অবচেতন মন-৩

শাব্দিক এর ছবি
লিখেছেন শাব্দিক [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/১০/২০১২ - ৫:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অবচেতন মন-১

অবচেতন মন-২

যা দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায় এমন অনেক কিছু দ্বারা আমরা আবর্তিত, যার প্রভাব প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অবচেতন মন তার মধ্যে অন্যতম।

অবচেতন মন কি? কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক হাবিজাবি কথা আগেই বলেছিলাম। আজকে যা নিয়ে লেখার অপচেষ্টায় আছি তার সঠিক বাংলা শব্দটা কি হবে বুঝতে পারছি না। Body language বলতে “শারীরিক পরিভাষা” বলা যেতে পারে। “শারীরিক আবেদন” শব্দটা কেমন যেন একটু ইয়ে শোনাচ্ছে। যেমনই শোনাক ব্যাপারটা বুঝতে পারলেই হল। ইংরেজি আরো দুটো শব্দ আছে এ সংক্রান্ত Gesture এবং Posture যার সঠিক বাংলা প্রতিশব্দও মন মত পাচ্ছি না। এছাড়া দুটি জরুরি ব্যাপার হল মুখোভঙ্গিমা (Facial Expression) এবং চোখের ইঙ্গিত (Eye movement)।

অবচেতনভাবে প্রতিনিয়ত আমরা কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়া করে থাকি। তিন গোয়েন্দার কিশোর পাশার কথা মনে আছে? গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লে সে ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু করে। অবচেতন ভাবে এমন অনেক অভ্যাস সবারই থাকতে পারে। ভেবে দেখুন আপনি নিজেও নিশ্চয়ই এমন অনেক অভ্যাসের দাস। এইসব অভ্যাসের অনেকগুলোই হল সার্বজনীন এবং কিছুটা জন্মগত। যেমন- হাসি এবং কান্না যথাক্রমে আনন্দ এবং বেদনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জন্মগতভাবেই যে কোন শিশু জেনে থাকে। দেখা গেছে জন্মান্ধ বা জন্ম বধির শিশুরাও একই ভাবে খুশি বা কষ্টের অনুভতি প্রকাশ করে থাকে। ‘হ্যাঁ বোধক’ প্রকাশে মাথা উপর নীচে দোলানো বা ‘না বোধক’ প্রকাশে মাথা ডানে বামে নাড়ানো অন্যতম সার্বজনীন ভঙ্গিমা। ‘আমি কি জানি?’ এই ধরণের আচরণ প্রকাশে শ্রাগ করা বা ঘাড় ঝাঁকানো এই ব্যাপারটিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ নির্বিশেষ মানুষ করে থাকে।

যখন আপনি রিল্যাক্সড মুডে হাত দুটি মুড়ে কাঁধের উপর রাখেন ভেবে দেখুন তো কোন হাতটা উপরে থাকে? দেখা গেছে প্রতি দশজনের মধ্যে সাত জন মানুষই বা হাতের উপর ডান হাত রেখে আরাম পায়।
নারীদের “তোমার চোখে দেখেছিলাম, আমার সর্বনাশ” জাতীয় মহোনীয় দৃষ্টি যাতে পুরুষরা কুপোকাত, সেই ব্যাপারটাও কিন্তু স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষ, আদিযুগ থেকে অপরিবর্তনীয়।

আমাদের মাথায় ছোটবেলা থেকেই ব্যকরণ বইয়ে পড়া সংজ্ঞা ঢুকানো আছে, মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হল ভাষা। একটু ইতিহাস ঘাটি, ধরা হয় ভাষার আবিষ্কার হয় আনুমানিক ৫০,০০০ বছর আগে। যার আরো আগে থেকে (প্রায় ৪০০,০০০-৩০০,০০০বছর) বহাল তবিয়তে মানব সম্প্রদায় জীবন ধারণ এবং বংশ বিস্তার করে গেছে। তাহলে ক্যাম্নে কি?
অঙ্গভঙ্গি, মুখভঙ্গি এবং শব্দ ছিল তথ্য এবং বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যম। মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দানুভূতি, বিপদ সংকেত সব কিছু প্রকাশের ভঙ্গিমা ছিল যেগুলো সার্বজনীন।

Alber Mehrabian বডি ল্যাঙ্গুয়েজএর এক গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখান, আমরা যখন কথা বলি, আমাদের ব্যবহৃত শব্দ শ্রোতার উপর প্রভাব ফেলে মাত্র ৭%, ৩৮% নির্ভর করে আমাদের কণ্ঠস্বরের উঠানামার উপর আর বাকি ৫৫% ই নির্ভর করে আমাদের অঙ্গ সঞ্চালনার উপর। তার মতে,

“It’s how you looked when you said,
Not what you actually said.”

আমাদের কারো কারো মধ্যে মানুষ চেনার বা পড়ার অসাধারণ ক্ষমতা দেখা যায়। মানে মানুষের চরিত্র বা মানসিক অবস্থা কিংবা মেজাজ মর্জি বিবেচনা করার ক্ষমতা অপরিসীম। এটা সম্ভব হয় কিছু ভঙ্গিমা বা আচরণকে সুত্র বা সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করার ফলে। এইক্ষেত্রে একটু নারীবাদি হতেই হচ্ছে, এইসব ক্ষমতা নারীদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষীণ।

যার কারণে নারীদের ইন্টিউশান পুরুষদের চেয়ে বেশি প্রখর দেখা যায়। মেয়েরা সাধারণত আশেপাশের মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চালচলন, আচার আচরণ লক্ষ্য করে থাকে এবং পরবর্তীতে এইসব আচার ব্যবহার (Nonverbal Signal) কে বিশ্লেষণ ও সরলীকরণ করে একটা সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যার কারণে কম সংখ্যক স্বামী তাদের স্ত্রীদের সাথে মিথ্যা বলে পাড় পেয়ে যান, কিংবা আদৌ পাড় পান কি না সন্দেহ। (অতএব সাধু সাবধান!!!!)

অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের এই চারিত্রিক গুণটির বিষয়ে পুরুষদের সম্যক ধারণার বেশ অভাব দেখা যায়, যার কারণে যুগ যুগ ধরে তারা ধরা খেয়েই চলেছেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি’র এক গবেষণায় কিছু নারী ও পুরুষদের একটি শব্দহীন শর্ট ফিল্ম দেখিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। দেখা যায় নারীরা গড়ে পরিস্থিতির ৮৭% মর্মোদ্ধার করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে পুরুষদের স্কোর হয় মাত্র ৪২%। মাতৃত্বএর প্রথম কয়েক বছর নারীদের এই গুনটির ভূমিকা অনন্য। শিশুদের না বলা অনুভূতিগুলি মা ছাড়া আর কেই বা বুঝে।

অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল চার্লি চ্যাপলিন।

charles-chaplin-304741l

শুধুমাত্র মুখের অভিব্যক্তি আর টুপি ও লাঠির নাড়াচাড়া দেখিয়ে চমৎকার রঙ্গবেঙ্গ করে বিশ্বের মানুষের মন মাতিয়ে গেলেন সারাটা জীবন এই ছোট্টখাট্ট মানুষটি। অভিনয়ের মূলমন্ত্রই কি তাই নয়? স্ক্রিপ্ট দেখে ডায়ালগ তো অক্ষর জ্ঞান থাকলেই পড়া যায়, ভাল অভিনয় কিন্তু এই অভিব্যক্তির উপরেই নির্ভরশীল।

নিজেকে আসলে কতটা চিনি আমরা? জটিল কোন ব্যাপার সহজে জানি বোঝাতে প্রায়ই বলে থাকি ‘এ তো হাতের উল্টা পিঠের মতই জানি’। প্রশ্ন হল নিজের হাতের উল্টা পিঠ কতটা চিনি আমরা? পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৫% এরও কম ভাগ মানুষ ছবি দেখে নিজের হাত সনাক্ত করতে পারে। নিজের চেহারা বাদ দিয়ে শরীরের বাকি অংশ আয়নায় দেখিয়ে কিছু সংখ্যক নারী পুরুষের উপর একটা পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষাটা ছিল এমন যে একটা লবির একপ্রান্তে একটা আয়না রেখে এর উপরের অংশটা ঢেকে দেয়া হয়, এমন ভাবে যেন অন্যপ্রান্ত থেকে কেউ ঢুকলে আয়নাটাতে নিজের শরীরের নিচের অংশ ৫/৬ সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টিগোচর হয়। এই পরীক্ষায় পুরুষদের মধ্যে ৮৫%জন নিজেকে চিনতে সক্ষম হন নি। যদিও ৫৭% মহিলা বুঝতে পারেন ওখানে একটা আয়না ছিল। ৩০% মহিলা মনে করছিলেন অপর প্রান্তের মহিলাটি বেশ পরিচিত কেউ হবে। পরীক্ষা শেষে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বেশিরভাগ পুরুষ এবং প্রায় অর্ধেক মহিলা তাদের চেহারা বাদ দিয়ে শরীরের নীচের কেমন বা কি ধরনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এ নিজেরা অভ্যস্ত তা সম্বন্ধে কোন ধারনা নেই। কারণ এ শারীরিক ভঙ্গিগুলো অবচেতন ভাবে তারা করতে থাকে।

তথ্যসুত্র
The definitive Book of Body language- Allan & Barbara Pease
http://en.wikipedia.org/wiki/Human
http://hypertextbook.com/facts/1997/TroyHolder.shtml
http://en.wikipedia.org/wiki/Behavioral_modernity
http://en.wikipedia.org/wiki/Body_language
ছবিসুত্র
http://www.cinemagia.ro/actori/charles-chaplin-2013/


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

( মাথা চুলকে নিয়ে ) বড্ড জটিল জিনিষ। তবে আসলেই উদাহারণ দিয়ে দিয়ে বেশ সরল করে লেখার চেষ্টা করে গেছেন। ভালো লাগল। চালায়া যান স্যার

০২

অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শিশুদের ভাব প্রকাশটা মনে হয় পৃথিবীর সবচে সুন্দর প্রকাশ

০৩

একটা কুচ্চেন আছেন - অবচেতন মন নিয়ে ফ্রয়েড এর কিছু রেফারেন্স পড়েছিলাম অনেক আগে। সেখানে অবচেতন আর স্বপ্ন নিয়ে কি না কি ছিল অতটা মনে নেই। কিন্তু এটুকু মনে আছে যে আমাদের মনের দ্বিধান্বিত সত্তাগুলিই নাকি অবচেতন এর বিভিন্ন স্কোপগুলি তৈরি করতে সহায়তা করে। তাহলে ঘটনা হল আমি অবচেতনে যা ভাবি তা আমি কি করে জানতে পারব? কিংবা এমন জিনিষ যা আমি অবচেতনেও ভাবি নাই ( ধরে নিলাম ) কিন্তু তার প্রতিফলন আবার হয় কেমন করে?

শাব্দিক এর ছবি

০১। ধন্যবাদ, বুঝাতে পারলাম কিনা বুঝতে পারলাম না। খাইছে

০২। আসলেই শিশুদের ভাব প্রকাশ সবচেয়ে পবিত্র আর নির্মল, যাতে কোন ভাণ নেই।

০৩। এহহে, কুচ্চেন করেই দিলেন বিপদে ফেলে।
আগেই বলেছিলাম

অবচেতন মন হল এমন সব কিছুর ভান্ডার যা ঠিক এই মুহূর্তে আপনার সচেতন মন ধারণ করছে না।

অবচেতন আর সচেতন দুটা সত্ত্বা ভিন্ন বলেই দ্বিধার সৃষ্টি করে। স্বপ্নের মাধ্যমে এর কিছু ভাইব পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা কিছুটা বুঝতে পারি আমরা অবচেতন ভাবে কি ভাবছি। অবচেতনেও ভাবি নাই তেমন ব্যাপার প্রতিফলিত হবার কথা নয়। নীচের পোস্টটিতে ব্যাপারটা আর একটু ডিটেলস আলোচনা করেছিলাম,
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42039

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পড়ছি, চলুক।
মানুষের মন রহস্যের আঁধার।

শাব্দিক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

রু এর ছবি

রিসার্চ করে বের করেছে যখন, তাহলে নিশ্চই ঠিক হবে। কিন্তু মেয়েদের ইন্টিউশন বেশি বা মনের কথা কিভাবে কিভাবে বুঝে যায়, এই আইডিয়াগুলা নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচন্ড বিরক্ত। সাধারণ কথাকে ঘুরে প্যাচায় মানে বের করার একটা এক্সকিউজ মনে হয়। দুঃক্ষিত, আমি মনে হয় একটু বেশি কড়া ভাবে বললাম।

শাব্দিক এর ছবি

দুঃখিত হবার কিছুই নাই, আপনার কড়া ভাবে বেশ মজা পেলাম।

আসলে মেয়েদের যে কোন ব্যাপার অবজার্ভ করার ক্ষমতা ছেলেদের যে সুক্ষ্ম, মানে সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলো মেয়েদের বেশি চোখে পড়ে আর স্থুল ব্যাপারগুলি নিয়ে ছেলেরা মাথা ঘামায় বেশি। এরজন্য ছেলেদের মনে হতে পারে মেয়েরা ঘুরায় প্যাচায় বেশি আর মেয়েদের মনে হতে পারে ছেলেরা বেকুব প্রকৃতির তাই ব্যাপারগুলি তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে পরবর্তীতে।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

sadatkamal এর ছবি

"৫৫%ই নির্ভর করে আমাদের অঙ্গ সঞ্চালনার উপর"।
____ তথ্যটা ভালো লাগলো।
একটি জানার ইচ্ছাঃ- আমাদের চোখ কিভাবে তার ভাষা অন্যকে বোঝাতে পারে(চোখের ভাষা)? এবিষয়ে জানতে পারলে ভালো লাগতো। আশা করি, আপনি পরবর্তীতে আমাদেরকে এ বিষয়ে জানাবেন।
আপনার লেখাটা অনেক দারুন তথ্য সমৃদ্ধ। চমৎকার।

শাব্দিক এর ছবি

লেখা পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আই কন্টাক্ট নিয়ে নিজেও তেমন একটা ডিটেলস পড়িনি, পড়লে আপনাদের শেয়ার করব অবশ্যই। হাসি

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।