খেলিছো হাঁড়ি লয়ে-২

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: বুধ, ১৫/০৬/২০১১ - ১০:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খেলিছো হাড়ি লয়ে-১

মানুষ যেভাবে বাঁচে

মাছ মাংস সবই যখন টুকটাক রান্না করে খাওয়ার মত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারছিলাম বেশ আলেকজান্ডারের মত বিজয়ানুভূতি হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুদিন যেতেই যখন দেখলাম যাই রান্না করি, তার স্বাদ একই রকম হচ্ছে, তখন আর আগ্রহ ধরে রাখতে পারলাম না। সে এমনি রান্না যেখানে আমিষ নিরামিষের পার্থক্য ঘুঁচে যায়। কত মুরগীর মুরগী জনম বৃথা গেলো আমার হাতে পড়ে, তার ইয়ত্তা রাখে কে!

আলেকজান্ডার যেখানেই রাজ্য জয় করত, একটা করে নগরীর নাম আলেকজান্দ্রিয়া রেখে দিত। ভাগ্যিস ব্যাটা গঙ্গার পাড়ে থেমে গিয়েছিলো, তা না হলে আমি আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মে উচ্চশিক্ষার্থে আলেকজান্দ্রিয়ায়ই যেতাম। আমি আলেকজান্ডার না, তাই অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে একই রান্না রাঁধা আমার পোষালো না। রক্ত ঝরানোর ব্যাপারটা হলো, রান্নার পূর্বরাগে কাটাকুটি করতে গিয়ে বাহাতের আঙ্গুলগুলো ফালাফালা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আলেকজান্ডারও রক্ত ঝরাত, তবে বেতনভূক সৈন্যদের, আমার মত নিজের রক্ত ঝরিয়ে রাজ্য-জয় করতে হলে অনেক আগেই কৌপিন পড়ে সন্নাস নিয়ে নিত।

কিন্তু বাঁচতে হলে (জানতে) খেতে হবে। বিকল্প অনুসন্ধান করে দেখা গেলো হয় নিয়মিত বাইরে খেতে হবে, না হয় মাইক্রোওয়েভ রেডি খাবার নৈপুণ্যের সাথে গরম করে খেতে হবে। কিছু দিন বাহারি ছবিওয়ালা প্যাকেট লাঞ্চ কিনে গরম করে খেয়ে দেখলাম। প্রচন্ড অবাক হলাম এটা ভেবে মানুষ কী করে এত সুন্দর দেখতে কিন্তু খেতে ভয়ানক খাবার তৈরী করতে পারে! সসের মূল উদ্দেশ্য যদি কেউ খাবার সুস্বাদু করা ভেবে থাকে, তার ভুল ভাঙ্গার জন্য এই রকম কয়েক প্যাকেট খাবার মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে কাজ করবে, আমি নিশ্চিত।

প্যাকেজ ফুডে বেশি দিন পোষাল না, প্রতিবেশি ও বন্ধু ড্যানিয়েলের পাল্লায় পড়ে তাই বাইরে খাওয়ার অভ্যাসই গড়ে উঠতে শুরু করলো। আমি হয়তো নিজেক শাসাই, “দরীদ্র গ্র্যাড স্টুডেন্ট, বাইরে খেয়ে এত টাকা যে উড়িয়ে দিচ্ছ, তা কি ঠিক হচ্ছে?”, কিন্তু ড্যানিয়েলের কাতর অনুরোধ উপেক্ষা করি এত পাষণ্ডতো আমি কখনোই ছিলাম না। মনে পড়ে, হলের খাবারের তালিকায় থাকা বৈচিত্র্যময় প্রাণীসম্ভারের বেশিরভাগ দ্রব্যমূল্যের উল্কাপাত সহ্য করতে না পেরে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে হতে যখন শুধুমাত্র পাঙ্গাস আর তেলাপিয়ায় এসে থামলো, তখন গোটা দুই টিউশনি আর সফটওয়্যারের দোকানদারির বাবদে পাওয়া টাকার সবটা উড়িয়ে দিয়ে স্টার আর নান্না মিয়ার দোকানে গিয়ে কোনরকমে প্রাণ ধারণ করতাম। শুরুতে একা একা যেতে ভালো লাগতো না, তাই একে ওকে সাধতাম। বেশিরভাগ সময় ব্যাপারটা ‘হিজ হিজ হুজ হুজ’ থাকায় পাষণ্ড বন্ধুগুলা যেতে ক্রমাগত অস্বীকার করতে থাকলে প্রায় সময় একা একাই খেতে যেতে হত। তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একজন বেটার হিউম্যান হওয়ার খাতিরেই বাইরে নিয়মিত খেতে শুরু করি।

কিন্তু সমস্যা হলো, চ্যাপেল হিলে একটা মাত্র ব্যস্ত রাস্তা জুড়েই যাবতীয় রেস্তোরা আর বার। ঘুরে ঘুরে একেক দিন একেক রেস্তোরাতে যেতে যেতে খুব তাড়াতাড়িই দেখলাম প্রায় সব রেস্তোরাতে খাওয়া হয়ে গেছে। মেক্সিকান দোকানে এতবার গিয়েছি যে ক্যাশিয়ার আমার নাম পুরোপুরি সঠিক ভাব উচ্চারণ করতে পারে। ম্যাকডোনাল্ডসের মেন্যুর দিকে না তাকিয়ে এখন নাম্বার দিয়ে খাবার চিনতে পারি। ভিয়েতনামিজ, মালয়েশিয়ান, ইন্ডিয়ান, মেডিটেরেনিয়ান এভাবে পুরো বিশ্ব জয় হয়ে যায় অল্প সময়ে, আর বিজয়ের পথ ধরে আসে ক্লান্তি; প্রতিবেলা কোথায় খেতে যাবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার গুরুভারের সাথে। আমার একটা বহুজাতিক বন্ধু সার্কেল আছে চীনা, ভারতীয়, অ্যামেরিকান আর বাংলাদেশি মিলে। অ্যামেরিকান বন্ধু তার জাতিসত্ত্বার সাথে বেমানান রকম ভাবে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার অভ্যাস থেকে মুক্ত হয়ে অন্যদের উপর এই গুরুভার চাপিয়ে দিতে চায়। তখন চীনা বন্ধুর বিদগ্ধ মতামত আশা করলে সে তার সমস্ত প্রজ্ঞা খাটিয়ে জাপানি দোকানে সুশি খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, আমি তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ওর হাতে যাওয়ার আগেই কোন একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করি। ভারতীয় বন্ধু আমাদের কাফেলায় যোগ দিতে দিতে আমরা সিদ্ধান্তে নেয়ার স্টেপ পার করে রেস্তোরায় ঢুকে পড়ি প্রায়ই, তাই এই গুরুদায় হতে সে মুক্ত। আর আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে অর্জিত জ্ঞানের কিছুটা কাজে লাগিয়ে র‍্যান্ডম নাম্বার জেনারেশনে লেগে যাই, তারপর র‍্যান্ডমলি একটা রেস্তোরা নির্বাচিত।

একদিন কোন ভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে ড্যানিয়েল আমার কাছে কয়েন চেয়ে নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে মারলে আমি টান টান উত্তেজনা নিয়ে শিনের দিকে তাকাই, সপ্তাহ ঘুরার আগেই সুশি খেতে হবে কিনা তা নির্ভর করছে শিন হেড না টেইল কল করবে তার উপর। আইনস্টাইন বলেছিলেন, “গড ডাজ নট প্লে ডাইস”। ওয়েল, হি ডাজ নট হ্যাভ টু ঈট আইদার।


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

আপনার বন্ধুগুচ্ছ তো সেরকম দেখি!

চালিয়ে যান, যে কোন এক দিকে মোক্ষলাভ অনিবার্য। হয় চরম সুস্বাদু বস্তু রাঁধতে শিখবেন, নয় মাইক্রোওয়েভের প্যাকেট খাদ্য খেয়েও প্রাণ ধারণ করা যায় সেটা প্রমাণ করবেন, আর নয়তো বাইরে খেয়েও "দুঃস্থ এবং বেচারা" (উভয়ার্থে Poor) গ্র্যাড স্টুডেন্ট বাঁচতে পারে সেটা দেখাবেন...

সজল এর ছবি

নামের আগে যেন বেচারা না লেগে যায়, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

পড়ুয়া এর ছবি

আহারে এত কষ্ট!

সজল এর ছবি

এত কষ্টের কিছু না আসলে, মূল ব্যাপার আলসেমি।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

কৌস্তুভ এর ছবি

হো হো হো

পাণ্ডবদা কি কয়েছিলেন সেটা আমি নাহয় এখানে আর না-ই বললাম...

পাগল মন এর ছবি

কয়া ফ্যালেন। কথা প্যাডের মধ্যে রাখতে হয় না। চোখ টিপি

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সৎ পরামর্শ কেউ কানে তোলে না গো দাদা!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সজল এর ছবি

অমাবস্যা-পূর্ণিমায় কাটা লেজের জায়গায় ব্যাথা করে বলে পান্ডবদা না হয় এই পরামর্শ দেন, সেটা বুঝি। কিন্তু নিজের লেজ কাটার আগেই যে কেন কৌস্তুভ অন্যের লেজ নিয়ে টানাটানি করেন কিছুই বুঝি না চোখ টিপি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অপছন্দনীয় এর ছবি

"ঐ পাতে দৈ দাও" জানেন তো?

পাগল মন এর ছবি

মজা পেলাম পড়ে।
আমি অবশ্য নিজেই রান্না করি, দরিদ্র ও দুঃস্থ গ্রাজুয়েট ছাত্রের আর কী-ই বা করার আছে? মন খারাপ
তবে আমার রান্না এতটা খারাপ হয় না, আমিষ, নিরামিষ আলাদা করা যায়। চোখ টিপি

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

সজল এর ছবি

আপনার তাইলে রান্নার প্রতিভা আছে! সাবাশ, একদিন বড় রাধুনি হয়ে দেখিয়ে দিন হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

একজন পাঠক এর ছবি

ঘরে খান, পয়সা বাঁচান। একজনের জন্য one-pot meal ভাল চলবে। একটা pressure cooker কিনতে পারেন। তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে যায়। hippressurecooking dot com তে গুতো দিয়ে দেখতে পারেন।

সজল এর ছবি

পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। রান্নার যোগাড় থাকে সব সময়ই, শুধু শুরু করে দিলেই হলো।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আশালতা এর ছবি

সিদ্দিকা কবিরই হোক বা অন্য যেকোনো কুকবুক, সেটা ফলো করার প্রথম শর্তই হল বইএর একদম প্রথম থেকে পড়া শুরু করা । সরাসরি রেসিপিতে চলে গেলে সমস্যা হবেই । কারণ অনেক রান্নায়ই অনেক রকম টার্ম ব্যবহার করা হয় যেগুলো না বুঝলে ঐ রান্না করা সম্ভব নয় । সিদ্দিকা কবিরের বইটা যথেষ্টই ভালো এদিক থেকে । বইএর প্রথম দিকে এই টার্মগুলো সুন্দরভাবে ডিটেল দেয়া আছে ।
আপনি মাপ ঠিক করার জন্য মেজারিং কাপ এবং চামচ এর সেট কিনে ফেলুন । এতে দুনিয়ার যেকোনো রেসিপি ফলো করতে ব্যপক সুবিধে হবে । রান্নার টেস্ট প্রতিবার একিরকম হবে । টেনশন কমবে ।
মশলাগুলোর ইংরেজি নাম কিন্তু ঐ বইয়েই দেয়া আছে ।তারপরও সমস্যা থাকলে আওয়াজ দিবেন, ফ্রী উপদেশ দিতে আমি খুব ভালবাসি দেঁতো হাসি

আর হ্যাঁ, লেখা অতীব ভালো হয়েছে ।
হ্যাপি কুকিং হাসি

সজল এর ছবি

মেজারিং সেট কিনেছিলাম, ব্যবহার করা হয় না বলে কিছুদিন আগে বাসা পাল্টানোর আগে ফেলে দিলাম। কিনতে হবে সামনে। বইএর শুরুতে এই ইনফরমেশনগুলো আছে, সেটা কাজে লাগবে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অপছন্দনীয় এর ছবি

ওহ, আর অভিজ্ঞতায় বলে বই পড়ে রান্না হয়না। সিদ্দিকা আন্টির মত মিলিগ্রাম মেপে মশলা দিয়ে যে বস্তু তৈরী হয় সেটা সময়ের সাথে পালটে যায়, কারণ কিছু মশলার ফ্লেভার তার উৎপত্তিস্থল আর বয়সের উপরে পালটায়। এই ক্ষেত্রে দরকার পড়ে নিজের চিন্তা, হিসেব, আন্দাজ আর এক্সপেরিমেন্টাল মনোভাব। এই আমি যেমন দেখুন, সম্পূর্ণ মশলাবিহীন রান্না করে খাই দেঁতো হাসি

সজল এর ছবি

মশলাই যদি না দিবেন, তাইলে আর রান্নার ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী? ক্ষুধা পেলে গ্রোসারি শপে গিয়ে সবজি, মাছ মাংস পরিমাণ মত চিবিয়ে খেয়ে আসবেন।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অপছন্দনীয় এর ছবি

দারুণ আইডিয়া! এটা মাথায় আসেনি। কালকে থেকেই শুরু করবো, অনেক ধন্যবাদ হাসি

আশালতা এর ছবি

কে বলে বই পড়ে রান্না হয়না ? হওয়াতে পারলে খুব হয়, দিব্যি হয় । অবশ্য 'বই' টা এখানে একটা ফ্যাক্টর । আমার কাছে একটা বই আছে যেটায় বেশনের লাড্ডুর রেসিপিতে আছে- 'আন্দাজ' মত ঘিয়ে বেশন দিয়ে 'খানিক' 'টেলে', 'আন্দাজ' মত চিনি দিয়ে 'গড়ে' নিতে হবে । এরকম বইএর 'অভিজ্ঞতায়' পড়লে যে রান্না হবেনা, তা বেশ বলা যায় ।

হিসেব আর আন্দাজ একদম ফার্স্ট লেভেলের রাঁধুনিদের অভিজ্ঞতা তিক্তই করে শুধু । এগুলো বেসিক জ্ঞান সম্পন্নদের জন্য। আর মশলা বা অন্য উপকরনের বয়েস বা ফ্লেভার প্রশ্নযোগ্য হলে সেগুলোর জায়গা সোজা ডাস্টবিনে, রান্নায় নয় ।

উপকরনের গুণাগুণ সামান্য হেরফের হলেও রেসিপিমত ঠিকঠাক মেপে দিলে আর স্টেপগুলো ঠিকমত ফলো করলে সেটা অখাদ্য হবার কোন কারণ নেই । রান্নায় মাপ এবং কিছুক্ষেত্রে স্টেপ খুব জরুরী, ফলো না করলে রান্না ঠিক হবেনা । প্রথম কিছুদিন হাত পাকিয়ে 'ভাও' বুঝে নিলে তারপর ইচ্ছেমত চিন্তা আর এক্সপেরিমেন্ট করা যায় ।
তবে মশলা না খেলে তো ঝামেলাই নাই । না রাহেগা বাঁশ, না বাজেগি বাঁশ্‌রি !

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

রান্নার মতো একটা দারুণ ক্রিয়েটিভ কাজরে মানুষ এতো অবহেলা করে ক্যান বুঝি না। আমার তো রান্না করতে দারুণ ভালো লাগে

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সজল এর ছবি

যে পারে সে কখনোই বুঝবে না...

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ফাহিম হাসান এর ছবি

আমিও আনাড়ি বাবুর্চি। আসেন কোলাকুলি করি কোলাকুলি

সজল এর ছবি

চলেন হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।