মুক্তি, মুক্ত চিন্তায়

আসাদুজ্জামান রুমন এর ছবি
লিখেছেন আসাদুজ্জামান রুমন (তারিখ: সোম, ২৩/০৭/২০০৭ - ৬:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রবার্ট মাইলসের ফ্রীডম শুনে মনেহয়, আসলেই আমাদের ডেস্টিনি কি! সবার জন্য মুক্তি নাকি সবার কাঁধে পা রেখে নিজের একটু ভালো থাকা নিশ্চিত করা, সকল প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে একটু একটু করে মুক্ত করা। নিজের মুক্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে অন্যদের দুর্ভাগ্যের কারেন্ট জালে জড়িয়ে ফেলা।

ফিরিঙ্গি বণিকদের কাছে বাংলার হৃত সাম্রাজ্য উদ্ধার এবং মুক্ত আকাশের নীচে এক টুকরো মুক্ত জমির জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাদের দুশো চৌদ্দটি বছর। অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের রবার্ট ব্রুসের জন্য। যে এসে বাংলার ইতিহাসের সবচাইতে দীর্ঘ অমানিশা থেকে ভোরের আলো দেখিয়েছে, লাল টকটকে একটা সূর্য্য উপহার দিয়েছে বাঙালীদের। মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছে মুক্তিকামী কোটি বাঙালীকে। দুশো চৌদ্দ বছর আগের বিশাল মানচিত্রের বদলে অতি খর্বাকায় ব-আকৃতির এক নতুন ভূমির জন্ম নিলো। হোক খর্বাকার, তবুও তো মুক্ত একটা ভূমি, মুক্ত বাতাসে নাক ডুবিয়ে মুক্ত জমিতে গড়াগড়ি করার পিতামহ-প্রপিতামহ-প্রপ্রপিতামহের অপূর্ণ বাসনা পূরণ হলো উত্তর প্রজন্মের দ্বারা।

একটা মানচিত্রের সঙ্গে জন্ম নিলো একটা পতাকা, একটা সঙ্গীত। কথা ছিলো কোন সীমাবদ্ধতা ছাড়াই পতাকা, সঙ্গীত এবং মানচিত্রের সুফল পাবে মানুষ। বস্তুত ঘটলো ভিন্ন কিছু। ৩৬টি জন্মদিবসের পরও স্থায়ীত্ব আসেনি কোন ক্ষেত্রেই। পরিশেষে সর্ব-সাধনার ধন 'গণতন্ত্র' টিকিয়ে রাখতে অবলম্বন করতে হয় 'অগণতান্ত্রিক ফর্মূলা'। গ্রেফতার হয় আহমেদ নূর রা। আটকাদেশ দেওয়া হয় জাতীর পিতার তনয়াকে।

এক গুমোট পরিস্থিতি সর্বত্র। স্বাধীন দেশ পেয়েছি আমরা কিন্তু 'মুক্তি' জিনিষটা এখনো শব্দকোষের পাতা থেকে বের হয়ে আমজনতার সামনের গুমোট পরিবেশ দূর করতে পারেনি। কবে পারবে সে দূর অস্ত। আদৌ পারবে কিনা, আদৌ মুক্তি আমাদের মিলবে কিনা সে সময়ই বলে দেবে। আমরা কেবল আশা করতে পারি। উই পিপোল ক্যান অনলি হোপ, এ হোপ ফর দ্য বেস্ট!

আমরা আধুনিক হয়েছি। সাউথ এশিয়ান হয়েও আমরা পাশ্চাত্যের সঙ্গে পাল্লা দিই। আমাদের পেটে দানা আর লজ্জা নিবারিত না হলেও চুলে স্টাইল করে জেল লাগতে ভুলি না। লাখ লাখ লোক আগুন রোদে রিক্সা নামক অ-যান্ত্রিক যানবাহন টানলেও আমাদের লেটেস্ট মডেলের পোর্শে হাঁকানো থেমে থাকে না। যে রাস্তায় টুপটুপ করে একজন লোয়ার ক্লাস সিটিজেনের ঘাম ঝড়ে সেই একই রাস্তায় RAV-4 ফোর ডব্লিউ ডি-র মোটা মোটা টায়ার গড়গড়িয়ে চলে যায়। আমরা ইংরেজী উচ্চারণে ভাঙা বাংলায় কথা বলতে 'এট হোম ফিল' করি। আমরা জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলার কথা তুলি।

আমরা মুসলিম, কাজে না হোক নামে তো অন্তত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কিনা হবে একজন 'মালাউনের' বানানো! কখনোই না। আর এটা কেমন জাতীয় সঙ্গীত হলো। না আছে সৃষ্টিকর্তার কথা না আছে নবী-রাসূলগণের কথা না আছে পোর্চেতে দাঁড় করানো ফেরারীর মালিক মানুষের কথা। দেশের সবুজ ফসলী ভূমির, ঝলমলে বাতাসী প্রান্তর, আর দেশের প্রতিটা বর্গইঞ্চি পরিমান জায়গার হৃদয় ছোঁয়া বর্ণনা থাকলেই তো আর জাতীয় সঙ্গীত হয় না! জাতীয় সঙ্গীতের তালে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট জানানোর সময় সবুজ জমিনে লাল রক্তের দাগ দেখে চোখ ভিজে উঠলে কিংবা ভেতরে ভেতরে দেশের প্রেমে পড়ে গেলে সেটা অন্যায়! দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকুক বা না থাকুক জাতীয় সঙ্গীতের বিবর্তনে সচেষ্ট ভূমিকা থাকা চাই!- এই অসুস্থ বোধের খপ্পর থেকে মুক্তি মিলুক আমাদের। রবি ঠাকুর হিন্দু, নজরুল ইসলাম হিন্দুয়ানী, অমুক ওপার বাংলার, তমুক মস্কো-পিকিং পন্থি- এসব সাম্প্রদায়িক ইস্যু গুলো সামনে টেনে এনে বিশেষ মহলের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থায়নের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পাক বাংলার জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা আর মানচিত্র। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক কিংবা ইসলামী রিপাবলিক বানানোর বিবেচনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অসাম্প্রদায়িক পরিচয়কেই শ্রদ্ধা জানানো হোক।

মাথার ওপর মূল্য নির্ধারিত 'মুরতাদ'র চাইতে মুক্ত মাটির বিরোধীদের ঘৃণিত করা হোক। 'মুরতাদ'রা নিজের দেশে ফিরতে না পারলে দেশের বিরোধীরা কেন দেশে থাকবে! দেশের বিরোধী হয়েও যদি নির্ভয়ে পথ চলতে পারা যায় তাহলে নিজের দেশের মাটিতে অন্য যে কারো তার চেয়ে বেশি অধিকার থাকা উচিৎ। সংস্কারপন্ন হলেই কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। মুক্তির জন্য চাই শিক্ষা। সে শিক্ষা, যে শিক্ষা মূল্যবোধ জাগাবে, ভালোবাসতে শেখাবে নিজের দেশের প্রতি, তার মানুষের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি, তার প্রতি বর্গ মিলিমিটার জায়গার মাটির প্রতি।

চোখ বুজলেই ধপ করে নাকে এসে লাগবে চেনা-অচেনা ফুলের ঘ্রাণ, গৃহস্থের বাড়ির দাওয়া থেকে রোয়া ধানের ধোঁয়া ওঠা ভাতের গন্ধ। চিকিৎসার অভাবে অবহেলায় টুক করে মরে যাওয়া কোন দূর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার খবর তিন লাইনে শেষ হবে না কোন নামী সংবাদপত্রের চতুর্থ পাতায়। সিগনালে আটকে যাওয়া ফুলঅটোমেটিক SAAB- এর ধারে কাছে ঘুরঘুর করবে না টোকাইয়ের দল।

শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে মুক্তি- মীনা কার্টুন প্রমোট করে আমাদের সরকারী নন-সরকারী সংস্থা, কিন্তু এর 'থিইম সং' থেকে কেবল একটা লাইন আমাদের এনে দিতে পারেনা কেউ। আমাদের মুক্তি মেলেনা, আমরা দাসত্ব প্রথার যুগ পেরিয়ে এসেও আধুনিক দাসে পরিণত হচ্ছি একে একে, দিনের পর দিন।

--------

লেখাটি হাজারদুয়ারীতে প্রকাশিত।


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

প্রত্থম লেখায় ফাটাইয়া ফালাইছে রে

আপনাকে স্বাগতম আসাদুজ্জামান রুমন। আঁকিবুঁকি শেষে আপনার স্বনাম যাত্রা সফল হোক।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আর নানা স্বাদের লেখার দাবী তুলছি।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

আসাদুজ্জামান রুমন এর ছবি

সবিনয় ধন্যবাদ জনাব।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

রুমন সাহেব, আপনার লেখার ফ্যান হয়ে গেলাম। চমৎকার লিখেছেন। নিয়মিত লিখুন। আপাতত এ লেখাটির জন্য আপনাকে জাঝা
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সালাম নিন রুমন সাহেব ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তারেক এর ছবি

অসাধারণ! বাংলা হোক ধর্মের স্বার্থপরতামুক্ত।

Imagine there's no heaven It's easy if you try. No hell below us Above us only sky.

কিছু কাপুরুষের হাতে মুক্তি সঁপে দেব? কেন? আমরা কেন হারব? না, হারব না!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অমিত এর ছবি

অসাধারণ।
_____ ____________________
suspended animation...

ফারুক হাসান এর ছবি

এই রকম আরো চাই। আরো

-----------------------
জানেনিতো, ইহা নিতান্তই নিজস্ব মতামত

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ঠিকাছে। দেখা হইলে দিমুনে কিছু....
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

জটিল জটিল! ভাই কোথায় ছিলেন এতদিন?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হিমু এর ছবি
দিগন্ত এর ছবি

মুক্ত-মন ব্যাপারটা আসলে একদিনে আসে না। ধীরে ধীরে আসে ... ঘটনা হল, একদিক থেকে মুক্ত হয়ে আমরা অন্য কিছুতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। তাহলে মুক্ত-চিন্তা ব্যাপারটা কিভাবে আসতে পারে?


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আপাতত সাদা চোখে 'মুক্তি' ব্যাপারটাকে ডেফাইন করার শুরুটা করা যেতে পারে। এটা অনেকটা মৌলিক চাহিদাগুলোর মতো, আগে শুরুটা হোক, তারপর তাতে মাঁস লাগানো যাবে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।