১৯৮০ সালের ৪ ডিসেম্বর। ক্লিভল্যান্ড ওহায়োর একটি দোকানে ডাকাতি হচ্ছিল। ডাকাতদের গুলিতে মারা গেলেন একজন মানুষ, নাম স্টেলা ওয়ালশ। নামটা হয়তো এখন অপরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু তার সময়ে তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলা ক্রীড়াবিদদের একজন। দৌড়ে ২০টি বিশ্বরেকর্ড এর অধিকারী এই মানুষটি ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এ ১৯৩২ এবং ১৯৩৬ অলিম্পিকে রূপা এবং সোনার মেডেল অর্জন করেন, যথাক্রমে। যদিও আমেরিকাতে থাকতেন, তিনি আসলে তার জন্মস্থান পোল্যান্ডের হয়ে অলিম্পিকে লড়েছেন। দুঃখজনক ঘটনাটি তাঁর প্রাণ কেড়ে নেয়।
কিন্তু মজার ব্যাপারটি হল তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। মৃতদেহের অটোপসি করতে গিয়ে ডাক্তারগণ দেখতে পেলেন যে ৬৯ বছর বয়সী এই মানুষটি আসলে সবাই যেমনটা ভাবতেন তেমন নন। মহিলাটি ছিলেন একজন পুরুষ (প্রায়)। যদিও তিনি বিয়ে করেছেন, মেয়েদের জীবন যাপন করেছেন, মেয়েদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, কিন্তু স্টেলার যৌনাঙ্গ ছিল পুরুষাঙ্গ!
ব্যাপারটা প্রকাশ পাওয়ার পরে বহু বির্তকের জন্ম নেয় অলিম্পিকে লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে নিয়ে। কিন্তু সেই তর্কে আমি যাচ্ছিনা। এখানে বলছি অন্য কথা। জিনেটিক পরীক্ষা বলছে স্টেলা আসলে ঠিক পুরুষও ছিলেন না, তিনি ছিলেন 45X0 এবং 46XX ক্রোমোজমের অধিকারী। ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখ্যা করছি।
আমরা জানি মানুষের কোষে ২৩ ধরনের ক্রোমোজমের জোড়া আছে। এসব ক্রোমোজমে আমাদের জিনগুলি এবং বিভিন্ন সংকেত সাজানো থাকে। সন্তান জন্মাবার সময় ভ্রূণে এই ক্রোমোজমগুলির ২৩তম জোড়াটা আসলে নির্ধারন করে দেয় আপনি ছেলে হবেন না মেয়ে হবেন। ছেলেদের ক্ষেত্রে জোড়াটি XY এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে XX। অর্থাৎ Y ক্রোমোজমের উপস্থিতি নির্ধারন করছে সন্তানের লিঙ্গ। আর এই লিঙ্গ নির্ধারিত হয় শুধুমাত্র ছেলেদের ক্রোমোজম দ্বারা। কেননা, তারাই একমাত্র Y ক্রোমোজম প্রদান করতে পারে সন্তানে। তাই ছেলে হবে না মেয়ে হবে সেটা নির্ভর করছে পিতার উপর।
X ক্রোমোজম
Y ক্রোমোজম
এখন প্রাকৃতিকভাবে সন্তান যখন নেবেন বলে স্থির করেন বাবা মা, তখন তাদের সঙ্গমের প্রয়োজন হয়; আর সেসময় মায়ের ডিম্বের সঙ্গে বাবার শূক্রাণুর মিলন ঘটে। মায়ের ডিম্বে আছে শুধুমাত্র একটি করে একধরনের ক্রোমোজম - X ক্রোমোজম, আর বাবার শুক্রাণুতে আছে হয় X ক্রোমোজম নাহয় Y ক্রোমোজম। অর্থাৎ যদি বাবার শুক্রাণূতে X ক্রোমোজম থাকে তবে সন্তান মেয়ে হবে (XX), আর যদি Y ক্রোমোজম থাকে তবে ছেলে হবে (XY)।
আর শিশুসন্তান দৈহিকভাবে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় যৌণাঙ্গের গঠন দ্বারা। আমাদের যৌণাঙ্গ গঠিত হয় ভ্রূণে থাকা Wolffian duct এবং Mullerian duct রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। Wolffian duct থেকে পুরুষাঙ্গ তৈরি হয় আর Mullerian duct থেকে নারী যৌণাঙ্গ তৈরি হয়। ছবি দেখুন।
তাহলে-
ক.
