বেশ ছোটবেলার কথা। আমার বয়েস তখন ১০-১২ বছর হবে। জন্মদিনে উপহার পেলাম একটা 'ব্রাউনি বক্স ক্যামেরা।' দেখতে একটা ছোট জুতার বাক্সের মত এই ক্যামেরাটা, তবে জুতার বাক্স যেমন সাধারনত সাদা রঙের হয় তার বদলে এটি ছিল কাল। ছবি তোলার বদলে এটি আমি আমার ‘স্ট্যাটাস সিমবল’ হিসাবে বেশি ব্যাবহার করার সুযোগ পেলাম। তখনকার দিনে এই ক্যামেরাতে ব্যবহার করতে হত ১২০ সাইজের ফিল্ম। তখন সাদা-কালোর দুনিয়া। রঙ্গিন ফিল্ম তখনও শুরু হয়নি। একটা ফিল্মে সম্ভাবত ১২ টি ছবি উঠানো যেত। আমার প্রথম ফিল্মটা শেষ হবার পর আর ফিল্ম কেনার সুযোগ হয়নি। স্থানীয় একটি স্টুডিওতে ফিল্ম ভরা অবস্থাতে নিয়ে গেলাম। তারা তাদের ডার্ক রুমে নিয়ে যেয়ে ক্যামেরা থেকে ফিল্ম বের করল। আমার হাতে ক্যামেরা ফেরত দিয়ে পর দিন ছবি নিতে আসতে বললো যাতে এই সময়ে তারা ফিল্মটা প্রসেস করে রাখতে পারে। আমার বিশেষ অনুরোধে সুযোগ দিল তাদের ডার্ক-রুমে ঢুকে ফিল্ম ডেভেলপ করার সময় থাকতে দিতে। খুবই আগ্রহ ভরে সেই রুমে ঢুকে দাঁড়ালাম। পাশাপাশি ৩ টা প্লেটে কিছু কেমিক্যাল ঢেলে রাখল প্রথমে। তারপর আমাকে বুঝাল যে সম্পূর্ণ অন্ধকার না করলে ছবি নষ্ট হয়ে যাবে ডেভেলপের সময়। বাকী সময়টা অন্ধকারে দাঁড়িতে থাকলাম আমি – কিছুই দেখতে পারলাম না। শেষের প্লেটটাতে ছিল ‘হাইপো’ যাকে ‘ফিক্সার’ বলা হয়। সেখানে কিছুক্ষণ ফিল্মের নেগেটিভটা থাকার পর রুমের মধ্যে একটা খুব কম পাওয়ারের লাল বাতি জ্বালিয়ে দিল। এবার একটু একটু দেখতে পেলাম। এর পর একটা ক্লিপ দিয়ে ফিল্মটাকে ঝুলিয়ে রাখা হল। শুখাবার জন্যে এভাবেই নাকি সাড়া রাত রাখতে হবে ফিল্মটাকে। আমাকে পরের দিন সকালে আসতে বলল নেগেটিভ থেকে পজিটিভ করা দেখার জন্যে।
পরের দিন যখন স্টুডিওতে গেলাম তখন পজিটিভ করার প্রনালীটা দেখলাম। একটা কাঁচ লাগানো ছোট ফ্রেমের উপর প্রথমে কাঁচের উপর নেগেটিভটা রাখার পর একটা সাদা পজিটিভ কাগজ রেখে ফ্রেমটা তার ঢাকনি দিয়ে চেঁপে বন্ধ করা হল। তারপর একটা ইলেকট্রিক বাতীর সামনে কিছুক্ষন কাঁচের দিকটা ধরে রাখা হল। এরপর পজিটিভ কাগজটা একটা প্লেটের কেমিকেলের মধ্যে রেখে দিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দিল স্টুডিওর টেকনিশিয়ান। কিছুক্ষণ পর দেখলাম আস্তে আস্তে সেখানে ছবি ফুটে উঠছে। কেমন যেন ম্যাজিকের মত সবকিছু লাগছিল তখন। ছবি তোলা তখনকার দিনে চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না।
আমাদের বাড়ীতে নতুন কেউ বেড়াতে এলে আমি তার সামনে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ঘুরতাম । সে একটু আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে বুঝাতাম কি করে ছবি তুলতে হয়, কি করে ডেভেলপ করতে হয় আর কি করে পজিটিভ ছবি বানাতে হয়। এভাবেই আমার সাথে ডঃ শহীদুল্লার প্রথম সাক্ষাৎ। আমার বাবার বিশেষ পরিচিত ও বন্ধু স্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আমার বাবা যখন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তেন তখন থেকে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর সাথে তার পরিচয়। বয়সে তিনি আমার বাবার থেকে প্রায় ১০ বছর বড় ছিলেন, তবে খুব স্নেহ করতেন বাবাকে। আমার বাবার আর তার নামের মিল ছিল তাই তারা একে অপরকে ‘মিতা’ বা 'মিতা ভাই' সম্মোধন করতেন।
তিনি তখন সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে অবসর নিয়েছেন এবং বাংলার মানুষের জীবনের উপর একটা বই লিখছেন বা প্রজেক্ট করছেন। বাবার সাথে সেই ব্যাপারে কিছু আলোচনা করার জন্যে যশোরে এসে আমাদের বাড়ীতে এক দিন কাটিয়ে গেলেন। একটা কাল ঠোঙ্গার মত টুপি, যার মাথার উপর লেজের মত একটা কিছু ঝুলতো, তাই মাথায় দিতেন তিনি (পরে জেনেছি এই টুপিকে 'ফেজ' টুপি বলা হয়)। প্রথম প্রথম একটু ভয় হচ্ছিল তার কাছ ঘেঁষতে। তিনিই আমাকে ডেকে নিলেন তার কাছে। আদর করে কোলে বসালেন।
- কি এটা? - জিজ্ঞাসা করলেন আমার হাতের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে।
- এটা আমার 'ব্রাউনি ক্যামেরা' (নামটা শেখা হয়ে গেছে তখন)।
- কিসের ছবি তুলছো?
- এখন আর ছবি তুলি না। আমার ফিল্ম শেষ হয়ে গেছে। তুমি কি জানো কি করে ফিল্ম থেকে ছবি বানায়?
এবার শুরু হয়ে গেল আমার 'ফটোগ্রাফি-১০১ লেকচার'। ধৌর্য ধরে চুপচাপ শুনে গেলেন তিনি।
- ফিল্ম থাকলে কি ছবি তুলতে?
- এখনো ঠিক করিনি - খুব বিজ্ঞ ভাবে বললাম আমি।
তার পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন। বললেন - "নতুন ফিল্ম কিনে তুমি এবার তোমার মনে যেসব জিনিস দাগ কাটবে সেগুলির ছবি তুলবে। আমি যখন আবার আসবো তখন দেখাবে আমাকে সেগুলি।"
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-র সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারের স্মৃতি এটি। তিনি ছিলেন এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ। একাধারে ভাষাবিদ, গবেষক, অনুবাদক, লোকবিজ্ঞানী, পাঠসমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসৈনিক এবং একজন খাঁটি বাঙালি মুসলিম ও দেশপ্রেমিক। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষা গবেষণায় অদ্বিতীয়। একই সাথে তিনি ছিলেন ধর্মবেত্তা ও সূফীসাধক।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যে কয় জন ব্যক্তি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এই প্রতিবাদ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে শুরু করেছিল রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের। তার বক্তব্যের জন্যে তিনি রয়ে গেলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন, "আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালল-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার কোন জো-টি নেই।"
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের আহ্বানে তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্রজনতার মাঝে সশরীরে উপস্থিত থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পুলিশী হামলায় টিয়ার গ্যাসে নিগৃহীতও হয়েছিলেন।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে ১০ জুলাই ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে তিনি উর্দু, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দুর পাশাপাশি হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্ত্বের সাথে সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পাশ করেন। বাঙালি মুসলমান ছেলেদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অনার্স নিয়ে পাস করেন।
সংস্কৃতিতে অনার্স পাস করার পর সংস্কৃত নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে চাইলে তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতগণ তাঁকে পড়াতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর দু'বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বি.এল. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি ফ্রান্সের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করার পূর্বে কিছুকাল তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আমার বাবা এবং আমি – আমরা সবাই এক সময় যশোর জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। বাংলাদেশের অন্যতম এক পুরান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এটি (প্রতিষ্ঠা ১৮৩৮ সাল)।
আঠারো শতকের মুসলিম সমাজ, পারিবারিক ঐতিহ্য ও পৈত্রিক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বর্তী, জার্মান, ফরাসী, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, আমি বাংলা ভাষাই জানি।
বিভিন্ন ভাষায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র দখল ছিল অসাধারণ ও অসামান্য। উর্দুভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১ - ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। আমরা বর্তমান যে বাংলা পঞ্জিকা দেখি সেটা তার নেতৃত্বে সৃষ্ট একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ। এর আগে কিছু কিছু বাংলা মাসে ৩২ দিনও হতে পারতো। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর ইমেরিটাস নিযুক্ত হন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হন। তার লেখা অনেক বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - ভাষা ও সাহিত্য, সিদ্ধা কানুপার গীত ও দোহা, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, দীওয়ানে হাফিজ, অমিয়শতক, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, শিকওয়াহ ও জাওয়াব-ই-শিকওয়াহ, বিদ্যাপতি শতক, বৌদ্ধ মর্মবাদীর গান, কুরআন প্রসঙ্গ, বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ইকবাল, আমাদের সমস্যা, ইসলাম প্রসঙ্গ, ইত্যাদি। তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্যবই লিখেছেন, ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তাঁর লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে তাঁর ৩৭টি রচনা। অন্যান্য বিষয়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮০টি। এ ছাড়া তিনি তিনটি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা ও লিখেছেন।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক স্বতন্ত্র ধর্মী গবেষক ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল জটিল দিকের গ্রন্থিমোচন এবং নবতর ব্যখ্যা। এই মনীষীকে ঠিক ভাবে জানতে হলে সম্পূর্ণ মুক্ত মন এবং তখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে সমাজ ব্যবস্থার কথা মনে রেখে এগুতে হতে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এক বিরল বাঙ্গালী এবং আমাদের গর্বের ধন।
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক 'প্রাইড অফ পারফরম্যান' এবং ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে 'নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স' পদকে ভূষিত করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পদকে ভূষিত করেন। তিনি আজীবন ছাত্র এবং আজীবন শিক্ষক ছিলেন। সারা জীবন শুধু জ্ঞানের পিছু ছুটেছেন এবং জ্ঞান বিলিয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে। আজীবন উদ্যমী এই মানুষটি সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, 'ভাল হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো।' ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আমার সৌভাগ্য যে তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তার সাথে আবার দেখা হবার সূযোগ আমার হয়েছিল। ঢাকাতে আমার বাবার সাথে তার বেগম বাজারের বাড়ীতে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ঢাকার চকবাজারের সংলগ্ন হচ্ছে বেগমবাজার। বেগমবাজারের দক্ষিণ উপপ্রান্তে জনাকীর্ণ পথের কোণাকুণি জায়গাটায় একটি দো'তলা বাড়ি, নাম 'পেয়ারা ভবন'। বাড়িটির মাঝখান দিয়ে একটা সরু করিডর। করিডর দিয়ে সামনের দিকে এগুলে দোতলা ওঠার সিঁড়ি। নিচ তলায় একটি পড়ার ঘর এবং লাইব্রেরী। সেখানেই আমাদেরকে নিয়ে বসালেন তিনি। কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার ঘরটি। সাড়া দেওয়াল জুড়ে কাঠের অনেক আলমারী। সেখানে বিভিন্ন ভাষার হরেক রকমের অসংখ্য বই। তার মধ্যে ছিল - বাংলা, ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ল্যাটিন, হিব্রু, আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দী, অসমীয়া, উড়িয়া, মারাঠি, তামিল, গুজরাটি, সিংহলীসহ কোন না ভাষার বই। বইগুলি থরে থরে সাজানো আছে আলমারী ও শেলফে এবং প্রত্যেকটি বই আচার্যের বহু বিনিদ্র রজনীর পড়াশুনার সাক্ষর বহন করে চলেছে। তখনও আশ্চার্য স্মৃতিশক্তি তার।
আমাকে বললেন - "তোমার বাবা একসময় ছোট গল্প লিখতো, দেখবে?"
খুব অবাক হলাম - জানা ছিল না এ খবর আমার।
তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশু পত্রিকা 'আঙ্গুর' আত্মপ্রকাশ করে ১৯২০ সালে। আলমারী খুঁজে খুঁজে তিনি বের করলেন আঙ্গুরের পুরানো কয়েকটি সংখ্যা। তার মধ্যে ঠিকই বের করে দিলেন আমার আব্বার লেখা একটি গল্প। এই বয়েসেও তার এই প্রখর স্মৃতিশক্তি দেখে বুঝলাম কি করে তিনি এমন একজন মনীষী হয়েছেন।
তার একটা কথা আমি এখনো মনে রেখেছি - "তোমার মনে যেসব জিনিস দাগ কাটবে সেগুলির ছবি তুলবে।"
তাই করে চলেছি আমি - ক্যামেরার বদলে মনের স্মৃতিপটে ছবি তুলে চলেছি।
মন্তব্য
লেখাটা ভালো লাগলো সেই সাথে মনে পড়ে গেলো যশোর জেলা স্কুলকে।
ভাল লাগল। ভাল থাকবেন।
স্মৃতিচারন বেশ লাগলো।
দারুন লাগলো আপনার লেখাটি।ভালো থাকবেন।
ক্রেসিডা
মনের স্মৃতিপটের ছবিগুলো যে এত সুন্দর, মায়াময়।অনেক ধন্যবাদ সবার সাথে ভাগ করে নেয়া স্মৃতির জন্য।
আপনার সেই ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছা করছে
এই ভদ্রলোককে আমার বিশদ ভাল লাগে।
"ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বর্তী, জার্মান, ফরাসী, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, আমি বাংলা ভাষাই জানি।"
ভাষাবিদদের ভাষা আয়ত্ব করার প্রয়োজনিয়তা ঠিক ততটুকুই যতটুকু ফরমুলা-১ এর কলাকুশলীদের চ্য়াম্পিয়ন ড্রাইভার হওয়া প্রয়োজন। ড শহীদুল্লাহ মগধি প্রাক্ররিত ভাষা নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন, এই ভাষা থেকে আসা সবগুলো ভাষা নিয়ে তিনি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। কিন্তু, উদাহরন স্বরূপ একজন তিব্বতির সাথে তার কথপোকথন বা তিব্বতিতে চিঠি আদানপ্রদানের কোন নিদরশন আমরা দেখিনা, দেখার প্রয়োজনও নেই। একজন চোস্ত দোভাষির চাইতে তিনি ভাষাবিদ হিসাবেই বেশী মূল্য়বান।
নতুন মন্তব্য করুন