আবোল তাবোল-২

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৫/২০১১ - ১২:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্য সবার মতই আমারো আকাশ ভালো লাগে। এখন তো আরো বেশি, কারণ সব বদলে যাওয়ার মাঝে আকাশটাই শুধু একই রকম রয়ে গেছে। ঢাকার মত দিগন্ত আটকে দেয়া ইমারত নেই বলে কখনো কখনো হয়তো একটু বেশিই মন কাড়ে। আর তাই বিকালে বা মাঝ রাতে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় কিংবা উড়তি পথে হোস্টেসের চোখ এড়িয়ে আইফোনের দায়সারা গোছের ক্যামেরা তাক করে একের পর এক আকাশের ছবি তুলে যাই। আকাশের ছবি তুলার ঝক্কি কম, কোনরকমমে কিছু মেঘ একটা ফ্রেমে ঢুকিয়ে শুট করে ফেললেই হলো।

কিন্তু এই চিরচেনা আকাশ একদিন চমকে দেয়। ম্যাক বার্গার কিনে ফিরছিলাম পার্কিং লটের মাঝ দিয়ে, ফ্র্যাটার্নিটি কোর্টের বিল্ডিং এর সামনে আন্ডারগ্রেডদের জটলা দেখতে দেখতে। কি ভেবে চোখ গেলো আকাশে। রোজকার মতই পেঁজা মেঘ, চোখ সরিয়ে নীল দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু না ওইখানেও মেঘ। তারপর দেখি পুরা আকাশ ঈষৎ ঘোলাটে মেঘে বন্দী, কোথাও একটু ফাঁকা জায়গা নেই। হঠাৎ করে মনে হতে থাকলো এই শহর আমাকে আটকে ফেলেছে, আমার আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো, তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে বাকিটা পথ আর উপরে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছালাম ডিপার্টমেন্টে। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা তাড়া করছে, আর আমি শেষ দরজাটা বন্ধ হওয়ার আগে কোন রকমে পালিয়ে এলাম।

আমার শহর জুড়ে গাছ আর গাছ। প্রথম রাতের কথা মনে পড়ে, অন্ধকারে রাস্তার দুইপাশে ঘন গাছের সারি দেখে মনে হচ্ছিলো বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ক্যাম্পাস হাউজিং এ থাকি, নাম হচ্ছে ওডাম ভিলেজ, নাম থেকেই স্পষ্ট এলাকাটা কেমন। এখানেও বিশাল এলাকা জুড়ে গাছ আর গাছ, তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু বাড়ি আর আমাদের গ্রামের মতই বাড়িগুলার মাঝ দিয়ে বিশাল উঠান। আমার অ্যাপার্টমেন্টটা তুলনামূলক ভাবে নতুন, বেশ আধুনিক ধাঁচের। ভেতরের ফার্নিচার গুলো বেশ সুন্দর, কাউচে শুয়ে বসেই আমার সময়ের বড় একটা অংশ কেটে যায়, জানালা খুলে দিলে বেশ পাখির ডাকও শুনা যায়। বাসার উল্টাদিকেই আপাতদৃষ্টে বেশ ঘন একটা জঙ্গল, এর ভেতরে একদিন ঢুকব ঢুকব করে আর কখনো ঢুকা হয়নি। পরে অবশ্য বুঝা গেলো, মাত্র পঞ্চাশ ফুট পরেই কিছু বাড়ি আছে, সুতরাং জঙ্গলে ঢুকার অতৃপ্তি মুছে ফেললাম। তবে যতই সবুজ দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে রাখুক, এলাকাটা আমার একদিনের জন্যও পছন্দ হয়নি, থাকতে হয় বলেই থাকা।

টাকা বাঁচানোর জন্য বা প্রতিবেশ বদলানোর জন্য এই হাউজিং ছেড়ে দিচ্ছি এমাস থেকেই। দুই দিন প্রাণপন খেটে সবকিছু পরিস্কার করে আরএ কে ডেকে এনে ছাড়পত্র নিলাম গতকাল। দেশ থেকে বয়ে আনা জিনিসের সাথে গত আটমাসের বেহিসেবী কেনাকাটার ফলে আমার ব্যাক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ অন্তত আয়তনে দাড়িয়েছে অনেক। সেগুলো নতুন বাসায় সরিয়ে রেখে এলাম একটু আগে। হাউজিং এ শেষ রাত। বেশ কদিন ধরেই বেশ খারাপ লাগা শুরু হয়েছে এই জায়গাটা ছেড়ে দিতে হচ্ছে বলে, যে জায়গাটা আমার একদিনের জন্যও নিজের বলে মনে হয়নি। অভ্যস্ততা?

চ্যাপেল হিল মাঝে মাঝেই আমাকে আটকে ফেলার ভয় দেখায়, আর আমি বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য নেশাগ্রস্তের মত হয়ে যাই। ওডাম ভিলেজের বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই শহরের বাইরে শপিং এ যাই, গিয়ে হয়তো তিন চার রকমের চকলেট কিনে ফিরে আসি, আর কিছু কেনার থাকেনা প্রায়ই। সামারে সবাই হয় বাড়ি গিয়েছে অন্য স্টেটে না হয় নিজের দেশে। আমি তবু বাসে চড়ে প্রতি উইকএন্ডে একবার ওই শপিং মলে যাই, গিয়ে চিক ফিলের বার্গার খেয়ে পরের বাস ধরে ফিরে আসি। বাসের ড্রাইভার চেহারা চিনে ফেলেছে, সে প্রায়ই আমাকে বলে, “ইউ আর অ্যা প্রিটি বিজি ম্যান”। আমি হেসে সায় দেই। মনে মনে বলি, “তুমি আর বুঝবে কি হায়...”।

এখন সামার, চ্যাপেল হিলের সামার ঢাকার সামারের চেয়ে কম কিছু নয়। গরমে প্রায় সেদ্ধ হওয়ার জোগার। তবে ভালো ব্যপার হচ্ছে আমার প্রফেসর চীনে গিয়েছে দিন দশেকের জন্য। সুবর্ণ সময়, তাই সে চলে যাওয়ার আগে দিন ছয়েকের ছুটি চেয়ে নিলাম, এবার বেড়িয়ে পড়ব চ্যাপেল হিল ছেড়ে। নিউইয়র্কের উঁচু বিল্ডিং গুলোর তলা গুণে, বোস্টনে এমআইটি আর হার্ভার্ডের বিল্ডিং গুলোর স্থাপত্য বিচার করে তারপর ডিসিতে কিছু "জরুরী" কাজ সেরে তারপর ফিরব; তখন না হয় নতুন করে আবার চ্যাপেল হিলের মোকাবেলা করা যাবে। সে পর্যন্ত, হে আমার নিয়তির শহর, বিদায়!

ছবি: 
09/06/2009 - 4:51pm

মন্তব্য

পাগল মন এর ছবি

আকাশের ছবিটাতে এই খাম্বাটা না থাকলে আরো ভালো লাগত। হাসি

আমার অবশ্য এখন যে শহরে থাকি সেটা বেশ ভালো লাগে, পাহাড়, সমুদ্র সব একসাথে আর খুব কম শহরেই পাওয়া যায়। তবুও শহরের আশেপাশের কয়েকটা শহরে ঘুরতে যাই মাঝেমাঝে। কিন্তু পাশ করার পরে আর এ শহরে থাকতে পারবো কিনা এ চিন্তা করে মাঝে মাঝে ভালো লাগে না। ঢাকার পরে আমার পছন্দের শহর এটা, ভ্যাঙ্কুভার।

সব বদলে যাওয়ার মাঝে আকাশটাই শুধু একই রকম রয়ে গেছে

কথাটা মনে হয় পুরোপুরি ঠিক না। ঢাকায় ধোঁয়ার জন্য আকাশ প্রায় সবসময় কালো হয়ে থাকে অথবা আকাশের নীল কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে থাকে যেটা এখানে নেই। এখানকার আকাশ অনেক বেশি নীল।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

সজল এর ছবি

খাম্বার ব্যাপার হইলো মেঘবন্দী একটা ভাব আনতে চাইছিলাম। আকাশ, মেঘ এইগুলা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ঠিক ঢাকার আকাশ বুঝাতে চাইনি, বাংলাদেশের কথা বললাম।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সচল জাহিদ এর ছবি

কখনো বলা হয়নি বোধয়, আপনি বেশ ভাল লিখেন। আপনার ব্লগর ব্লগর গুলিতে বেশ সবসময় একটা প্রচ্ছন্ন দুঃখবোধ থাকে, নিঃসঙ্গতা টাইপের, যেটা ভাল লাগে।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ জাহিদ ভাই, আপনার উৎসাহ আমার অনেক কাজে দিবে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

আমার তো কখনো আকাশ এক মনে হয় না, প্রতিদিন নিজের মেজাজের প্রতিচ্ছবি দেখি।

ভ্রমণ শুভ হোক, ছবি তুলেন দেদারসে।

সজল এর ছবি

হুম, আকাশ তো র‍্যান্ডম প্যাটার্ন। নিজের মনই ঠিক করে ওই খানে কী দেখতে চায়। শুভ কামনার জন্য ধন্যবাদ।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

অভ্যস্ততা কঠিন জিনিস, নিতান্ত অপছন্দের স্থান-কাল-পাত্রকেও আপন করে নেয়। ...

এই দিনলিপি সিরিজের প্রথম পর্বে কি ক্যাসিনো বিষয়ক আলোচনা ছিলো ?? মনে করতে পারছি না ঠিক, আবার আপনার লেখার স্টাইলে কেনো যেন ওই লেখার কথা মনে পড়ছে।

সজল এর ছবি

আপনি মনে হয় এটার কথা বলতে চাচ্ছিলেন। সিরিজ কিছু না, নতুন নাম মাথায় আসলো না, তাই...

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

‘আবোল তাবোল‘ ভালো লাগছে। আপনার লেখার ভঙ্গিটা চমৎকার। আশাকরি খুব শিঘ্রি আরো লেখা পাবো। অনেক ধন্যবাদ।

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

তিথীডোর এর ছবি

''মস্ত আকাশ, মস্ত সাগর, দিনে দিনে শুধু রঙ বদলায়...''♫♪

ভ্রমণ শুভ হোক। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সজল এর ছবি

ভ্রমণ শুভ হয়েছে। গানের লিংক দেন।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আয়নামতি1 এর ছবি

ভ্রমণ আনন্দময় হোক হাসি

সজল এর ছবি

ভ্রমণ আনন্দময় হয়েছে হাসি । ধন্যবাদ।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ফাহিম হাসান এর ছবি

যে কোন শহরেই বেশিদিন থাকলে আটকে ফেলার অনুভূতি হয়। মিল খুঁজে পেলাম।

সজল এর ছবি

তাই হবে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

পড়তে এসেছি এর ছবি

আকাশের বদলটা সত্যিকার অর্থে কি আকাশের বদল! বদলায় তো শুধু আমাদের চোখ ও আকাশের মধ্যে যা থাকে তাই। যেমন মেঘ, ধুলো আর ধোঁয়া। এরাই আমাদের বাধা দেয় আকাশকে চিনতে, চেনা মুখকে আড়াল করে।
তিথীডোর এর গানটা বেজে চলেছে নিউরনের ফাঁকফোকরে, মৌসুমী ভৌমিকের, 'যখনি একটু ছুটি পাই', গানটা চমৎকার একটা গান।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ 'পড়তে এসেছি'। গানটা আর পেলামই না।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নাফিস  এর ছবি

ভাইয়া, এত সুন্দর করে কিভাবে লেখেন?? অসাধারন!!!!!!

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ নাফিস হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।