ইদানীং "চাপাতি-খারাবি ইউনিট (চা-খাই)" এর ডিরেক্টর মাসুদ সাহেবকে বেশ তটস্থ থাকতে হচ্ছে, সবই অবশ্য মিডিয়া আর ব্লগারদের জন্য। তার মুখটা তিতা হয়ে যায়, দেশে গুলিতে মানুষ মরে, টেটা বর্শাতে মানুষ মরে, এমনকি রিকশা চাপা পড়ে মানুষ মরে। কই, সেইগুলা নিয়েতো জঙ্গিদের কাজ বলে কান্নাকাটি শুরু হয় না! যত দোষ চাপাতির! রাগ চেপে গণিতে চৌকস এনালিস্ট কুদ্দুসকে ডেকে সবগুলা খুনের মাঝের যোগসূত্র বের করার দায়িত্ব দেন তিনি।
কুদ্দুস মাত্রই ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়েছে, দুনিয়ার সব কিছুকেই সে এখনো গাণিতিক সমস্যা হিসাবে দেখে। সে ঠিক করল খুনগুলার মাঝে প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে হলে প্রতিটা খুনের ভিকটিমকে বহুমাত্রিক ডাটা-পয়েন্ট হিসাবে দেখতে হবে, তার পর বহুমাত্রিক স্থানে এই ডাটা পয়েন্টগুলাকে প্লট করলেই বুঝা যাবে এর মাঝে কোন প্যাটার্ন আছে কিনা। প্রথমে যে মাত্রাটা সে বের করে, তা হচ্ছে লেখালেখির পরিমাণ। দেখা যাচ্ছে প্রথম দিককার খুন হওয়া প্রায় সবারি নানা জায়গায় লেখালেখির বদভ্যাস আছে। এর পরে দেখা গেলো ভিকটিমদের মাঝে সহীহ মুসলমানিত্বও বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা মাত্রা। নাস্তিক কে স্কেলের সবচে ঋণাত্বক প্রান্তে রেখে, তার পরে মালাউন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, কাদিয়ানী ইত্যাদিকে রেখে একটা সংখ্যাভিত্তিক পরিমাপ দাঁড় করিয়ে ফেলে কুদ্দুস। এর পরে সে সম্পদের পরিমাপ, শিক্ষার পরিমাণ, সরকারী দলের সাথে আত্মীয়তার পরিমাপ ইত্যাদি তথ্যের ভিত্তিতে আরো কয়েকটা মাত্রা দাঁড় করিয়ে ফেলে। সব মিলিয়ে গোটা দশেক মাত্রা দাঁড়িয়ে গেলে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে অপারেশন রুমে হাজির হয়ে কুদ্দুস, চাকরির প্রথম সপ্তাহেই সবাইকে চমকে দেবে, এই রকম একটা স্বপ্ন নিয়ে সবার সামনে দাঁড়ায় সে।
প্রথমেই বহুমাত্রিক ডাটা কি সেটা বুঝানোর চেষ্টা করে সে, কেউ কেউ বুঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও আপত্তি জানায় না কেউই। সমস্যা দেখা দেয় মাত্রাগুলো একে এক ব্যাখ্যা করতে থাকলেই। লেখালেখির পরিমাপ মাত্রাতে জীবনে লেখালেখি না করা সিনিয়র অফিসারদের আঁতে বেশ ঘা লাগে, প্রকাশকদের জোর জবরদস্তি করে প্রতি বইমেলায় কবিতার বই বের করা ফজল সাহেবের সাপোর্ট উপেক্ষা করেও এই মাত্রাকে মানতে কাউকে রাজী করানো যায় না। এর পরে আসে ছহিহ মুসলমানিত্বের পরিমাপ। কুদ্দুস তার ব্যাখ্যার অর্ধেক পর্যন্ত যেতে পারে, অপারেশন রুম কাঁপিয়ে গমগমে গলায় নাস্তিক কবি নজরুলের কবিতা নকল করে আবৃত্তি করে উঠেন বজরুল সাহেব, "নাস্তিক কি মালাউন ওই জিজ্ঞাসে কোন জন, চাপাতির কোপে মরিছে সন্তান মোর মার"। তার আবৃত্তিতে কিছু একটা ছিলো, তাই হঠাৎ করে একরাশ আবেগ এসে গ্রাস করে সবাইকে। সবাই নিজনিজ রুমাল কি টাইয়ের কোনা দিয়ে তাদের চোখ মুছে নেয়। কান্নার উপদ্রব থেমে আসলে কারো কারো উপর রাগ ভর করে, তারা উত্তেজিত ভাবে কুদ্দুসকে ধর্ম টেনে এনে ভিকটিমদের মাঝে বিভেদ তৈরি করার দায়ে অভিযুক্ত করে।
প্রথম দুইটা মাত্রা ধরা খেয়ে গেলে বেপরোয়া হয়ে কুদ্দুস এবার সম্পদের পরিমাপকে একটা মাত্রা হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বলতে থাকে, "দেখা গেছে কিছুটা বিত্তবান বিধর্মী লোককে ইসলাম অবমাননার দায়ে চাপাতির কোপ খেতে হয়েছে, এ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে..."। তার কথা শেষ হবার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠেন ইসলাম সাহেব। তার কান্নার ফাঁকে ভেসে আসে, "হায়াত মউত আল্লার হাতে। মরলে বাদে সবারি ৬ হাত জমি লাগে, আপনি বলতে চান আল্লাহর চোখে ধনী গরীবের ফারাক আছে? নাস্তেক কোনহানকার!..."। কুদ্দুসের গলা শুকিয়ে আসে, সে শুকনা গলায় স্বীকার যায়, এই খুনগুলার মাঝে প্যাটার্ন খুঁজতে যাওয়া তার ঠিক হয় নাই। মানুষের বানানো কোন মাত্রা দিয়েই কোন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না, আর আল্লার বানানো মাত্রা বুঝার শিক্ষা তার ভার্সিটি তারে দেয় নাই।
ডিরেক্টর উপর মহলে চিঠি লিখে পাঠান, খুন খারাবিগুলার মাঝে কোন যোগসূত্র নেই, সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
বেদাতি গণিত দিয়ে কুদরতি চাপাতি খুনকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টার শাস্তি হিসাবে কুদ্দুসকে যাবতীয় চিন্তাভাবনার কাজ থেকে সরিয়ে একটা বড় মনিটরের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়। কোন জায়গায় চাপাতি রিলেটেড খুন-খারাবি ঘটলে সে জায়গার ম্যাপটা একটু বড় হয়ে মনিটরে ভেসে উঠে, আর ঠিক খুনের জায়গাটাতে একটা লাল রক্তের ফোঁটা ভেসে উঠে। বিদেশী ভেন্ডরদের কাছ থেকে কেনার সময় একটা ছোট সবুজ ফোঁটা ভেসে উঠার ব্যবস্থা ছিলো। চাপাতিতে লেগে থাকা রক্তের দাগে মায়াবি কিছু আছে, এই যুক্তিতে আইটির হেড, ভেন্ডরদেরকে হাজার বিশেক ডলার বেশি দিয়ে সবুজ গোল ফোঁটাকে লাল রক্তের ফোঁটায় রূপান্তরিত করেন।
সারাদিনে গাণিতিক কিছু করার সুযোগ না পেয়ে মরিয়া হয়ে উঠে কুদ্দুস। লাঞ্চ এনে দেয়া পিওনের কাছ থেকে তাই টাকাপয়সার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিসাব নিয়ে সেইগুলা যোগবিয়োগ করে তার কিছুটা শান্তি আসে। তার পর আবার তাকে ফিরে যেতে হয় মনিটরে কিছুক্ষণ পর পর যোগ হতে থাকা লাল ফোঁটাগুলার দিকে। ঝিম লেগে আসা চোখে হঠাৎ সে চেনা রক্তের ফোঁটার আকৃতি হারিয়ে যেতে দেখে। কোন রকমে নড়ে চড়ে উঠে সে দেখতে পায় অনেকগুলা ফোঁটা পাশাপাশি হয়ে বিরাট একটা রক্তের চাকা হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন ফোঁটা দ্রুত যোগ হতে থাকলে মনিটরে দেখানো ম্যাপ দ্রুত বদলাতে থাকে, আর তাতে খেই হারিয়ে ফেলে কুদ্দুস। ব্যাপারটা ভালোমত বুঝার জন্য ম্যাপের নড়াচড়ার ফিচারটা বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাপটাকে জুম ইন করে সবগুলা ফোঁটাকে একবারে দেখার চেষ্টা করতে থাকে সে। বার কয়েক জুম ইন করা হলে, চেনা একটা আকৃতি দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। কানায় কানায় লাল রং এ পূর্ণ একটা প্রায় ত্রিকোণাকৃতি একটা দ্বিমাত্রিক ছবি, তার নীচে ঘন নীল, তিন পাশ ঘিরে ধূসর ম্যাপ। কুদ্দুসের মনিটরে এখন সম্পূর্ণ লাল রঙে চিত্রিত বাংলাদেশের মানচিত্র।
ব্রেইন ইমেজিং এর নতুন মেশিনটা নিয়ে গর্বের শেষ নেই নিউরোলজি বিভাগের প্রধান সাদেকের। এই হাসপাতালে যোগ দেয়ার পর থেকেই মেশিনটা কেনানোর জন্য হেন দফতর নেই যেখানে তার দৌড়াতে হয়নি। ভাগ্যিস বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফেরার সময় সাথে করে সে মজবুত সোলের জুতা নিয়ে এসেছিলো, নইলে জুতার তলা ক্ষয়ে যাওয়ার সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতাটাও তার হয়ে যেতো।
মেশিনটাকে তার প্রায় জাদু দিয়ে বানানো মনে হয়। হেলানো চেয়ারে আরামে বসে স্যুইচ টিপে দিলেই উপর থেকে একটা অর্ধগোলাকৃতি শিরস্ত্রাণের মত জিনিস নেমে এসে মাথায় বসে যায়। তারপর সেই শিরোস্ত্রাণের মধ্য দিয়ে কিছু মায়াবী আলো খেলে যায়, আর একটা গুনগুন শব্দ হতে থাকে। সাদেক পড়াশোনা করে দেখেছে এই আলোটা আসলে কোন কাজ করে না, সাইফাই ভাব দিয়ে সহজে বিক্রি করার জন্য এই জিনিসটা দেয়া হয়েছে। মাথার ভেতরের বৈদ্যুতিক সিগন্যালের তারতম্য মেপে আর শিরোস্ত্রাণের তৈরি করা চুম্বক ক্ষেত্রের পাওয়া ফিডব্যাক মিলিয়ে ব্রেইনের একটা ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। এই মেশিনটার বিশেষত্ব হচ্ছে এটা নানা রকম কোষ আর কলার মাঝে পার্থক্য ধরতে পারে, আর তাই চূড়ান্ত ছবিতে রক্ত নালি, ধূসর পদার্থ, স্নায়ুপ্রান্ত ইত্যাদি খুব স্পষ্ট করে আলাদা আলাদা ভাবে বুঝা যায়।
মেশিনটা আনুষ্ঠানিক ভাবে চালুর জন্য আমন্ত্রণের ভিত্তিতে দশ জন মানুষের ব্রেইন ইমেজ তৈরি করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। একদিন এসে সবাই ওই চেয়ারটাতে বসে তার ব্রেইনের তথ্য দিয়ে যায়, একটা শক্তিশালী কম্পিউটার সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে পরের দিনের মাঝেই সবগুলা ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে ফেলে। সাদেক ভার্চুয়াল রিয়েলিটির একটা কনসোল মাথায় দিয়ে ত্রিমাত্রিক মডেলগুলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। চেনাজানা সব আকৃতিগুলো দেখে তার অমানুষিক আনন্দ হয়। ফ্রন্টাল লোবের একটু নীচে টেম্পোরাল লোব, পাশের প্যারাইটাল, আর একেবারে পিছনের অক্সিপিটাল, সেরেবেলাম ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখতে দেখতে তার মনে হয় ছোটবেলার ফেলে আসা বাড়িতে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দশ নাম্বার ব্রেইনটাতে এসে একটু চমক উঠতে হয় তাকে। ব্রেইনের বাইরের কাঠামোটা চমৎকার বুঝা যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে এসে কোন চেনা আকৃতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চার পাঁচটা জায়গায় ছড়ানো কিছু ধূসর রং এর দলা মতো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এরা এত দূরে দূরে যে ব্রেইনের চেনা এলাকার কোনটাতেই এদের বসানো যাচ্ছে না। এই প্রায় শূন্য ব্রেইন, ধূসর পদার্থ যেখানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা নিয়ে কীভাবে একটা মানুষ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে ভেবে চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলে সাদেক। নিজেকে সামলে নিয়ে এই ব্রেইনের মালিককে সতর্ক করে দেয়ার জন্য ফোন তুলে নেয় সে। ওই পাশ থেকে একটা ভারি গলা ভেসে আসে, "আসাদুজ্জামান কামাল বলছি"।
এডিট: গুগল ডকসে লিখছিলাম, মাঝের দুই প্যারা উলট পালট হয়ে গেছিলো। এখন ঠিক করে দিলাম।
মন্তব্য
কোথাও "খান" নামটা মিছিং আছে মনে হলো।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
খান অসাবধানতা বশত নাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
সব ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
হ, কিছুর সাথেই কিছুর মিল নাই
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
স্যাটায়ার হলেও পড়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
সামনে আসছে শুভ দিন, cheers!
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
চিয়ারস!
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
দেশে থাকলে 'আসাদুজ্জামান' লেখাই ভালো। আর বাইরে থাকলে পুরোটা লিখতে পারেন।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
মাথায় আছে
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
নতুন মন্তব্য করুন