স্বর্ণমন্দির থেকে বের হয়ে আমরা মধ্যাহ্ন ভোজনের জায়গা খুঁজতে লাগলাম। আমাদের দলের নতুন সদস্য উজ্জ্বলের উপদেশে “ফিস্ট” নামের রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। বান্দারবান এসে পোলাউ করমা খাওয়ার আগ্রহ কারও দেখা গেল না। তার চেয়ে সাদা রূপচাঁদা মাছ, চিংড়ী শুঁটকী ভর্তা (যদিও আমি এই দলের না), টাকি মাছের ভর্তা আর সবজি ভাজি হ্যাঁ ভোটে জয়যুক্ত হল। মাছের স্বাদের তুলনা নেই। ঢাকার প্রিজারভেটিভ দেয়া তিনদিনের বাসি মাছ আর সবজির চেয়ে এখানকার খাবার অমৃত লাগল। তবে একই দলভুক্ত সবাই একসাথে রাঙ্গামাটিও ভ্রমনের কারণে স্বীকার করতে বাধ্য হল রাঙ্গামাটির মত এ অঞ্চলেও মরিচ সস্তা।
এরপর তিনটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম মেঘলা’র উদ্দেশ্যে। সূর্যাস্তটা যে করেই হোক দেখতে হবে নীলাচল, সেভাবে প্ল্যান করা। মেঘলার সামনে সম্প্রীতির সাইনবোর্ডটা সবার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিল। ঢুকতেই চোখে পড়ল বড়সড় পিকনিকের দল, শুক্রবার হওয়াতে প্রচুর লোকের ভিড়। সিড়ি দিয়ে অনেকটা নীচে নেমে যেতে হল। এরপর চোখে পড়ল ঝুলন্ত ব্রীজ। বেশ নড়বড়ে, আর আমার মত দুঃসাহসী মানুষদের জন্য বেশ উৎসাহজনক। হাউকাউ করে কষ্টেশিষ্টে পাড় হচ্ছিলাম ঝুলন্ত সেতু (তখনও জানি না আগামীকাল আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে)।
ওপারে বেশ কয়েকটা ভাস্কর্য দেখতে পেলাম, খোলা আকাশের নীচেই, আর পাহাড় ঘেরা উপত্যকার অংশটুকু, কিছু কিছু জায়গা দেখলে আর শহরে ফিরে যেতে মন চায় না। কিছুদূর হাঁটার পর ছোট্ট একটা বাজারের মত দেখতে পেলাম, যেখানে ডাব, তেঁতুল, কলা বিভিন্ন ফল বিক্রি হচ্ছে।
এতখানি রাস্তা পাড় হয়ে আমরা বেশ তৃষ্ণার্ত। কচিডাবের পানি খাওয়ার জন্য যথার্থ সময়। এরপর দেখা গেল ক্যাবলকার। বাংলাদেশে এই জিনিষ আগে দেখি নাই। যাই হোক ত্রিশ টাকা পারহেড ভাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম সবাই। একটা লেক পাড় হয়ে আবার এপাড়ে ফিরে আসলাম আমরা, লেকের সৌন্দর্য অবলোকন ছাড়া আর কোন এক্সাই্টমেন্ট পেলাম না। এরচেয়ে ঢের অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল ঝুলন্ত সেতু পাড় হওয়াটা, যা কিনা আবার পাড় হতে হবে, এই ব্যাপারে আমার সাথে সবাই একমত হল। ছোট একটা ‘সাফারি’ নামের চিড়িয়াখানাও ছিল, পথে যেতে যেতে দেখলাম। খাঁচা বন্দী এইসব জীবজন্তুর প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই, তাই ছবি তোলা হয়নি।
এরপর আরো একটা ঝুলন্তসেতু (অপেক্ষাকৃত শক্তপোক্ত) পাড় হয়ে আমরা চান্দের গাড়ীর কাছে চলে আসলাম।
পরবর্তী গন্তব্য নীলাচল। বেশ খাড়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চান্দের গাড়ী উঠে চলছিল। যেহেতু আমি ড্রাইভিং সীটে বসেছিলাম না, তাই সিরাজ ভাইয়ের উপড় ভরসা করে গাড়ীর গ্রিলের ফাঁকে মাথা বের করে দাঁড়িয়ে হইচই করতে সমস্যা হচ্ছিল না।
নীলাচল পৌঁছে প্রথমেই দেখা হল এক গাতক ভাইয়ের সাথে, যার গান আর ঢোলের আওয়াজ পুরো পরিবেশ আর প্রকৃতিকে মুখরিত করে রেখেছিল।
“নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুনয়নে নিশা লাগিল রে”
এরপর
“বন্দে মায়া লাগাইসে, পিরীতি শিখাইসে”।
মৌ এত মুগ্ধ ছিল যে উনার কাছ থেকে ওকে সরানোই যাচ্ছিল না। বলল, সে আর যাবে না, ওখানেই বসে গান শুনবে। তোরা উপরে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখে ফেরার পথে আমাকে নিয়ে যাস।
বেশ খানিক ধাপ উঠে নীলাচলের উপর পৌঁছলাম। নীলাচল নামটা যথার্থ তা আশেপাশের রূপ দেখে যে কেউ মানতে বাধ্য। চারপাশ ঘিরে পাহাড়, শীতের শেষভাগের হালকা কুয়াশা যেন নীল শাড়ির আঁচলে নিবিড়ভাবে ছেয়ে রেখেছে পাহাড়ী বনগুলো ছোট্ট হয়ে আসা স্বর্ণ মন্দিরের চূড়াটাও উঁকি মারছে দূরে। ছোট ছোট ঘরবাড়ি সমেত পাহাড়ি গ্রামগুলি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। মন ছুটে যায়, কোন দূর অজানা পাহাড়ি মেঠো পথে।
আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, যে উদ্দেশ্যে আসা সেই পড়ন্তবেলার সূর্যদেবতার দর্শন পেতে। তার আগের মুহূর্তগুলি কন্যাসুন্দর আলোয় বুলিয়ে নিয়ে গেল পুরো নীল শাড়ীর আঁচলখানি।
আর সূর্যাস্ত, সে আর নতুন করে কি বলব, প্রতিদিনই একই সূর্য আস্ত যায়, তারপরও তা যেন মনে হয় পূর্বে হয়নি, পৃথিবীর প্রতিটি অংশে এর রূপ ভিন্ন, অবর্ণনীয়, অকৃত্রিম, অভূতপূর্ব কেন, প্রকৃতির এ রহস্য হয়ত চিরদিনই অমীমাংসিত থেকে যাবে।
সূর্যাস্তের পর আমরা ফিরে আসলাম নীড়ে।
রিসোর্টে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে ইফতি বের করল তাশের প্যাকেট। রাত তিনটা পর্যন্ত নাকি টোয়েন্টিনাইন চলবে। কারণ তিনটার সময় আমাদের নীলগিরি রওনা হবার কথা সূর্যোদয় দেখতে। কিন্তু দু/ এক রাউন্ড চলার পর আমরা আর চোখের পাতা খোলা রাখতে পারলাম না।
(চলবে)
মন্তব্য
বান্দরবান, বগা লেক, নীলগিরি, নীলাচল গিয়েছি। তবে কিছু শখ অপূর্ণ থেকে গেছে। ইচ্ছে ছিল সাঙ্গু নদী ধরে নৌকা করে থানচি না কোথায় পর্যন্ত যাওয়া যায় - সেখানে যাব। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কন্সার্নের কারনে আমার স্থানীয় বন্ধুবান্ধবদের প্রবল আপত্তিতে সেটা আর সম্ভব হয়নি। নীলগিরিতে আর্মির আউটপোস্টে দুর্দান্ত লোকেশনে কয়েকটা কেবিন আছে - ওখানেও দুএকটি দিন থাকার খুব ইচ্ছে ছিল। সুযোগ হয়নি।
আপনার সিরিজটা খুব ভাল লাগছে।
****************************************
সাঙ্গুনদীতে নৌকা চড়া আমারও হয়নি, তার উপর শুকনা মৌসুম এ যাওয়া হয়েছে যেহেতু, নদীতে পানি খুব কম ছিল। আরো যাবার ইচ্ছা আছে বান্দরবান। শীতে এবং বর্ষায়।
লেখা পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ভালো লাগলো শাব্দিক! চলুক
ধন্যবাদ রংতুলি সাথে থাকার জন্য।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
নাহ! এবার দেশে আসলে বান্দরবান যেতেই হবে!
বটতলার উকিল
অবশ্যই যাবেন। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টুরিস্ট স্পট বান্দারবান।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
যাই নাই এখনো কবে যাবো তাও বুঝতেছি না। অণু ভাইয়া বিদেশ বিদেশ ঘুরে তাই হিংসা করা বাদ দিয়েছি কিন্তু মানুষ দেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমি যেতে পারলাম না দেখলে হিংসা লাগে আমি এতো হিংসুক কেন?
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
অনুর সাথে আলিফ লায়লার জ্বিনভুতের তুলনা করা উচিত, কোন মানুষের না। দেশে দেশে কই ঘুরলাম? একবার একটু গেলাম তাও যদি মানুষ নজর দেয়। আমি তো ঘরে বসে সুন্দর সুন্দর লেখা লিখতে পারি না ।পোস্টাব কি?
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
মেঘা, রাজশাহী আসবেন?
আপনি রাজশাহী নাকি। আমি তো ভাবলাম এখনো রোমবাসী।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আসছি। এই সেপ্টেম্বরেই চলে আসছি পাকাপাকিভাবে। আর ইয়ে, আমি আসলে রোমবাসী নই, বোলোনিয়া বাসী। শাব্দিক, আপনার সাথে দেখা হচ্ছে তো ঢাকায়?
ও হ্যাঁ পোস্টএ বলেছিলেন বোলোনিয়ায় আছেন, ভুলে গেছিলাম। চলে আসেন তাড়াতাড়ি , কি আছে বিদেশে?
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
তাড়াতাড়ি আসছি শাব্দিক। আপনার সাথে দেখা করতে হবেনা? আর ঘুরাঘুরি? রাজশাহীর ব্যাপক এলাকা চষে ফেলতে হবে তো! খনি আছে শাব্দিক, খনি!
আমাকে ছাড়া ঘুরাঘুরি চলবে না, বলে দিলাম।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
দারুন আপু দারুন।
আকাশের ছবিগুলো অসম্ভব সুন্দর এসেছে আপু।
আমার কপাল দেশে থাকতে কোথাও যাওয়া হয়নি।
এইবেলা খালি দেশে এসে নেই। তারপর আমিও ...
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
হুম, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ বোঝে না।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ইউ আর ইন ডিয়ার।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
মনি ভাই আসবো কবে যাবো বলেন।
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
মেঘা, আমি তো সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে দেশে আসবো। তখন একসাথে রাজশাহী ঘুরে আসার পরিকল্পনা আঁটতে হবে, বুঝলে? তোমাকে রাজশাহীতো দেখাবোই আর তোমার প্রিয় অণু ভাইয়ার বাসাতেও নিয়ে যাবো, ঠিক আছে?
চমৎকার কম্পোজিশন আপনার, কিছু ছবি ভালো কম্পোজিশনের গুণে মন ছুঁয়ে যায়। ধন্যবাদ শাব্দিক। বান্দরবন গিয়েছি, সময় কম থাকার কারণে বগা লেক দেখা হয়নি। আপনার ছবি দেখে উৎসাহ পাচ্ছি। এবার যাবো।
ধন্যবাদ মনি ভাই। বগালেক পরের পর্বে আসছে। এটা তো মেঘলার একটা লেক।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
বাহ, লেখা ছবি দুটাই সুন্দর
ধন্যবাদ ।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
নতুন মন্তব্য করুন