চিন্তাভাবনা ২ঃ সাইকোপ্যাথ এবং সোশিওপ্যাথ - অনুশোচনা এবং নৈতিকতা

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: সোম, ১৬/০৯/২০১৩ - ৫:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিউরোবিজ্ঞানের প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তায় আলোচনাগুলি উঠে এসেছে। মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করা এসব মানুষেরা কৌতুহল নিয়ে মানুষের কর্মকান্ডকে দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন। এখানে আলোচনার কিয়দংশ তুলে দিচ্ছি।

সাইকোপ্যাথ মানুষ হল এমন ব্যক্তি যাদের মধ্যে কৃত ঘৃণ্য কর্মের জন্য অনুশোচনা জাগেনা। যেমন একটার পর একটা মানুষ খুন করা সিরিয়াল কিলার রা সবাই সাইকোপ্যাথ। অনুশোচনা হয়না বলেই এরা থামতে পারেনা। আবার এদেরকে ধরাও সেজন্য কষ্টকর হয়ে যায়। একজন কে খুন করার মত ঘটনা যদি কারও আচরনে প্রভাব না ফেলে, ব্যাক্তিটি ঠান্ডা মাথায় সবকিছুই করে যেতে পারে তখন তাকে দেখে সাইকোপ্যাথ কিনা সেটা বোঝা কষ্টকর হয়ে যায়। প্রতি ১০০ জনে একজন মানুষ নাকি কিছুটা মাত্রায় হলেও সাইকোপ্যাথ। কিন্তু এটাতো বুঝতেই পারছেন যে সবাই সিরিয়াল কিলার হন না। আবার সাইকোপ্যাথদের কাছে নৈতিকতার কোন মানে নাই। নৈতিকতার বোধটাই তাদের মধ্যে নেই। সমাজে টিকে থাকার জন্য সমাজের নিয়মগুলি শুধু মেনে চলে।

সাইকোপ্যাথ হওয়ার কারন যে মস্তিষ্কের ক্রিয়া সেটা তো জানেনই। মানুষের মস্তিষ্কের একটা অংশের নাম অ্যামিগডেলা। একে বলা হয়- 'আবেগের পরিচালক'। এই অংশটি আবেগের স্মৃতি এবং ভয়ের অনুভূতিগুলি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। নিউরোবিজ্ঞানীরা বলেন যে সাইকোপ্যাথরা সাধারন মানুষের চেয়ে ভালভাবে আবেগকে চেনার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সমস্যাটা হল 'কোনটাকে আবেগ বলে' এবং 'আবেগটা আসলে কেমন' এই দুইটার মধ্যে যোগাযোগ ঠিকমত করতে পারেনা তারা। ছোটবেলার কোন প্রচন্ড মানসিক চাপ মস্তিষ্কের আবেগের জায়গাটিত প্রভাব ফেলায় সাইকোপ্যাথ হওয়ার বহু উদাহরণ আছে। বিশেষ করে সিরিয়াল কিলারদের কমন প্রোফাইল এটা।

আরেকটু ভালভাবে বুঝতে একটি বিখ্যাত মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কথা বলছি। নাম 'ট্রলি সমস্যা', ৬০ এর দশকে ফিলিপা ফুট যার নকশা করেছিলেন। সমস্যাটা হল-

দুইটা রেইলওয়ে ট্র্যাক পাশাপাশি আছে। একটার মধ্যে ৫ জন মানুষ আটকে আছে। এখন একটা ট্রলি তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। তারা সবাই মারা যাবে যদি ট্রলিটা পাশের ট্র্যাকে ঘুরিয়ে দেয়া না হয়। কিন্তু এইখানেই ঝামেলাটা- পাশের ট্র্যাকে আরেকটা মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রশ্ন হল- এখন আপনি করবেন?