- যদি বাবার শুক্রাণুতে Y ক্রোমোজম থাকে তবে সন্তান হবে জিনেটিক পুরুষ।
- আর তাহলে ভ্রূণে টেস্টেস্টোরন হরমোন তৈরি শুরু হবে এবং Wolffian duct রূপান্তরিত হবে পুরুষাঙ্গে। আর Mullerian duct নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ ছেলে সন্তান।
খ.
- যদি বাবার শুক্রাণুতে X ক্রোমোজম থাকে তবে সন্তান হবে জিনেটিক নারী।
- আর তাহলে ভ্রূণে টেস্টেস্টোরন হরমোন তৈরি শুরু হবে না এবং Mullerian duct রূপান্তরিত হবে নারী যৌণাঙ্গে। আর Wolffian duct নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ মেয়ে সন্তান।
তাহলে বাহ্যিকভাবে অনেকটাই মেয়েদের মত দেখতে স্টেলার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? একটি জোড়ায় একটি ক্রোমোজম কম ছিল এবং কোন Y ক্রোমোজম ছিলনা একধরনের জিনেটিক সমস্যার কারনে। আসলে তার সমস্যাটা একটু জটিল ছিল, যার নাম মোজাইসিজম। মানে দুইধরনের যৌন ক্রোমোজমের জোড়া ছিল তাঁর ভ্রূণে- 45XO এবং 46XX। [সাধারন মানুষের থাকে থাকে একধরনের জোড়া হয় XY নয় XX।] তাই তাঁর দেহে টেস্টেস্টেরোন তৈরি হয়েছিল এবং পুরুষাঙ্গ গজিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল অলিম্পিকের মাঠে তাঁকে কোন দলে জায়গা দেয়া যেত? কী জানি!
এরকম অনেকধরনের জিনেটিক সমস্যার কারনে মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ের বিভ্রান্তি ঘটে। এখানে বলে রাখি- হিজড়াদের দৈহিক ব্যাপারগুলিও তাই ভ্রূণের খুবই জীববিজ্ঞানীয় ঘটনার ফসল। তাদেরকে ঘৃণা করার আগে ব্যাপারটা মনে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
এ বড় অকৈতব কথা
ফুলের ভাব কই কার কাছে। -লালন
এখন অন্যপ্রাণীতে লিঙ্গ নির্ধারণ কি একইভাবে হয়? উত্তর হবে ঠিক একইভাবে নয়, তবে কিছু মিল আছে। আসলে প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ নির্ধারনের ব্যাপারটা কাজ করে। নিচের ছবিটি আগে দেখে নিন:
দেখতেই পাচ্ছেন বিভিন্ন প্রাণীতে বিভিন্নরকমভাবে লিঙ্গ নির্ধারনের ব্যাপার আছে। যেমন,
- পাখিতে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারন করে মা। তার আছে XZ ক্রোমোজম, অন্যদিকে বাবার আছে ZZ। ঠিক মানুষের উল্টা।
- আবার তেলাপোকার ক্ষেত্রে Y ক্রোমোজমের শূণ্যতাই (XO) পুরুষকে নির্ধারন করে দেয়।
- আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত। পিপড়ায় যদি ক্রোমোজমের জোড়া থাকে, মানে ১৬ দ্বিগুণে ৩২ টি থাকে (ডিপ্লয়েড বলে) তবে সেটা হবে মেয়ে। আর যদি হ্যাপ্লয়েড হয়, মানে ১৬ টি ক্রোমোজম থাকে তবে সেটা হবে ছেলে।
এবার আসি মজার বিষয়টিতে- কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে জিন, বা ক্রোমোজম লিঙ্গ নির্ধারনে কোন প্রভাব ফেলেনা। বরং আশ্চর্যের কথা হল, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে ছেলে হবে না মেয়ে হবে। যেমন,
- বেশিরভাগ কচ্ছপ এবং কুমির (এলিগেটর) যেখানে ডিম সংরক্ষণ করে সেখানে যদি উষ্ঞ তাপমাত্রা থাকে তবে সন্তান হবে মেয়ে। আর যদি ঠান্ডা তাপমাত্রা থাকে তবে ছেলে। ব্যাপারটা এভাবে মনে রাখতে পারবেন: hot chicks এবং cool dude
- আবার কিছু সমুদ্র কেঁচোর ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ধারন সম্পূর্ণ নির্ভর করে সমুদ্রতলের কোথায় লার্ভা পড়েছে তার উপর। যেমন, উন্মুক্ত সমুদ্রতলে পড়লে সন্তান হবে মেয়ে, আর লার্ভাটি যদি কোন মেয়ে কেঁচোর উপর পড়ে তাহলে সন্তান হবে ছেলে।
- আর কিছু মরুভূমির গিরগিটির ক্ষেত্রে খুবই সোজা। সন্তান সবসময়ই মেয়ে!
লিঙ্গ নির্ধারন নিয়ে এই দারুন ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
২০১২ সালের একটি খবর বলছে ভারতে ১ থেকে ৫ বছর বয়সী মেয়ে সন্তানের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছেলে সন্তানের চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি। আর এই অস্বাভাবিক পরিসংখ্যানের কারনটা হল খুন। বাংলাদেশে এখনও নিশ্চয়ই কিছু ঘটনা এমন ঘটছে। আর মেয়ে সন্তান জন্মাবার জন্য মাকেই দায়ী করা হয় এসব ক্ষেত্রে, তাই মা নিজেই কন্যা সন্তান খুন করতে শোনা যায়।
আপনি যদি পাখি হতেন তাহলে নাহয় বুঝতাম যে আপনার সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারন করছেন মা। বা, আপনি যদি কচ্ছপ হতেন এবং ডিম পাড়তেন তবে বাসার ফ্রিজে ডিমটা রেখে দিলেই সন্তান ছেলে হয়ে ভূমিষ্ট হত। ভাগ্যভাল যে মানুষ কচ্ছপ বা পাখি নয়!
সূত্র:
১. স্টেলার ঘটনা: বই, সায়েন্স অফ সুপারস্টিশান
২. স্টেলার ছবি: উইকিপিডিয়া
৩. অন্যান্য ছবি: http://www.baby2see.com
৪. বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ইউটিউব
মন্তব্য
দারুণ; কৌতূহল উদ্দীপক লেখা।
আমি পড়ে জানাচ্ছি
ধন্যবাদ
স্টেলার এই অবস্থা কে কি আমরা ইন্টার সেক্স কন্ডিশন বলতে পারি ? আর ইন্টার সেক্স এবং ট্রান্সজেন্ডার দের মধ্যে মূল পার্থক্য টা কি ?
আমি এখনও খুব ভালভাবে বুঝছিনা পার্থক্যটা। এই লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন।
ভাল লেখা। আশা করি অনেকে পড়েছেন, পড়বেন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
খুবই জরুরী লেখা। পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত।
ধন্যবাদ
জানা গেল অনেক কিছু।
ধন্যবাদ
কৌতুহল উদ্দীপক লেখা। আপনার লেখা পড়ে নিজেই এব্যপারে নেটে ঘাটাঘাটি করলাম। অনেক কিছু জানতে পারলাম। এ বিষয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
সোহেল লেহস
ধন্যবাদ
এই কথাগুলো যদি এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষকে সহজ করে বোঝানো যেত, তবে অনেক সামাজিক অনাচার কমে যেতো।
অনেক ধন্যবাদ সজীব ওসমান।
শুভকামনা জনবেন।
--------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন