হারানো বছর

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: শুক্র, ০৬/০২/২০১৫ - ৪:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উচ্চশিক্ষার অকালসমাপ্তি করে একটা টিউবে মাস্টার্সের সার্টিফিকেট আর দুই লাগেজে স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি ভরে বছর দুই আগে চ্যাপেল হিল ছেড়েছিলাম। সেই থেকে মোটামুটি অস্তিত্ব থেকে ইলোপ হয়ে গিয়েছিলাম। সব সময় পরিকল্পনা মত সবকিছু হলে যা হয়, অনাকাঙ্খিত ব্যার্থতা গ্রহণ করার সক্ষমতা গড়ে উঠে না। বিদেশ বিভূঁই, যেখানে পায়ের নিচের মাটি সতত সরণশীল, এই ব্যাপার শেখার আদর্শ পরিবেশ না। তাই গত দুই বছর নিজের মুখোমুখি হইনি, বাইরের দুনিয়ার সাথেও যোগাযোগ ছিলো অনেকটা মৌলিক প্রয়োজন মাফিক। তা, আটলান্টিক থেকে প্যাসিফিক আর প্যাসিফিক থেকে আটলান্টিক পারাপার করতে করতে এক সময় মনে হলো, অনেকতো হলো, রাবণের চিতাও তো মনে হয় দুই বছর ধরে জ্বলেনি। ইট'স টাইম টু কাম ব্যাক টু লাইফ। আর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে হারানো দুই বছরের সালতামামি করা।

পশ্চিম যাত্রাঃ
মাস্টার্স শেষ করে কোন মতে একটা চাকরী জুটিয়ে স্যান ডিয়েগোর প্লেনে চেপে বসলাম। চ্যাপেল হিলে তুমুল তুষার ঝড় বইছিলো, আর স্যান ডিয়েগোতে অপেক্ষা করছিলো রোদে ভরা আরো একটা দিন। পুরান বাংলা উপন্যাসে শহরে শিক্ষিত চরিত্র যেমন একটা আদর্শ স্কুলের ঠিকানা আর নিয়োগপত্র সম্বল করে অজপাড়াগাঁয়ের দিকে যাত্রা করত, আমারো তেমন অবস্থা। স্যান ডিয়েগোতে কাউকে চিনি না, কোথায় থাকব তাও জানি না। যাত্রার আগের দিন ক্রেইগলিস্ট ঘেটে এক বাসা সপ্তাহ খানেকের জন্য ভাড়া করলাম, স্যান ডিয়েগোর প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে জলের দামে বলতে হয়।

সোমালিয়ার লোকজনের আত্মমর্যাদা যে অনেক বেশি, সে সোমালিয়ান পাইরেটদের কাহিনী থেকেই বুঝা যায়। কিন্তু তাই বলে সোমালিয়ান ট্যাক্সি ড্রাইভার আমার দুই দুইটা ভারী লাগেজ দেখেও বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সেটা আশা করিনি। মানীর মান রক্ষা করে ট্যাক্সিতে চড়ে কোন রকমে 'ক্যামিনিতো দেল চুকো'র সেই বাড়ির সামনে পৌঁছে বাড়ির মালিকের খোঁজে বাড়ির সামনের বাগানে বসে থাকা এক অশীতিপর বৃদ্ধের দেখা মেলে। এই বয়সে যার স্বর্গে থাকার কথা, সে স্যান ডিয়েগোর পাহাড় আর সমুদ্রের টানে কিনা পড়ে আছে দুনিয়াতে! তার অস্ফূট কথা আর মেয়াদোত্তীর্ণ শ্রবণশক্তির ফলে বাড়ির মালিকের কথা জিজ্ঞেস করতেই কয়েক মিনিট পেরিয়ে যায়। অবশেষে সে দরজা খুলে লিভিং রূমের সোফার উপরে উপুর হয়ে শুয়ে থাকা এক শরীর কে নির্দেশ করে।

বেচারা সোফা আর ফ্লোরের মাঝে ত্রিশংকুর মত ঝুলে আছে, পরনের প্যান্টটা লজ্জাস্থানের ঠিক নীচে কোন রকমে লেপটে আছে, ভাগ্যিস আন্ডারওয়্যারের আবিস্কার গত শতাব্দীতেই হয়েছিল।বৃদ্ধের ডাকাডাকিতে সে কোন রকমে চোখ খুলে তাকায়। আমার পরিচয় দিলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলো তোমাকে তোমার রূমটা দেখাই। তার মুখ খোলার সাথে সাথে বন্ধ ঘরে আটকে থাকা বাসি মদের গন্ধ সম্পৃক্তিতে পৌঁছায়। আমার রূমে যাওয়ার পথে একটা বড় রূম পেরিয়ে যাই, যার মাঝখানে বিছানা, বালিশ, কাপড় আর নানাবিধ গৃহস্থালী জিনিসপত্রের বিশাল এক পাহাড়। তারপর ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মত অন্য আরেক এনট্রান্সের মুখের জায়গা দেখিয়ে ভদ্রলোক বললো, এই তোমার রূম। অ্যামেরিকা আসার সময় অনেক স্বপ্ন দেখলেও কবরের মত জায়গায় বসবাস করব, সেটা কখনো চিন্তা করিনি। তাকে প্রাণঢালা ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি অন্য আরেকটা জায়গা দেখে এসে তোমাকে জানাব। তারপর কোনরকমে জান মান লাগেজ নিয়ে চম্পট।

ততক্ষণে ফোনের চার্জ শেষ, ইন্টারনেট ঘেঁটে যে একটা সামর্থ্যের মাঝের হোটেল বের করব, সে উপায় নেই। সেই ট্যাক্সিওয়ালা তখনো দাঁড়ানো। তাকে বললাম ধারে কাছের কোন হোটেলে নিয়ে যাও। সে তার বড় নজরের পরিচয় দিয়ে নিয়ে এলো ম্যারিয়টে। ম্যারিয়ট সাধারণত অনেক খরূচে হয়ে বলে অভিযোগ করলে সে তুঁড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো। দুরুদুরু বুকে রিসেপশনে গিয়ে রুমের তত্ত্বতালাশ করলে জানলাম মাত্র প্রতিরাতে আড়াইশ ডলারের বিনিময়ে থাকা যাবে। পকেটে দুই দুইটা গৌরীসেন (ক্রেডিট কার্ড) থাকার পরেও ম্যারিয়ট থেকেও ফিরে এলাম।

ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে অর্ধেক খরচের "এক্সটেন্ডেড স্টে" হোটেলে এসে শেষ পর্যন্ত থিতু হলাম। কলম্বাস যখন প্রথম অ্যামেরিকা এসে পৌঁছায়, তাকেও এত হ্যাঁপার মাঝে পড়তে হয়েছে বলে মনে হয় না। এইভাবে রবাহুতের মত ওয়েস্ট কোস্টে আমার যাত্রা শুরু।

(অনেক লিখে ফেললাম, বাকিটা আগামী দুই বছরের মাঝেই লিখে ফেলবো...)


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সুপার লাগল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলেন যে! পরেরটা এত দেরীতে দিলে শেষে আগ্রহ না মরে যায়।

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ প্রকৃতিপ্রেমিকদা। অনভ্যাসে এইটুকু লিখতেই দুই বার বসতে হলো। আবার ব্লগিং এ নিয়মিত হবার চিন্তা করছি, আশা করি বেশি দেরী হবে না।

অনেক দিন পর আপনারে ব্লগে দেখলাম মনে হয়।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

জীবন যাপন করছি, তাই অনিয়মিত। আমেরিকা বলে কথা। এখানে সবাই শ্রমের দাস (আমার ছোট ভাইয়ের কথা এটা)। তবে কয়েক সপ্তাহ যাবত মাঝে মাঝে আসছি।

তিথীডোর এর ছবি

পড়তে শুরু করার আগেই তো শেষ!
এরকম আইলসা ব্লগারকে হাচলত্বে ডিমোশন দেয়ার দাবি জানাই। রেগে টং

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সজল এর ছবি

"প্রকৃত ব্লগারকে" লোভ বা ভয় দেখিয়ে লাইনে রাখা যায় না। এইটুক লিখতে কত কসরত করতে হলো বিশ্বাস করবে না।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সজল এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আবার যে ব্লগে এসেছেন, সেটা একটা ভালো জিনিস।
কেবল ভয় থাকল যে, এর পরের পর্ব কবে লিখতে পারবেন।
কাজের ব্যস্ততা জিনিসটাই খারাপ, এটা না থাকলে আমরা অনেক অনেক ভালো লেখা পেয়ে যেতাম।

শুভেচ্ছা হাসি

সজল এর ছবি

কাজের ব্যস্ততা সব সময় বড় কথা না, লেখার ইচ্ছা হওয়াটাই মাঝে মাঝে কঠিন। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

তৃশিতা তৃশা এর ছবি

বেশ ভাল লাগল৷পরের অংশের অপেক্ষায় থাকব৷

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ তৃশিতা। অপেক্ষা দীর্ঘ হবে না আশা করি।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সবজান্তা এর ছবি

লেখাটা ভাল্লাগতেছিলো। জলদি শেষ কইরা ফেললা... পরের অংশ জলদি দিও।

সজল এর ছবি

হ, জলদিই দিব।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ধুর মিয়া। বাকিটা কই?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সজল এর ছবি

নেক্সট উইকের মাঝে আশা করি হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আয়নামতি এর ছবি

লেখাটা ভালোই তো এগোচ্ছিল হে! হুট করে ব্রেক কষার কোনো মানে হয় রেগে টং

লেখার যেটুক ঠিক পছন্দ হলো না

এই বয়সে যার স্বর্গে থাকার কথা, সে স্যান ডিয়েগোর পাহাড় আর সমুদ্রের টানে কিনা পড়ে আছে দুনিয়াতে!

কেন হলো না সেটা আর বিস্তারিত বলছি না। আশা করি বুঝে নেবেন।

বাংলা লেখার অভ্যাসটা নেই বলেই কিনা জানিনা বেশকিছু টাইপো চোখে পড়লো!
লিখুন সময় সুযোগ মত। ভালো থাকুন নিজের মত হাসি

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ আয়নামতি। অনেক দিন পরে লিখতে বসাতো, বানান ঠিক মত মনে নেই। আপত্তির জায়গাটা ডিউলি নোটেড।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

অনেকদিন পর একজন পুরনোদিনের ব্লগারের খোঁজ পাওয়া গেল। মানে সচলে আমার আগমণকালে আপনারাই ছিলেন নিয়মিত। পুরনো দিনের কাউকে পেলেই সচলের সেই রমরমা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তখন মন্তব্যে-প্রতিমন্তব্যে লেখাগুলো সত্যিই নতুন এক মাত্রা পেত।
যাক, অনেক আবেগঘন কথা লিখে ফেললাম। লেখা চলুক।
ভাল থাকুন। আনন্দে থাকুন। হাসি

সজল এর ছবি

নিজেরে প্রৌঢ় লাগতেছে খাইছে
সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ফাহিম হাসান এর ছবি

তারপর কী হল? তাড়াতাড়ি লিখেন!

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বেশী তাড়া দিওনা, শেষে কোয়ালিটিতে হেরফের হতে পারে হাসি

সজল এর ছবি

লিখতেছি হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

চলুক

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

আয়নামতি যেন সত্যিই আয়না!
ভাল লাগলো। নিয়মিত পেতে চাই।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

চালিয়ে যান ভ্রাতা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নিবিড় এর ছবি

শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল যে। শুরু করেন আবার হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আগামী দুই বছর এর মধ্যে ক্যান দাদা? আরো আগে করা যায় না?

----------
রাধাকান্ত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।