আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এইচ এস সি-র পর সবার ডিফল্ট ঠিকানা আমাদের পশ্চিম কাফরুল। তাছাড়া ঢাকার বাসা বলতে তখন সবাই একেই বুঝতো। কেউ অসুস্থ হয়ে এ বাসায় চিকিৎসার জন্য আসলে মনে হতো এটা একটা বিয়ে বাড়ি। এত্ত মানুষ!
ছুটির দিনগুলো ছাড়া প্রতিদিন দুপুরবেলা বেশীরভাগ সময় আমাদের বাসা খালি থাকতো। স্কুল থেকে আসার পর আমাদের কাজ থাকতো সবার ঘরে হানা দিয়ে হরলিক্স না হয় ডানোর কৌটা খুঁজে বের করা আর হাতের তালুতে নিয়ে খেয়ে সাবার করা।
আমাদের বাসার পাশেই ছিল আম্মুর চার মামার বাসা। সেখানে চার মামা তাঁদের ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আর আমরা পড়ে গেলাম নানাবাড়ির
আনন্দের এক্কেবারে মধ্যে। আর যারা এইচ এস সি র পর গ্রাম থেকে ব্রিলিয়েন্ট রেজাল্ট নিয়ে ঢাকায় আসতো কোথাও ভর্তি হবে বলে তারাও এই চৈতালে পড়ে একটা বছর নষ্ট করতো। তারপর আমার আব্বাজান হাল্কার উপর ঝাপ্সা একটা সান্টিং দিয়ে একঘরে করে দিত বেচারাকে।
এমনি বন্দী একবছর পার করে আমার সেজো মামা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেল। মামার ক্লাস শুরু হতে অনেক দিন লেগে যাবে তাই মামা নানুবাড়ি
থেকে আসবে কয়েকদিন। এই খবর পাওয়া মাত্র যার যার স্কুল বন্ধ বা বন্ধের পথে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যায়।
কোন সমস্যা নাই,তারপরও সমস্যা
এক জায়গায়। এখন হেড অফিসে কে সংবাদ পাঠাবে যে আমরা পিচ্চির দল নানুবাড়ি যেতে চাই। যাইহোক বাবলু মামা আব্বুর কাছে প্রস্তাব
রাখলো-বাচ্চারা অনেক দিন কোথাও বেড়াতে যায় না ঘুরে আসুক বাড়ি থেকে। আব্বুর কড়া চাহনি একজনও সাঁতার জানে না পুকুরের পানিতে পড়ে গেলেই তো শেষ। না না যেতে দেয়া যাবে না।
তারপর বাচ্চাকাচ্চার দল তাদের অশ্রু বিসর্জন শুরু করে। কেউ উপুর হয়ে শুয়ে বাংলা সিনামা
টাইপ আবার কেউ বিদ্রোহী টাইপ আমি পড়বো না, আমি খাবো না ইত্যাদি ইত্যাদি।
আব্বুর দুইটা ডায়ালগ ছিল এক.আমি চৈতাল পছন্দ করি না। যা আমাদের বাসায় বিকালে একবার আর ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে আরেকবার রোজ বসতো। আর দুই.আমার কান্নাকাটি একদম পছন্দ না। যা ছিল আব্বুকে রাজি করানোর একমাত্র হাতিয়ার।
যথারীতি আব্বুর ডায়ালগ-আমার কন্নাকাটি একদম পছন্দ না এখন খেয়েদেয়ে ঘুমাও সকালে দেখা যাবে। তার মানে সকালে আমরা নানুবাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু সকালে আব্বু দুইটা শর্ত জুড়ে
দিতো-এক.কোনভাবেই পুকুরে নামা যাবে না, দুই.ফিরে এসে অংক বই শেষ করে ফেলতে হবে। পরের চিন্তা পরে তাই যতজোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলা যায়। মহা আনন্দে সকালে আমরা মামার সাথে নানুবাড়ি যাই।
ছোট মামার সাথে আমাদের সবার অনেক ভাব। মামা টো টো কোম্পানির হোকার সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আমরাও মামার সাথে ঘুরে বাড়াই আর সুযোগ পেলেই- মামা নৌকায় চড়াও না প্লিজ সত্যি বলছি নৌকায় উঠে চুপ করে বসে থাকবো। মামা নৌকা চালানো শুরু করা মাত্র নির্ভীক ছেলেপেলে নানারকম কর্মকান্ড শুরু করে দেই।
মামার সাথে ঘুরে ঘুরে পুতুল নাচ দেখতে আরেক গ্রামে চলে যেতাম- পুতুল ঝর্ণা বিবির মালা বদল। একপট চাল দিয়ে সাপের খেলার আসর
বসাতাম-এই সর্পরাণী কপাল ছাড়া ছবল দেয় না আর কপালে ছবল দিলে এক্কেবারে শেষ। সবুজ রঙ্গের একটা সাপ হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে
সাঁপুড়ে কি সুন্দর করে বলতো ভয়ে গাঁ শিরশিরিয়ে উঠতো।
মামার সাথেই প্রথম আমরা বায়োস্কোপ দেখেছিলাম আমাদের নানুবাড়ির একতা স্কুল মাঠে। একটাকা করে আগে জমা করে তারপর বাজনার তালেতালে শুরু-কি চমতকার দেখাগেছে সংসদ ভবন আইস্যাগেছে, পোলাপানে
দেখতেয়াছে ব্রীজ দিয়্যা গাড়ি
চলতেয়্যাছে...সুন্দরবন আইস্যাগেছে আমাদের
যাত্রা শ্যাষ হইছে।
ছোট মামা যেটা দেখায় নাই তা হলো যাত্রাপালা। আমারা যখন ঘুম রাতের অন্ধকারে দুই তিন মামা মিলে যাত্রাপালা দেখতে পাশের কোন গ্রামে চলে গেছে আর সকাল বেলা আমাদের যাত্রার কাহিনী বর্ননা করেছে। আর আমরা গালফুঁলিয়ে গোপ করে থেকে কাহিনী শুনেছি। মামা যাত্রার অনেক ডায়ালগ মুখস্ত বলতে পারতো। মামাকে অনেক বেশী মিস করি। মামার আশাই কিভাবে যেন পুরন হয়ে গেল। সে টোটো কম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমাদের সবাইকে টাটা বাইবাই বলে এখন দেশবিদেশ জাহাজ দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে।
সেদিন সেজো মামাকে ফোন করলাম-
-মামা কি করো?
-তোমার মামাতো বোনকে বাতাস করি। ইলেক্ট্রিসিটি নাই তো তাই।
-মামা ঢাকা আসবা কবে?
-আসবো চীন মৈত্রীতে নাকি শিশু মেলা হবে। দেখার ইচ্ছা আছে আসতে পারি। তোমার বোন তো কিছুই দেখলো না। এবার দেখি...
খবর শুনে আমার ছোটবোনটিও লাফিয়ে ওঠে-আমিও শিশু মেলায় যাবো? কি আর করা নিয়ে গেলাম চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে। একঘন্টা পুতুল নাচের কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।
মজার ব্যাপার হলো আমরা নানুবাড়িতে যে পুতুল নাচ দেখতাম একই দল এখানেও পুতুল নাচ দেখাতে এসেছে। তবে তিন টাকার পুতুল নাচ তিরিশ টাকা, সময় আধাঘন্টা কমে পনের মিনিট হয়ে গেছে। এতেই আমার বোন মহা খুশি।
বাঁদরের খেলা দেখালাম দশটাকা দিয়ে-দুইটা বানরের একটা শুধু চরকির মতো ঘুরে আর আরেকটা শুধু টাকা তুলে একি! এরচেয়ে আমাদের দুইটাকার বানর গাছে চড়তো, ডুগডুগি বাজাতো, প্রয়োজনে ভাগ্য গননাও করে দিতো। কিন্তু আমার ছোট আপুমনি এতেই মহা আনন্দিত।
যাইহোক বায়োস্কোপ দেখে সে মুখটা গোমড়া করে বলে "ফালতু"। কারন হলো আধুনিক বায়োস্কোপের বাজনা বিলুন্ত হয়েছে আর দর্শণীয় স্থানগুলো রিয়াজ,শাবনূর আর শাহরুখ খান দখল করে নিয়েছে। এই হলো আমাদের বায়োস্কোপ।
মন্তব্য
আপনার স্মৃতিচারন খুব ভালো লাগলো। আমারো মনে পড়ে গেল ছেলে বেলার স্মৃতি, নানু বাড়ির স্মৃতি।
আরো লিখুন, লিখতে থাকুন। অপেক্ষায় থাকলাম।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ। আপনার কবিতা,ব্লগরব্লগর অনেক ভাল লাগে পড়তে।
আহা খুব ভাল লাগল পড়ে
আমি কখনও বায়োস্কোপ দেখিনি কিন্তু অনেক শুনেছি, তোমার লেখায় পড়ে মজা লাগল
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
আমি ধন্য ধন্য। আপু বাংলাদেশে আসলে যোগাযোগ রেখো তোমাকে বায়োস্কোপ দেখানোর ব্যাবস্থা করব।
সচলে স্মৃতিচারণ ধর্মী লেখা আমি খুব আগ্রহ করে পড়ি; কোন কোন ক্ষেত্রে একাধিকবারো পড়া হয়।
সব লেখাটার মত এটাও ভাল লাগল; আসলে স্মৃতিকাতরতা নিজেই একটা অন্যরকম ভাল লাগা।
চলুক স্মৃতিচারণ...
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
ধন্যবাদ রাফি ভাই।
অনেক ভালো হইছে লেখাটা ... আমাদের সবারই দেখি নানাবাড়ি আর ছোটমামা নিয়ে অনেক স্মৃতি জমে আছে
ভালো কথা, চৈতাল কি জিনিস?
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...
চৈতাল হলো- একসাথে অনেক মানুষ মিলে আড্ডা দেয়া, গল্প করা, গান গাওয়া...
ধন্যবাদ ভাইয়া। সবারটা তো জানি না কিন্তু আমি অনেক মিস করি নানুবাড়ি আর মামা বাড়ি।
নতুন মন্তব্য করুন