হাত ধরাধরি আমার সামনে হাটছে তারা। পিছন থেকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কত বয়েস হবে। তবে দু'জনেই প্রবীন তাতে সন্দেহ নেই। পুরুষটার এক হাতে ল্যাসে ধরা এক কুকুর তাদের সামনে সামনে হাটছে, আর অন্য হাত দিয়ে ধরে আছে রমনীর একটি হাত। তাদের থেকে আমার হাটার গতি একটু দ্রুত। খানিক্ষনের মধ্যে তাদের বেশ কাছে এসে গেলাম। দেখলাম বেশ বয়স্ক অথচ সুস্বাস্থের অধিকারী এক দম্পতি হাত ধরাধরি করে হাটছে। ভাল লাগল দেখে। হঠাৎ কি যেন হল, তাদের কাছে দাঁড়িয়ে পরলাম। আমার দেখাদেখি তারাও দাঁড়াল।
- কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি? - জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
- নিশ্চয়।
- তোমরা কি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী?
একটু অবাক হল আমার কথায়। হাসতে হাসতে উত্তর দিল -
- হ্যাঁ, ৪৫ বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে।
- তোমরা এখনকার আমেরিকাতে এক দুর্লভ বস্তু। এতদিন ধরে এক সাথে আছো এমনটা আর বেশী দেখা যায় না আজকাল।
- আমরা অবশ্য একটু কম বয়েসেই বিয়ে করেছিলাম।
- তোমাদেরকে এভাবে হাত ধরাধরি করে হাটতে দেখে সত্যি আমার খুব ভাল লেগেছে তাই অযাচিত ভাবে এই প্রশ্ন করলাম। আশা করি কিছু মনে করো নি।
- না, না মনে করার কি আছে।
এভাবেই পরিচয় এই দম্পতির সাথে। বিকেলে পাহাড়ের দিকে হাটার সময় প্রায় দেখা হয় আজকাল। আমাকে চেহারায় চিনে গেছে তারা। আজকাল দেখা হলে তারাই প্রথমে সম্ভাষন দেয় আমাকে। বিগত ৩০ বছর ধরে তারা এই শহরে আছে। বলতে গেলে তাদের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে এই শহরটি। এভাবেই জো এবং তার স্ত্রী জেনেটের সাথে আমার পরিচয়। কিছু দিন কথা বলার পরে বুঝলাম আসলেই তারা ভাল মানুষ। সব সময় তাদেরকে দেখি হাত ধরাধরি করে হাঁটছে তারা। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম শেষ কবে আমার স্ত্রীর সাথে এমনি ভাবে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছি আমি। মনে করতে পারলাম না। অবশ্য আমাদের কারণ আলাদা। তবু কেমন যেন একটু হিংসা হল এদেরকে দেখে।
যেহেতু এক মাস মাত্র বাকী আমেরিকার নির্বাচনের, সেদিন আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম - কাকে ভোট দেবে ঠিক করে ফেলেছো কি?
সোজাসুজি কাকে ভোট দেবে জিজ্ঞাসা করাটা হয়ত ঠিক হবে না, তাই একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম।
- জানি মিট-এর হয়তো কিছু দূর্বলতা আছে, তবুও তাকেই ভোট দেবো।
- ওবামা না কেন?
- ওবামা জিতলে আমেরিকার ভবিষ্যত অন্ধকার।
তর্কে না যেয়ে বোকার মত হাসি দিলাম, যেন তাদের কথা সমার্থন করছি। পরে বাড়ীতে ফিরে চিন্তা করতে লাগলাম জো-র কথাটা। গতবারে আমি ওবামাকে ভোট দিয়েছিলাম এবং এবারও দেবো বলে আশা রাখি। অধিকাংশ আমেরিকাবাসী বাংলাদেশীর মত আমি অবশ্য ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হইনি। রিপাব্লিকান পার্টির সদস্যও নই। আমি আমার নিজস্বতা নিয়ে থাকতে চাই। ভোটার হবার সময় বলতে হয় কোন দল করি, তবে সেখানে লেখা যায় যে আমি জানাতে চাইনা কোন দলের সমার্থক। কিছু দিন আগে স্থানীয় সরকার অফিস থেকে চিঠি এসেছে আমার কাছে। এমন চিঠি সবার কাছে গেছে। তাতে লেখা আছে কোথায় কোথায় ভোট কেন্দ্র এবং কবে থেকে ভোট দেওয়া যাবে। আমার নামের চিঠিতে উল্লেখ করা আছে আমার দল হচ্ছে - 'DTS' (অর্থাৎ 'Decline to state')।
আজকাল সকাল বিকেল সব সময় টিভি, রেডিও, ইত্যাদিতে নানা রকম বিশেষজ্ঞের আলোচনা চলছে। বিজ্ঞাপনের কথা বাদই দিলাম। কত মিলিয়ন, মিলিয়ন ডলার যে খরচ হচ্ছে এই সব বিজ্ঞাপনে তার হিসাব বোঝার সাধ্য আর আমার নেই। আমেরিকা এখন বাংলাদেশের মত 'বাল' আর 'বানপি'-তে বিভক্ত হয়ে গেছে। এখানে অবশ্য তারা অন্য নাম ব্যবহার করে। একটা হচ্ছে 'বুড়া দাদার দল' (নামটা আমার দেওয়া, ইংরেজীতে বলা হয় 'গ্রান্ড ওল্ড পার্টি') আর অন্যটা প্রথমে ছিল 'গনতন্ত্রী-প্রজাতান্ত্রিক' দল, যেটা পরে বাংলাদেশের ছাত্র-ইউনিয়নের 'মেনন-মতিয়া'-র মত ভাগাভাগি হয়ে যায়। এর এক ভাগ আমেরিকার 'সিভিল ওয়ার'-খ্যাত 'হুইগ পার্টি'-র সাথে মিলে 'গনতান্ত্রিক দল' বা এখনকার 'ডেমোক্রেটিক পার্টি' হিসাবে পরিচিত হয়। যুদ্ধের সময় আব্রাহাম লিংকন এই হুইগ পার্টির এক নাম করা নেতা ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি 'রিপাব্লিকান পার্টি'র টিকিটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখনকার দিনে এই রিপাবলিকান পার্টি ছিল ক্রীতদাস প্রথার বিপক্ষে এবং মুক্ত চিন্তাপন্থী। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু একটু একটু বদলে গেছে। তবে এখকার আমেরিকা যেন বাংলাদেশকে অনুসরন করছে সেটা বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। আমেরিকার এই দুই দলের মধ্যে নীতিগত তফাৎ বেশ কম।
এত দিনে নিশ্চয় সবার জানা হয়ে গেছে যে গনতান্ত্রিক দল থেকে ওবামা এবং প্রজাতান্ত্রিক দল থেকে মিট রমনি এবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। রমনি দেখতে শুনতে ভাল, লম্বা, গায়ের রং ফরসা। তার স্ত্রী এ্যানও দেখতে সুন্দরী। ধর্মে 'মরমন' অবলম্বী খৃষ্টান। অনেক মরমন মদ্যপান করে না এবং এক সময় একাধিক স্ত্রী নিয়ে এক সাথে বসবাস করতো। এটা আমেরিকাতে আইন বিরুদ্ধ হলেও কিছু কিছু এলাকাতে এভাবেই তারা থাকে আইনত একাধিক বিয়ে না করেই। সাধারনত মূলধারার প্রটেষ্টান, ব্যাপটিষ্ট ও ক্যাথলিক খৃষ্টানরা মরমনদেরকে খুব একটা ভাল চোখে দেখে না। তা সত্বেও জো'র কাছ থেকে যখন শুনলাম যে সে রমনিকে ভোট দেবে এবং কিছুতেই ওবামাকে ভোট দেবে না - তখন কিছুটা অবাকই হলাম। জো আর দশটা রক্ষনশীল গোড়া রিপাবলিকানদের মত নয়। স্বাধীন চিন্তার মানুষ সে - যতটুকু আমি জেনেছি। একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম এমন চিন্তার কারন কি হতে পারে।
