মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩ লক্ষের কাছাকাছি নারী ধর্ষণের শিকার হন বর্বর পাক-হানাদার, তাদের দোসর আলবদর-আলশামস-রাজাকার, তাদের বর্তমান সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী এবং বিচারাধীন বা বিচারপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা। কোন কোন সূত্রমতে সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে চার লক্ষের কাছাকাছি হতে পারে। ফলে প্রায় ২ লক্ষ নারীর অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারন করতে হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার নারীর গর্ভপাত করাতে হয়েছিল। বীরাঙ্গনা নারীর সন্তান হিসেবে যেসব শিশু জন্মলাভ করেছে তাদেরকে আমরা যুদ্ধশিশু বলছি। এই শিশুদের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য জানা যায়না, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, যুদ্ধবিদ্ধস্ত নাজুক অর্থনীতির দেশটিতে বেশিরভাগ শিশুরই প্রথমে হয় স্থান হয়েছিল অনাথাশ্রম নাহয় জন্মলাভের পরপরই মৃত্যুবরণ। বেশ কিছু বিদেশী সংস্থা এই নারীদের গর্ভপাতে সাহায্য করেছিলো। পরবর্তীতে জন্মলাভকৃত শিশুদের বাইরের বিভিন্ন দেশের মানুষকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ বা দত্তক নিতে (এডপ্ট) সাহায্য করেছিলো এই সংস্থাগুলি। এভাবে কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, অষ্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্সে বিভিন্ন নতুন ঘরে আশ্রয় হয়েছে যুদ্ধশিশুদের। যেসব সংস্থা বা মানুষ এই এডপশনের ব্যবস্থায় জড়িতে ছিলেন তারা বেশ কয়েকজন তখন কাজ করতেন ভারতে। এমন একটি কানাডিয় দম্পতি নিয়ে, এবং কানাডায় বাংলাদেশের প্রথম যুদ্ধশিশুর আগমন নিয়ে আজকের লেখা।
বলে রাখি, লেখাগুলি পত্রিকার খবর, ১৯৭২ সালে কানাডার দুইটি প্রধান পত্রিকায় প্রকাশিত, সংগ্রহ করেছিলেন বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক, অকালপ্রয়াত মিশুক মুনীর। খবরের কাগজের কাটিংএ তাঁর নিজের হাতের লেখাও দেখতে পাবেন। তাঁর সহৃদয় স্ত্রী, শহীদ পরিবারে সন্তান, মঞ্জুলী কাজী আমাকে অসাধারণ সংগ্রহগুলিকে ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন। সম্ভবত বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন মিশুক মুনীর , যেটা শেষ করা হয়ে উঠেনি। এই দম্পতিকে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
তবে এখানে যেই দম্পতির কথা বলছি তাঁদের নাম রবার্ট ফেরি এবং হেলকি ফেরি। রবার্ট ফেরি ছিলেন একজন কানাডিয় চিকিৎসক, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভারতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ভারতের বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনারত হেলকি ফেরি সেখানেই প্রথম সাক্ষাত পান রবার্ট ফেরির, তারপর বিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে থাকার কারনে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নারীশিশুর দুর্দশা নিয়ে ভালভাবেই অবগত ছিলেন তাঁরা।
----------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------
কানাডায় ফিরে এসে তাই, ১৯৭২ সালে, যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার ব্যাপারে কাজে লেগে যান তাঁরা। কানাডায় ৭টি পরিবারকে রাজি করান, কিন্তু কানাডিয় সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা হেলকি ফেরিকে দারুণভাবে হতাশ করে। সেখান থেকেই প্রথম খবর। অন্টারিওর বার্লিংটনের হেলকি ফেরি খাদ্য অনশণ শুরু করেন কানাডিয় শিশু মন্ত্রনালয়ের কাজের ঢিলেমির প্রতিবাদে। সাড়ে তিনদিন পরে তিনি অনশণ ভাঙেন। কানাডিয় সরকার আশ্বাস দেয় যে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। গ্লোব এন্ড মেইলের ১৯৭২ সালের ২১শে জুন তারিখের খবর।
----------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------
অতঃপর, ৭২ এর জুলাই মাসে রবার্ট ফেরি এবং হেলকি ফেরি বাংলাদেশে আসেন অনাথাশ্রম ঘুরে যুদ্ধশিশু সংগ্রহে যাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে দেখেন চিকিৎসক রবার্ট। প্রথম খবরটির একমাস পরে, জুলাই মাসের ২০ তারিখের খবর বলছে যে ফেরিদম্পতি বাংলাদেশ থেকে রওনা হয়েছেন কানাডা পথে, সঙ্গে ১৫ জন শিশু, যাদের বয়স ৩ সপ্তাহ থেকে ৮ মাস। অন্টারিও, কুইবেক, নোভা স্কোশিয়া এবং সাসকাচিওয়ান প্রদেশের বিভিন্ন নতুন বাসায় ঠাঁই হবে শিশুগুলির। খবর:
----------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------
টরন্টো স্টার পত্রিকার প্রথম পাতার খবর, জুলাই এর ২১ তারিখ, ১৫ জন শিশু এসে পৌঁছেছে কানাডায়। ছবিতে যেই শিশুটিকে দেখছেন তার নাম জরিনা। ব্র্যান্টফোর্ডের জন এবং ডরোথি মরিস যাকে দত্তক নিয়েছে। তারা নতুন নাম রেখেছে লারা, কিন্তু মধ্যনাম হিসেবে জরিনা থাকছে, তাহলে পুরো নাম - লারা জরিনা হ্যারিস। বাংলাদেশের এই যুদ্ধশিশুটিকেই পত্রিকায় প্রথম দেখে কানাডাবাসী। অবশ্য আর কারও ছবি ছাপা হয়েছে কিনা জানা নাই।
খবরটি আরও বলছে: হেলকি ফেরির অনশণ এই দত্তক নেয়ার ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করেছে। হেলকি নিজেই দুইজন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছেন, সাবিত্রী এবং অশোক। শিশুদের নিয়ে আসা এয়ার কানাডা'র ফ্লাইটটি ২ ঘন্টা দেরি করে, ফলে নতুন পিতামাতাগণ এয়ারপোর্টে এসে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। বনি এবং টনি বুনস্ত্রা ওমর নামের একজন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছেন। বাদল (নামটি ইংরেজীতে Bathel লেখা) নামের একটি শিশুকে দত্তক নিয়েছেন ডেইল এবং ডরেন গুড, নতুন নাম দিয়েছেন রায়ান প্যাট্রিক ব্যাথেল। রিজা রাফিয়া নামের ৫ মাসের শিশুটিকে দত্তক নিয়েছেন ডায়ান এবং ফিলিপ। (এই খবরে বাংলা নামগুলিকে শুদ্ধভাবে লিখেছে কিনা সেটা নিয়ে আমি একটু দ্বিধান্বিত)।
----------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------
পরের খবরটি ৪ মাস পরের, অর্থাৎ নভেম্বরের ২৮ তারিখ এর। আরও ৮ জন যুদ্ধশিশু এসেছে বাংলাদেশ থেকে। খবরটি শুরু হয়েছে এভাবে: "৮টি খর্বাকায়, পুতুলের মত শিশু গতরাতে টরন্টো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছে।"
খবরটিতে আরও বলছে, ৮ থেকে মাস থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ পাকিস্তানী হানাদারদের ধর্ষণের ফসল। বাকিদের তাদের পরিবার থেকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। শিশুদের মধ্যে প্রায় সবারই স্বাস্থ্যগত অবস্থা খারাপ, সবারই পেটে কৃমি পাওয়া গিয়েছে। যদিও হেলকি ফেরি প্রায় ১০০০ জন শিশুকে দেখে এসেছেন যাদের মধ্যে ৫৪ জনকে তিনি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এতজনকে আনতে অনুমতি দেয়নি।
যদিও ফেরি হতাশ, হয়তো মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ১ বছর পর বাংলাদেশ সরকার ভেবেছিলো যে তারা এখন এইসকল শিশুর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, বাইরের দেশে নতুন পরিবার খোঁজার প্রয়োজন নেই। এই বিষয়টা নিয়ে কেউ আলোকপাত করতে পারলে জেনে খুশি হবো।
সূত্র:
আমি এখানে কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছি যেগুলির আলাদাভাবে সূত্র না দিয়ে কানাডাভিত্তিক সংগঠন প্রজন্ম কানাডা'র তৈরি করা চমৎকার লিফলেটটি তুলে দিচ্ছি, যেখানে মূল সূত্র দেয়া আছে।
মন্তব্য
ধর্ষণের স্বীকার = শিকার।
****************************************
ঠিক করে দিয়েছি। ভুল ধরে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের [আইপিপিএফ] হিসাবে ধর্ষিতার সংখ্যা ২ লাখ। যুদ্ধশিশু সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত অস্ট্রেলিয় চিকিৎসক ড. জেফরি ডেভিস এর মতে এই সংখ্যা আরো বেশি। সরকারী পরিসংখ্যানে বলা হয়েছিলো ৩ লাখ। মার্কিন গবেষক সুসান ব্রাউমিলার এর মতে এই সংখ্যা ৪ লাখ। ডব্লিউসিএফএফসি'র গবেষণায় এই সংখ্যা সাড়ে চার লাখ।
যুদ্ধপরবর্তী কালে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রর চেয়ারম্যান বিচারপতি কে এম সোবহান, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপেরিয়র সিস্টার মার্গারেট মেরি, ড. জেফরি ডেভিস, ওডার্ট ভন শুলজ প্রমুখদের কাছ থেকে জানা গিয়েছিলো যে ঐ সময় ঢাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রায় ২৩ হাজার গর্ভপাত করা হয়।
কানাডিয় ইউনিসেফ কমিটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সে সময় বাংলাদেশে ভ্রমণ করেছিলেন, স্থানীয় লীগ অব রেডক্রস সোসাইটি এবং ইউনিসেফ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তিনি অটোয়ায় ফিরে গিয়ে সদর দপ্তরে জানান যে বাংলাদেশে প্রায় দশ হাজার যুদ্ধশিশু আছে। ব্রাউমিলার বলেন 'চুলচেরা সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে যুদ্ধের পরে প্রায় ২৫,০০০ নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলো।'
৭২ সালেই যুদ্ধশিশুদের দত্তকায়ন ও অভিভাবকত্ব দেওয়ার জন্য সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক রাষ্ট্রপতির ১২৪ নম্বর আদেশ [বাংলাদেশ অ্যাবানডান চিলড্রেন {স্পেশাল প্রভিশণ} ১৯৭২] জারি করা হয়। কিন্তু কিছু শিশুদের ক্ষেত্রে অপব্যবহার বা অত্যাচারের অভিযোগ পাওয়ায় কয়েক বছর পরেই এই আইনটি বাতিল করা হয়।
নিলীমা ইব্রাহিম একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে প্রথম পর্যায়ে মৌলভীরা দত্তকায়ন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলো। কারণ শিশুদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলো পশ্চিমের খ্রিস্টান দেশগুলো।
যুদ্ধশিশুদের বড় অংশই কানাডায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। কিছু বাচ্চাকে পাঠানো হয়েছিলো ফ্রান্সে আর সুইডেনে।
'ওয়ার বেবিজ' নামে এই ডকুমেন্টরিটা দেখতে পারেন
তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে সাজিদ হোসেন এর 'একাত্তরের যুদ্ধশিশু' ডা. এম এ হাসান এর 'যুদ্ধ ও নারী', নীলিমা ইব্রাহিম এর 'আমি বিরাঙ্গনা বলছি' প্রভৃতি বই থেকে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
তথ্যগুলির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি সেকেন্ডারি রেফারেন্স ব্যবহার করেছি, আপনার সাথে অমিল আছে। খুঁজে দেখবো।
খুঁজে দেখেন। আমি মোটামুটি তাৎক্ষণিক একটা মন্তব্য করেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আরো অনেক তথ্যই আছে। লেখার ইচ্ছাও আছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
লিখে ফেলুন। আমার কাছে আরও কিছু পত্রিকার খবর আছে এবিষয়ে। দিয়ে দেব পরের পর্বে। কাজে লাগাতে পারেন।
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
পোষ্টটাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য নীচের লিঙ্কগুলো আপনার কাজে লাগতে পারে।
১। 1971: Rape and its consequences
উপরের সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ পাবেন নীচের লিঙ্কে-
২। ৭১-এ নারী ধর্ষণের ফলাফল — যা চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা
ধন্যবাদ। মূলতঃ কানাডার খবরের কাগজের লেখাগুলিকেই হাইলাইট করতে চেয়েছিলাম।
ব্যাথেল (Bathel) নামটা সম্ভবত বাদল হবে; কমেন্টের প্রামাণ্যচিত্রটিতে 'রায়ান বাদল' এর কথা বলা আছে। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ, এরকম লেখা খুঁজছিলাম মনে মনে।
কুণ্ঠিত পান্থ
আসলেই তো, আমার মাথায় আসেনাই। অনেক ধন্যবাদ। মূল পোষ্টে ঠিক করে দিচ্ছি।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন