যারা ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব এবং যোগ্যতমের টিকে থাকার মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন বোঝেন তারা এটাও বোঝেন যে, কালের বিবর্তনে জীবের যেমন উদ্ভব হবে তেমন বিলুপ্তিও ঘটবে। মানুষ এই ধারার শুধু একটা প্রজাতি মাত্র। আমরা অন্য যেকোন জীবের মতই ভালনারেবল। শুধুমাত্র একটা কোন ভাইরাস, বা কোন প্রলয়ঙ্কারি মহাকাশীয় ঘটনা আমাদেরকে চীরতরে মুছে দিতে পারে। যদিও আমরা মনে করি আমারাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং বুঝদার, তার মানে এই নয় যে আমাদের বিলুপ্তি হতে পারেনা।
যদি কাছাকাছি সময়ে কখনও মানুষের বিলুপ্তি হয় তবে তাকে সম্ভবত গণ-বিলুপ্তি বা mass extinction ই বলা হবে। কারণ বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে ভাল অভিযোজিত জীবদের মধ্যে মানুষ অন্যতম। সেজন্য ধীরে ধীরে মানুষের বিলুপ্তির সম্ভাবনা কাছাকাছি সময়ে প্রায় নেই।
বড় ধরনের গণ-বিলুপ্তি পৃথিবীর ইতিহাসে ৫ বার হয়েছিল। পঞ্চম, অর্থাৎ সবার শেষেরটি হয়েছিল ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে, বিশাকার উল্কা পতন বা জলবায়ুগত কারনে। পৃথিবীর প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল; ডাইনোসরাও তাদের অন্তর্গত।
ধারণা করা হয় সবচেয়ে কাছাকাছি যে সময়ে মানুষের গণ-বিলুপ্তি হয়েছিল সেটা ছিল ৭০,০০০ বছর আগে। সুপার-ভল্কানো বা দানবাকারের অগ্নুৎপাতের কারনে। অর্ধেকেরও বেশি মানুষ পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান মানুষের জেনেটিক ভ্যারিয়েশান খুব কম হওয়ার কারনকে এই গণ-বিলুপ্তির ফসল হিসেবে দেখা হয়। সম্ভবত একটা বটলনেক তৈরি হয়েছিল। আবারও হয়তো এমন গণ-বিলুপ্তি হবে।
ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি। মনে করি একটা বনে শীম্পাঞ্জীর একটা দল বসবাস করে। এখন এই শীম্পাঞ্জী প্রতিটির যদি জেনোম বিন্যাস বের করা হয় তবে দেখা যাবে একটা শীম্পাঞ্জী আরেকটির সঙ্গে বিন্যাসে কিছু পরিমান ভিন্নতা দেখাচ্ছে। এখন এই ছোট দলটির মধ্যে শীম্পাঞ্জীর জেনোম বিন্যাসে ভিন্নতা পৃথিবীর বর্তমানে বেঁচে থাকা ৭.১ বিলিয়ন মানুষের একজনের সঙ্গে আরেকজনের মধ্যে বিন্যাসে ভিন্নতার চেয়ে অনেক বেশি। বহু বছর আগেই শীম্পাঞ্জীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের এতটা কম পার্থক্য থাকাটা অস্বাভাবিক। এর কারন হিসেবে বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন সম্ভবত বর্তমান মানব সম্প্রদায় বংশবৃদ্ধি করেছে খুব অল্প সংখ্যক একই গোত্রের প্রাচীন মানুষের কাছ থেকে। এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে শুধুমাত্র যদি কোন এক সময়ে পৃথিবী থেকে বেশিরভাগ মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায় তবেই। যদিও খুব অল্প সংখ্যক উপাত্ত নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে, তারপরও উল্লেখযোগ্য যে, জিনেটিক পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে সম্ভবত ৭০,০০০ বছর আগেকার কোন ছোট মানব সম্প্রদায়ের বংশ হল এখনকার মানুষ। একে মানব প্রজাতির বটলনেক (bottleneck) বলা হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন কোন গণ-বিলুপ্তি কারনে মাত্র ২০০০ মানুষ বেঁচে ছিল পৃথিবীর বুকে।
এই অনুমানকে সমর্থন দেয়ার মত কিছু তথ্যও কিন্তু পাওয়া গেছে। ভৌগলিক পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে সুমাত্রায় একটি সুপার ভল্কানোর অগ্নুৎপাত হয়েছিল, যেটা ৬৫ কোটি মাইল এর সমপরিমান পাথরের বাষ্প উদগিরণ করেছিল! টোবা হ্রদ তৈরি হয়েছিল এই অগ্নুৎপাতের ফলে। কিন্তু সুপার ভল্কানো কিভাবে এত বড় প্রভাব ফেলতে পারে পরিবেশে? কারণগুলো এমন হতে পারে-
ছবিঃ টোবা সুপার ভল্কানোর পরিধির তুলনা
সুপার ভল্কানোর ফলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের একটা বিরাট অংশ ঢেকে যায় গাঢ় ছাই দিয়ে। এই ছাই এতই গাঢ় হয় যে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারেনা প্রায় কয়েকশো বছর! ফলে পৃথিবীতে নেমে আসে এক শীতল-যুগের। সুমাত্রার অগ্নুৎপাতের ফলে ১৮১৬ বছর ধরে উত্তর গোলার্ধ কোন গ্রীষ্মের মুখ দেখেনি! অন্যদিকে অগ্নুৎপাতে তৈরি কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমানের কারনে বায়ুমন্ডল বেশিরভাগ জীবের জন্যই বেঁচে থাকতে অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তৃতীয়ত, যেসব রাসায়নিক নির্গত হয় অগ্নুৎপাতে তার বেশিরভাগই পৃথিবীকে দুষিত করে রাখে কয়েকশ বছর ধরে। ফলস্বরূপ তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার কথা। বায়ুমন্ডলের এই পরিবেশ পরিষ্কার করে আবার জীবের বেঁচে থাকার জন্য স্বাভাবিক হতে তাই কয়েকশ বছর থেকে হাজার বছর লেগে যায়। সম্ভবত এসব কারনেই কিছু মানুষ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সবাই মরে গিয়েছিল। যারা বেঁচে ছিলেন তারাই আমাদের পরদাদা-দাদীরা।
এবার আসি অন্য একটা কৌতুহলকর এবং বহু-বিতর্কিত বিষয়ে। আমরা কি আবার এমন বিলুপ্তির সম্মুখীন হব? উদাহরণ খুঁজতে খুব বেশি দূরে যেতে হয়না। মানুষের বেশ বড় একটা গণ-বিলুপ্তি কিন্তু বিংশ শতাব্দীতেই হয়েছিল। ১৯১৮ এর শুরু থেকে ১৯২০ সাল এর শেষ পর্যন্ত একধরনের ভাইরাস পৃথিবীজুড়ে ৫০ কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছিল, যার মধ্যে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। এই সংখ্যাটা ছিল মোট মানুষের ৩ থেকে ৫ শতাংশ! যে ভাইরাসে আক্রমণ করেছিল তার নাম স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাস। আমাদের সময়ের (২০০৯ সালে প্যানডেমিক) বার্ড ফ্লু ভাইরাসের মত একই গোত্রের ভাইরাস (H1N1)। এইজন্যই ফ্লু আক্রমণকে এত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন বিজ্ঞানীরা।
ছবিঃ স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে পাবলিক নোটিশ
আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদধের চেয়েও ভয়াবহ আরেকটা যুদ্ধ যে লাগবেনা সেটা কে বলতে পারে? তবে যুদ্ধ দিয়ে পুরো প্রজাতির বিলুপ্তি হওয়াটা হয়তো একটু অবাস্তব। মহাকাশীয় বা প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা অণুজীবের আক্রমণই হয়তো একসময় আবার কোন মানুষের গণ-বিলুপ্তির কারণ হবে। আমেরিকার ইয়েলোস্টোন নামক ঘুম্ন্ত আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় কিন্তু কাছাকাছি এসে গেছে। এর অগ্নুৎপাত হলে উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। সুমাত্রার মত সুপার ভল্কানোর মতই ব্যাপারগুলির কারনে।
আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে আমাদেরকে ক্লোন করে ফিরিয়ে আনার জন্য কোন এলিয়েন হয়তো চেষ্টা চালাবে!
সচলায়তনে জীবের বিলুপ্তি নিয়ে আমার সিরিজটার এটাই ছিল শেষ পর্ব। অন্য কোন সিরিজ নিয়ে এসে যাবো শিঘ্রই। শুভকামনা।
সূত্রঃ
http://www.scientificamerican.com/article.cfm?id=humans-might-have-faced-extinction
http://www3.nd.edu/~cneal/CRN_Papers/Schulte10_Sci_Chicxulub.pdf
http://news.bbc.co.uk/2/hi/science/nature/2975862.stm
http://io9.com/5501565/extinction-events-that-almost-wiped-out-humans
http://www.npr.org/blogs/krulwich/2012/10/22/163397584/how-human-beings-almost-vanished-from-earth-in-70-000-b-c
মন্তব্য
ভালো লাগলো।
____________________________
ধন্যবাদ
দর্শনের ভাষায় বলে, অনিত্য বস্তু মানেই যার সৃষ্টি হয়েছিলো এবং যার ধ্বংসও অনিবার্য। টিকে থাকার সময়কালটা নির্ধারণ হয় বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর।
অতএব---
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
হুম।
পরের সিরিজের জন্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আমিও
কায়ামাত
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সেইটাই। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু
ভালো লাগলো।
লেখার শেষ প্যারাগ্রাফের প্রথম লাইন পড়ে অনেকগুলো সাইফাই এর কথা মনে পড়ে গেলো। এমনকি একটা মুভিও। স্পিলবার্গের এআই।
কার্ল সাগানের কনট্যাক্ট এ ছিলো, একজন ক্যানসার আক্রান্ত প্রোটাগনিস্ট জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে একটা স্পেস ক্যাপসুলে নিজেকে ডিপ স্পেসে নিয়ে অ্যাবসোলিউট জিরো টেম্পারেচারে জমিয়ে ফেলে- দূর ভবিষ্যতে কোন সভ্যতা তাকে জাগিয়ে তুলবে এই আশায়।
হায়রে অমরত্বের সাধ।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
দারুণ একটা সিরিজ শেষ করলেন অভিনন্দন
অনেক অনেক ধন্যবাদ
খুব ভালো লেখা হচ্ছে সজীব। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারছি।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ধন্যবাদ সুমাদ্রী। তোমার লেখা আমি আগে থেকেই পড়ি।
কসকি মুমিন । তাইলে তো আমেরিকা যাওন বাদ দিয়া, ভুটানের দিহে মেলা দেই।
এ্যা ইয়ে একটা প্রশ্ন, ওই দু'হাজার জন (যারা আমার দাদার-to the power-পর দাদা) কেমনে বাইচাছিলো? টেকনিকটা বাইর কইরা, বিক্রয় ফোটা(ডট) কম এ ছাড়লে ভালা হইতো।
লেখা ভালো হইছে
ধন্যবাদ। কিন্তু ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন আদৌ পরের অগ্নুৎপাত ইয়েলোস্টোনে হবে কিনা সেটা নিশ্চিত নয়। আর আমাদের সময়কালে হওয়ার চান্সও খুবই কম। তাই নিশ্চিন্তে চলে যান আমেরিকা।
দারুণ একটা সিরিজ লিখেছেন আমরা বিলুপ্ত হওয়ার পর কি আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমান কোন জীবের উদ্ভবের সম্ভাবনা আছে ?
আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান কোন প্রাণী পৃথিবীতে আসতে হলে সেটা শুধুমাত্র হতে হবে মানুষের বিবর্তনের পরের ধাপ। কিন্তু আমরা বিলুপ্ত হয়ে গেলে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলেই মনে করি। কিন্তু যদি হয় এমন তবে বহু বহু বছর আবার লাগবে আমাদের মত বড় মস্তিষ্কের দুপেয়ে বুড়ো আঙুল ব্যবহার করার মত বিবর্তিত কোন প্রাণীর উদ্ভব।
এমনকরে বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লিখলে মজাই লাগে- সচলায়তনে অনেক প্রচলিত কথাটা।
একটু উল্টা কৌতূহল- দুপেয়ে এহন যেমন কইরা টিকা আছে, মানে দিনগুজার করতাছে আর কি এই ধরাধামে- সেই হিসাবে দুপেয়ে পিথিমিতে টিকা থাকলে ভালু না কেল্লাফঁতে হইলে ভালু? মানে পিথিমির ভালুমন্দ জিজ্ঞাস করছি, দুপেয়ের না।
এইটা একটা ট্রিকি প্রশ্ন। পৃথিবীর জন্য ভাল বলতে আপনি কি বোঝান সেটা হচ্ছে কথা। মহাকাশীয় কোন পরিবর্তন ঘটানোর মত শক্তিশালী আমরা এখনও নই। যদি না পৃথিবী পুরো ধ্বংস করে দিতে পারি। তবে সেই পরিমান নিউক্লিয়ার বোমাও আমাদের কাছে নাই। একটা হিসাব দেই এখানে- মনে করেন আমেরিকা এবং রাশিয়ার মোট ২৬,০০০ বোমা আছে। তাহলে হিসেব করে দেখা গেছে এই বোমা সব একসাথে বিস্ফোরণ করলে উত্তর মেরু নাকি মাত্র এক ইঞ্চির ৪ ভাগের এক ভাগ নড়বে।
খাইসে!
বেশ বেশ, পরের সিরিজ আসুক জলদি
facebook
ভয় পেলাম।
হেহে
দারুণ হয়েছে। পরের সিরিজের অপেক্ষায় রইলাম।
- একলহমা
ধন্যবাদ
দারুণ সিরিজ। এরপর কোনটা আসছে? লেখা চাই নিয়মিত।
আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে আমাদেরকে ক্লোন করে ফিরিয়ে আনার জন্য কোন এলিয়েন হয়তো চেষ্টা চালাবে! এলিয়েনের বিষয়টা কি ফান করে বলা নাকি সিরিয়াসলি বলেছেন
ধন্যবাদ। সিরিয়াসলি বলিনাই। কিন্তু হতেও তো পারে! তাইনা?
ভালো লাগলো আপনার সিরিজটা।
নতুন কোনো সিরিজের অপেক্ষায়।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
ধন্যবাদ
যতদূর জানি সুমাত্রার মাউন্ট তোবার সুপার ভল্কানোর কারনে বটল নেক হয়েছিল শুধুমাত্র ভারতে, সে কারনে ভারতে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ভ্যারিয়েশন কম এবং এটা ভারতের বাইরে দেখা যায় না।
আব্দুল্লাহ এ এম
আপনি অনুগ্রহ করে একটা সূত্র দিতে পারবেন? আমার পড়া সবই দেখাচ্ছে পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ে। তবে এটা নিতান্তই তত্ত্ব। বিতর্ক আছে এটা নিয়ে অনেক। বরং এক জায়গায় পড়লাম ভারতের প্রত্নত্ত্বিক ইতিহাস বলছে এরকম কোন প্রলয়ঙ্কারি দূর্যোগ ভারতের উপর প্রভাব ফেলেনি।
নতুন মন্তব্য করুন