বগালেক পাহাড়ের নীচে পৌঁছে দশ টাকা করে ছয়টা লাঠি ভাড়া নেয়া হল, নিজেদের বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস মনে হতে থাকে। আমি ফটুকবাজি করতে করতে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ি। এদিকে এক্স ক্যাডেট মৌ তরতর করে অনেক খানি উঠে যায়। এবার আমি চরম বিপাকে, রোদে গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাল্যান্স পাচ্ছি না মোটেই, সরুখাড়া রাস্তা। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে গেলাম পা ফসকে। পাহাড়ের ঢালে একটু ছায়া পেয়ে ধপ করে বসে পড়লাম, আমি আর যাচ্ছি না। ইফতি এবার হাল ধরল। হ্যাচকা টান মেরে আমাকে উঠায় বলল, যাবি না মানে, তোর চৌদ্দগুষ্টি যাবে। এইভাবে আরো একঘন্টা। পাহাড়ি ঢালের বাঁকগুলি ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। ভয়ে কাঠ হয়ে ইফতির হাত ধরে উঠে চলছিলাম। আর সে ভ্যাজর ভ্যাজর করে জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছে, বুঝলি প্রথম যে মহিলা সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়, সেও কুয়াশায় আটকে গিয়েছিল.........। ওর জ্ঞান দেবার অভ্যাস কখনও যাবে না। মনে হচ্ছিল ধাক্কা দিয়ে ওকে দুই হাজার ফুট উপড় থেকে ফেলে দিই। নিতান্তই আমাকে হেল্প করছিল বলে আমি ইচ্ছাটাকে দাফন করলাম।
কিছুক্ষণ পর উপরে তাকিয়ে দেখি, বিজয়িনী হাসি দিয়ে মৌ দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের চুড়ায়। অন্যদলগুলো বেশ হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিল ওকে, আপনার মত নারীদের জন্যই বাঙ্গালী নারী এভারেস্ট এর চুড়ায় পৌঁছেছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, হেনতেন। আমরা বাকিরাও পৌঁছে গেলাম একসময়।
পাহাড়ের উপর আমার দুজন বন্ধু হল। একজনের নাম লিন্ডা আর ছোটজনের নাম কারানা, তারা আমাকে নিজ হাতে লেক থেকে মাছ ধরে উপহার দিল, এবং কথা দিল আমার শহরে একদিন যাবে।
দারুণ সুন্দর সে লেক সাতাশ’শ ফুট পাহাড়ের উপর কিভাবে তৈরি হল সে এক আশ্চর্য। স্থানীয়দের কাছে অলৌকিক গল্প প্রচলিত থাকা তো স্বাভাবিক। তাদের কাছ থেকে গল্পটা জানলাম। “বগা” অর্থ হল সাপ। তাদের কাছে শুনলাম, তারা বিশ্বাস করে লেকের নীচে নাকি বিশাল এক সাপ বাস করে। বছরে একবার সে উঠে আসে, তখন লেকের পানি ঘোলা হয়ে যায়।
গল্পটা অনেকটা এমন, সে অনেককাল আগের কথা। পাহাড়ের উপর ছিল একটা গ্রাম। প্রতিদিন গ্রাম থেকে চুরি যেত একজোড়া গবাদি পশু। একসময় সবাই জানতে পারল, বিশাল এক সর্প বাস করে এক গর্তে, যে কিনা গ্রামের গরু ছাগল সব খেয়ে ফেলছে। একদিন গ্রামবাসীরা মিলে ঠিক করল একটা ছাগল রেখে সর্পরাজকে ফাঁদে ফেলবে। যেই কথা সেই কাজ, সাপটাকে ধরতে গিয়ে কিছু মানুষ উল্টো সাপের পেটে গেল। তারপর গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকটি স্বপ্ন দেখল, যে সর্পরাজ সবাই কে গ্রাম থেকে চলে যেতে বলল। পরের দিন সবাই গ্রাম ত্যাগ করলে, গ্রামটা ডুবে গেল। এইভাবেই নাকি স্থানীয়দের মতে এই লেকের জন্ম।
আমরা সেই প্রখ্যাত লেকে নৌকা ভ্রমণ করলাম। ফিরে গিয়ে পাহাড়ী গ্রামের বাজারে গিয়ে বসলাম। সেখানে খাওয়া দাওয়া চলল খানেকক্ষণ।পথে আসার সময় পাহাড়ের গায়ে প্রচুর কলাগাছ, পেঁপেগাছ দেখেছিলাম। বাজারেও তাই পেলাম। অমৃত স্বাদ লাগল লাল রঙের গাছ পাকা পেঁপে খেতে।
এবার পাহাড় থেকে নামার পালা। নামাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও আমি বেশ কয়েকবার পিছলে যাচ্ছিলাম। আরেকটা মুল সমস্যা ছিল আমি হিল ট্র্যাকিং এর জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না, ফলে তেমন জুতা নিয়ে যাইনি। খালি পায়ে নামতে হচ্ছিল, তার উপর সূর্য বাবাজি মাথার উপর থাকায় মাটিও ছিল তেমন তপ্ত।
ফেরার পথে রুমা বাজারে স্থানীয়দের দোকানে লাঞ্চ সারলাম। আবারো সেই খাড়া ঢালের মেটে রাস্তা পাড় হয়ে শহরের দিকে যেতে লাগলাম। পরের গন্তব্য স্থান ছিল শৈলপ্রপাত। বগালেকে যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় সাত থেকে আট ঘন্টা লেগে যায়। রাত তিনটায় যাত্রা শুরু করার অ্যাডভান্টেজটা ততক্ষনে টের পেলাম। কারন এইসব প্রতিটি স্পট দেখতে প্রায় পুরো একদিন লেগে যায়।
সেদিন বিকাল চারটার দিকে পৌঁছলাম শৈলপ্রপাত ঝর্নায়। শীতের শেষে সময়টা হওয়াতে বেশ সরু হয়ে এসেছে পানির স্রোত। ভরা বর্ষায় নিশ্চই অন্যরকম রূপ হয় এর। কিন্তু এই পথে আসাটা বর্ষায় খুব সহজ নয়। তারপরেও যতগুলো ঝর্ণা দেখেছি এখন পর্যন্ত তার মধ্যে এটা অন্যরকম লাগল, মূলত এর স্তরে স্তরে আটকে থাকা শিলাগুলির জন্য। অবশ্যই শৈলপ্রপাত নামকরণটা যথার্থ। পাথরগুলি বেশ চওড়া, অনেকবেশি স্থান জুড়ে থরে থরে সাজানো।
শৈলপ্রপাতের পাশে স্থানীয়দের বিকিকিনি চলছে।নানারঙ্গের হাতেবুনা শাল, ফলমূলের হাট। আমরাও নিজেদের পছন্দের রঙের শাল কিনলাম দুই একটা।
এইটা ছিল আমাদের এই যাত্রায় শেষ দর্শনীয় স্থান। এরপর রিসোর্টে ফিরে নিজেদের গাট্টিবোঁচকা বেঁধে চললাম রাত আটটার ঢাকার বাস ধরতে। নিয়ে চললাম অভূতপূর্ব একগাদা স্মৃতি।
বাসে উঠেই কানে গুজে দিলাম হেডফোন।
“যাবি যদি উড়ে দূরে নীল অজানাতে, মনে রেখে আমায় মনে করে”।
শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম জানি না, চোখ খুলে দেখি কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে আসলাম ঢাকায়। আজ রবিবার, আবারো অফিস।
(সমাপ্ত)
মন্তব্য
অসাধারণ। তুমি তো দারুণ ছবি তুলো হে। তোমার এই পোস্ট গুলো দেখে আবার বান্দরবন যাওয়ার ঝোঁক চাপছে মাথায়। সেদিন কয়েক কলিগকে পটাচ্ছিলাম যাওয়ার জন্য।
আপু আমারে বলছে আমি দেশে আসলে আমারে নিয়া যাবে।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ভাল ভাল। আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি আমাকে নেয়ার কথা কেউ বলল না
তুমি ও তো কইলা না যে আমারে নিয়া যাবা।
যাও যাও কলিগদের নিয়া যাও।
সত্যি চল আমি দেশে আসলে একটা ট্যুর দেই সবাই মিলে।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
সেইই জলছবি কলিগদের সাথে প্ল্যান করে আর যাইতে চায় আমাদের সাথে। ক্যাম্নে কি?
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
হয় ছবি গুলা কিন্তু আসলেই জোশ হইছে।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ফ্রেশ নাও।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
তোমার মত সুন্দরী পাইলে মডেল ফটোগ্রাফি শুরু করব? বল রাজী?
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আপনেও লাইনে দাড়ান।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
চেনা দৃশ্য। তবে আপনার ছবিতে আবার নতুন করে দেখলাম।
ধন্যবাদ পথিক পরাণ।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
---
পিনাক পাণি
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
অসাধারণ
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ধন্যবাদ আপু।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
রুমা বাজার থেকে বগালেক হাইটা গেছিলাম দশ বছর আগে, তখন চান্দের গাড়ির রাস্তা হয়নাই বগালেক পর্যন্ত. ওই রাস্তা দিয়া কেওকারাডং তাজিনডং পার হয়া থানচি. কি চমৎকার জায়গা!
..................................................................
#Banshibir.
অনেকেই ওই রাস্তা হেটে যায়। রাস্তাটা যা ওইটা কে রাস্তা বলা যায় না। আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার দুর্দান্ত সাহসী ছিল বলেই বোধহয় ওই পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আসলেই চমৎকার জায়গা।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
দ্রুত অন্য কোথাও বেড়াতে যান। গিয়ে দেদারসে ছবি তুলে সাথে সাথে আমাদের দেখিয়ে দিন। তর সইছেনা।
পয়সা দেন, আপনার ইতালি ঘুরে আসব।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
পিচ্চিগুল কী গুটুলগুটুল! কয়েকটা ছবিতে বেশী রঙ এসেছে, খেয়াল রাইখেন
facebook
ওরা আসলেই ম্যালা কিউট।
রঙের ব্যাপারটা খেয়াল রাখব নেক্সটটাইম।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
বগালেক গেছেন কিন্ত চিংড়ি ঝর্ণার কোন ছবি নাই দেখে খানিকটা অবাক হলাম। যান নাই মনে হচ্ছে বগালেক লেক থেকে মাত্র ৪০মিনিটের পথ। ওটা দেখলে হয়তো শৈলপ্রপাতকে ঝর্ণা বলতে চাইতেন না আর!
ঘুরাঘুরি জারি থাকুক
চিংড়ি ঝর্না যাওয়া হয়নি, শৈল প্রপাত আমার দেখা অনেক ঝর্নার তুলনায় খুব ছোট, কিন্তু এর শিলারূপ আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ নাঈম।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
নতুন মন্তব্য করুন