নব্বই দশকের মাঝামাঝির দিকে বাংলা সফট-রক ব্যান্ড 'ফিডব্যাক' তাদের এপিক লোকগীতি ভিত্তিক ফিউশন এ্যালবাম 'বাউলিয়ানা' প্রকাশ করেছিলো যা কিনা দেশি তরুণদের গানের স্বাদে আমূল পরিবর্তন করেছিলো; এমনকি পরবর্তীতে বাংলা ব্যান্ডের ধারাকে ঘুড়িয়ে দিয়েছিলো। সাত বছর গবেষণার পরে ফিডব্যাক সেই এ্যালবাম প্রকাশ করেছিলো যা কিনা ছিলো মূলত লালনের গানের ফিউশন। তবে লালনের গানের সুর একটু গম্ভীর এবং কথা একটু বেশি আধ্যাত্মিক হবার কারণে ফিডব্যাক এই এ্যালবাম প্রকাশের ব্যাপারে একটু সংশয়ে ছিলো এই নিয়ে যে ব্যান্ডের গানের শ্রোতারা এই বিশাল পরিবর্তন কতটুকু সহজে গ্রহণ করতে পারবে।
আর তাই এই এ্যালবামের (বাউলিয়ানার) টেস্ট কেস হিসাবে আগে অন্য একটি এ্যালবাম প্রকাশ করেছিলো যা কিনা ছিলো ফিডব্যাক ও আব্দুর রহমান বয়াতির যৌথ প্রয়াস। এই এ্যালবামে একটাই গান ছিলো, ক্যাসেটের ১২টা ট্র্যাকে একটাই গান - 'মন আমার দেহ ঘড়ি' নামে। এটাই বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম রক-লোকগীতি ফিউশন। ফিউশন করা গানটা ছিলো অনেক লাইভলি এবং আপ-বিট, যা কিনা লালনের গানের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি ব্যান্ডের গানের কাছাকাছি ছিলো। ফলে দেশের তরুণরা গানটা গ্রহণ করেছিলো - এ্যালবামটা ছিলো সুপার হিট (আমি নিজেও এ্যালবামটা প্রকাশের ১ মাস আগে থেকে গানের দোকানে ঘোরাঘুরি করেছি এবং এ্যালবামটা প্রকাশের দিনই কিনেছি)। পরবর্তী কয়েক বৎসর ফিডব্যাকের কনসার্টে এই গানটা গাওয়া ছিলো মাস্ট। এমনকি এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে।
সেই হিসাবে দলছুট, বাংলা, লালন, জলের গান, চিরকুট সহ আজকে যে বাংলা ব্যান্ডগুলো লোকগীতি ভিত্তিক ফিউশন গান গেয়ে শহুরে ছেলেপুলের কাছে লোকগীতিকে তুলে ধরেছে তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলো ফিডব্যাক আর আব্দুর রহমান বয়াতি। এই ধারাতেই দলছুট গেয়েছিলো 'গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে' যা কিনা শুধু বাংলা ব্যান্ড সংগীতকেই নতুন উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলো তা নয়, বরং শহুরে প্রজন্মকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা আরেক লোকগীতির সম্রাট বাউল করিমের গান শোনার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিলো। লালনের গান নিয়ে ফিডব্যাকের বাউলিয়ানা, বা বাংলার আনুশেহর বা লালন ব্যান্ডের সুমির গান আমাদের অনেককেই নতুন করে লোকগীতির দিকে ফিরে তাকানোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো। আর এর শুরুটা হয়েছিলো 'মন আমার দেহ ঘড়ি' দিয়েই।
আর তাই তার মহাপ্রয়াণে আজকে আমি শোকাহত। পরিণত বয়সে মৃত্যু, তাই আক্ষেপ কম। যদিও চিকিৎসা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে অনেকের মনেই। তবে গরীব দেশ আর কতটুকুই বা করতে পারত। যাই হোক, তার অবদানকে আমি শ্রদ্ধা ভড়ে স্মরণ করছি, নাগরিক এই আমাদের লোকগীতির জগতের সন্ধান দেবার জন্য। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে এই আমরা হয়তো তার সন্ধান করতে পারিনি ঠিক মত, তিনি কিন্তু ঠিকই আমাদের সন্ধান করেছিলেন। আর তাই আমাদের কাছে তার সংগীতের ডালি নিয়ে এসেছিলেন। আর সাথে ঘড়ি মেকারের সন্ধান করা চলছিলোই। আশা করি যে না ফেরার দেশে তিনি এখন ঘড়ির মেকারকে খুঁজে পেয়েছেন, এবং মেকারও তাকে সাদরে আলিঙ্গন করেছে।
সবশেষে ফিডব্যাক ও আব্দুর রহমান বয়াতী গানের ভিডিও লিন্ক এখানে এম্বেড করে দিলামঃ
এম্বেড করা লিন্ক কাজ না করলে নীচের লিন্কে গিয়ে সরাসরি দেখে নিতে পারেনঃ
গানটি শুনতে পারবেন এবং ডাউনলোড করতে পারবেন এখানেঃ
উল্লেখ্য যে এটি লিগ্যাল কপি, মাকসুদ ভাই নিজেই তার ভক্তদের মাঝে বিতরন করেছিলেন।
মন্তব্য
অনেক ধন্যবাদ। পুরোনো সব স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন।
"মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করে" প্রথম শুনেছিলাম ১৯৭৭ সালে একটি অনুষ্ঠানে পিলু মমতাজ এর কন্ঠে। শুনে আমি সহ দর্শকদের অধিকাংশই চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়িয়েছিলাম প্রচন্ড উত্তেজনায়। তখন অবশ্য জানতাম না এটা আব্দুর রহমান বয়াতির গান।
আব্দুল্লাহ এ এম
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
লোকজ গানগুলিকে প্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে ফিডব্যাক আর মাকসুদ।ফিডব্যাকের সেই সাহসী উদ্যেগের কারনে আজকে বাউলিয়ানা গানের সাথে নতুন প্রজন্ম পরিচিত।অথচ যারা বিভিন্ন সেমিনারে ব্যান্ড সংগীতকে নাক সিটকিয়ে কথা বলেছে,এখনো বলে বাউল গানের প্রচার আর প্রসারের জন্যে তাদের অবদান শূন্য।বেচে থাকুক বাউলগান,বেচে থাকুক লোকজ গান।
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন