চৈত্রসংক্রান্তি, চৈত্র মাসের শেষদিনটির গোধূলী লগ্নে ধূলো উড়িয়ে ঘরে ফেরা রাখাল কি জানে একটু পরেই লাল সূর্যটা ডুবে গিয়ে যে নতুন দিনের আগমনী বার্তা জানাবে সেই নতুন দিনের আগমন ইতিহাস!
গাঁয়ের মহাজন কি জানে তাঁর খাজাঞ্চি বগলের নিচে যে লাল মলাটের স্বাস্থ্যবান খাতাটি নিয়ে ঘুরে তার হিসাব বন্ধের পিছনে 'হালখাতা' নামক শব্দটির ইতিহাস!
গঞ্জের পাইকারী ব্যবসায়ী কি জানে, তাঁর সকল ক্রেতার কাছ থেকে পুরনো বছরের হিসাব বুঝে নিয়ে যে মুফতে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিলো তার পেছনের ঘটনা!
কিংবা ওইযে হালের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে অভ্যস্ত যে ছাত্রটি গায়ে দামী রঙ-চঙা পাঞ্জাবী চড়িয়ে সাতসকালে রমনার বটমূলে গিয়ে হেরে গলায় "এসো হে বৈশাখ, এসো এসো" গানে তাল মেলাচ্ছে সে কি জানে এই গানটির পেছনের ইতিহাস!
আমি নিশ্চিত না হয়েও বলতে পারি, উল্লেখিত জনের মতো অনেকেই জানে না বৈশাখের ইতিহাস, বৈশাখের ঐতিহ্য, বৈশাখের আবেদন একজন বাঙালীর জীবনে কতটুকু।
বৈশাখ বাঙালীর জীবনে এমনি এমনি আসেনি। এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার চেষ্টা করেছে বৈশাখের ঐতিহ্যকে রুখে দিতে, তার ইতিহাসকে ধ্বংস করতে, প্রচার করেছে "হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি" বলে। কিন্ত ইতিহাস বলে, যার হাত দিয়ে বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন হয়েছে তিনি কেবল মুসলমানই ছিলেন না বরং সারা মুসলিম বিশ্বে একজন নামকরা, উদারপন্থি শাসক হিসেবে আজও পরিচিত। সেই জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের শাসনভার গ্রহনের আগে মুঘল আমলের পুরোটা সময় ধরেই কৃষিখাজনা আদায় হতো হিজরী সনের হিসাবে।
হিজরী সন নির্ধারিত হয় চাঁদের হিসাব অনুযায়ী, কিন্ত উপমহাদেশের সারা বছরের কৃষিকাজ চাঁদের সাথে অতোটা সম্পর্কায়িত নয়, যে কারণে কৃষকেরা তখন খাজনা প্রদানে নানা প্রতিকূলতার সন্মুখীন হতো। যথাসময়ে যথাযোগ্য খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়ে তখন সম্রাট আকবর তাঁর সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফাতেউল্লাহ্ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী চন্দ্রাব্দ এবং বাংলা পঞ্জিকার সমণ্বয়ে "বাংলা বছর"-এর প্রচলন করেন, যা "ফসলী সন" নামে ১৫৮৪ এর মার্চ মাসে প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিনটি থেকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়।
সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলা নতুন বছরাগমনের অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিনটির উৎসবমূখর উদযাপন হয়ে আসছে। বছরের শেষদিন, চৈত্রসংক্রান্তির সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দেবার আগেই পুরাতন অর্থবছরের সকল হিসাব চুকিয়ে ফেলার নিয়ম। বছরের প্রথম দিন মহাজন, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতা বন্ধুদের নিমন্ত্রন করে মিস্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়ীক লেনদেনের পুনঃসূচনা করতেন "হালখাতা" বা হিসাবের নতুন খাতা খোলে। হালখাতার লুপ্তপ্রায় এই ধারাটা সোনা-ব্যবসায়ীরা আজও ধরে রেখেছে।
সম্রাট আকবরের আমলে সর্বভারতে খাজনা আদায়ের নতুন বছরের সূচনা হলেও, পুরনো দিনের সকল হিসাব পেছনে ফেলে আনন্দের নতুন বছরে পদার্পন বাঙালীদের মাঝে ঐতিহ্য হিসেবে টিকে গেছে 'পহেলা বৈশাখ' হিসেবে। সবচেয়ে বর্ণাঢ্য বৈশাখ উদযাপন হয় ঢাকা শহরকে ঘিরে। বছরের প্রথম সূর্যের আলোকে বরণ করে নিতে দলে দলে লোক সমবেত হয় রমনার বটবৃক্ষের তলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, যা সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে। পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলেদের পাশে খোঁপায় বেলী ফুলের মালায় সজ্জ্বিত হয়ে, লাল পেড়ে সাদা শাড়ীর তরুণীরা মেতে ওঠে "ইলিশ-পান্তা" উৎসবে।
গ্রামাঞ্চলও কোনদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই "পহেলা বৈশাখ" উদযাপনে। জায়গায় জায়গায় বসে মেলা হরেক রকম জিনিষের পসরা সাজিয়ে। বাড়ি বাড়ি বিলানো হয় ঘরে তৈরী মিষ্টি, নতুন চালের পায়েস ইত্যাদি।
আর সবকিছু ছাপিয়ে এ প্রজন্মের একজন বাঙালীকে বৈশাখ যা শেখায় তা হলো সংগ্রাম করার সংকল্প। বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই "ছায়ানট" ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই "পহেলা বৈশাখ" বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপ ধারণ করে। ১৯৭২ সালে (বাংলা ১৩৭৯ সন) 'পহেলা বৈশাখ' বাংলাদেশের জাতীয় পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১এ ফেব্রুয়ারীর মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছে বৈশাখের উদযাপন। সেই সূত্র ধরেই ২০০১ (বাংলা ১৪০৮ সন) সালের বোমা-গ্রেনেড হামলা।
কিন্ত অজেয় বাঙালীর সামনে মাথা তুলে কোনদিনই দাঁড়াতে পারেনি কোন সাম্প্রদায়িক শক্তি। পহেলা বৈশাখের আবেদনও শেষ হয়ে যায়নি শত বাঁধার মুখেও। ঢাকার রমনা কিংবা গাঁয়ের সবচেয়ে প্রাচীন বটগাছটির গন্ডি পেরিয়ে বৈশাখ আজ পালিত হয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শহরে যেখানে ন্যূনতম সংখ্যক বাঙালীও বিদ্যমান।
এইতো আমাদের বাঙালী ঐতিহ্য, এইতো আমাদের বৈশাখের ঐতিহ্য, যেকোনো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, সহস্র প্রতিকূলতা ছাড়িয়ে, রাস্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার মাঝেও আমাদেরকে মাতিয়ে তোলে বর্ষবরণ উদযাপনে।
শুভ নববর্ষ
***********************************
এখানে আংশিক পরিবর্তিত।
হাজারদুয়ারীর এপ্রিল ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত
***********************************
মন্তব্য
অনেক কিছু জানতে পারলাম যা জানা ছিলো না। ধন্যবাদ
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
ধন্যবাদ আপনাকেও সঙ্গে সুন্দর কিছু নাম না জানা ফুলের বৈশাখী শুভেচ্ছা।
সুন্দর ও দরকারি একটি লেখার জন্যে ধন্যবাদ।
একটি তথ্য বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ আছে। এ কথা ঠিক যে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই রবীন্দ্রচর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়, এমনকি থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয় বিভিন্নভাবে। ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় স্বতস্ফুর্ত রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ছিলো তার বিরুদ্ধে একটি বিশাল প্রতিবাদ। নববর্ষে রমনার বটমূলে ছায়ানট-এর অনুষ্ঠানও সেই ধারায় শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যতোদূর মনে পড়ে, প্রচার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা ১৯৬৭ সালের।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ধন্যবাদ জুবায়ের ভাই।
ছায়ানট যখন প্রথম বৈশাখ উদযাপন করে সেই সালটা ছিলো ইংরেজী ১৯৬৫। বাংলাপেডিয়া মতেঃ The historical importance of Pahela Baishakh in the Bangladesh context may be dated from the observance of the day by Chhayanat in 1965. In an attempt to suppress Bengali culture, the Pakistan Government had banned tagore songs.
এই নিষেধাজ্ঞার প্রতি বৃদ্ধাঙুলি দেখাতেই ছায়ানটের সেদিনের আয়োজন ছিলো। ১৯৬৭ সালে হয়তো সেই নিষেধাজ্ঞাটা আনুষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিলো (আমি আসলেই জানি না) ভিনদেশী হায়েনাদের দ্বারা।
অনেকদিন পরে রুমান সাহেবের লেখা পেলাম।
শুভ নববর্ষ।
- হ, ইয়া হাবিবি কিধারছে জানি ঘুরতা হ্যায়?
শুভ নববর্ষ
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
স্যরি রুমন হবে।
রুমান না ।
ভালো লাগল পড়ে। শুভ নববর্ষ আপনাকেও।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
বেশ তথবহুল লেখা।
..শুভ নববর্ষ ১৪১৫।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
অনেক কিছু জানলাম।
(বিপ্লব)
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
শুভ নববর্ষ!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
সকল সচলকে বৈশাখের শুভেচ্ছা
শুভ নববর্ষ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
শুভ নববর্ষ
****************
নতুন মন্তব্য করুন