১।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লে মানুষ অনেক কিছু করে। আমি ঠান্ডা মাথায় ব্রাউজার খুলে মোশন প্ল্যানিং এর টিচার রনকে ইমেইল করে বললাম, “তোমার কোর্সের ফাইনাল প্রজেক্ট আগামী চার দিনে আমি কমপ্লিট করতে পারব না, ইনকমপ্লিট দিয়ে দাও”। সেটা গত ফল সেমিস্টারের কোথা। সেই ইনকমপ্লিট প্রজেক্টকে কমপ্লিট করার নিমিত্তে রনের সাথে প্রায় পনেরো-ষোলটা ইমেইল চালাচালি করে গতকাল দ্বিতীয়বারের মত দেখা করা গেলো।
একাডেমিক মিটিংগুলোতে সত্যিকার অর্থে আমার বলার কিছু থাকেনা, আমি ব্যাপারগুলোকে আনুষ্ঠানিকতা হিসাবেই দেখি। তাই রুমে ঢুকে প্রথমেই, “কিরাম আছ? গরম কিরাম লাগে?” ধরনের স্মলটক শুরু করলাম। কিন্তু এইসব করেতো পাঁচ মিনিটও কাটানো যায় না। তাই কাজের কথা খুঁজতে শুরু করি। টেবিলের উপর একটা কাচের পাত্রে কতগুলা চকলেট রাখা, সেদিকে আরোপিত নির্মোহ দৃষ্টিক্ষেপ করি। রন আমাকে চকলেট সাধে, আমি নিতান্ত অনিচ্ছার সাথে একটা চকলেট তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে খোসা ছাড়িয়ে মুখে দেই। কাজের কথায় তাড়াহুড়া করা নিষেধ, আমি তাই চকলেটের স্বাদ আস্বাদনে কিছুটা সময় দেই।
প্রজেক্টের বিষয় একটু তান্ত্রিক ঘরানার। মানুষের মাথার খুলির কিছু অংশ রোবট দিয়ে খুঁড়ে ইনফেক্টেড টিস্যু ফেলে দিতে হবে। এই খনন কাজ যেহেতু জীবিত মানুষের খুলিতে চলবে, তাই খনন কাজটা তাড়াতাড়ি সমাধা করার জন্য একটা অপটিম্যাল ত্রিমাত্রিক পথ পরিকল্পনা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, “সহজ অ্যালগরিদমটি যায়না পাওয়া সহজে”, আর অনেকদিন হলো আমি মাথাটাথা খাটানোর মত নিরর্থক কাজ করি না। তাই, মোটামুটি কোন ধারণা ছাড়াই মিটিং করতে গেছি। খালি মাথা হচ্ছে আমার জন্য সৃজনশীলতার (ভাব দেখানোর) পূর্বশর্ত। তাই হড়বড় করে একগাদা অ্যালগরিদমের আইডিয়া দিতে থাকলাম। রন মনে হয় তেমন একটা বুঝতে না পেরে কিছুটা ইমপ্রেসডই হয়ে যায়।
২।
ভর দুপুর, চারদিক এমনিতেই খা খা করে। অফিসে বসে আমারো কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। কিছুক্ষণ মনের অলিগলি খুঁজে বুঝলাম, অফিসে আসার সময় বাসে চাপিয়ে আনা সাইকেল বাস থেকে নামাতে ভুলে গেছি। এর মাঝে পেরিয়ে গেছে ঘন্টা দুয়েক। মোটামুটি আশা ছেড়ে দিয়েই চ্যাপেল হিল ট্র্যানজিটে ফোন দিলাম, ভদ্রলোক বলল ডিপোতে থাকতে পারে, ওইখানে গিয়ে দেখো। আমি যথাশীঘ্র সম্ভব সাইকেল উদ্ধারের সংকল্প স্থির করে ফোন রাখলাম।
সেই যথাশীঘ্র সময়টা আসতে আসতে মাস খানেক পেরিয়ে গেলো। যাইহোক আইফোনের পঞ্জিকা দেখে একটা শুভদিন স্থির করে এনএস রূটের বাসে চরে বসলাম। তারপর মোটামুটি সভ্যতার শেষপ্রান্তে বাসের শেষ স্টপে এসে নামলাম। ম্যাপ দেখে দেখে ডিপোর উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার অন্যপাশে ফুটপাথ আছে, এদিকে সাদা দাগ টেনে আলাদা করা চিকন সোলডার আর সোলডার ঘেষে জংলী ঘাসের চত্বর। সোলডার আর ঘাসের উপর দিয়েই হাঁটতে লাগলাম, চ্যাপেল হিলের ড্রাইভারেরা ভদ্রলোক বিশেষ, ধাক্কা দিলেও বেশি জোরে দিবে না ধরে নিয়ে অল্প একটু রিস্ক নিয়েই নিলাম।
একটা দুইটা সরকারী বেসরকারী অফিস বাদ দিলে মোটামুটি বিরাণ এলাকা ধরে হাঁটছি। মিনিট পাঁচেক পরেই বেশ পরিপাটি ফুটপাতে উঠে এলাম। দুই দিকেই লম্বা গাছের সারি, বামদিকে গাছের গা ঘেষে একটা রেল লাইন অনেক দূরে চলে গেছে। চকিতে মনে পড়ল প্রায় বিশ বছর আগের কথা। ছয়/সাত বছরের তখন, মাথায় বুদ্ধি পুরোপুরি গজিয়ে উঠতে পারেনি তখনো। হৃদয় আকৃতির একটা বিশেষ কেক (ঈমানে বলি তখন এত কিছু বুঝতাম না, ভাবতাম পানপাতার মত) কেনার জন্য বাসা থেকে অনেক দূরের একটা বেকারিতে হেঁটে হেঁটে চলে গেছি। বেকারী বন্ধ পেয়ে দুর্দান্ত সাহসে ভর করে কখনো যাইনি এমন একটা রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ করে পৌঁছে গেলাম একটা রেল লাইনে, রেল লাইন অনেক দূরে চলে গেছে, কিন্তু আশেপাশে আর কিছুই নেই। হঠাৎ করে মনে হলো পৃথিবীর শেষ মাথায় পৌঁছে গেছি। বাড়ির পথও গেছি ভুলে, আর একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি হলো, আমার আর কখনো বাড়ি ফেরা হবে না। এত বছর পরে, এত হাজার মাইল দূরে হঠাৎ করে সেই একই অনুভূতি ফিরে এলো।
ডান দিকে একটা খাল গাছের ফাঁকে ঘন জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। একটা জায়গায় জঙ্গল কিছুটা হালকা। ফাঁকা চত্বরে কিছু হার্ডওয়্যার পড়ে আছে, কিন্তু কোথাও কোন মানুষ নেই। হলিউডি অ্যাপোক্যালিপটিক সিনেমার দৃশ্য উঠে এসেছে যেন। আরেকটু এগোতে বৈদ্যুতিক বেড়া দিয়ে আটকানো ক্ষেত আর মাঠ। একটা মাঠে আবার কতগুলো গরু চড়ে বেড়াচ্ছে, বেটাদের (বেটিদেরও হতে পারে, দূরত্বের কারণ জেন্ডার নির্ণয় সম্ভব হয়নি) স্বাস্থ্য দেখে হিংসাই হলো। বেড়ার গায়ে লেখা “বৈদ্যুতিক বেড়া! তফাত যাও!”। গরুগুলোর ইংলিশ পড়তে পারে কিনা কে জানে, না জানলে বেচারাদের চামড়ায় খারাবিই আছে।
CHT এর অফিসে গিয়ে দোতলায় উঠে দেখি কোথাও কেউ নেই, রিসিপসনিস্টের টেবিলে রাখা একটা ঘন্টা ছাড়া। মনের আনন্দে ঘন্টা বাজিয়ে দিলাম, বাতাস হয়ত অনেক হালকা, তাই পাশের ঘরে শব্দ পৌঁছাতে মিনিট পাঁচেক লেগে গেলো। সাইকেল হারানোর কথা বলতেই সাইকেলের গ্রেইভইয়ার্ডে নিয়ে গেলো, কোন আইডি দেখতে না চেয়েই বলল, তোমার সাইকেল বেছে নাও। ইচ্ছামত ভালো দেখে একটা সাইকেল বেছে নিয়ে সটকে পড়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ, কিন্তু এই ভুলোমনা সাইকেল মালিকেরা দেখা যায় আমার চেয়েও ফকির। অগত্যা কি আর করা, সুযোগের অভাবে সততার পরিচয় দিয়ে নিজের সাইকেল নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
পরের সোমবার, ফোনে কথা বলতে বলতে একটা ডাইনিং হলে ঢুকছি, হঠাৎ মনে হলো কি জানি ফেলে এসেছি। পরের কাহিনী জানতে আগ্রহীরা শুরু থেকে আবার পড়তে পারেন।
মন্তব্য
আপনার এত ভুলোমন, তো কথা হোল আগ্রহীরা কবার করে উপর থেকে পড়বে ?
প্রথম বার বাসের পিছনে কিছুটা দৌড়েই সাইকেল পেয়ে গেছিলাম, তাই এই কাহিনী দুইবার পড়লেই হবে
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আমার মত ফাঁকিবাজি করে আর কয়দিন?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
বেশি দিন না, খুব শীঘ্রই গ্র্যাডস্কুলকে বিদায় জানাচ্ছি।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
বিদায় কেন? পিএইচডি শেষ নাকি?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
হাহা মজা পাইসি।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
মাস্টার্স করার সময় আমি বাসা থেকে সাইকেলে যাতায়াত করতাম। ওয়ালমার্টের সাইকেলগুলোর তুলনায় আমার সাইকেলটা বেশ ভাল মানের ছিল। আমি সাইকেলটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম এক নেপালি বন্ধুর কাছ থেকে। সে পেয়েছিল আরেক নেপালি বন্ধুর কাছ থেকে। সেই নেপালি বন্ধুটি আবার সাইকেলটা কিনেছিল এক আমেরিকান বন্ধুর কাছ থেকে। আমি আবার আসার সময় সাইকেলটা দিয়ে এসেছি এক বাংলাদেশি ছাত্রকে। ইকোনো লেখে চমৎকার, এক কলমে মাইল পারের মতো করে আমরা এক সাইকেলে কয়েক জীবন পার করে দিয়েছিলাম।
বাসা থেকে সাইকেলে ল্যাবে যেতে সবমিলিয়ে মিনিট পাঁচেক সময় লাগতো। আমি কেন জানি আস্তে সাইকেল চালাতে পারতাম না। বাসা থেকে ল্যাবের রাস্তার অর্ধেক ছিল আপ স্লোপ। ওইটুকু রাস্তা চালাতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলে তখন রিকশাওয়ালাদের মতো করে বাকি রাস্তা প্যাডেলের উপর দাঁড়িয়ে থেকে জিরিয়ে নিতাম। সাইকেল চালানো অবস্থায় আমার সেই হাস্যকর দাঁড়ানোর ভঙ্গী দেখে আমার বউ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেত।
আমি এই আপস্লোপ এড়ানোর জন্য যাওয়ার সময় বাসে সাইকেল তুলে দেই। প্যাডেলের উপর দাঁড়ানো শিখতে হবে দেখি!
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
একেবারে জাত রসিকতা আপনার হাতে! কত নির্ভার !
ধন্যবাদ সাত্যকি!
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আপনার আবল তাবল লেখা অনেক ভালো লাগলো কিন্তু!!
__________
বুনোফুল
ধন্যবাদ বুনোফুল।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আমার সাইকেল নিয়ে সকল অভিজ্ঞতাই মর্মান্তিক। ছোটবেলা একবার সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে এক বন্ধুকে ড্রেনে ফেলে দিয়েছিলাম। আরেকবার এক পিচ্চির গায়ে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। আরেক বন্ধুর সাইকেল ছিল। পাবলিকের মাইরের হাত থেকে বাঁচার জন্য সাইকেল ফেলে চলে এসেছিলাম। পরে ওই বন্ধু গলদঘর্ম হয়েছে সাইকেল উদ্ধার করতে গিয়ে
লেখার শুরুতে একটা while অথবা for i=1:inf কমান্ড দেয়া উচিৎ ছিল। ভাগ্যিস আপনার এই লেখা কোন সর্দারজী পড়বে না। ওদের সম্পর্কে প্রচলিত কৌতুক আছে, কোন সর্দারকে একটা খালি পৃষ্ঠার উভয় পাশে PTO (Please Turn Over) লিখে দিলে সারাদিন নাকি ব্যস্ত হয়ে পাতা উল্টাতেই থাকে।
আমি বুড়ো বয়সে সাইকেল চালানো শিখলাম। তবে এরই মাঝে তিনবার সিরিয়াস রকম আহত হয়েছি।
ইটারেশনে না দিয়ে রিকারশনে দিয়ে দিলাম আর কি
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
যাক, অনেকদিন পরে পদধূলি দিলেন - তাও চক্রাকার ফাঁকিবাজি মার্কা পোস্ট!
ছবি দেখে, পোস্ট পড়ে এই গ্রীষ্মে আমারো সাইকেল কেনার খায়েশ হচ্ছে।
------
বি দ্র: বাসে চরে বসলাম > বাসে চড়ে বসলাম
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আরে, লিখেতো ফাটিয়ে দিচ্ছি। এই মাসেই তিনটা লেখা দিলাম।
সাইকে চালানোর জন্য সামার বেস্ট।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
খুব মজা পেলাম পড়ে। পরের সোমবারের কাহিনী বলতে গিয়ে যখন আবার শুরু থেকে পড়তে বললেন, তখন ব্যাপক হাসি পেল, যদিও আপনার জন্য আরো একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল। এভাবেই লেখা জুড়ে আপনি হেসেছেন খুব কম, কিন্তু পাঠককে হাসিয়েছেন বিস্তর!
আচ্ছা, ছোটবেলায় যখন রেললাইনের ধরে চলে গিয়েছিলেন, পরে নিজেই পথ চিনে বাসায় পৌঁছতে পেরেছিলেন?
ধন্যবাদ কাজি মামুন। উলটো দিকে ঘুরতেই একটা বাজারে পৌঁছে গেলাম, তারপর এক ভদ্রমহিলাকে বললাম, "আমি হারিয়ে গেছি"।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
সজলদা, এই লেখাটা ভালো লাগল। নিছক বকরবকর একে বলতে পারছি না। দ্বিমত পোষণ করছি।
-এটা বকরবকর নয়।
আমি বিসিএস পরীক্ষার এডমিট কার্ড প্রিন্ট করতে গিয়ে পেনড্রাইভটা খুইয়েছি। পরে অনেক বলে কয়েও উদ্ধার করতে পারিনি। ওতে বিসিএস এর যাবতীয় ডকুমেন্ট ছিল, ডিলানের ডিস্কোগ্রাফি ছিল। বাংলাদেশের ৯৮% মানুষ সৎ জাফর ইকবাল স্যারের এই বাস্তবতাবর্জিত উক্তি আমি সমর্থন করার কোন কারণ জীবনে খুঁজে পাই নি। ওই লোকটা মোটামুটি ভাল বেতন পেয়েও একটা আটশো টাকা দামের পেনড্রাইভের লোভ সামলাতে পারল না! আমার দেশের মানুষকে আমি এভাবে দেখতে চাই না। জায়গামত যারা আছে তাদের অধিকাংশই চূড়ান্ত অসৎ- এই সত্য বললে আমার দেশপ্রেম কমে যাবে না! আমাদের কলেজে ৫ বছরে ৩ জন প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন- এর মধ্য দুজন চোরের চোর, আরেকজন উন্মাদ এবং শিবিরের কমিশনখোর! প্রশাসনের বাকি লোকগুলোও ছিল তেমনি। এবং এই খারাপ লোকগুলো মাত্র ২% না। অধিকাংশ লোকই অপকর্ম করছে এবং দোষ ঢাকতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ততোধিক নগ্ন দুর্নীতির উদাহরণ দিচ্ছে! ২% ধরে নিলেও ১৫ কোটি লোকের ২% মানে কিন্তু ৩০ লাখ! এই পরিমাণ দুর্নীতিবাজ একটা দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট!
নতুন মন্তব্য করুন