এটা কোন সমবেদনামূলক বা রাগ ঝাড়ার বা কতবড় ক্ষতি হল সেই হিসেব করার লেখা নয়। সমস্যাটা সমাধানে কী করা যায়, ভবিষ্যতে এধরনের সমস্যায় কী করতে হবে সেসব নিয়ে আমার ভাবনা। একটা আউটলাইনও বলতে পারেন।
তেল বির্পযয় সমাধানে যে ৫ টি উপায় অবলম্বন করা যায় সেগুলি নিচে বর্ণনা করা হল:
এই কাজটি সর্বপ্রথম ধাপ। যে স্থানে তেল পড়েছে, বা বিপর্যয়ের স্থানে যত দ্রুত সম্ভব ঘের দিয়ে ফেলতে হবে। তেল পানিতে ভাসমান, এবং পানিতে খুব বেশি মিশে যায় না। তাই একে স্থানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ রাসায়নিক বা অন্য দ্রব্য ব্যবহারের চেয়ে সহজতর এবং নিরাপদ। আমাদের দূর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যদি এই কাজটি অতিদ্রুত করতে পারতেন তবে এত স্থানে তেল ছড়াতো না। কিন্তু এখনও সুযোগ আছে। যেমন, যেসব খবর এবং ছবি পাচ্ছি সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে চিকন নালা বা সরু নদীতে তেল ঢুকেছে। ঘের দেয়ায় নদী বা নালার সুবিধা হল এর দুইদিকে পথ বন্ধ করে দিলেই হয়। তেল যেদিক থেকে ঢুকছে তার উল্টা দিকে এভাবে ঘের দেয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। এই কাজটি স্থানীয় মানুষজন করতে পারেন। কিভাবে করবেন?
ছবি: এরকম খাল বা নদীগুলির ভাসমান মুখ খুব সহজেই বন্ধ করে দেয়া যায়। http://www.bbc.com/
পানিতে ভাসমান কোন বস্তু, যেমন, ড্রাম, প্লাস্টিকের ব্যাগ এসব একটার সঙ্গে আরেকটা বেঁধে নদী বা নালার এপাড় থেকে ওপাড় বন্ধ করে দিন। এসব বস্তু পানিতে ভাসবে (ড্রাম ব্যবহারের সময় কিছু পানি ঢুকিয়ে ড্রামগুলিকে অর্ধভাসমান বানালে সবচেয়ে ভাল)। লক্ষ্য রাখতে হবে যে পানির দুই দিকে কিছু অংশেও ড্রাম থাকলে ভাল। কারন জোয়ারে পানি উপরে উঠে আসে এবং নদীর দুই দিক প্লাবিত হয়। সেজন্য ঘের দেয়াটা জোয়ারের সময়ে করলেই ভাল। এরকম ঘের দেয়ার জন্য কিছু ভাসমান বস্তু (ছবিতে দেখা যাচ্ছে) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে থাকার কথা। তারা স্থানীয় মানুষদের কাছে এসব সরবরাহ করে সাহায্য করতে পারেন এখনও।
ছবি: সুন্দরবনে তেলকে ঘের দেয়ার পদ্ধতি (prothom-alo.com/)
ঘের দিয়ে পানি যেমন আছে তেমন রেখে দিন। প্রাকৃতিকভাবেই তেলগুলি চলে যাবে, তবে বেশ কিছু সময় লাগবে। যেসব উপায়ে তেল অপসারিত হবে সেটা হল প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদ্ধতি, তাপ এবং বায়ুপ্রবাহে হয় তেল ভেঙে যাবে বা উড়ে যাবে। এই পদ্ধতির সমস্যা হল সময়; ফলে প্রাথমিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলি ঘটবেই।
বাংলাদেশে যেসব বিপর্যয় ঘটে তার মধ্যে তেল বিপর্যয় প্রায় শেষ দিকে চিন্তা করার কথা। ঘূর্ণিঝড়, পাহাড় ধ্বস, ভূমিকম্প, বন্যা, আর্সেনিক, রোগবালাই ইত্যাদির জন্যই আমরা প্রস্তুত থাকি। ফলে দেশে বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা হয়তো ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গিয়েছে এই নতুন বিপর্যয়ে। কিন্তু এখনও এই ঘের দেয়ার কাজটি সঠিকভাবে করে প্রাকৃতিকভাবে তেলকে সরানোর ব্যবস্থা করা যায়। আর তেলকে এক জায়গায় আবদ্ধ করে রাখলে সুন্দরবনের জীবেরা হয়তো সেসব এলাকা কিছুদিন এড়িয়ে যাবে, এবং পরে তেল সরে গেলে ফিরে আসবে। খুব বড় বিলুপ্তির মত ঘটনা ঘটবেনা।
আরেকটা কাজ করা যায়। একধরনের রাসায়নিক ছড়ানো, যাকে ইংরেজিতে বলে ডিসপার্সেন্ট। এগুলি পানি এবং অন্যান্য বস্তু থেকে তেলকে ভালভাবে পৃথক করে রাখে। মানে তেল খুব সহজে কিছু গায়ে লেগে যেতে পারেনা। এই লিংকে মেক্সিকোর সমুদ্রে তেল বিপর্যয়ের সময় ব্যবহৃত একটি কার্যকর ডিসপার্সেন্ট এর খবর পাবেন, যেটা সামুদ্রিক জীবের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিয়েছিল। অর্থাৎ ডিসপার্সেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতির ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে।
এই পদ্ধতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। পাত্রে করে তেল তুলে পানি থেকে সরিয়ে ফেলা। কার্যকরী পদ্ধতি, যদি না তেল বেশি ছড়িয়ে পরে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে এটা এখন গুরুত্ব হারিয়েছে, তেল ছড়িয়ে পড়েছে বিধায়। এই পদ্ধতিতে তেল দূষণ ছড়ানো বেড়েও যেতে পারে, যদি স্থানীয়রা যুক্ত হন এবং সঠিকভাবে তেলকে প্রক্রিয়া করতে না পারেন, একজায়গায় ধরে রাখতে না পারেন। আবার তৈলদ্রব্য নিয়ে কাজ করার অজ্ঞতা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
ছবি: এমন স্থান থেকে সম্ভবত পাত্র দিয়ে তেল তুলে অপসারণ সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। http://phys.org/
তেল স্থলে খুব বেশি ছড়ানোর কথা নয়। তাই কিছু সময় পরে এমনিই প্রকৃতি সরিয়ে ফেলবে স্থলের উপরিভাগের তেল। কিন্তু ব্যাপারটাকে ত্বরান্বিত করা যেত কিছু জৈব উপায়ে। কিন্তু এমনটা করা যেত যদি দেশে ভাল বায়োটেকনোলজি ল্যাব বা গবেষণাগার থাকতো এবং এধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করতো। যারা তেল ভেঙে ফেলা অণুজীবের মিশ্রণ নদীর দুইপাশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরবরাহ করতে পারতো। এখানে একটা গল্প বলি।
আমার এক বন্ধু ভারতের ব্যাঙ্গালোর এর একটা বায়োটেকনোলজি গবেষণাগারে বড় পদে চাকরি করে। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যার জৈবপ্রযুক্তিগত সমাধান দেয়। যেমন, তাদের কাছে একবার কিছু মাছ ব্যাবসায়ী এসে বলেছিল যে তাদের মাছে ব্যাকটেরিয়া উপদ্রব খুব বেশি, ফলে বাজারজাত এবং বিদেশে পাঠাতে খুব সমস্যা হচ্ছে। আমার বন্ধু তাদেরকে কিছু ভাইরাসের দ্রবণ তৈরি করে দিয়ে দিল, যেসব ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলবে। ব্যাবসায়ীদেরকে শুধু দ্রবণটি মাছের উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। কী দারুণ হত যদি আমাদের দেশের সমস্যাগুলি সমাধানে এমন গবেষণাগার থাকতো!
আমি জানিনা দেশের কোন সংগঠন এমন উদ্যোগ নিতে আগ্রহী কিনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেল ভাঙতে পারা বিভিন্ন অণুজীব নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং হয়েছে। কিছু কার্যকর প্রাকৃতিক এবং জিনগতভাবে পরিবর্তিত ব্যাকটেরিয়া ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। যোগাযোগ করলে সেসব গবেষণাগার নিশ্চয়ই এসব অণুজীব দিয়ে সাহায্য করতে রাজী হবে। এই লিংক থেকে বিভিন্ন তেল বিপর্যয়ে ব্যবহৃত কিছু বায়োরিমেডিয়েশান দ্রবণ/রাসায়নিক/জৈব মিশ্রণের উদাহরণ এবং কোথা থেকে তাদের পাওয়া যাবে তার লিংক দেখতে পাবেন।
ছবি: স্থলের এমন তেল দূষণ দ্রুত দূরীকরণে কোন রাসায়নিক বা জৈব মিশ্রণ সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। http://bdnews24.com/
তবে এখানে বলে রাখা ভাল, এমনভাবে স্থলের তেল অপসারণের খুব বেশি উদাহরণ পাওয়া যায়না। কিন্তু আমাদেরকে তো চেষ্টা করতে হবে। এভাবেই সবচেয়ে নিরাপদে স্থলের তেল দ্রুত দূরকরা সম্ভব। পানিতে এটা করা যাবেনা হয়তো, ডাইলুটেড বা ঘনত্ব কমে যাবে বিধায়।
সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে তেলের জাহাজ চলাচল বন্ধের ব্যাপারে আমার প্রথম চিন্তা ছিল বিপক্ষে। কারনটা হল, এদিক দিয়ে বন্ধ করা হলে অন্য দিক দিয়ে তো ঠিকই তেল নিতে হবে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে পরিবহন করে। ফলে কোন না কোন নদী তো ঠিকই ঝুঁকিতে পড়ছে। তাই, পরিবহণ পথগুলি বন্ধের কথা চিন্তা না করে বরং দূর্ঘটনা এড়ানোর কথা চিন্তা করা বেশি জরুরি হয়তো।
ছবি: সুন্দরবনের যে অঞ্চলে জাহাজডুবি হয়েছে এবং যতটুকু এলাকায় তেল ছড়াতে পারে। riverdiaries.tumblr.com
পরে ভেবে দেখলাম, সুন্দরবনের বাইরে দিয়ে যদি সহজ পন্থায় বা অন্যপথে তেল পরিবহণ সম্ভব হয় তবে সেটাই করা উচিত। বনের জীবজন্তু, উদ্ভিদগুলির জন্যই। তবে মনে রাখা ভাল, অন্যপথে এমন দূর্ঘটনায় তেল ছড়ানো সম্ভাবনা আরও বেশি হওয়ার কথা, যদি নদীগুলি বড় হয়। এতে বেশি পরিমাণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ারও সম্ভাবনা। কালকে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তেল চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। শুভ উদ্যোগই হয়তো।
কিন্তু আমি এখনও মনে করি, তেলের জাহাজের দূর্ঘটনা যেকোন এলাকাতেই ভয়ঙ্কর। ফলে দূর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আরও সজাগ হওয়া প্রয়োজন।
আমি এখানে সুন্দরবনের মত তেল বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশ গ্রহণ করতে পারে এমন কয়েকটি কার্যকর ধাপের ব্যাপারে আলোচনা করেছি। পাঠকদের আইডিয়া, মন্তব্য আকাঙ্খা করছি। পোষ্টটা সেই অনুযায়ী পরিমার্জনেরও আশা রাখি।
মন্তব্য
নৌপথে তেল পরিবহনের জন্য একটি আলাদা নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি প্রবর্তন করা গেলে ভালো হতো। তেলবাহী ট্যাঙ্কারের জন্য আলাদা পর্যায়ক্রমিক তদন্তের ব্যবস্থা থাকা দরকার। যে ট্যাঙ্কারটা ডুবে গেছে, সেটা আদৌ তেল পরিবহনের উপযোগী ছিলো কি না, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়লে দ্রুত সাড়া দেওয়ার একটা প্রোটোকল তৈরি করা দরকার। সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীকে সে প্রোটোকলে অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাড়া দেওয়ার মহড়া করাতে পারলে ভালো হয়। নৌপথে দেশের অনেক জায়গায় তেল যায়, এরকম দুর্ঘটনা আবারো যদি ঘটে, আর কর্তৃপক্ষ যদি একই রকম ঢিমেতালে প্রতিক্রিয়া দেখায়, ক্ষতি অনেক বেশি হবে।
অবশ্যই। এমন একটা দূর্ঘটনা থেকে শেখার ব্যাপারটাকে এখন গুরুত্ব দিলেই হয়। পৃথিবীর বহু দেশেই সম্ভবত এমন প্রোটোকল তৈরি করা আছে, বিশেষ করে যারা তেল উৎপাদন, পরিবহন এবং বাজারজাতে যুক্ত। তাদের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
দুঃখজনক সত্য হল তেল তো ভালো, অনেক যাত্রীবাহী লঞ্চেরও যাত্রীবহনের উপযোগিতা হারানোর পরে সেগুলো মানুষ পরিবহন করে যায়।
খুবই সময়োপযোগী একটা পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
যত্ন নিয়ে লেখা সময়োপযোগী পোস্ট।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন