বছর ঘুরে আবারো আসছে বি-স্ক্যানের জন্মলগ্নের সেই দিনটি। ১৭ই জুলাই। সকলের ভালোবাসা-অনুপ্রেরণায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে বি-স্ক্যান এগিয়ে চলেছে তৃতীয় বর্ষপূর্তীর দিকে। প্রতিবারের মতোন এবারও বি-স্ক্যান এই দিনটি উদযাপনের মাধ্যমে সর্বত্র সচেতনতার বীজ বপন করতে চায়। এবার ঠিক হয়েছে প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্যে পারিবারিক এবং সামাজিক সকল প্রতিবন্ধকতা দূরীকরনে নতুন প্রজন্মের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বি-স্ক্যান এর তৃতীয় বর্ষপূর্তী উপলক্ষ্যে আগামী জুলাই’১২ এর দ্বিতীয় সপ্তাহে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে দু’দিন ব্যাপী বিতর্ক প্রতিযোগীতা’র আয়োজন করা হবে।
“জাগো হে নবীন, ভিন্নভাবে সক্ষমদের জন্যে চাই সমাজ প্রতিবন্ধকতাহীন” স্লোগানকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই বিতর্ক প্রতিযোগীতার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের নবীনদের মাঝে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে জাগরণ সৃষ্টি করতে চাই আমরা। যেহেতু অদূর ভবিষ্যতে এই সব তরুণেরাই এক একজন লেখক, শিল্পী, স্থপতি, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ হয়ে ভূমিকা রাখবে দেশের মজবুত ভিত্তি গঠনে। যাদের নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের জন্যে বসবাসযোগ্য আগামীর বাংলাদেশের।
বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথাঃ
উন্নত বিশ্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেখানে অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোগ করছে সমান অধিকার, সেখানে আমাদের দেশের কঠিন বাস্তবতা এই যে, সর্বত্রই তারা বৈষম্যের শিকার। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র -- কারোরই যেন সময় নেই তাদের কথা ভাবার। নতুবা স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও নিজের দেশে তাদের লড়াই করতে হতো না নিজেদেরই অস্তিত্ব প্রমাণে! আর দশজন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের যা নাগরিক অধিকার অথচ এই দেশেরই নাগরিক প্রতিবন্ধী মানুষেরা তা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত প্রতিনিয়ত। দুঃখজনক হলেও সত্য এদেশে আজ পর্যন্ত তাদের সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয় নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( World Health Organization - WHO) ও বিশ্ব ব্যাংক (World Bank) এর ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে করা এক জরীপে আমরা জানতে পারি, বিশ্বে মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন ১০০ কোটি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ। ঠিক এভাবেই প্রতিটি দেশের জনগোষ্ঠীর ১৫ ভাগ ধরলে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান হয় ২ কোটি ৪০ লক্ষ।
এদিকে ১৮ই এপ্রিল”২০১০ এ জাতীয় দৈনিক সমকালের একটি নিবন্ধে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত উল্লেখ করেন মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের দেশের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৫ কোটি ২০ লক্ষতে। তার তৎকালীন গবেষণা মতে,
* প্রতি দুই থানার মধ্যে একটি থানায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন।
* প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ মোটামুটি পাঁচ ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার।
* এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ (৭৯ লাখ) শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি,
* ১৫ দশমিক ১ শতাংশ (সাড়ে ২২ লাখ) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি,
* ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ (২২ লাখ) বাক্-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি,
* ১৪ শতাংশ (১৬ লাখ) বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং
* ৬ দশমিক ৭ শতাংশ (১০ লাখ) বহুমুখী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দারীদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রথমেই হন পারিবারিকভাবে বঞ্চনা অথবা অবহেলার শিকার। পারিবারিক অসচেতনতার কারণেই সমাজ তাদের সহজে গ্রহণ করতে চায় না। সহপাঠীদের বৈরী আচরণ এবং অভিভাবকদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল কতৃপক্ষ ভর্তীতে অনীহা প্রকাশ করে। কর্মজীবনে প্রবেশ করলে সেখানে সহকর্মীদের অসহযোগীতামূলক মনোভাব ছাড়াও নানারকম বিড়ম্বনার কারণে মনোবল হারিয়ে ফেলতে থাকেন ধীরে ধীরে। চারপাশের বিরূপ পরিবেশের কারণে সামাজিক অংশগ্রহণ থেকে গুটিয়ে নিজেদের ভিনগ্রহের বাসিন্দা ভাবতে থাকতে শুরু করেন। খুব অল্প সংখ্যাকই পারেন বৈরী পরিবেশে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে। সহায়ক ব্যবস্থাগুলোর অভাবও এর অন্যতম কারণ। যেমন-
* হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের জন্যে সহায়ক ব্যবস্থাযুক্ত যানবাহন, সিঁড়ির পাশে র্যাম্প, এক্সেসিবল টয়লেটের অপ্রতুলতা।
* দৃষ্ট প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মুক্ত চলাচলের জন্যে ব্রেইল বাটন ও ফ্লোর এনাউসমেন্টযুক্ত লিফট এবং রাস্তায়, ফুটপাথে, সিঁড়ি বা বাধা যুক্ত স্থানের সর্বত্র ব্রেইল ব্লক না থাকা।
* বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের সর্বস্তরে অংশ নিতে ইশারা ভাষার ব্যবহারের প্রচলন শুরু না হওয়া ইত্যাদি।
তাছাড়া ব্রেইল ও ইশারা ভাষা পদ্ধতির প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহের অভাব তাদের একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান অন্তরায়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং বিভিন্ন ধরণের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের জন্যে আছে আলাদা বিশেষ স্কুলে শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা ও প্রবেশগম্যতার অভাবে বঞ্চিত হন শিক্ষা, বিনোদন, কর্মসংস্থান ও সব ধরণের মৌলিক অধিকার থেকে। একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা তো বহু দূরের কথা তাদের জন্যে নেই সহায়ক ব্যবস্থা সম্বোলিত বিশেষ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। এদেশে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন তারাই।
বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও এই অধিকার এর বিষয়গুলোকে বহু আগেই জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ (Convention on the Rights of Persons with Disabilities – CRPD) এ মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেই ২০০৭ সালের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশ এই অধিকার রক্ষা সনদে স্বাক্ষর করলেও বিগত পাঁচ বছরেও তার বাস্তবায়ন সেভাবে আমাদের চোখে পড়েনি। জাতীয় ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮ থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্যে সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার বিধান প্রনয়ণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্যে ঘরে বাইরে সর্বত্র একটি শব্দ, “না”। খুব কমই তাদের জন্যে “হ্যাঁ” শোনা বা দেখা যায়। বাস্তবচিত্রটা হলো প্রতিবন্ধী বান্ধব অবকাঠামোর পাশাপাশি মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে। এসব কারণেই বেশির ভাগেরই জীবন কাটে চার দেয়ালের নিভৃতে। অপ্রাপ্ত এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হতে হতে অনেকটা যেনো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। এখন সময় এসেছে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা এতে মূখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের অধিকার সম্পর্কে সাধরণ জনগণের মাঝে পরিস্কার ধারণা দেওয়া গেলেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সম্ভব। আর একমাত্র সচেতনতা সৃষ্ঠির মাধ্যমেই তাদের সহায়ক যাতায়াত সুবিধা, একিভূত শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান এবং সর্বজনীন প্রবেশগম্যতাসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা কাগুজে হরফ থেকে বেরিয়ে বাস্তবে রূপ নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
Convention on the Rights of Persons with Disabilities – CRPD (Bangla version)
তথ্য সহায়তাঃ
সালমা মাহবুব, সাধারণ সম্পাদক, বি-স্ক্যান।
দৈনিক সমকাল, ১৮ই এপ্রিল”২০১০ সংখ্যা।
মন্তব্য
আমি প্রথম!
এই জন্যে আপনেরে
কিন্তু প্রথম হলে তো চলবে না শুধু। লেখাটা পড়ে গঠনমূলক আলোচনা শুরু করুন এবার
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।
শনিবারের প্রেজেন্টেশন এর পড়া টা কে করে দিবে? আপনি????
বিশাল এক স্ক্রিপ্ট এখনো প্রথম পাতা উল্টানোর সময় টুকুও হয়নি।
আমার ধারনা, বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যার হার বরং বেশী হতে পারে। এর কারণ হিসেবে বলতে পারি অপুষ্টি (মা ও শিশুর), অশিক্ষা এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব। বিতর্ক আয়োজনের উদ্যোগটা নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাল উদ্যোগ তবে এতে সীমিত সংখ্যক বিদ্যালয়কে না রেখে সবাইকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, আরো ছোট বয়সীদের জন্য বয়স ভিত্তিক রচনা বা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার আয়োজন করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে দারিদ্র্্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলার আরেকটা কারণ। সরকার থেকে প্রতিবন্ধী শিশুর ভরণপোষনের জন্য একটা ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
হতে পারে। এই জন্যেই অত্যন্ত জরুরী এদের পরিসংখ্যানটা বের করা। এবারের আদমশুমারীতে এই সংখ্যা নিরূপণের উদ্দেগ নেওয়া হলেও ব্যাপক প্রচারণার অভাবে তেমন একটি সাড়া পরেনি। বেশির ভাগ ঘরেই দেখা গেছে প্রতিবন্ধী সন্তানকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা। সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হলে যখন দেখা যাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে একমাত্র তখনই কেবল এদের জন্যে রাষ্ট্র তথা সমাজ তাদের জন্যে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দেগ নেওয়ার তাগিদ অনুভব করবে।
পরামর্শের জন্যে কৃতজ্ঞতা। দেশ ব্যাপী এ আয়োজনটি করারই ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য কি সহজে পূরণ হয়! আমাদের সীমিত সাধ্য যতটুকু সম্ভব আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আবারো ধন্যবাদ আপনাকে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।
বি-স্ক্যানের প্রতি শুভ কামনা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
আপনার পরিসংখ্যানের তথ্যগুলো কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নেয়া? আমার মনে হয় সংখ্যাটা আরো বেশী হতে পারে। কারণ গণনায় ফুটপাতবাসীরা বরাবরই বাদ পড়ে ঠিকানাবিহীন বলে। তবু এর ভিত্তিতেও কাজ করা যায়। সবচেয়ে বেশী ভুক্তভোগী আর্থিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী। ওদের কোন উপায়ই নেই আসলে। অসহায় লাগে ভাবলে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
#অভিনন্দন আপনাকে প্রিয় সাবরিনা।।।অনেক সুন্দর পোষ্ট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( World Health Organization - WHO) ও বিশ্ব ব্যাংক (World Bank) এর জরীপ এবং অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত সাহেবের একটি গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে করা দু'ধরণের পরিসংখ্যান আমার লেখাতেই তো উল্লেখ করেছি! আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে মনে হয়
তবে উপায় নেই কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা বাঙালীরা উপায়ের পথটি তৈরি হতে দেই না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।
বেশ ভালো লাগলো লেখাটি। প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া উচিৎ।
আমার মনে হয় প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানসিকতার বদল তখনই সম্ভব যখন সামগ্রিকভাবে মানুষ হিসেবে আমরা সংবেদনশীল হতে পারব, আরেকটু ভাল মানুষ হতে পারব।
নতুন মন্তব্য করুন