও বুকে ডোরা রয়েছে। ৩টি উপ-প্রজাতির মধ্যে C. b. benghalensis এবং সম্ভবত C. b. affinis বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব: বাংলা নীলকণ্ঠ পাতাঝরা বন, বনের প্রান্তদেশ, তৃণভূমি, ক্ষুদ্র ঝোপ, খামার ও গ্রামাঞ্চল বিচরণ করে; পাতাহীন ডাল, বেড়ার বাঁশ অথবা বৈদ্যুতিক তারে একাকী বসে থাকে। নীরবে বসে এরা ধীরে লেজ ওপর-নিচে দোলায় ও নিচের ভূমিতে শিকার খোঁজে; আহার্যতালিকায় রয়েছে পোকামাকড়, টিকটিকি, ব্যাঙ ও সাপ। ঘাসে বা ঝোপে আগুন দেওয়া হলে পোকা ধরার জন্য এরা পাশে বসে অপেক্ষা করে। এপ্রিল-মে মাসের প্রজনন ঋতুতে এরা উঁচু গলায় ও তীক্ষ্ণ সুরে ডাকে: ক্রাক.. ক্রাক..; ছেলে ও মেয়ে সমবেত ওড়ার মহড়া দেয়; এবং গাছের কোটরে অথবা দালানকোঠার ফাঁক-ফোঁকরে ঘাস ও খড়কুটো দিয়ে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৫টি, মাপ ৩.৮×২.৮ সেমি। ১৭-১৯ দিনে ডিম ফোটে; ২০-২৫ দিনে ছানার গায়ে ওড়ার পালক গজায়।
বিস্তৃতি: বাংলা নীলকণ্ঠ বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি; সকল বিভাগের গ্রামাঞ্চলে বিচরণ করে। পারস্য উপসাগর থেকে পুরো ভারত উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সুদূর চীন ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা: বাংলা নীলকান্ত বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ: বাংলা নীলকণ্ঠের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার তাউরা ( গ্রীক: Korakias = তাউরা, bengalensis = বাংলার)।
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এই নিবন্ধটির লেখক ইনাম আল হক ও সুপ্রিয় চাকমা।

রেজা খানের ‘বাংলাদেশের পাখি’তে পেলাম আরেক রহস্যের সমাধান। নীলকণ্ঠের হঠাৎ ওভাবে মরার মতো আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার রহস্য । আসলে ওটা পুরুষ পাখির একটা ছল। স্ত্রীকে ভোলানোর জন্য। সেদিন একটা তৃপ্তির ঢেকুর নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। নীলকণ্ঠের দেখা এভাবে পাওয়া যায় সুদূরতম কল্পনাতেও ভাবিনি।
এরপর আরও সাত দিনে দশ বার ওই মাঠে গেছি, অন্য মাঠেও খুঁজেছি--নীলকণ্ঠের দেখা আর মেলেনি!

11
স্থানীয় নাম : নীলকান্ত, নীলকণ্ঠ, কাঁচ পাখি
ইংরেজি নাম : Indian Roller.
বৈজ্ঞানিক নামCoracias benghalensis.


মন্তব্য

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আহা, গাঢ় সবুজের মাঝে ধুসর-নীল, দারুণ! দারুণ হয়েছে ছবি ধারণ। চলুক

জিল্লুর রহমান সোহাগ  এর ছবি

অসাধারণ লেখা সেইসাথে ছবিগুলো। শুভকামনা জানবেন

জিপসি এর ছবি

পাখিটা খুব সুন্দর। ৩০ এক্স দিয়ে তো বেশ ভালই ছবি তুলতে পেরেছেন, টেলিলেন্স ছাড়া এত ছোট পাখির ছবি তোলা সহজ নয়। আমি নিজেও মাস ছয়েক ধরে পাগলের মত পাখির পিছে ছুটে বেড়াচ্ছি আমার ৬৩ এক্স কম্প্যাক্ট দিয়ে।

পাখি নিয়ে আপনার নতুন সিরিজের অপেক্ষায় রইলাম।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।