তাজিনডং মুখী দলটি বাকলাই পাড়ার পাদদেশে এসে পৌঁছানোর পর গত পর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল। গত দুই পর্বের বিবরণ পাওয়া যাবে পর্ব ১ এবং পর্ব ২ এ।
১ - বাকলাইপাড়ায় আদিবাসী ঘরে বিশ্রামরত অভিযাত্রীরা
২ - বাকলাই পাড়ার ঘরবসতি
৩ - বাকলাই পাড়ায় মধ্যাহ্ণ ভোজ
৪ - বাকলাই পাড়া থেকে সূর্যাস্ত
৫ - বাকলাই পাড়ায় বম শিশুদের সাথে আগুনের পাশে
৬ - বাকলাই পাড়ায় সুপ্রভাত
৭ - মেঘে ঢাকা তাজিনডং
৮ - তাজিনডংয়ের পথে
৯ - সিমৎলাপি পাড়ায় অভিযাত্রীরা
১০ - তাজিনডংয়ের পাদদেশে অভিযাত্রীরা
১১ - তাজিনডং বিজয়ীরা
১২ - তাজিনডংয়ের আশেপাশের প্রকৃতি
১৩ - শের্করপাড়া
১৪ - শের্করপাড়ার সঞ্জীবনী ধারা
১৫ - গাছসিঁড়ির নিচে
১৬ - বোডিংপাড়ার পাথুরে ঝিরি
১৭ - পাহাড়ের ওপর থেকে ছবির মত বোডিং পাড়া
১৮ - থানচির কমলা বাগান
১৯ - থানচিতে সূর্যাস্ত
২০ - বিধ্বস্ত বিজয়ীরা
২১ - বিশ্রামরত অভিযাত্রীদের বিজয়গাঁথা শোনাচ্ছে হারিকেনের জ্বলন্ত শিখা
বাকলাইপাড়া যখন দেখা গেল, তখন অভিযাত্রীদের দেহে আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। প্রখর রোদ আর প্রচন্ড শারীরিক পরিশ্রম সেই সাথে পানির তেষ্টা মিলে অভিযাত্রীরা বোধবুদ্ধিহীন জড়বস্তুর মত এগিয়ে চলল বাকলাই পাড়ার দিকে। বম গ্রামটি যে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত, তার নিচে একটা চমৎকার ঝর্ণার দেখা পাওয়া গেল। কাক চক্ষু নয়, রীতিমত কাকের গাত্রবর্ণের একটি জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে সেই ঝর্ণার নিচে। বরফশীতল সেই জলে তৃষ্ণা এবং শারীরিক পরিশ্রম দুই-ই ধুয়ে গেল। দেহ - মনে সজীব শীতলতার স্পর্শ নিয়ে অভিযাত্রীরা দেড়টা নাগাদ বাকলাই পাড়ায় প্রবেশ করল।
দুপুরে চমৎকার খাওয়া হল মুরগী আর চালকুমড়ার ঝোল দিয়ে। পাহাড়ের গায়ে ছবির মত গ্রামটিতে অলস বিকেল কাটলো অভিযাত্রীদের। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত আর রাতে বম শিশুদের সাথে আগুনের ধারে খোশগল্পে স্মরণীয় একটা দিন শেষ হল।
ভোর হতেই তাজিনডং যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হল। দলে অবশ্য ভাঙন দেখা দিল। চার জনের একটি দলের গন্তব্য ঠিক হল তাজিনডং হয়ে ম্রো গ্রাম বোডিংপাড়া আর দু'জনের দ্বিতীয় দলটি কুংলাপাড়া হয়ে ঝিরিপথে বোডিং পাড়া। প্রথম দলের গাইড হিসেবে বাকলাই পাড়ার আরেস বম এবং দ্বিতীয় দলের গাইড হল পুরনো গাইড বেলাল। সূর্য ওঠার কিছু পরেই রাতের বেঁচে যাওয়া তরকারী দিয়ে ভাত খেয়ে দুই দল তাদের গন্তব্যের পথে রওয়ানা হল।
তাজিনডংমুখী দলটি বাকলাইপাড়া আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে পাহাড়ী পথে ঘন্টা দুয়েক ওঠানামা করে পৌঁছে গেল সিমৎলাপি পাড়া। রূপসী গ্রামটিতে মিনিট দশেকের বেশী বিরতি নেয়া গেল না। গভীর জঙ্গলে ঘেরা একটি গিরিখাদ গ্রামটির ঠিক একপাশে। বিশাল পাথুরে বোল্ডারে সাজানো সেই খাদটিতে সৃষ্টির পর কখনো সূর্যের আলো পড়েনি বেশ বোঝা গেল। প্রাচীন বৃক্ষ শোভিত খাদটি পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই পেছনের পাহাড়ী ক্যানভাসে ফুটে উঠল সিমৎলাপি পাড়ার অবয়ব। নিসর্গের অপূর্ব সৃষ্টির কোলে সযত্নে আশ্রয় পাওয়া এই ছোট্ট পাড়াটিতে আবার আসতে হবে, অভিযাত্রীরা সবাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল। শুকনো পাহাড়ের ফাঁক ফোকর গলে পথ এগিয়ে চলেছে তাজিনডং এর দিকে। একঘন্টা পাহাড় বাওয়ার পর অভিযাত্রীদের একটা শিরশিরে অনুভূতি আচ্ছন্ন করল। কোথা দিয়ে হাঁটছে সবাই! দু'পাশে যতদূর চোখ যায় নিঃসীম শূন্যতা, আর দূরে নীলগিরির সারি। পায়ের নিচে এক চিলতে পথের দু'দিকেই ঝপ করে হাজার ফুটের ওপর গহীন খাদ। ঝোপ জঙ্গলের কারণে কখনো খাদের গভীরতা বোঝা যায় না। হ্যাভারস্যাকের নিচে পিঠ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করল চার অভিযাত্রীর। ভয়াল সেই পথ পেরিয়ে আসতেই চোখের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল গর্বিত তাজিনডংয়ের মধ্যম চূড়া। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শৃংগ (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)। তাজিনডং এ ওঠার চূড়ান্ত ধাপগুলো ফেলে আসা পথের মতই বিপজ্জনক ছিল। একটু ভুল জায়গায় একটা পদক্ষেপ যে কাউকে মুহূর্তে নিয়ে যেতে পারত না-ফেরার দেশে। কিন্তু ভুল হল না। পাথুরে খাড়া দেয়াল বেয়ে এক এক করে সবাই উঠে গেল গর্বিত শিখরে। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভূবিন্দু। একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার বোধ অভিভূত করল চার অভিযাত্রীর প্রত্যেককে।
এবার ফেরার পালা। গাইড আরেসকে নিয়ে সোয়া ঘন্টার পাহাড়ী পথ পেরিয়ে সূর্যের অসহ্য উত্তাপ আর তীব্র পানির অভাব উপেক্ষা করে মৃত প্রায় অভিযাত্রীরা পৌঁছে গেল বম গ্রাম শের্কর পাড়ায়। শের্কর পাড়ার পাদদেশে ঝর্ণার স্বচ্ছ জলধারায় মুখ রেখে অভিযাত্রীরা খুঁজে পেল সেই জীবনের সন্ধান, যেখানে কঠোর পরিশ্রম আর সামান্য চাওয়াই বদলে দিতে পারে বেঁচে থাকার অনেক নিগূঢ় অর্থ। পুরো এক ঘন্টার বিরতির পর পাঁচ জনের দলটি পাহাড় ভেঙে আবার রওয়ানা হল। এবার গন্তব্য ম্রো গ্রাম বোডিং পাড়া, যেখানে গাইড বেলালকে নিয়ে দলের দু'জন সদস্য অপেক্ষা করছে। ঘন্টা দুয়েক লাগল পাহাড়ের নিচে ঝিরির পাড়ে দক্ষ শিল্পীর তুলিতে আঁকা মায়াবী গ্রামটিতে পৌঁছতে। পথ যথারীতি ওঠানামায় ভরপুর ছিল, তার সাথে যোগ হয়েছিল, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ওঠার জন্যে পাহাড়ীদের ব্যবহৃত বিশেষ গাছ-সিঁড়ি। একপাশে বাঁশের রেলিং না থাকলে, যা পেরোতে সুস্থ মানুষের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু হত না।
বোডিং পাড়া গ্রামটা ওপর থেকে ছবির মত মনে হলেও, কাছে থেকে বোঝা গেল, ভয়ানক নোংরা। গ্রামের পাশে চমতকার ঝিরিটাকে শুকর, গরু আর মানুষের বিষ্ঠা মিলেমিশে পূতি গন্ধময় করে তুলেছে। গ্রামের মানুষের আদিমতা স্পষ্ট। মেয়েরা ঊর্ধাঙ্গের ব্যাপারে উদাসীন আর পুরুষেরা কোমরে এক টুকরা কাপড় জড়িয়েই সন্তুষ্ট। ঘন্টা খানেক গ্রামটিতে বিশ্রাম নিয়ে সিদ্ধান্ত হল, এখানে রাত কাটানো সম্ভব নয়। খাবার-পানীয়জলের অভাব প্রকট এখানে। আজকের মধ্যেই যেভাবে হোক থানচি পৌঁছাতে হবেই। পেট ভরে জংলী বরই আর র্যাকস্যাকে থাকা খেজুর চিবিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল। গ্রামের ঠিক পাশ থেকে যে পাহাড়টা উঠে গেছে, তা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়ার মত খাড়া। এক ঘন্টা পর সেই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর দলের সবার জমিয়ে রাখার শেষ শক্তি টুকুও ফুরিয়ে গেল। বোধশক্তিহীন জড় বস্তুর মত এবার সামনে এগিয়ে চলা। ঘন্টা দুই কাটার পর পাহাড়ের পাদদেশে একটা ঝর্ণার দেখা মিলল। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে মশারা সেখানে দিব্যি গুণগুণ করে বেড়াচ্ছে। ম্যালেরিয়ার ভয় উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত হল, এখানেই মধ্যাহ্ণ ভোজন শেষ করার। সূর্য যদিও ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে ঢলে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্যাগ হাতড়ে পাওয়া গেল কিছু শুকনো চিড়া আর ড্রাইকেক। ঝর্ণার জলে ভিজিয়ে মহানন্দে তাই খাওয়া হল। ঝিরির মধ্য দিয়ে ভয়ানক পিচ্ছিল পথ আর তারপরে একটা চমতকার কমলা বাগান পেরিয়ে অভিযাত্রীরা এসে দাঁড়ালো তাদের শেষ বাধার সামনে। একটা গহীন অরণ্যে ঘেরা পাহাড়। পথ আকাশের দিকে সর্পিলাকারে উঠে গেছে। ঝুরঝু্রে মাটিতে প্রতি মুহূর্তে পা হড়কে যায়। একপাশে পাথুরে দেয়াল, অন্যপাশে অতলান্ত খাদ, যেখানে পড়লে উদ্ধার করার জন্য এক ব্রিগেড সেনাসদস্যও অসহায় হয়ে থাকবে। শরীর নিংড়ে বের করা সামর্থ্যের শেষ বিন্দু টুকু ব্যবহার করে অভিযাত্রীরা যখন পাহাড়ের ওপরে পৌঁছালো, তখন সূর্য আবির রঙে রাঙা হয়ে, দূরের পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গাইড বেলাল জানালো, বিপজ্জনক পথ শেষ। এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটলে ও কোন ভয় নেই। থানচি আর আধঘন্টা দূরে। ধীর পায়ে হেঁটে পরিশ্রান্ত অভিযাত্রী দলটি যখন থানচি বাজারে প্রবেশ করল, তখন রাত্রি তার কালো ছায়া বিস্তার করেছে আদিম পাহাড়, অরণ্য শাসিত পার্বত্যেজেলা টির ওপর। রাতটা থানচিতে একটা চায়ের দোকানের মাচার ওপর কাটিয়ে অভিযাত্রীরা পরদিন ভোরে বান্দরবান, চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা ফিরে এল। সাথে নিয়ে এল পার্বত্য অঞ্চলে কাটিয়ে যাওয়া বহুমূল্য কিছু স্মৃতি যা পরবর্তী জীবনে প্রতিমুহূর্তে তাদের প্রেরণা যোগাবে জীবনকে অন্য চোখে দেখার, জীবনের অন্যরকম অর্থ খুঁজে বের করার।
(শেষ)
মন্তব্য
ময়নাপাহাড়ের কথা মনে আছে সাল্লু?
মনে থাকবে না হিমু ভাই! আপনার সাথে ঐ পাহাড়ে ওঠার পরেই তো আবিষ্কার করলাম, বেঁচে থাকাটা কেন এত আনন্দের?!
তোমাদের এই অভিযানের শেষ পর্যায়টা পড়ে মনে হলো, ঠিক ঘরে ফেরার পথেই কেন সবসময় একটা ঝুরঝুরে মাটির পথঅলা পাহাড় থাকে? ময়নাপাহাড়ে একাধিকবার সরসর করে নিচে পড়তে নিয়েছিলাম ... মাঝে মাঝে মনে পড়লে নড়েচড়ে বসি।
ঝরঝরে লেখা।
ছবির সাথে ক্যাপশান মিলিয়ে পড়তে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো। বাকি সব ঠিক আছে।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
অনেক ধন্যবাদ লুৎফুল ভাই, ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য। ছবি ফরম্যাটিং এর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
সাল্লুকে একটা কায়দা বলি। একটা এক কলামের টেবল খুলে তার মধ্য ছবি আর ক্যাপশন ঢুকাও। সচলে বিবিকোড আর এইচটিএমএল কাজ করে।
ধন্যবাদ হিমু ভাই। পরবর্তীতে এই টিপস ব্যবহার করব।
খুব রোমান্টিক লাগছে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
অনেক ধন্যবাদ তানবীরা আপা, চমৎকার কমেন্টের জন্য।
ভাইরে,
কোনটা যে কয় নাম্বারছবি সেটা বুঝতে যথেস্ট বেগ পেলাম।
ছবির ফরম্যাটিং য়ে গন্ডগোলের জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত প্রকৃতি প্রেমিক ভাই।
সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগলো...
অনেক ধন্যবাদ শিমুল ভাই, ধৈর্য ধরে পড়ে উৎসাহ ব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন