‘কাকে নিয়ে গেল?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল পাণ্ডে।
‘কাকে নিয়েছে বুঝতে পারছি না।’ সতেরো-আঠারো বছর বয়সী একটা ছেলে জবাব দিল। চোখে তার বিস্ময় আর আতঙ্কের ছাপ। ‘নয়জন আগুন পোহাচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ বাঘ এসে একজনকে তুলে নিয়ে গেল। কিন্তু এখন দেখছি সবাই আছি। আরেকজন কখন এসে আগুন পোহাতে বসেছিল কে জানে!’
‘ভয় পেয়ো না,’ বললাম আমি। ‘গ্রামটা তো খুব বেশি বড় নয়। খোঁজ নিয়ে দেখো, কে হারিয়েছে। টুরিস্টদের কেউ হলে তারও খোঁজ শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। চলো আমরাও যাচ্ছি তোমাদের সাথে।’
কিন্তু পা আর তুলতে পারলাম না। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার ভেসে এলো উত্তরের বন থেকে। কলজে কাঁপানো ভয়ংকর চিৎকার। সহজ-সরল মানুষগুলো ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওদের শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরাতেই আবার এলো সেই চিৎকার। থেমে থেমে পর পর কয়েকবার। চিৎকারটা ক্রমেই যেন দূরে সরে যাচ্ছে। একেবারে উত্তরের বনের গহীনে।
বুধা সিং ভয়ে-আতঙ্কে ঢোক গিলতে গিল বলল, ‘চুরাইল, বাবুসাব। অপদেবতা!’
‘চুরাইল, মানে করবেটের বন্ধু ড্যানসির সেই বনশি।’ বিড়বিড় করে বললাম আমি। ‘সেই চুরাইল এতদিন পর ফিরে এলো। অথচ করবেট যৌবনের শুরুতেই চুরাইল রহস্য ভেদ করেছিলেন।’
১১ মে
রাতটা টেনশনে কাটল। ভেবেছিলাম সকালে হয়তো কোনও কুল-কিনারা করা যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। এরই মধ্যে খবর এলো টনকপুরে দুটো বাঘ নাকি একসাথে হামলা করে একজনকে ধরে নিয়ে গেছে। কাকে নিয়েছে, কেউ জানে না। দুটো বাঘ একসাথে হামলা করে একথা এই প্রথম শুনলাম। বাঘ বড্ড একষেড়ে প্রাণী। একসাথে শিকার করার প্রশ্নই ওঠে না। পাণ্ডেকে বললাম, ‘যাবে নাকি একবার?’
পাণ্ডে রাজি হলো। বুধা সিংকে আমাদের ফোন নম্বর দিয়ে এলাম। সকাল দশটার দিকে নৈনিতাল থেকে বাস ধরলাম কাঠগোদামের। ওখান থেকে বাস পাল্টে সোজা টনকপুর।
ঘটনা সত্যি। দুটো বাঘ এক বৃদ্ধকে তুলে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম বাঘ দুটোর একটা মেয়ে কিনা। আবার ধারণাই ঠিক। বাঘের মিলন ঋতু এখন। দুটো একসাথে থাকতেই পারে। কিন্তু ভিক্টিমের হদিস তখনও মেলেনি।
টনকপুর থেকে দু-কিলোমিটার দূরে সারদা নদী। মাঝখানে বাওড়ের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নদীর বেশ কিছু শাখা। নদীগুলোর বুকে চর। দ্বীপের মতো। জঙ্গলে ঠাঁসা। একদল জেলে গিয়েছিল মাছ ধরতে। তারা দেখে এসেছে বাঘ দুটো। মরা একটা মানুষকে খুবলে খাচ্ছে। মাঝিদের অনুরোধ করলাম আমাদের যেন সেখানে পৌঁছে দেয়। কিন্তু যা ভয় ওরা পেয়েছে কেউ রাজি হলো না। শেষমেষ ফোনে অমরেশ দেশাইয়ের শরণাপন্ন হলাম। তিনি বনবিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করে দিলেন।
বনবিভাগে থেকে একটা ট্রলার দেওয়া হলো। আধঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলাম আমরা। বড় বড় ঘাসে ঢাকা জঙ্গল। তার মাঝখানে দুটো বাঘ দাঁড়িয়ে। আমার হাতে এনাইহিলিন গান। বাঘ দুটো আক্রমণ করতে এলেই ঘোড়া টিপে দেব। ভ্যানিশ হয়ে যাবে।
বাঘ দেখলাম, কিন্তু কোনও মড়ার সন্ধান পেলাম না। বাঘ দুটো বরং মিলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মাঝিদের কথা যদি ঠিক হয়, ওদুটো মানুষখেকো। সুতরাং ওদের মেরে ফেলাই উচিৎ। এনাইহিলিন গানের ট্রিগারে চাপ দিলাম। একটা বাঘের গায়ে গুলিটা লাগল। কিন্তু ভ্যানিশ হলো না। আসলে কিছুই হলো না।
গানটাতে কোন সম্যস্যা হয়েছে কিনা দেখলাম। সব ঠিক আছে। তাহলে?
ঘাসে ঢাকা জায়গাটার ওপারে একটা ঘন জঙ্গল ছিল। হঠাৎ সেটা নড়ে উঠল। প্রবল আলোড়ন তুলে বেরিয়ে এলো বিরাট এক মদ্দা হাতি। হাতিটা জলাশয় পেরিয়ে সোজাসুজি চলে এলো বাঘ দুটোর কাছাকাছি। হাতিটাকে দেখেই ফুঁসে উঠল বাঘদুটো। একটা বাঘ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। অন্যটা চলে গেল হাতিটার পেছনে। মুহূর্তের মধ্যে জলাশয়ের বালিয়াড়ী পরিণত হলো রণক্ষেত্রে।
পেছনের বাঘটা লাফিয়ে চড়ে বসল হাতির পিঠে। হাতি তখন মাথাটা ঘুরিয়ে শুঁড় বাগিয়ে চেষ্টা করল পিঠের বাঘটাকে ধরার। ততক্ষণে সামনের বাঘটা হুঙ্কার ছেড়ে হাতিটার মাথায় চড়ে বসেছে। শুরু হলো বনের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই জাতের মরণপণ লড়াই। এ দৃশ্য মিস করতে চাই না। পিঠের আন্টি-গ্রাভিটেশনাল ব্যাগ থেকে ছোট্ট ক্যামেরাটা বের করে ভিডিও করতে শুরু করলাম।
যুদ্ধ চলল দিন ভর। এক সময় সন্ধ্যা ঘনাতে শুরু করল। আমরা ফিরে এলাম টনকপুর।
১২ মে
সকাল বেলা আবার গিয়ে দেখি পাথুরে নুড়ি বিছানো এক জায়গাতে হাতিটা মরে পড়ে আছে। হাতির মাংস ছুঁয়েও দেখিনি বাঘমামারা। এখন কথা হচ্ছে, বাঘ দুটো কোথায়? ওদুটো মানুষখেকো। ওদের শেষ করতে হবে। কিন্তু গতকাল অ্যানাইহিলিন গান দিয়েও ওদের কিছু করতে পারিনি। কেন এমন হলো?
বাঘেদের পায়ের ছাপ ধরে অনুসরণ করার চেষ্টা করলাম। নুড়ি-পাথর ছাড়িয়ে বালুর ওপর পায়ের ছাপ রেখে বাঘ দুটো এগিয়ে গেছে জঙ্গলের ভেতর। ছাপ অনুসরণ করে এগোলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর হঠাৎই গায়েব হয়ে গেছে পায়ের ছাপ। আবার পেছন ফিরে এলাম। পেছনের ছাপগুলো অনুসরণ করার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, ভীষণ আশ্চর্য ব্যাপার! পেছনের ছাপগুলোও নেই!
পাণ্ডেকে সাথে নিয়ে এলাম নুড়ি পাথরের সেই জায়গায়। ওখানে হাতিটা মরে পড়ে ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। এতবড় হাতি মুহূর্তের মধ্যে গায়েব হয়ে গেল! এতো মহা ভৌতিক ব্যাপার। ট্রলারের মাঝি ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বলল, ‘হুজুর আমার চোখের সামনে থেকে হাতিটা গায়েব হয়েছে। এ-কী দিন এলো! অপদেবতা চুরাইল রুষ্ট হয়েছেন আমাদের ওপর।’
ফিরে এলাম টনকপুর। আমরা মাঝিকে বলেছিলাম ঘটনা চেপে যেতে। কিন্তু এমন ঘটনা চাপা থাকে? আমরা টনকপুর ছাড়ার আগেই গোটা শহরে রাষ্ট্র হয়ে গেল ঘটনাটা।
১৩ মে
টনকপুর থাকতে চেয়েছিলাম আরও একটা দিন। রহস্যটা ভালো করে বোঝার জন্য। কিন্তু সন্ধ্যায় পাণ্ডের মোবাইলে ফোন এলো। বুধা সিংয়ের। দোকান থেকে ফোন করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে নৈনিতালেও। ওঁর চাচা কুঁয়ার সিংকে নাকি দেখা গেছে নৈনিতালে।
কথাটা বিশ্বাস হলো না আমার। বললাম, ভুল দেখেছেন। কিন্তু বুধা সিং ভগবানের দিব্যি কেটে বলল। সে সত্যিই কুঁয়ার সিংকে দেখেছে। শুধু সে-ই নয়। নৈনিতালের যেসব বুড়োরা ছোট বেলায় কানওয়ার সিংকে দেখেছে সবাই নাকি চিনতে পেরেছে তাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চাচার সাথে কথা কইতে পারেনি বুধা সিং। চাচা নাকি তার কথা শুনতেই পায়নি। অতএব টনকপুরের রহস্য রেখে কানওয়ায় সিংকে খুঁজতে চললাম আবার নৈনিতালে। কিন্তু নৈনিতালে আর যাওয়া হলো না।
কাঠগোদাম এসে শুনলাম নতুন খবর। কালাধুঙ্গিতে নাকি দেখা গেছে চুরাইলকে। চুরাইল হলো অপদেবতা। সুন্দরি মেয়ের রূপ ধরে লোকালয়ে আসে। তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকে মানুষকে। মানুষ তার হাতছানিতে সম্মোহিত হয়ে যায়। সহজেই পা দেয় চুরাইলের ফাঁদে। চুরাইলের পায়ের পাতা পেছনের দিকে ফেরানো। তাই পেছন দিকে হাঁটতে পারে সে। ছুটলাম কালাধুঙ্গিতে।
এই সিরিজের অন্যগল্প : বিষ্ণুপদের বিড়াল, অন্য পৃথিবী, কিউপিড ব্যালান্স, জামিল ও অদৃশ্য মানব, ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি-১, ২, ৩, ৪, ৫
মন্তব্য
আজকেও শেষ করলেন না? এমন জায়গায় কেউ থামে নাকি? আরেকটু বড় করে দেন।
স্বয়ম
না, এত তাড়াতাড়াড়ি শেস হবে কী করে, বড় গল্প যে!
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ম্যাগীর সাথে হাটে অক্কন দেহা হইল। হেই কইলো, "এত রাইতে রনির জন্য ৫০ গ্রাম মাছ কিনতে বাইর হইছি, হে দেহি আমার পিয়ানোটা ই বাজাইতে পাগল"।
ম্যাগির মতো আমার একটা দিদি থাকলে আমিও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতাম।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
নিয়া গেল ষাঁড় আর খুবলে খুবলে খাইল মানুষ? ঠিক করেন:
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
মিসটেক---মিসটেক! ঠিক করে দিয়েছি মরুর বাগান দা। ধইন্যাপাতা আপনাকে।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
জিম করবেট থেকে কাহিনীগুলো ভালোই নিয়েছেন। সাথে আবার সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর আবিস্কার অ্যাানাইহিলিন গান। দুইজনই প্যাটেন্টকে কখনো গুরুত্ব দেননি বলে তাদের কথা উল্লেখ না করেই ঢালাওভাবে ব্যবহার করা উচিত না বলে মনে করি।
দুটো পার্টই পড়লাম। এর মাঝে জোড়া বাঘ-হাতির ঘটনাটা খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। এটি পুরোপুরি জিম করবেটের বর্ণনা থেকে নেওয়া।
আরেকটি অনুরোধ। 'জিম করবেটের শিকারকাহিনী এর ছায়া অবলম্বনে' কথাটি কোনো এক কোনায় যুক্ত করে দেবেন প্লিজ।
Muntasir Akash ভাই, দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। কাহিনী যতটুকু এগিয়েছে, কল্পবিজ্ঞানের বিজ্ঞানটুকু এসেছে বলে আপনার মনে হয়েছে? আসলে এই পুনর্মঞ্চায়ন বিষয়টাই এই গল্পের বিজ্ঞান। এটাই আবার মূল রহস্য, এই রহস্য যখন ভেদ হয়ে যাবে তখন স্পষ্ট করে বিষয়টা চলে আসবে। তাই আলাদা করে ছায়া অবলম্বনে লেখার প্রয়োজন মনে করিনি। শেষপর্ব অবধি নজর রাখবেন আশা করি।
শঙ্কুর এনাইহিলিন গান কীভাবে জামিলের হাতে এলো, সেকথা এই সিরিজের প্রথম “ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি”তে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি। এখন কথা হচ্ছে আমার গল্পে এনাইহিলিন গান আদৌ ব্যবহার করতে পারি কিনা। বিশ্ব সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞানগুলোতে খেয়াল করে দেখেন, এটমিক ব্লাস্টার, লেজার গান, বাইভার্বাল—যন্ত্রগুলো অহরহ ব্যবহার হচ্ছে। আমি কিন্তু সেভাবে করিনি। সেটা ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি পড়লেই বুঝতে পারবেন।
Muntasir Akashভাই, আপনার সবগুলো অভিযোগ আমি মাথা পেতে নিলাম। তবে এখনই কারেকশনে যাচ্ছি না। আমি গল্পের শেষ পর্বে আপনার মন্তব্য আবারও আশা করছি। তখন পুরো কাহিনীর প্রেক্ষাপটে যে যে পরামর্শ দেবেন, সেগুলো সংশোধনের শতভাগ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।আপনার প্রতিটা মতামত গুরত্বের সাথে বিবেচনা করব। কারণ প্রিন্ট ভার্সনে বই আকারে যখন এই কাহিনীগুলো বই আকারে বের হবে তার আগে সমস্ত ত্রুটি বিচ্যূতি সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। তখন তো আর কারও মন্তব্য পাবো না। এখানকার মন্তব্যগুলো তাই ভীষণ রকম জরুরি।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
বাঘ-হাতিটা মডিফাই করবেন অন্তত।
আর আপনার উত্তরের জন্য ধন্যবাদ!!
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম!
নতুন মন্তব্য করুন