দেখা গেল সাইকোপ্যাথ এবং সাধারন মানুষ দুইজনই খুব বেশি কষ্ট না করেই একটাই উত্তর দেবে- ১ জন মানুষকে মেরে ৫ জনকে বাঁচানো। তাইলে এখান থেকে সাইকোপ্যাথ চেনার উপায় কি? এর সমাধান জুডিথ থমসন করেছেন মূল পরীক্ষাটাকে একটু পরিবর্তন করে।

৫ জন মানুষ ঠিকই আটেক পরেছে ট্র্যাকে, একটি ট্রলিও তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। কিন্তু আপনি ট্র্যাকের উপর একটা ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন একটা মোটাসোটা মানুষকে নিয়ে। আপনি শুধুমাত্র ৫ জন মানুষকে বাঁচাতে পারবেন যদি মোটা মানুষটাকে ট্রলির পথে ট্র্যাকের উপর ঠেলে ফেলে দিন তবে। মানুষটার গায়ে লেগে ট্রলি থেমে যাবে। ৫ টা মানুষ বেঁচে যাবে। কিন্তু মোটা মানুষটা অবশ্যম্ভাবিভাবেই মারা যাবে। প্রশ্ন হল- আপনি কি মোটা মানুষটাকে ঠেলে ফেলে দেবেন?

এই ট্রলি সমস্যাটা আপনাকে একটি ব্যক্তিগত নৈতিক দ্বন্দে ফেলে দেবে। আপনার মস্তিষ্কের অ্যামিগডেলাতে করাঘাত করবে। এবার আসি মজার দিকটায়। সাধারন মানুষ উত্তরটা দিতে বহুবার ভাববে, দ্বিধায় ভুগবে এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে চাইবেনা মোটা মানুষটাকে ঠেলে ফেলে দিতে। কিন্তু একজন সাইকোপ্যাথ এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হবে ভিন্ন, সে চোখের পলক না ফেলে বলে দেবে যে- মোটাটাকে ঠেলে ফেলে দেব, যদি সেটা ট্রলিটাকে থামায়।

হয়তো ভাবছেন পরীক্ষা দুইটার মধ্যে পার্থক্য কি। পার্থক্য হল প্রথম পরীক্ষায় দুইটা গ্রুপেরই মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, হয় ১ জন নয় ৫ জন। আপনি শুধু পছন্দ করেছেন কোন গ্রুপ মারা যাবে সেটা। কিন্তু দ্বিতীয় পরীক্ষায় মোটা মানুষটার মারা যাওয়ার কথাই নয়। কিন্তু আপনি তাকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছেন ৫ জন 'মারা যাওয়ার কথা' এমন ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য।

কার্যকারণ জীববৈজ্ঞানিকভাবে ছোট করে ব্যাখ্যা করি। এই প্রশ্ন দিয়ে সাধারন মানুষকে যদি মস্তিষ্কের তাৎক্ষণিক ক্রিয়া বোঝার যন্ত্র fMRI এ বসানো হয় তবে তার অ্যামিগডেলা জ্বলে উঠবে যন্ত্রের রিডার এ। আর যদি সাইকোপ্যাথকে বসানো হয় তবে শুধু অন্ধকার দেখা যাবে অ্যামিগডেলার জায়গায়। অর্থাৎ সাধারন মানুষ মস্তিষ্কের এই জায়গাটা ব্যাবহার করছে একটি নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু সাইকোপ্যাথ করছেনা।

অ্যামিগডেলা গাঢ় নীল রঙেঃ

এইখানে একটা কৌতুহলকর বিষয় চিন্তা করতে পারেন। আপনি যদি একটা জাতির ভাগ্য নির্ধারক হন তবে আপনাকে এরকম সাইকোপ্যাথিয় সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে- জাতির সার্বিক ভালোর জন্য। এইজন্য বড় বড় নেতাদের, বিশেষ করে একনায়কদের জন্য হয়তো সাইকোপ্যাথ হওয়া ভাল। জোশফ স্ট্যালিনের ক্ষেত্রে এমনটা বলা যায়। কিন্তু তারা কি আসলে সাইকোপ্যাথ নাকি সোশিওপ্যাথ?

সোশিওপ্যাথ হল তারা যাদের কোন কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা নাই, কিন্তু নৈতিকতা আছে, যা একটা বিশষ রকমের। মনে করেন হিটলার ইহুদিদের মেরে ত্বদা বানিয়ে দিল, অনুশোচনা ছাড়াই। কিন্তু অন্যদিকে নিজের প্রেমিকার প্রতি যত্নশীল হওয়ার মত অনুভূতি তার ছিল। আবার, মনে করেন কোন ধার্মিক যোদ্ধা, বা ব্লগার রাজিব কে যারা মারল- তাদের তো কৃতকর্মের অনুশোচনা হয়নি। কিন্তু তাদের নৈতিকতা আছে একটা বিশেষরকমের- ধর্ম অনুযায়ী। মস্তিষ্ক ধোয়াচ্ছন্ন এই ভেবে যে সর্বশ্কিতমানের কাছ থেকে এরকম আদেশ আছে। এটাই নৈতিক। এই প্রসঙ্গটাতে আবার আগের পর্বে ফিরে এসেছি। সমাজে সোশিওপ্যাথদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবেনা।

যাই হোক। আপনি কি সাইকোপ্যাথ বা সোশিওপ্যাথ? নাকি সাধারন মানুষ?


মন্তব্য

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

সব্বোনাশ! আমি তো ট্রলি সমস্যায় মটুরামকে স্যাক্রিফাইস করার কথা ভাবছিলাম, আমার কি হবে?

সজীব ওসমান এর ছবি

আপনার অ্যামিগডেলা জ্বলে উঠেছিল কিনা সেটা হল ব্যাপার। দ্বিধায় ভুগেছিলেন কিনা সেইটাও কথা। নাইলে বন্ধুবান্ধবদের উপদেশ দিন আপনার কাছ থেকে দূরে থাকতে! খাইছে

সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ এর ছবি

লেখাটি নতুন কিছু চিন্তার খোরাক যোগালো। এই সিরিজের পরের লেখার জন্যে অপেক্ষায় রইলাম হাসি

সজীব ওসমান এর ছবি

ধন্যবাদ

নিলয় নন্দী এর ছবি

লেখাটা চমৎকার। বিশেষ করে শেষাংশ।
হাততালি

সজীব ওসমান এর ছবি

হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন হচ্ছে, আমি কিন্তু মুটকুকে ফেলার কথাতে চিন্তিত হয়ে পরেছিলাম তার মানে আমি সাধারন মানুশ- ইসরাত

সজীব ওসমান এর ছবি

হাসি

শিশিরকণা এর ছবি

দু'টো পরীক্ষা দেখেই প্রথমে মনে হল, কেন এই দুইটা উপায়ের মাঝেই বেছে নিতে হবে, তৃতীয় কি উপায় বের করা যায় , ট্রলি কি থামানো যায় না? এরপরে মনে হলো লোক কম মরলে ভাল, কাজেই একজনের উপর রিস্ক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হিসাবমতে আমি সাইকোপ্যাথ। সোশিওপ্যাথ হইলো সেই ব্যাটা যে ৬ জন মানুষকে রেল ট্র্যাকের উপরে বেন্ধে রাখছে।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

সজীব ওসমান এর ছবি

পরীক্ষাটি এভাবেই ডিজাইন করা যে আপনার অপশন দুইটা। এই পরীক্ষায় মোটা মানুষকে ঠেলে ফেলে দিলেই কেউ সাইকোপ্যাথ নয়। আপনি যে তৃতীয় উপায়ের কথা চিন্তা করেছেন সেটা বলে যে আপনি সাইকোপ্যাথ নন।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভালো লাগছে সিরিজটা। তবে মাত্র একটা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সাইকোপ্যাথ নির্বাচন করে ফেলাটা একটু বেশী সরলিকরণ মনে হলো। যদিও আমি এ ব্যপারে কিছুই জানি না, তার পরও মন্তব্য করে ফেললাম।

____________________________

সজীব ওসমান এর ছবি

এইটা একটা উদাহরণ মাত্র। যেকোন অতি তুচ্ছ মানসিক রোগ নির্ণয়ের জন্যও রোগীকে শ'খানেক সমস্যা দিয়ে সেই রোগকে কনফার্ম করা হয়।

কড়িকাঠুরে  এর ছবি

প্রথম পরীক্ষাটায় কি সময় বেঁধে দেয়া এমন করে যে একজনকে বাঁচাতে চাইলে পাঁচজন মারা যাবে বা পাঁচজনকে বাঁচাতে চাইলে পাঁচজনের সবাই হয়তো নাও বাঁচতে পারে- পাঁচজনকেই বেঁধে রাখা যেহেতু? বাঁধন খুলতে সময় লাগবে।

প্রথমেই মনে হয়েছিল একজন কে বাঁচাই যাতে দুজন মিলে অপর পাঁচজনকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা যেতে পারে। তখনই মনে হলো সময়ের ব্যাপারটা। উল্টোটাও করা যাবে হয়তো, পাঁচজনের একজন আগে- পরে দুজন মিলে অন্য দুজনকে- পরে একজন দৌড়াবে একলা বাঁধা একজনের জন্য বা পাঁচজনের মধ্যে উদ্ধারকৃত প্রথমজনই যাবে একলা বাঁধা লোকটির জন্যে... ইয়ে, মানে...

শেষটুকু... চলুক

সজীব ওসমান এর ছবি

হেহে।। পরীক্ষাটা মনে হয় এতটা প্যাঁচালো না। সরল। হয় ১ জন মারা যাবে নয় ৫ জন।

সজীব ওসমান এর ছবি

ভোগার কথা। এইখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপারও আছে। তাইলে কি সাইকোপ্যাথদের কোন দোষ নাই? দোষ সব মাথার? এইসব নিয়ে বিতর্ক হয়। মূলতঃ অপরাধের বিশ্লেষণ। পরে হয়তো লিখবো।

আইলসা  এর ছবি

চমৎকার লেখা খুব ভালো লাগলো। আচ্ছা যদি কোন সাইকোপ্যাথ যার আ্যমিগডেলা কাজ করেনা, কোনভাবে ঠিক করে দেয়া যায়, তাহলে কি সে অনুশোচনায় ভুগবে?

সজীব ওসমান এর ছবি

ভোগার কথা। এইখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপারও আছে। তাইলে কি সাইকোপ্যাথদের কোন দোষ নাই? দোষ সব মাথার? এইসব নিয়ে বিতর্ক হয়। মূলতঃ অপরাধের বিশ্লেষণ। পরে হয়তো লিখবো।

এক লহমা এর ছবি

লেখা ভাল হইছে, কিন্তক, আমি এইসবের মইধ্যে নাই। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

গৃহবাসী বাউল এর ছবি

আপ্নে কোন লেভেলের সাইকোপ্যাথ এইটা নিয়া দ্বিধান্বিত? নাকি আপ্নে মটু সহ দুই লাইনের ৬ জন, সাথে তাগোরে যেই ব্যাটা বানছে তারে সহ ট্রলির নিচে ফেলতে চাইছিলেন? খাইছে

-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

খাইছে

ভাবছিলাম ১ লাইনে গোয়াযম আর আরেক লাইনে নিযামি, সাকা, মুজা, ছাইদি, কাদের এইগুলারে বানলে কেমুন হৈব, তারপর ২ লাইনেই কেমনে টেরেন উঠানি যায় ভাবতে গিয়া কনফু খাইলাম হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

কি এক ঝামেলায় ফেললেন! চিন্তিত
ফিলিপা ফুট এটা কি করলেন। ট্রলিতে একটা ব্রেক লাগিয়ে দিলেই তো আর কোন ঝামেলা ছিলনা। হাসি
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

-ছায়াবৃত্ত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।