এবারে নির্বাচনে উপরের দু'জন ছাড়াও আরো তিন জন প্রার্থী দাঁড়িয়েছে প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে। এদের এক জন গ্যারি জনসন। আমি যে রাজ্যে বাস করি সেই নিউ মেক্সিকো-তে সে গভর্নর ছিল দুই টার্ম - অর্থাৎ একটানা ৮ বছর। স্কুল শিক্ষক রাশিয়ান মা এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বাবার সন্তান গ্যারি। ছোটবেলায় বাড়ী বাড়ী যেয়ে 'হ্যান্ডিম্যান' বা 'যোগালী' কাজ করতো। পরে ইলেক্ট্রিকাল কন্ট্রাক্টিং কাজ থেকে শুরু করে এখন তার বিরাট কন্ট্রাক্টিং কোম্পানী। হাজারের উপর তার কর্মচারী। এখানে ইন্টেল-এর (কম্পুউটার চিপ) কারখানা তৈরীর সময় প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের কাজ পেয়েছিল। আগে রিপাবলিকান পার্টি করলেও প্রেসিডেন্ট হবার জন্যে দলের সমার্থন পায়নি। পরে 'লিবারেটেরিয়ান পার্টি'-র মনোনয়ন পেয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছে। সে চায় যে এখনি আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করুক এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেক কম করে ফেলুক। গ্যারি একজন ভাল স্পোর্টসম্যান। 'ট্রাইথেলনে' অংশ নিয়ে থাকে। এভারেস্ট বিজয় করেছে। প্রেসিডেন্ট হতে পারলে ভালই চালাবে বলে আমার ধারনা - কিন্তু নির্বাচিত হবে না।
গ্রীন পার্টির পক্ষ থেকে জিল স্টেইন দাঁড়িয়েছে। তারও জেতার সম্ভাবনা নেই। নীতিমালার দিক থেকে গ্রীন পার্টির আদর্শ খুব সুন্দর। রালফ নাদের পর পর দুই বার চেষ্টা করেছিল প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে জিততে - পারেনি। বরং ওবামার কিছু ভোট নষ্ট করেছে। গতবার গ্রীন পার্টির সদস্য মালিক রহিম কগ্রেসের জন্যে দাঁড়িয়েছিল - সেও জিততে পারেনি।
ভার্জিল গুদে এবার দাঁড়িয়েছে 'কনষ্টিটিউশন পার্টি'-র পক্ষ থেকে। প্রথমে গুদে ছিল ডেমোক্রেটিক দলের মনোনিত কংগ্রেসম্যান। পরে পার্টি বদল করে হয়েছিল রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান। আশা করি সে কিছুতেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হবে না। কারন সে প্রকাশ্যে মিনেসোটা-র প্রথম মুসলমান কংগ্রেসম্যান এলিসন যখন কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়ে কোরান হাতে শপথ নিয়েছিল তখন প্রচন্ড আপত্তি তুলেছিল। এছাড়া অভিবাসন কমাতে আগ্রহী গুদে।
আমেরিকার নির্বাচনের নিয়ম একটু গোলমেলে। সাধারন আমেরিকানরা ভোট দিলেও তাদের ভোটে নির্বাচিত হয় না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় 'ইলেক্টোরাল কলেজ'-এর সদস্যদের ভোটে। পাকিস্তানের আইয়ুব খান যেমন 'বেসিক ডেমোক্রেসি' তৈরী করেছিল - অনেকটা যেন মিল আছে তার সাথে। এর ফলে সংখ্যাগত ভাবে বেশী ভোট পেয়েও কেউ হয়তো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত নাও হতে পারে। যেমন হয়েছিল ২০০০ সালে। আল গোর বেশী ভোট পেয়েও নির্বাচিত হতে পারেনি এবং তার বদলে জর্জ বুশ ক্ষমতা দখল করেছিল। আমি এখানে যতটা সহজ করে লেখার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা আরও গোলমেলে। বিভিন্ন রাজ্য (স্টেট) বিভিন্ন নিয়মে তাদের 'ইলেক্টোরাল কলেজ' নির্বাচিত করতে পারে। আগের থেকে নির্ধারন করা আছে কোন রাজ্যে কত জন 'ইলেক্টোরাল কলেজ' হবে। অধিকাংশ রাজ্যের নিয়ম হচ্ছে যে প্রার্থী বেশী ভোট পাবে সেই রাজ্যের সব 'ইলেক্টোরাল কলেজ' তার হয়ে যাবে। নিউ মেস্কিকো-র 'ইলেক্টোরাল কলেজ' সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৫, অপর দিকে প্রতিবেশী রাজ্য টেক্সাস-এর 'ইলেক্টোরাল কলেজ' সংখ্যা হচ্ছে ৩৪ - সব চাইতে বেশী সংখ্যা হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া-তে - ৫৫ জন। সাধারন মানুষের ভোট দেওয়া নভেম্বরের ৬ তারিখে শেষ হলেও 'ইলেক্টোরাল কলেজ'-এর ভোটাভুটি শেষ হতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হবে। যদিও নির্বাচনের শেষ দিনেই বেসরকারী ফলাফল জানা যাবে বলে আশা করি।
এ পর্যন্ত ওবামা ৪৩২ মিলিয়ন ডলার চাদা উঠিয়েছে এবং এর মধ্যে ৩৪৫ মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে খরচ করেছে। রমনি উঠিয়েছে ২৮০ মিলিয়ন এবং তার থেকে ২৩০ মিলিয়ন খরচ করে ফেলেছে। আমেরিকার নির্বাচন হচ্ছে টাকার খেলা। আমেরিকাতে নির্বাচনের দিন (এ বছর তারিখটা হচ্ছে ৬ই নভেম্বর) সাধারন ছুটি ঘোষনা করে না সরকার। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদেরকে কয়েক ঘন্টার ছুটি দেয় ভোট দেবার জন্যে। এই শহরে প্রায় ৭০টি ভোট কেন্দ্র খোলা হচ্ছে আমার কাছে পাঠানো চিঠি থেকে জানলাম। তাদের যে কোন একটি কেন্দ্রে যেয়ে ভোট দিয়ে আসতে পারবো। এছাড়া ভোট দেবার জন্যে নভেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। আগাম ভোটিং শুরু হচ্ছে অক্টোবরের ২০ তারিখ থেকে। তখন নির্ধারিত ১৭টি কেন্দ্রের যে কোন একটিতে যেয়ে ভোট দিয়ে আসতে পারবো। এছাড়াও যারা ব্যক্তিগত ভাবে কোন কারনে উপস্থিত থেকে ভোট দিতে পারবে না তাদের জন্যে 'অনুপস্থিতি ভোটিং'-এর ব্যাবস্থা আছে। এর জন্যে চিঠি লিখে বা ইন্টারনেটে যোগাযোগ করা যায়। এত সব সুবিধা থাকার ফলে ভোট দিতে যেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বেশী সময় নষ্ট করতে হয় না। এই সব কথা টেলিফোনে বাংলাদেশের এক বন্ধুকে বলছিলাম। আমার সব কথা শুনে সে জানালো যে বর্তমানের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নাকি আমেরিকার চাইতেও এগিয়ে আছে।
- কি ভাবে? - বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
- এখানে এখন মনের কথা বুঝে ভোট দেওয়া হয়।
- মানে বুঝলাম না। একটু খুলে বলবি?
- খুব সোজা। সব কিছু এত 'অর্গানাইজড' যে কষ্ট করে ভোট কেন্দ্রে যেয়ে ভোট দিতে হয়না।
- তাই নাকি?
- অন্তত ভোটার আইডি কার্ড চালু হবার আগে পর্যন্ত তাই ছিল।
- ঠাট্টা করছিস?
- ঠিক ঠাট্টা না। কয়েক বছর আগের ঘটনা এটা। আমি সকালে তাড়াতাড়ি উঠে গোসল করে নাস্তা শেষ করে ভোট দেবার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হবো এমন সময় এক ফোন এল। খুব ভদ্রতা সহকারে সালাম দেবার পর জানালো - "স্যার আমরা আপনার পাড়ার 'এক্স যুব কেন্দ্রের' সদস্য। আজকে এই ভোট কেন্দ্রে খুবই ভীড়। ভোট দিতে অন্তত ৩/৪ ঘন্টা লাইনে দাড়িঁয়ে থাকতে হবে। আমাদের ছেলেরা অবশ্য আগে থেকেই জায়গা দখল করে আছে। আর আমরাতো জানি আপনি কাকে ভোট দেবেন, তাই আপনাকে আর কষ্ট করে এখানে আসতে হবে না। আমরা ইতিমধ্যেই আপনার ভোটটি দিয়ে দিয়েছি।" এখন বোঝ, আমরা আমেরিকার থেকে কত এগিয়ে আছি।
বাংলাদেশকে ধরে ফেলার জন্যে এখন আমেরিকাও উঠে পড়ে লেগেছে। তারা এখন 'ডাটা মাইনিং' বা তথ্যের খনিতে ঢুকে পরে তথ্য সংগ্রহের কাজে উঠে পরে লেগেছে। যারা 'ডাটা মাইনিং' শব্দটার সাথে অতটা পরিচিত নন তাদের সুবিধার জন্যে কিছুটা সহজ করে বোঝাবার চেষ্টা করছি।
প্রথমে ভাবছিলাম 'হাচিনা'-র উদাহরন দেবো, পরে আবার ভয় হল কেউ যদি মনে করে যে আমি 'আঙ্গুলীয় বাংলাদেশ'-এর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করার চেষ্টা করছি এবং ফলাফল স্বরূপ কাগু, খাগু, মাগু, ইত্যাদি লেখা শুরু করে তবে শেষ পর্যন্ত আমার প্রিয় 'সচলায়তন'-এ লেখালেখি বন্ধ করতে হবে। তবে এ কথা হয়তো অনেকের জানা নেই যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে কারো নেই। বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত যেখানে এত চেষ্টা করেও অপমান করতে পারেনি, সেখানে এই চেষ্টা করা বিফল।
[এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি, যদি বিগত নির্বাচনের সময় আমি বাংলাদেশে থাকতাম, তবে অবশ্যই শেখ হাসিনা এবং তার দল আমার ভোট পেতেন। এখনও তার ক্যাবিনেটে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন আছেন। তবে যতদিন না তিনি অন্যায় ভাবে প্রফেসর ইউনূসকে নাজেহাল করার জন্যে প্রকাশ্যে সবার কাছে ক্ষমা চাইবেন - ততদিন তার প্রতি আমার কোন শ্রদ্ধা দেখাতে পারবো না।]
তাই নিজেকে নিয়েই শুরু করি। ইন্টারনেটে বর্তমানে সর্ব সাধারনের জন্যে বেশ কিছু 'সার্চ ইঞ্জিন' আছে যেমন - গুগল, ব্যাবিলন, বিং, ইয়াহু, আমাজন, টুইটার, ই-বে, উইকি, ইত্যাদি। এখানে যদি গুগল ব্যবহার করে বাংলায় লিখে 'সাইফ শহীদ' খোঁজ করি তাহলে ২ লাখের বেশী খোঁজ চলে আসে। এদের মধ্যে অবশ্য সাইফ আলি খান, শহীদ কাপুর এমন কি গাদ্দাফীর ছেলে সাইফ-এর উল্লেখ এসে যায়। তবে যদি এভাবে লিখি - "সাইফ শহীদ", তবে ৬০,০০০ -এর কিছু উপরে নেমে আসে এই সংখ্যাটা। আমার মনে হল এটাও বেশ বড় একটা সংখ্যা। হতে পারে ঠিক এই নামে আরও কেউ থাকতে পারে, তাই এক এক করে পৃষ্ঠা বদল করে দেখতে থাকলাম। প্রতি পাতায় ১০টি করে তালিকা দেয়া, ২৪ পাতার পর, অর্থাৎ ২৩২ টি তালিকার পর লেখা দেখালো যে একই রকম তালিকা হওয়াতে দৈত তালিকা দেখানো হয়নি তবে ইচ্ছা করলে সেটাও দেখতে পারি। ইচ্ছা প্রকাশ করার পর এবার ৫২ পাতা পর্যন্ত যেতে পারলাম। তার মানে প্রায় ৫০০-এর বেশী তালিকা। এগুলি সবই অবশ্য আমাকে নিয়ে তালিকা, তবে ৬০,০০০ সংখ্যাটি কি ভাবে এলো? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো বের করতে পারিনি।
ইংরেজীতে নাম লিখে সার্চ করতে গিয়ে প্রথমে এল ১০,০০০ উপরের তালিকা। তার থেকে সাহিদ কাপুর, কারিনা, সাইফ আলি খান, ইত্যাদিকে বাদ দেবার পরও ৩/৪ হাজার তালিকা পেলাম। ডাটা মাইনিং-এর কাজ হচ্ছে এই সব বিভিন্ন তালিকা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সঠিক ভাবে খুঁজে বের করা। বিভিন্ন ধরনের 'ফরমুলা' বা 'এলগরিদম' তৈরী করে এই বিশেষ খোঁজার কাজটি করা হয়। চার বছর আগের নির্বাচনে ওবামার দল এই তথ্য প্রযুক্তিকে খুব ভাল ভাবে কাজে লাগিয়েছিল। তারা মোটামুটি খুঁজে খুঁজে বের করেছিল এক এক জন ভোটারকে কি ভাবে চিহ্নিত করবে। যারা কখনই ওবামাকে ভোট দেবে না, বা যারা সব সময়ই তাকে ভোট দেবে তাদের পিছনে বেশী সময় নষ্ট করার মানে ছিল না। বরং যারা তখনও ঠিক করতে পারেনি কাকে ভোট দেবে তাদের পিছনে সময়, টাকা এবং প্রভাব খাঁটিয়ে গেছে যাতে তারা ওবামাকে ভোট দেয়।
আগেই বলেছি যে আমি কোন দলের সাথে নাম না লিখিয়ে নিজেকে স্বতন্ত্র বলে নাম লিখিয়েছি। গত নির্বাচনের কিছুদিন আগে আমি ওমাবার কোন এক বক্তৃতার পর মিডিয়াতে দেওয়া নাম্বারে একটা ছোট্ট টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম। তখনি আমার টেলিফোন নাম্বার তাদের ডাটাবেসে ঢুকে গেছে একটা নির্দিষ্ট ক্যাটাগ্যারিতে। যার ফলে এখনও মাঝে মাঝে আমার কাছে টেক্সট ম্যাসেজ আসে যখন ওবামা আমাদের শহরে বক্তৃতা দিতে আসবে বা আমার আগ্রহের বিশেষ কোন জিনিস ঘটতে যাচ্ছে। একবার ম্যাসেজ আসলো যে আমি যদি ওবামার সাথে ডিনার খেতে আগ্রহী তবে জানাতে - লটারী করে ঠিক করা হবে কাদের এই সুযোগ হবে। লটারীতে আমার বিশ্বাস নেই তাই উত্তর দেবার দরকার মনে করিনি।
সার্চ ইঞ্জিন ছাড়াও আরও উপায় আছে ডাটা মাইনিং-এর। ক্রেডিট রিপোর্টিং থেকে বের হয়ে আসে এক ব্যক্তি কোথা থেকে কত টাকা ধার নিয়েছে এবং কি ভাবে সেই ঋন শোধ করে যাচ্ছে। কোথায় কত টাকা কি ভাবে সে খরচ করছে সব খবর লিপিবদ্ধ আছে কোথাও না কোথাও। খোঁজ করতে যেয়ে দেখলাম আমার এক প্রফেসর বন্ধু ২৫ হাজার ডলার করে তিনবার রিপাবলিকান পার্টির ফান্ডে টাকা দিয়েছে। অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম কথাটা ঠিক। সে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত এবং তাদের এক বিশেষ স্বার্থের কারনে প্রতিষ্ঠানের জন্যে তার নিজের নামে টাকাটা দিয়েছে। অর্থাৎ 'বিগ ব্রাদার' সব কিছু তার নজরে রাখতে সক্ষম।
এবারের নির্বাচনে এই ডাটা মাইনিং যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বা হবে তা আর কখনো এত ব্যপক ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। আমরা যেন ক্রমেই জর্জ অরওয়েলের পৃথিবীতে প্রবেশ করছি। ওবামার সাথে সাথে রমনিও পিছিয়ে নেই এই ডাটা মাইনিং-এর কাজে। টেক্সাসের বাক্সটন কোম্পানী তার এই ডাটা মাইনিং ও এনালাইসিসের কাজে ব্যস্ত। ফেসবুক, টুইটার ও বিভিন্ন সামাজিক কার্যাবলী থেকে তথ্য সংগ্রহ ও শ্রেনীবিভক্তি করা হচ্ছে। যারা এবারে ভোট দিতে বেশী উৎসাহী নয় তারা হয়তো নির্বাচনের কিছু দিন আগে তাদের 'বন্ধুর বন্ধু' জাতীয় কারো কাছ থেকে ফোন পাবে জানতে চেয়ে যে সে ভোট দিতে যাচ্ছে কিনা। যখন শুনবে যে সে আগ্রহী নয়, তখন তাকে সুন্দর ভাবে বোঝানো হবে যে সে যদি ভোট না দেয় তার মানে তার চাইতে কম বোঝে এমন কাউকে হয়তো ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। কি ভাবে বোঝানো হবে, কতটা বোঝানো হবে - এসবই আগে থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এখনো নির্বাচনের ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোন ফোন পাইনি। তার মানে দুই দলই জানে যে আমি কাকে ভোট দেবো।
অথচ সত্যিই কি আমি জানি কাকে ভোট দেবো? আমেরিকা প্রবাসী আমার শ'খানেক বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সাথে কথা বলে যা বুঝেছি তা হচ্ছে যারা ভোট দেবে তাদের ৯৭% ওবামাকে ভোট দেবে। তা হলে আমি কেন চিন্তা করছি? আমার মাঝে অগ্রীম চিন্তা করার একটা খারাপ অভ্যাস আছে। তাই আমি ভাবছি ওবামা আবার প্রেসিডেন্ট হলে কি হতে পারে?
ধরলাম ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হল, কিন্তু কংগ্রেস এবং সিনেট দু'টাই রিপাবলিকানদের হাতে চলে গেল। কি ভাবে দেশ চালাবে সে? ২০০৮ সালে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল ওবামা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বুশের শাষন থেকে কতটা পরিবর্তন এনেছে সে এই চার বছরে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধ শুরু করতে কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হয়, যুদ্ধ থামাতে অনুমতির প্রয়োজন হয় না। ওবামা ক্ষমতা লাভের পর চাইলে কি তখনি যুদ্ধ থামাতে কি পারতো না? উল্টা আফগানিস্থানে আরও সৈন্য প্রেরন করেছে ওবামা। ৯/১১-এর ৩,০০০ মৃত্যুর বদলা নিতে যেয়ে ইতিমধ্যে ইরাক ও আফগানিস্তানে ৬,০০০ আমেরিকানের মৃত্যু ঘটেছে। মিশর, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, বাহরেইন, সিরিয়া - সব জায়গা এখন অশান্ত। এটা বুঝতে কষ্ট হয় না এগুলিতে আমেরিকার কোন হাত ছিল কিনা। আমেরিকার জনপ্রিয়তা বাইরের পৃথিবীতে আরো কমেছে। তা হলে লাভ কার হচ্ছে?
অনেক সাধারন আমেরিকানের ধারনা ওবামা আসলে মুসলমান এবং সমাজতন্ত্রী। এদের সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই - যুক্তি এবং প্রমান দিয়ে তাদেরকে বোঝানো খুবই দুরূহ। সমাজতন্ত্রের মানে এরা ঠিক মত বোঝে না। যারা এ দেশে সব চেয়ে বঞ্চিত তারাই যেন ওবামকে বেশী অপছন্দ করছে। ওবামা ব্যক্তিগত ভাবে খুবই বুদ্ধিমান, ধীরস্থির এবং সুন্দর বক্তা - যদিও রমনির সাথে প্রথম বিতর্কে তার তেমন কোন প্রকাশ ঘটেনি। ওবামার আগে থেকে কোন বড় প্রতিষ্ঠান চালাবার অভিজ্ঞতা ছিল না, না হলে হয়তো প্রথম থেকেই বেশ কিছু কার্যক্রম নিতে পারতো। সেই হিসাবে রমনি ঝানু ব্যবসায়ী এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে খুব একটা খারাপ চালাবে না। অনেক রকমের চিন্তা করে দেখলাম - আসলে নির্বাচনে যেই জয়লাভ করুক না কেন - দেশ যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে - কে তখন দেশের প্রেসিডেন্ট সেটা বড় কথা না।
আসলে কে চালায় আমেরিকা?
মন্তব্য
আমেরিকার নির্বাচনের বিষয়ে অন্য আরও চলামান বৈশ্বিক ইস্যুর মতই ‘জাস্ট কিছুটা’ খেয়াল রাখি। তবে আমাদের প্রবাসীদের উপর এর প্রভাব এবং প্রবাসীদের বিশ্লেষণে খুব আগ্রহী হই। আপনার লেখাটাও আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। যদিও খুব বেশি কিছু জানতে পারলাম না। ছোটখাট কয়টা মন্তব্যঃ
মাধ্যযুগের বায়বীয় ‘ফ্যাক্টরের’ বাইরে এসে অভজেক্টিভলি ব্যাপারটাকে দেখছে দেখে জো'র প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল। মনে হল আপনিই এই ফ্যাক্টরের বাইরে বের হতে পারেননি।
ইন্টারেস্টিং হল আইয়ুব খানও তার বেসিক ডেমোক্রেসিতে আমেরিকার 'ইলেক্টোরাল কলেজ'এর উদাহরণ দিয়েছিল। কিন্তু বেসিক ডেমোক্রেসি আর আমেরিকার সিস্টেমে ‘বেসিক’ পার্থক্য আছে। আইয়ুব খানের কথিত ‘বেসিক ডেমোক্রেটসদের’ উপর তার নিজের প্রভাব ছিল...। আমেরিকায় তা না।
ডিজিটাল বাংলাদেশতো যতদূর মনে পরে ভোটার আইডি কার্ড চালু হবার পরের আইডিয়া।
মিস্টার শহীদ, আমেরিকার নির্বাচনের বিশ্লেষণে আপনি যেভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারটা ‘গরু রচনা লিখতে গিয়ে গরুকে নদীতে নামাবার মত’ করে আনলেন, আমার মনে হয়েছে ‘আমাদের দেশের স্ট্যান্ডার্ডে’ আরেকটু ‘অর্গেনাইজড’ হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশে ভোট দিতে গিয়ে ভোট দেয়া হয়ে গেছে এমন ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু আপনার কথিত বন্ধুর ব্যাপারটার সময়, স্থান ইত্যাদি রহস্যময়ই রয়ে গেল
'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নাকি আমেরিকার চাইতেও এগিয়ে আছে। নাহ্, মিলল না। আরও ‘অর্গেনাইজড হতে হবে’।
হাত ধরাধরি করে হাঁটা 'অচেনা' পুরুষ-মহিলার কাছে যদি আপনি জানতে চান –‘কিছু মনে না করলে..., তোমরা কি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী’? তবে প্রশ্ন থাকে ডেটা-মাইনিঙের বিপক্ষে আপনার অবস্থান কেন?
(মন্তব্য সম্পাদিত)
সংখ্যাগত ভাবে বেশী ভোট পেয়েও কেউ বাংলাদেশেও প্রধান দল হিসাবে নির্বাচিত নাও হতে পারে - এইটা অধিকাংশ ডেমোক্রাসিরই বৈশিষ্ট্য।
ওবামা যে বুশের শাসন থেকে র্যাডিকালি পরিবর্তন আনতে পারে নি তার অনেক ভাল দিকও আছে। আমেরিকায় কোনোকিছুই র্যাডিকালি পরিবর্তন করা দুরূহ, কারণ অনেকগুলো ফ্যাক্টরের সামষ্টিক ফলের ওপর চলে দেশটা। দেশ যেই পথে চলছিল ওবামা তার থেকে উলটোপথে হাঁটছে, তাই মোড় ঘুরতে সময় লাগবেই। তা বলে বুশের সাথে ঠিক তুলনা চলেনা। রমনি ধনী মানুষ, তায় ল্যাটিনো আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোট খুব একটা পাবে না। নির্বাচনে রমনির জেতার সম্ভাবনা তাই খুবই কম।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
নতুন মন্তব্য করুন