আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি। একটা দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছে একটা বছর। অনেক লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। অনেক টকশোর বকবকানি শুনেছি। শুনেছি পুলিশের আশাবাদ। ফল কিন্তু শূন্যই রয়ে গেছে। অভিজিৎদা হত্যার বিচার হবে কি হবে না, সে বিষয় নিয়ে লেখার উদ্দেশ্য নয়; সেটা বোধহয় সবাই অনুমান করতে পারছেন। আমি শুধু একবছর আগের সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে চাই।
অভিজিৎদার সাথে আমার পরিচয় গতবছর বইমেলাতেই। একদিন সন্ধ্যায় দেখি, শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে লম্বা চওড়া একটা লোক দাঁড়িয়ে। দেখেই চিনে ফেললাম। আমার ফেসবুকের বন্ধু। সেই সুবাদে টুকটাক মেসেজ চালাচালি হয়েছিল। তবে পরিচয় ছিল তাঁর বাবা অজয় রায়ের সাথে। তাঁদের বাসায় গেছি বেশ কয়েকবার ‘সতন্ত্র ভাবনা’ আর ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ বইদুটির পাণ্ডুলিপি নিয়ে। কারণ ওইসময় আমি বইদুটির প্রকাশক অঙ্কুর প্রকাশনীর সম্পাদনা বিভাগে কাজ করি। সেখানেই অভিজিৎদার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটা পেয়েছিলাম। বিজ্ঞান বলুন, দর্শন বলুন বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য দলিল। লোকটার প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধা তৈরি হয়ে যায়।
যতবার অজয় স্যারের বাড়ি গেছি পাণ্ডুলিপি নিয়ে, ততবার তাঁর সময় নষ্ট করেছি, পদার্থবিদ্যার হাল-হকিকত নিয়ে জানতে চেয়েছি। তিনি বিরক্ত হননি, কোথাকার কোন প্রকাশনীর দুটাকার কর্মচারির সাথে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নানা বিষয় আলোচনা করে গেছেন স্নেহশীল শিক্ষকের মতো। পুরো পরিবারের প্রতিই অন্যরকম এক ভালোবাসা জন্ম নেয় মনে।
যাইহোক, বইমেলায় অভিজিৎদাকে দেখেই এগিয়ে গেলাম পরিচিত হতে। ভেবেছিলাম চিনবেন না, ফেসবুকে কত লোকের সাথেই তো হাই হেলো হয়, কজনকে আর মনে থাকে। কিন্তু তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে গড়গড় করে ওই মেলায় প্রকাশতি আমার তিনটি বইয়ের নাম বলে গেলেন। সত্যিকারের বড় মানুষ বোধহয় এঁদেরই বলে!
এরপর প্রায়ই প্রতিদিনই তাঁর সাথে আমার দেখা হতো। বইমেলায় আমার আড্ড স্থল ‘ছায়াবীথি’। প্রকাশক আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমার আরেক বন্ধু তারেক অণুর দুটি বই প্রকাশ হয়েছে ওখান থেকেই। আমার নিজেরও একটা বই আছে ওখানে। সবমিলিয়ে জম্পেস আড্ডা জমত প্রতিদিন বিকেলে ছায়াবীথির সামনে। সেই আড্ডায় আমি আর অণুদা তো কমন, বিজ্ঞানকর্মীদের ভিড়ও ছিল। প্রতিদিন আমাদের আড্ডায় যোগ দিতেন ফারসীম স্যার ও ফারহানা ম্যাডাম। তবে আড্ডা ভালো জমত অভিজিৎদা এলে। তিনিও ততদিনে জেনে গেছেন বিজ্ঞানের পোলাপানরা ছায়াবীথির সামনে ভিড় করে। ছায়াবীথির পেছনেই শুদ্ধস্বরের স্টল। তাই সেখান থেকে ছায়াবীথিতে আসতে দুই পাও খরচ করতে হত না।১৮ তারিখ আমার আর ইমতিয়াজ ভাইয়ের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও করে দিলেন অভিদা।
আমাদের প্রতিদিনের আড্ডায় বিজ্ঞান নিয়ে কথা হত না বললেই চলে—ইয়ার্কি ঠাট্টা, একজন আরেকজনকে পচানো—এসব বিষয়ই প্রাধন্য পেত। ফারসীম স্যার একদিন বললেন, একদিন স্যতিক্যারের সিরিয়াস আড্ডা দেওয়া যাক। আড্ডা হবে শুধু বিজ্ঞা লেখকদের নিয়ে। সবাই রাজি। তিনি সেইদিন রাতে একটা গ্রুপ মেসেজ খুললেন। বেশ কয়েকজনকে অ্যাড করলেন। তাদের সবাই বিজ্ঞান লেখক এবকজন কি দুজন বোধহয় সাংবাদিক।
সবাই রাজি। ফারসীম স্যার প্রস্তাব করলেন, আড্ডা হবে বাংলা একাডেমির তৈরি করে দেওয়া ‘লেখক আড্ডা’ ছাউনিতে। এই প্রস্তাবটা আমার মনোঃপুত হলো না। ওদিকটা একটু নির্জন। তারচেয়ে ভালো ছায়াবিথীর সামনে হোক। এখানে জায়গাও অনেক, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাও আছে। তাছাড়া এমন একটা আড্ডা হলে একটু মিষ্টি মুখ করলে ভালো হয়। ছায়বীথির প্রকাশক জাহাঙ্গীর আলম সুজনকে বললাম সেকথা। তিনি নাস্তার স্পন্সর করতে রাজি হলেন।
আড্ডা শুরু হবার কথা ছিল সাড়ে ছটায়। কিন্তু তখনও অভিজিৎদা কিংবা ফারসীম স্যার কেউই আসেননি। তবে একদল ছেলে হাজির। ওদের বেশিরভাগই ‘জিরো টু ইনফিনিটির’ সাথে যুক্ত। আমি নিজেও একসময় এই বিজ্ঞান ম্যাগাজিনটার সাথে জড়িত ছিলাম। ওতে নিয়মিত লিখতাম। সুতরাং আমি না চিনলেও ওই ছেলেরা আমাকে চেনে। ওরা বলল বিজ্ঞান আড্ডার ওরা থাকবে। যেহেতু জিরো টু ইনফিনিটির সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ আছে ওদের সাথে, সে এই আড্ডারও অন্যতম উদ্যোক্তা, তাই আমার মনেই মাথায়ই আসেনি এটা বিজ্ঞান লেখকদের আড্ডা; সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। আর সেভাবে আমাদের কিছু জানানোও হয়নি। এসব ছেলেদের বেশিরভাগই ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখে। সুতারাং ওরাও লেখক।
ওরা জানাল, ওরা আরেকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। ‘বাংলাদেশ সায়েন্স সোসাসাইটি’ নামে আরেকটা বিজ্ঞান ক্লাব গঠিত হয়েছে সদ্য। সেটার ওযেবসাইট লঞ্চ উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেখান থেকে সরাসরি এখানে এসেছে। সাথে এনেছে প্রচুর নাস্তা। মাহমুদ বললেন, আমাদের আড্ডার জন্য আর নাস্তা কেনার দরকার হবে না।
সময় ঘনিয়ে গেছে। কিন্তু অভিজিৎদা কিংবা ফারসীম স্যার কারও পাত্তা নেই। বাধ্য হয়ে ফারসীম স্যারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, আরও কিছুক্ষণ দেরি হবে।
তারপর উনারা এলেন। কিন্তু যখন আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা, সে সময় দেখি শুদ্ধস্বরের সামনে জটলা। কোনও এক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। এদেকি সায়েন্স সোসাইটির অনুষ্ঠান শেষ করে আসা ছেলেরা আর থাকতে চাইল না। নানা অজুহাত দিয়ে কেটে পড়ার তালে। তখন মাহমুদের অনুরোধে সবাই মিলে বসে নাস্তা-টাস্তা করে ওরা চলে গেল। আমি অবশ্য ছবি তুলেছিলাম ওদের।
ছায়াবীথি থেকে পর্দা ধার করে মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছিলাম আড্ডার জন্য। সাড়ে সাতটার কাছাকাছি। অভিজিৎদাকে নিয়ে এসময় আড্ডা দেওয়া ঠিক হবে না মনে করে আমি পর্দা গুটিয়ে ছায়াবীথিকে ফেরৎ দিলাম।
তারপর যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছি। আমি আর হিমাংশু কর বসে আছি বাংলা একাডেমির মাচা্য়। তখন ঘড়ির কাঁটা সাতটা চল্লিশের ঘরে। ফারসীম স্যার এসে মাহমুদকে বললেন আড্ডা হবে। মাহমুদ বললেন, স্যার, ছেলেরা তো চলে গেছে। ফারসীম স্যার বললেন, গেছে তাতে কি? ওরা কে? ওদের জন্য আমাদের আড্ডা হবে না এটা আবার কেমন কথা।
আমি বললা, রাত হয়ে গেল, আজকে না হয় বাদ দিই।
স্যার বললেন, দাদা (অভিদা) হয়তো এই মেলায় আর আসবেন না। তাকে ছাড়া আড্ডা জমবে?
কথা মন্দ নয়। অগত্যা আবার পর্দা বিছিয়ে আড্ডা শুরু হলো। অভিদা এলেন। কিন্তু লোক বড় কম। ফারসীম স্যার বললেন যারা যারা এখানে আছেন সবাইকে ডেকে বসান। আমাদের সচলের ম্যাক্সদা ছিল, গ্রাম থেকে আসা আমার এক বড় ভাই ছিল, ওনাদের ডেকে বসালাম। বন্যা আপু একটু দূরে বসে ছিলেন। তিনি আড্ডায় যোগ দিতে চাইছিলেন না। আমি জোর করে তাকে বসালাম।
আড্ডা শুরু হলো, যথারীতি হাসি-ঠাট্টা হলো, বিজ্ঞানের কথাও হলো। অনেক সিরিয়াস কথাও হলো। আড্ডার আগে আসা ছেলেদের ভেতর একজনের উপস্থিতি নিয়ে আমার মেজাজ খারাপ হলো। গরল উগরে দিলাম মাহমুদের দিকে। ফারসীম স্যারও মেজাজ খারাপ করলেন তার ব্যাপারে।
৮ টার কিছু পরে আড্ডা ভাঙল। ম্যাক্সদা আমাকে অনুরোধ করলেন, অভিদার সাথে যেন তাঁর ছবি তুলে দিই। তখন কে জানত এই ছবিটাই হতে যাচ্ছে অভিদার জীবিত অবস্থার শেষ ছবি!
আমি আর মাহমুদ পর্দা ভাঁজ করায় ব্যস্ত। কয়েক মিনিট গেল তাতে। তারপর দেখি অভিদাও নেই, ফারসীম স্যারও চলে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মেলাও ভাঙল। আমি, সুজন ভাই, হিমাংশু মেলা থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে আড্ডার বিষয়ে অনেক গল্প করলাম। তারপর ফেরার পালা। পল্টনে এসেই হিমাংশুর ফোন, রনিভাই অভিদাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন ডেড।
আমরা তো হতভম্ভ! কিছুক্ষণ পর আবার হিমাংশুর ফোন। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, অভিদা আর নেই। মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে গেল। ছুটলাম মেডিকেলে। হিমাংশু রয়েছে। পরে রায়হান আবীর গেলেন। টুটুল ভাই ভাইয়ের অবস্থা দেখার মতো নয়।
কী করব কী করা উচিৎ কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সারারাত আমি আর হিমাংশু হাসাপাতালে কাটিয়ে দিলাম। একটু আগে আড্ডা দেওয়া লোকগুলোর কেউ একবারের জন্য এলো না। কেউ একবার ফোন করে জানতেও চাইল না। আমরা শুধু কপাল চাপড়ে সারারাত আফসোস করেছি। লাখটাকর গাছ খেল দুই টাকার ছাগলে!
মন্তব্য
সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যা অথবা রাত
..................................................................
#Banshibir.
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হ
ফারসীম লোকটার নাম শুনেই বিরক্ত লাগলো।
সাবধানে থাকুন আপনি। আর কিছুই বলার নেই।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
সোহেল ইমাম
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন