গানম্যান সম্বন্ধে আমার ধারনা একেবারে নস্যি। দেশের বড়-বড় নামি দামি লোকের নিরাপত্তার জন্য নাকি গানম্যান থাকে। তা থাকবেই না কেন। তাঁরা কি আর আমার মত ম্যাংগো পিপল ? তাঁদের জীবনের দাম অনেক বেশি। আগে কখনো দামি জীবন রক্ষার্থে নিয়োজিত কোন গানম্যানের সাথে কথা হয়নি। বারে !, আমার বুঝি ঐসব বন্দুক, পিস্তল ভয় লাগে না !!
আমার মামাত ভাই তানজিমের একটা অপারেশন হবে বিকাল পাঁচটায়। আমি ভাবলাম অফিস শেষে ভাইটাকে একটু দেখে আসি। অফিস ড্রপের গাড়িতে উঠার সাথে সাথেই বেশ একটা বৃষ্টি শুরু হল। প্রচণ্ড গরমে বৃষ্টিটা হয়ত আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল কিন্তু কিছুসময় পর এই আশীর্বাদই আমার কাছে দুর্দশায় পরিণত হল। পাঁচটায় রওনা হয়ে ধানমন্ডির ওই হসপিটাল যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় সোয়া সাতটা। পুরা দুই ঘণ্টা লেগে গেছে আসতে। তাও একদম হসপিটালের গেট পর্যন্ত গাড়িতে আসিনি। জ্যামের ঠেলায় বেশ আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি। তারপর হেটে হেটে বাকি-পথ।
কয়েক-ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মামাকে ফোন দিলাম। যদিও মামাকে ফোন দিতে চাচ্ছিলাম না। কারণ তার ছেলের অপারেশন হচ্ছে, তাই মানসিক অবস্থা বেশি ভাল হবার কথা না। তবে আর কে কে হসপিটালে উপস্থিত আছে না জানায় মামাকেই ফোন দিলাম। মামার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। মামা বলল, লিফটের তিন চেপে চলে আস। লিফটের সামনে বেশ বড়সড় লাইন। ভাবলাম সিঁড়ি দিয়ে যাই। কিন্তু আশেপাশে সিঁড়ি খুঁজে না পেয়ে আমিও লাইনে দাড়িয়ে গেলাম। প্রাইভেট হসপিটালে এত গিজগিজ ভিড় কেন ঠাওর করতে পারছিলাম না।
লিফটটা তিনে এসে যখন থামল এবং দরজাটা খুলে গেল। আমি লিফটের বাইরে পা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু একি ! শুধু মাথা আর মাথা চারিদিক। এর মধ্যে আমি মামার মাথাটা খোঁজার চেষ্টা করছি। প্রায় ছফুট উচ্চতার মামাকে খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে পাব আশা করছি। পেলামও দেখি মামা একটু দুরেই দাড়িয়ে আছে। বেশ চিন্তিত মুখ। আমি অনেক জনের চিপাচুপা এড়িয়ে মামার কাছে হাজির হই। আমার হিসাবে এতক্ষণ অপারেশনটা শেষ হয়ে যাবার কথা। মামা কে জিজ্ঞাস করতে, মামা বলল পাঁচটায় শুরু হবার কথা থাকলেও অপারেশন শুরু করেছে সাড়ে ছয়টায়। মামাত বোন অরিন আর খালাত ভাই প্রান্ত উদ্বিগ্ন-মুখে ঘুরাঘুরি করেছে, মাঝে মাঝে আবার কাঁচের ভিতর দিয়ে অপারেশন থিয়েটার এর ভিতর দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে ওরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণের মধ্যে অপারেশন শেষ হল। আমার ডাক্তার খালাত ভাই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে জানাল, অপারেশন ঠিকঠাক-মত হয়েছে। হঠাৎ মামী আর খালাদের দেখি মানুষের ভিড় ঠেলে অপারেশন থিয়েটার সামনে হাজির। অথচ এত মানুষের মাঝে আমি এতক্ষণ তাদের দেখতে পাইনি। কারণ তারা কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে একটু দূরে সিঁড়ীতে বসে ছিল। সবাই আশ্বস্ত হল।
সবাই একে একে চলে গেল। আমি মামার সাথে কিছুক্ষণ থাকব। অবশ্য প্রান্ত কিছুতেই যেতে চাচ্ছিল না। কারণ তানজিম তার শুধু কাজিনই নয় সে তার বেস্ট ফ্রেন্ডও বটে। তাই বাবার সাথে সেও বেশ কিছুসময় থাকল। কিছুক্ষণ পরে সবাই চলে গেলে শুধু আমি আর মামা থাকলাম। কিন্তু রাত বাড়ছে কিন্তু মানুষের চাপ এখনও কমছে না কেন বুঝতে পারছি না। সেই যে এসেছি তখন থেকে এই ভিড়ের চাপে অতিষ্ঠ। মামা যেহেতু অনেক আগে থেকেই এখানে তাই মামাকে জিজ্ঞাস করলাম। ব্যাপারটা কি ? মামা যা বললেন তা হল, এখানে আজকে একজন রাজনৈতিক নেতার অপারেশন হচ্ছে। তাই চারিদিকে তাঁর শুভানুধ্যায়ীতে ভরে গেছে।
নেতাদের মানুষ এত ভালবাসে যে সব কাজ কাম ছেড়ে এখানে চলে এসেছে। আমার মত চুনোপুঁটি যাদের বড় বড় নেতার ছত্রছায়ায় থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ওঠা হয় নাই, তারা কিভাবে বুঝবে নেতার মর্ম। বসার জায়গা না পেয়ে সিঁড়ীর এক কোনায় বসে পড়লাম। যেহেতু অতি অল্প জায়গায় বসতে হচ্ছে কারণ সিঁড়ি দিয়ে অন্য মানুষদের উঠার জায়গা রাখতে হবে। মামা যেহেতু লম্বা মামা একটু উপরের সিঁড়িতে বসলেন আর আমি তাঁর দুই পায়ের মাঝে সিঁড়িতে বসলাম। কিছুক্ষণের জন্য সেই ছোটবেলার মামা-ভাগ্নেতে পরিণত হলাম যেন। আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে কারণ তানজিম এখন আইসিইউ তে আর সেটা এখানেই। এখান থেকে ওকে কেবিনে দিবে যখন তখন এখান দিয়েই নিয়ে যাবে।
আমি সিঁড়িতে বসে বসে নেতার লোকদের কাণ্ড-কারখানা দেখছিলাম। এরা আসলে এখানে কি করছে? এ গল্প সে গল্প , আইসিইউ তে থাকা নেতা তো তা দেখতে পাচ্ছেন না। তারা অপেক্ষায় আছেন যদি নেতা তাড়াতাড়ি বের হন আর তাদের এক-পলক দেখেন তাহলে তো নেতার সুনজরে থাকা যাবে। কয়েকজন তো আইসিইউ এর ভিতর এ চলে যেতে চান। আইসিইউ গেট প্রহরীকে ব্যাপক বেগ পেতে হচ্ছে এই আগ্রহী মানুষের বেগ সামলাতে। এরা অন্য জায়গার মত হসপিটাল এ এসেও বেগ খাটিয়ে কাজ আদায় করতে চায়।
এত হৈ-হুল্লোড় এর মধ্যে একজন দেখলাম আইসিইউ এর গেটের পাশে চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে। চেয়ারটা মনে হয় ঐ গেট প্রহরীর। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। কোমরের একদিকে দেখলাম বেল্টের সাথে একটা ওয়্যারলেস সেট অথবা ওকি-টকি। আরেকপাশে একটা পিস্তল। আমি পিস্তলের রকমফের বুঝি না। তাই স্পেসিফিক বলতে পারছি না। মামাকে জিজ্ঞাস করলাম উনি কে? মামা বললেন উনি হচ্ছেন ঐ নেতার গানম্যান।
একজন নেতার জীবন অনেক দামী। তাঁর সাথে সারাক্ষণ গানম্যান থাকেন। কারণ তাঁর জীবনে নিরাপত্তা দরকার। কিন্তু ম্যাংগো পিপল(আমজনতা) এর জীবন অনেক নিরাপদ। তাই তাদের এসব গানম্যানের দরকার নাই। এই দেশে দুষ্কৃতকারীদের হাতে কয়জন নেতা-গোতা মারা যান আর কতজন সাধারণ মানুষ মারা যায় সে হিসাব কাউকে পরিসংখ্যান দিয়ে বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। একজন দেশ-প্রধানের পরিবারের কাছে তাঁর জীবন যেমন দামী ঠিক তেমনি একজন দিনমজুরের পরিবারের কাছে তাঁর জীবনের দাম এতটুকু কম নয়, বলেই আমি জানি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের ‘গানম্যান’ দাবি করেছেন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য গঠিত আইনজীবী প্যানেলের (প্রসিকিউশন) প্রত্যেক সদস্যের নিরাপত্তায় একজন করে গানম্যান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) কাউন্সিলররা জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে গানম্যান চেয়েছেন। পাত্তি-ওয়ালা লোকজন নিজেরাই ‘গানম্যান’ পুষছেন। আবার কোনও কোনও নেতা নিজেই ‘গানম্যান’ বনে গেছেন। কয়েকদিন আগে পত্রিকার পাতায় এমন একজনকে দেখা গেছে গাড়ির জানালা দিয়ে গুলি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের আমজনতার ‘গানম্যান’ কোথায়? আমি আপনাকে খুঁজছি,একটু দেখা দেবেন কি মহাশয়!
------------------------------------------------
সচলে আগের লেখাগুলো।।।।
১। (ঃঃ স্কুলব্যাগ, তুমি বড্ড ভারি ঃঃ)
২। (বাটুল বৃক্ষ ঁ
৩। (স্কুলঃঃঃ মন ছুটে যায়...
৪। (ওরে ইলিশ, মাঝে মাঝে
৫। (আকু-পাকু’র কথোপকথনে...)
৬। (ভাবছি, আমিও কি রাস্তায় নেমে যাব ?)
৭। (চার দেয়ালের ভিতর থেকে বৃষ্টি উপভোগ...)
৮।(বিয়ের দিনে মামা উধাও...।)
৯।(হঠাৎ পথে বৃষ্টি)
মন্তব্য
চমৎকার বর্ণনা দিলেন। অসাধারণ লিখেছেন। আমজনতার গান ম্যান সে নিজেই। জীবনকে হাতে নিয়ে প্রতিনিয়ত
সে পথ চলছে। টিকে আছে , বেচে আছে যেমনটি আছে এই দেশ।
অনেক ধন্যবাদ। বর্ণনা ভাল লেগেছে জেনে খুব ভাল লাগল।
সচলের আগের লেখাগুলোর তালিকা কি খুব দরকার আছে?
লেখা ভালো হয়েছে।
হাচল হবার পর এইটা আমার প্রথম লেখা। তাই ভাবলাম পুরান লেখাগুলোর লিস্টি টা এখানে দিয়ে দেই। কারন পুরান লেখাগুলো কবে নাগাদ একাউন্ট এ আসে জানি না। পুরান লেখার লিস্টটা মেইল অবশ্য করেছি contact সচলায়তন এ। যাই হোক এগুলো আপনার চক্ষুপীড়ার কারণ হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত।
পড়া আর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আপনাদের ভাগ্য ভালো যে, নেতার জন্য আপনার ভাইয়ের অপারেশন আর ও পিছিয়ে যায়নি। এদের চেলাদের হুঙ্কারে কর্তব্যরত ডাক্তারদের ঠিকমত কাজ করার উপায় থাকেনা , হাঁকডাকে নাকি অস্থির করে ফেলে ডাক্তারদেরকে। আপনার ভাই সুস্থ হয়ে উঠুক ওর জন্য অনেক শুভকামনা।
হ্যাঁ ভাগ্য ভালই বলতে পারেন। আপনার শুভকামনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
পড়া আর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
যারা বন্দুক ধারণ করে তাদেরকে বলে গানম্যান
আর যারা গুলি ধারণ করে তাদেরকে বলে গুল্লিম্যান
সমস্ত গুল্লি যেহেতু আমজনতার বুকে ধারণ করার উদ্দেশ্যেই তৈরি সেহেতু সক্কলেই গুল্লিম্যান
দারুন বলেছেন । কি মজা আমরা সবাই গুল্লিম্যান !!
পড়া আর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
facebook
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অনেক ধন্যবাদ।
আপনার ভাই সুস্থ হয়ে উঠুক দ্রুত ।
কড়িকাঠুরে
শুভকামনা আর পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
একজন গ্যানম্যান পোষা নেতা মানে তার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। তার মানে তার অপারেশন খুব দামী কোন হাসপাতালেই হয়েছে। সেরকম হাসপাতালে আই.সি.ইউ এর সামনে আপনার বলা ভিড় এর মতো ভিড় কর্তপক্ষ এলাও করে? আমি শিওর না, নরম্যালি আই.সি.ইউ এর রুমটা একটু ভিতরের দিকে থাকে। একদম আই.সি.উ এর দরোজার সামনে মাথা গোনা যায় না এমন ভিড় আমার কল্পনায় যায় না। হয়তো আমি দেখি নাই তাই। হাসপাতালের নামটা বলতে আশা করি আপনার আপত্তি নাই।
আপনার লেখার ভঙ্গি খুবই সুন্দর।
ভালো থাকবেন।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ভাই ক্রেসিডা, এটা বেশ দামী হসপিটালই। নামটা বলতে চাচ্ছি না, দুঃখিত। হাসপাতালের নামটা মনে হয় মূল বক্তব্যের সাথে অতটা প্রাসঙ্গিক না। তবে আমরা আসলে একবারে আইসিইউ এর সামনে ছিলাম না। অপারেশন থিয়েটার আর আইসিইউ এর বাইরের দিকে আরেকটা কাঁচের পার্টিশন ছিল। আর তাঁর বাইরের লবিতে ছিলাম আমরা। এইজন্য কয়েকবার সিঁড়ির কথা উল্লেখ করেছি। যেখানে আমরা বসেছিলাম।
পড়া আর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
হাচলত্বের অভিনন্দন।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
লেখা ভালো হয়েছে।
হাচলত্বের অভিনন্দন।
হিল্লোল
এক গানম্যান দেইখা এতো কথা আর আমি তো ১৩ জন হেভিলি আর্মড গানম্যান মেইন্টেইন করতাম একদা।
আপনার লেখাটি ভালো লেগেছে। যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, তা সবারই প্রশ্ন। আম জনতার গানম্যান কৈ?
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
লিখা ভালো লাগল।
হাচলত্বের অভিনন্দন
অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
আমারো একটা গানম্যানের স্বপ্ন ছিল এককালে। কিন্তু আমার এক মামার কোন এক কুক্ষণে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল তার নিজের প্রহরী। সেই থেকে গানম্যান স্বপ্ন উধাও।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
স্বপ্ন উধাও হয়ে ভালই হইছে। আপনার মাথাটা বাইচা গেছে। ভাল থাকবেন। লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন