১৮৯১ সালে জন রাড্ রেইনি নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির মাসিক পত্রিকায় সুন্দরবন নিয়ে একটা প্রবন্ধ ছেপেছিলেন (https://doi.org/10.2307/1800883)। সুন্দরবনের ভূ-প্রকৃতি, জীবজন্তু, পরিত্যক্ত দালানকোঠা, স্থানীয় লোকজনের পেশা, কেচ্ছাকাহিনী-- সবকিছু নিয়ে মোটামুটি সুখপাঠ্য লেখা। স্থানীয় ভাষা-সংস্কৃতিতে তার বেশ দখল, স্থান বা মানুষের নামের ইংরেজি করেছেন বেশ অবিকৃত ভাবে, ডেক্কা-মেক্কা-জাতীয়-ফাজলামি নাই বললেই চলে।
লেখার শেষে গিয়ে দেখি জন রেইনি কিছুটা ঊষ্মা প্রকাশ করছেন ১৯৬৫ সালের ফরেস্ট অ্যাক্ট-এর নামে সুন্দরবনের 'সংরক্ষিত বনাঞ্চল" স্ট্যাটাস-এর ব্যাপারে। তার মতে প্রাচীনকালে এখানে জঙ্গল-টঙ্গল ছিল না, লোকজন বেশ চাষবাষ করে বেড়াত, কোন এক সময়ে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপে পড়ে মানুষ অত্র এলাকা ছেড়ে চলে যায়, আর সেখানে গজিয়ে ওঠে সুন্দরবন। কিন্তু বনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে অতি-উর্বর জমি, যাতে ধানচাষ করার জন্য বৃষ্টির আশায় বসে থাকারও দরকার হয় না। জন রেইনি'র মতে সুন্দরবন সাফা করে দিয়ে তাতে ধানচাষ করে পুরো ভারতবর্ষের দুর্ভিক্ষ-সমস্যার সমাধান করে ফেলা সম্ভব। এ পর্যায়ে এসে তিনি রেফারেন্স টানলেন ১৮৭৪-এ ক্যালকাটা রিভিউ-তে এ নিয়ে লেখা আরেক প্রবন্ধের-- লেখকের নাম এইচ জেম্স রেইনি।
ভারতের দুর্ভিক্ষ নিরসনে রেইনি পরিবারের উৎকন্ঠা দেখে কৌতূহল হলো। ব্রিটিশ পাব্লিক রেকর্ড সাঙ্ঘাতিক জিনিস-- কিছুটা খুঁজতেই বেরিয়ে এল যে এইচ জেম্স রেইনি আমাদের জন রাড্ রেইনির অগ্রজ (এইচ্ জেম্স কলকাতা নিয়ে লেখা একটা বই ভাইয়ের নামে উৎসর্গ করেন, তাতে ধরে নেওয়া যায় তাদের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক ছিল।)। পলাশীর যুদ্ধের পর পর তাদের পিতামহ জেম্স রেইনি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড থেকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা আসেন। ১৮০৯ সালে কলকাতায় তাদের পিতা উইলিয়াম হেনরি স্নেইড রেইনি'র জন্ম হয়, যিনি খুলনা অঞ্চলে জায়গা-জমি নিয়ে থিতু হন। খুলনা জুড়ে তার বেশ ক'টি চিনির কল ও নীলকুঠি ছিল। এই নীলকর রেইনি সাহেবকে নিয়ে বেশ মজার তথ্য পাওয়া যায় সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) বইতে। রেইনি সাহেব বেশ অত্যাচারী ছিলেন, লোকজনকে রাস্তাঘাট থেকে ধরে এনে কাজে লাগিয়ে দিতেন বলে শোনা যায়। সে থেকে একটা প্রবাদ-বাক্যও চালু হয়ে যায়-- "শ্বশুরবাড়ি যাইবার পথে রেণী সাহেবের খড় কাটা"। তার অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়ালে (আর কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব দেখা দিলে) স্থানীয় জমিদার শিবনাথ ঘোষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। দুই পক্ষের লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত লাঠালাঠি চলতে থাকে। শিবনাথের লাঠিয়াল সাদেক মোল্যা রেইনির সাঙ্গো-পাঙ্গোদের পিটিয়ে নামধাম করে ফেলেন।
"গুলিগোল্যা সাদেক মোল্যা রেণীর দর্প করল চুর
বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা, ধন্য বাঙ্গালা, বাঙ্গালী বাহাদুর"
এই লাঠালাঠি, মামলা মোকদ্দমা সামাল দেবার জন্য কোম্পানি সরকারকে খুলনাকে মহকুমা ঘোষণা করে থানা বসাতে হয়। কিন্তু তাতে কাইজা থেমে থাকে না, বরং শিবনাথ রেইনি'র মালবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে, নীলগাছ কেটে নিয়ে তার নীল ব্যবসায় লালবাতি জ্বালিয়ে দেন।
তো এসবের মধ্যেই এইচ্ জেম্স ও জন রাড্ রেইনি-- দু'ভাইয়ের জন্ম। ১৮৫৫ সালে তাদের পিতা গত হলে বাপের জমিদারি এ দু'ভাইয়ের হস্তগত হয়।
আমার ভুল হতে পারে-- হয়ত রেইনি ভায়েরা সত্যিই মানবদরদি ছিলেন, ভারতের ভুখা-নাঙ্গা মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্যই সুন্দরবন আবাদ করে ধানী জমি বানিয়ে ফেলার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে এত গোলগোল বাক্যব্যয়ের পেছনের উদ্দেশ্যটা ছিল বৈষয়িক।
তবে সুন্দরবন আবাদ করার বুদ্ধিটা রেইনি'দের মাথায় প্রথম এসেছিল তা নয়। ১৮৪৯-এ মোরেল পরিবার (যাদের নাম থেকে মোড়েলগঞ্জ, খুব সম্ভবত মোড়ল শব্দটাও) প্রথম সুন্দরবনের একাংশ ইজারা নিয়ে ধান ও নীল চাষ করে ফুলে ফেঁপে ওঠেন। কিন্তু ১৮৬১-এর কৃষক বিদ্রোহের জের ধরে তাদের অত্যাচার-অনাচারের খবর জানাজানি হয়ে পড়লে (এবং ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রের অনমনীয়তায়) ১৮৭৮-এ তাদেরও এ অঞ্চল থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয়।
যাই হোক, রেইনিদের পরবর্তীতে কী হয়েছিল জানিনা। খুলনা অঞ্চলের কেউ যদি আরও কিছু জেনে থাকেন এদের ব্যাপারে,শোনার আগ্রহ রইলো।
মন্তব্য
নামটা মোড়েলগঞ্জ না, মোরেলগঞ্জ। আর মোড়ল এসেছে 'মণ্ডল' (headman) থেকে।
ধন্যবাদ! সরকারি ওয়েবসাইটে মোরেলগঞ্জ-ই লেখা। আমি বাংলাপিডিয়াতে মোড়েলগঞ্জ দেখলাম।
রেনি: "এত এত খাবারের অভাব চারিদিকে! নৌকায় আসার সময় দেখলাম, বনের কুমিরও মানুষের কষ্টে কাঁদছে।"
সেখান থেকে "কুম্ভিরাশ্রু" বাগধারার উৎপত্তি।
(উৎস: বানিয়ে বললাম, এরকম কিছুর ঐতিহাসিক রেকর্ড নাই। তবে, রেনি সাহেবের উপচে পড়া দরদ "কুম্ভিরাশ্রু" র সাথে তুলনীয় হতে পারে)
রেইনি সাহেবের বইটা পড়ার আগ্রহ জাগলো। সুন্দরবন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা বিষয়ে কিছু জানা নেই। কিন্তু সুন্দরবনের একাংশে মানববসতি ছিল সেটা ঠিক। সেই মানববসতি উঠে যাবার কারণ হিসেবে মগ ফিরিঙ্গী জলদস্যুদের দায়ী করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস চিরকালই এই অঞ্চলের সঙ্গী ছিল। সেটা নিয়েই মানববসতি ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতকের পর থেকে ওই অঞ্চলে জলদস্যুতের উৎপাত শুরু হয়। ফলে সেই কারণটাকেই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন