খাঁচায় বন্দি পাখি আমি কখনওই পছন্দ করিনা। কিন্তু আমাদের কাছে দুইটা পাখি ছিল যারা খাঁচাকেই ঘর বানিয়েছে। হাতে যখন এসেছিল তখন খাঁচাকেই দুনিয়া ভাবে তারা। পাখিগুলিকে বলে 'বাজি' (budgie), অষ্ট্রেলিয়ার মরুভূমির পাখি। ছোট আকারের টিয়া পাখি বলা যায়। এই সুদূর কানাডায় তাদেরকে আনা হয়েছিল পোষা পাখি হিসেবে পালার জন্য। তাদের কয়েক বংশধর পরের প্রজন্ম হল এই পাখিগুলি।
পাখিগুলি একজন মানুষ আমাদেরকে বিনামূল্যে দিয়েছিলেন। তাঁর নাতনির জন্য কিনেছিলেন, কিন্তু নাতনি কয়েকদিন পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় তিনি আর এদের ভরণপোষনের দায়িত্ব নিতে চান নি। প্রথমে যখন আমরা পাখিগুলি পাই তখন আমি ভাবলাম ছেড়ে দেব। তবে শীতকাল ছিল বলে কানাডার ঠান্ডায় এদের ছেড়ে দিলে ঘন্টাখানেকও বাঁচতোনা হয়তো। পরের বছরের গ্রীষ্মের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ততদিনে আমাদের বেশ চিনে গিয়েছিল তারা। খাবারের জন্য ডাকাডাকি করতো দেখতে পেলে। তবে ছোটবেলাতেই পোষ মানানো হয়নি বলে এরাও পোষ মানতে চাইতো না। ধরতে গেলেই কামড় খেতে হত। আর খাঁচার বাইরে আসতে চাইতো না। জোর করে বের করে দিলেও হয় খাঁচায় ফিরে আসতো, না হয় দূরে বসে থাকতো খাঁচায় কিভাবে ঢুকবে বুঝতে না পেরে। সেটা আরও ঝামেলার, খাঁচার বাইরে খাবার কোথাও রেখে দিলে খেতে হবে এখান থেকে তাও বুঝতো না। খাঁচার ভেতরেই ঢুকতে হবে তাদের, সেখানেই সংসার।
গ্রীষ্ম এসে গেল, আমারও মনে হল এখন ছাড়ার সময় হয়েছে। তবে তার আগে একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম এরা কানাডার বন্য পরিবেশে বাঁচবে কিনা। বুঝতে পারলাম যে বাঁচবে না, হয়তো একদিনেরও বেশি। কারনগুলি হল- ১] খাবার খুঁজে পাবেনা কানাডার পরিবেশে। মুক্ত জায়গায় খাবার খোঁজার স্কিল ও তাদের নাই। ২] বন্য পরিবেশে বেঁচে থাকার যেই ইন্সটিংক্ট জীবের আছে, যেই স্কিল দরকার সেগুলি পাখিগুলির নাই। মাথার উপরে বাজপাখি ঘুরতে দেখলে বরং এরা বিপুল উৎসাহে চেচামেচি করে। লুকানোর কোন চেষ্টাই থাকেনা। ৩] গ্রীষ্মে না হয় বাঁচলো, কিন্তু ঠান্ডা এলে বাঁচবে কিভাবে? তাই ভাবলাম, যদি কোনদিন অষ্ট্রেলিয়া যাই (আমার কাজের জন্য যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল) তবে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। তাদের ভাইবোনদের সাথে কোন পালে মিশে গিয়ে হয়তো বেঁচে থাকতো তারা।
কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে দুটা পাখিই মারা যায় সম্প্রতি। সেই করুণ কাহিনী আর এখানে বলছিনা। শোক কাটিয়ে আমি একটা ছোট ব্যক্তিগত প্রকল্প হাতে নিয়েছে মৃত পাখিগুলিকে নিয়ে; তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এবং ব্যক্তিগত আগ্রহ মেটানোর জন্য। ধারনাটা পেয়েছি একটা ইতালীয় ডিজাইনার দলের কাছ থেকে। তারা মানুষের মৃতদেহকে গাছ বানিয়ে ফেলেন।
মানুষকে সমাধিত করবার জন্য এই অভিনব প্রস্তাবটি করেন ইতালীয় দলটি। তাদের প্রকল্পের আউটলাইনটা এরকম:
সমাহিত মানুষটির দেহ থেকে জৈবাণু শুষে নেবে গাছ, বাড়বে, বাঁচবে, বংশবৃদ্ধি করবে। এভাবে গাছটাই যেন মৃত মানুষটির প্রতীক হয়ে যাবে। বিভিন্নধরনের গাছ দিয়ে সমাধি তৈরি করা যায়।
আবার এভাবে যেমন ব্যক্তিগত সমাধি তৈরি করা যায় তেমনি অনেকগুলি গাছ-মানুষ (বা মানুষ-গাছ) নিয়ে সমাধিস্থলও তৈরি করা যায়। অনেকগুলি উদ্ভিদ-সমাধি মিলে তৈরি হতে পারে এক অনন্য স্মৃতির বন!
শেষকৃত্য এবং সমাধির জন্য এইটা একটা অসাধারণ ধারণা। মানুষের মৃতদেহকে আমরা বিভিন্নভাবে কাজে লাগাতে পারি। চিকিৎসা এবং গবেষণায় ব্যবহারের পর এই ধারণাটাকেই আমার সবচেয়ে দারুণ মনে হয়েছে।
আমিও এমন একটা সমাধি তৈরি করতে চাইলাম আমাদের পাখিগুলি জন্য। তৈরির আউটলাইনটা নিচের ছবিতে দেয়া হল:
আমি পছন্দ করেছি একটা ছোট ক্যাকটাস প্রজাতি, Echeveria গণের। এই উদ্ভিদগুলি বেশ কিছুদিন বাঁচে, এদের দেহ থেকে আবার নতুন উদ্ভিদ তৈরি করা যায়। মানে বাডিং পদ্ধতিতে অনন্তকাল প্রজন্মান্তর করানো সম্ভব। আবার আকারে ছোট বলে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাও যাবে, আমরা বাসা, স্থান, শহর বা দেশ পরিবর্তন করতে গেলে। দেখতে এমন হল:
সময়ের সাথে পাখিগুলির মৃতদেহগুলি পঁচে, গলে মাটিতে মিশবে। সেখান থেকে তার দেহের জৈবাণুগুলি আস্বাদন করবে ক্যাকটাসটি, বেড়ে উঠবে, কোন এক সময়ে ফুলও দেবে। পাখিগুলি বেঁচে থাকবে গাছ হয়ে। এটাই পৃথিবীর জৈবিক ইতিহাস। এমন জীবনান্তর ঘটে চলেছে বিলিয়ন বছর ধরে।
মন্তব্য
পাখিযুগলের জন্য ভালবাসা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ
মানুষ গাছের ধারনাটা পড়ে অনেকগুল হরর গল্পের প্লট মাথায় চলে এলো।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
লিখে ফেলো
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
লিখে ফেলেন
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ভালো লেগেছে আইডিয়াটা
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
পাখির শোক কাটিয়ে উঠুন। ক্যাকটাস গাছে ফুল ধরলে এই পোস্টের মন্তব্যে তার ছবি যোগ করে দিয়েন।
তখন হয়তো একটি পোষ্টই দিয়ে বসব
পাখি যুগলের জন্য ভালবাসা। আমার পোষা বিড়াল চ্যাপলিনের মৃত্যুর সময় এই বৃক্ষ সমাধির বিষয়টি যদি জানা থাকত! ;-(
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
হুমম..
ইতালীয় ডিজাইনার দলের অসাধারণ এই ধারণাটি পড়ে খুবই মুগ্ধ হলাম।
আমি তোমাদের কেউ নই -> আতোকেন
ভালো লাগলো আইডিয়াটা।
মানুষ গাছের প্রস্তাবটি বেশ আগেই কোথাও পড়েছিলাম। আমার কাছে এটা অভিনব মনে হয়নি। আর পাখিগাছের আইডিয়াটাও চমৎকার হিসাবে গ্রহন করছি। আমাদের দেশে সত্যিই যদি মানুষ গাছের বাগান দেখা যেতো মানুষের সমাধিস্থল জুড়ে!!!!!
Jaraahzabin
এটা আমি ২০১৪ সালে প্রথম পড়েছি। আপনি কত আগে পড়েছেন বুঝতে পারছিনা। আমার কাছে অভিনবই মনে হয়েছে। আমাদের দেশে সমাধিস্থলে গাছ লাগানোতে ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকতে পারে।
দারুণ
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
পাখি-গাছ বড় হোক, বেঁচে থাক। ভালবাসা পাখিদের জন্য, গাছেদের জন্য।
দেবদ্যুতি
পৃথিবীর সকল জীব সুখী হোক।
রবিকবিতায় তালগাছ পাখিদের মত ডানা মেলে উড়াল দিতে চেয়েছিল, পারে নি। আপনার কর্মকান্ডে মৃত পাখিরা গাছ হয়ে যাবে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ভাল বলেছেন!
কর্মসূত্রে আমাকে সারা বছর অনেক ট্রাভেল করতে হয়। আমার বউ ঠিক এই ছবির মত দেখতে দুটো বাজি কিনে এনেছিল বছর চারেক আগে কথা বলে সময় কাটানোর জন্যে। দুটো পাখিই বুড়ো ছিল। নাম দেয়া হয়ে ছিল কিকি আর পপ।
সবুজটা বছরখানেক আগে মারা গেল, নীলটা তখন খাওয়া বন্ধ করে বসে থাকল। আমরা ভেবে ছিলাম ছেড়ে দেব, কিন্তু ছেড়ে দিলেও ও উড়তে পারত না, ঘুরে ঘুরে খাচার ভেতর ঢোকার চেষ্টা করত। বাধ্য হয়ে আর একটা সবুজ দেখে এনে দিলাম। কয়েক সপ্তাহ আগে নীলটা মারা গেল, সবুজটা এবার খাওয়া বন্ধ করে বসে থাকল, ডাকডাকিও বন্ধ। আবার গিয়ে একটা নীল নিয়ে আসলাম। রাতে ওরা আমার ঘরে থাকে। সকালে চেঞ্জ করতে ঘরে ঢুকলেই মহা উতসাহে তারা ডাকাডাকি শুরু করে।
অনেক বড় মন্তব্য হয়ে গেল কিন্তু ছবিটা দেখে কথাগুলো না বলে পারলাম না।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
হুমম, এরা অনেক মায়ায় জড়ায়। নিজেদেরকেও, মানুষকেও
বাবার কবরের পায়ের কাছে একটা নিমগাছ ছিল, আর মাথার কাছে রক্তজবার ঝাড়। নিমগাছটা বেড়েছিল প্রায় দশ মিটারের মতো, রক্তজবার ঝাড় ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল। গোটা কবরস্থানটা তো আর আমাদের ছিল না, অথবা আমরাও প্রতিদিন সেখানে যেতাম না, তাছাড়া আমাদের জানা ছিল না নিমগাছে কাঠ খুব দামী; তাই একদিন দেখা গেল নিমগাছটা কারা যেন করাত দিয়ে গোড়া থেকে কেটে নিয়েছে। আরেকদিন দেখি রক্তজবার ঝাড় মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে গেছে। পিতার অস্থি-মাংস শুষে বড় হওয়া নিমগাছ আজ হয়তো কারো ঘরে ফার্নিচার হয়ে আছে, আর মৃত রক্তজবা হয়তো জ্বালানী হয়ে কারো খাবার রান্না করেছে।
গাছ লাগালেই শুধু চলবে না, গাছটাকে বাঁচাতেও হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
যত্নেই রেখেছি। সঙ্গে নিয়ে ঘুরবো বলে ছোট গাছ, ছোট টব।
বাহ, আমাদের বার্ড ক্লাবের সদস্যদের দেখাব। মানব গাছেরটা আগেই দেখেছিলাম, পাখির টা প্রথম দেখলাম।
facebook
ধন্যবাদ। তাঁরা কী বলেন জানাবেন।
দারুন আইডিয়া।
যারা মেডিক্যালে মৃতদেহ দিতে চান না তাদের এভাবেই দেহ কাজে লাগানো উচিত।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
বাহ!!
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন