কার্তিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক, বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান, সুলতানপুর গ্রামে। চট্টগ্রামের অন্য বহু জায়গার মতই এই গ্রামও রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্ত্রাসের এলাকা ছিল একসময়। ঘন্টাদুয়েক আগে কার্তিক ফেইসবুকে লিখেছে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্ত্রাসীগণ তার মামলার সাক্ষী দেয়ার জন্য ভীতি প্রদর্শন করছিল তাদের গ্রাম এবং পরিবার কে। কুখ্যাত রাজাকারটার ফাঁসির রায় বহাল রয়েছে। প্রতিটা রায়ের পরবর্তী রাতের মতই আজকের রাতটা গুরুত্বপূর্ণ কার্তিকদের জন্য, তাদের উপর হামলা হতে পারে এই সংশয় থাকে। জেগে থাকতে হবে, পাহারা দিতে হবে গ্রাম।
কার্তিক কে তার পোষ্টটা ব্লগে দিয়ে যেতে বলেছিলাম। তার সময় হয়নি, টহলে যেতে হবে এখনই। আমাকে দিয়ে দিতে বলল। কার্তিক তার গ্রামের মানুষ রক্ষা করতে টহলে গিয়েছে।
আসুন আমরা লেখাটা পড়ে ফেলি, আর তাদের গ্রামকে শুভকামনা জানাই।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত ৫ নং অভিযোগ যাতে তার ফাঁসির আদেশ বহাল রয়েছে, রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের নেপাল চন্দ্র ধর সহ অনেক মানুষ হত্যা, সেই নেপাল চন্দ্র ধর সম্পর্কে আমার জ্যাঠা হন। আমার গ্রামের বাড়ি রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের দক্ষিণ বণিক পাড়া। নেপাল জ্যাঠার ঘর আর আমার ঘরের মধ্যে আর একটি মাত্র ঘর, দূরত্ব এতটাই কম। দাদি বেঁচে থাকতে উনি যুদ্ধের গল্প শুনাতেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে রাতের আঁধারে রামগড় দিয়ে ত্রিপুরা পালিয়ে যাওয়ার গল্প, শরণার্থী শিবিরের গল্প, অপুষ্টিতে মারা যাওয়া দাদির বড় ছেলের গল্প, সিমান্তের কাছাকাছি যুদ্ধের গল্প, মর্টার শেলকে কলার মোচা ভাবার গল্প, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে বসত বাড়িতে ঘরের বদলে মাটির স্তুপ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার গল্প, আরো কত কি। যে গল্পটি তিনি এড়িয়ে যেতে চাইতেন তা এ সাকা চৌং এর গল্প। কদাচিৎ বললেও খুব নিচু গলায় বলতেন, বলার সময় উনি শিউরে উঠতেন কিনা বুঝতাম না, তবে এতটুকু বুঝতে পারতাম সাকার নির্যাতনের কাহিনী তিনি বলতে খুব একটা নিরাপদ বোধ করতেন না এমনকি যুদ্ধের ৩০ বছর পরও। ছোটকাল থেকে আমরা শুনে এসেছি সে সব কাহিনী, প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে, যেসব কাহিনী শুনলে যে কারো রোম খাঁড়া হয়ে উঠবে। নেপাল চন্দ্র ধর পাঞ্জাবিদের (পাক বাহিনীকে আমাদের এলাকায় পাঞ্জাবি বলা হয়) আসার খবর শুনে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঘরে ফেলে আসা রান্না করা ভাতের হাঁড়িটি আনতে গিয়ে ধরা পড়েন, পরে শহীদ হন। তিনি তাঁর মার একমাত্র ছেলে ছিলেন। একমাত্র সন্তান হারিয়ে বাকিটা জীবন উনার মা ভিক্ষা করেই পেট চালাতেন।ট্রাইবুনাল গঠনের পর, জীবিত সাক্ষীদের মধ্যে আতঙ্কের চরমরূপ আমি দেখেছি। আমার বাড়িতে অন্তত ৬-৭ জন আছেন যারা আমাদের বাড়িতে ঘটানো সাকার অপকর্মের সাক্ষী। কিন্তু সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ৩ জনকে সাক্ষী হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়, যার মধ্যে ২ জন সাক্ষ্য দেওয়ার ভয়ে ভারতে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় বার বার করে সবাইকে আকুতি জানিয়ে যান যে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে কেউ যেন কোন তথ্য না দিই। প্রসিকিউশান তাঁদের বাড়িতে আসলে, তাঁদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় কেউ মুখ খুলেন নি। কিন্তু, অনিল বরণ ধর, যিনি পাক বাহিনীর গুলিতে তাঁর একটি হাত হারান, তিনি পালিয়ে যেতে পারেন নি সীমিত অর্থ সামর্থ্যের জন্য। সাক্ষ্য চলাকালে তাঁরে চোখেমুখে ভয়ের বিভীষিকা দেখেছে সবাই, আজ তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে গুপ্ত স্থানে নির্বাসিত আছেন, আমিও জানিনা তিনি পরিবার নিয়ে কোথায় থাকেন।
প্রতিটা রায়ের সময় বাড়িতে আতঙ্ক বিরাজ করে, সাকার রায়ের ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। আজও বাড়িতে সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। তবে আগের সেই রাউজান নেই, রাউজানে হরতাল হয়না, গাড়ি পুড়েনা, পেট্রোল বোমায় রাউজানে কেউ দগ্ধ হননি। জঙ্গিবাদের স্থান রাউজানের নেই। ফজলে করিম থাকতে আমাদের চিন্তার কারণ আছে বলে মনে করিনা। কিন্তু কাপুরুষের দল পিছন থেকেই ছোড়া মারে, তাই আমাদেরও সতর্ক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। রাতে বাড়িতে পাহারা বসানো হবে, আমিও সার্ভিলেন্স টিমের সদস্য। টিমের জন্য আখনি বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে, সাথে তেলাপিয়া মাছ ভাঁজি। খেলারাম খেলে যা, আমরাও জেগে আছি।
জয় বাংলা।
(ফেইসবুক পোষ্টটি লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত)
মন্তব্য
প্রথম বাক্যটির পর যে দ্বিতীয় বাক্যটি এল, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, ভেবেছিলাম, দ্বিতীয় বাক্যটি হবে, আজকের রাত কার্তিকদের জন্য উৎসবের রাত্রি। কিন্তু বাস্তব এমনই কঠিন! আজ আমরা যখন রাজাকারের বিচার উদযাপন করতে থাকি, তখন আমাদের অজান্তেই এই বিচারকে সম্ভব করে তুলেছেন যারা, সেই অনিল বরণ ধরদের গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে থাকতে হয়! এমন আরও সাক্ষীর কথা মিডিয়ায় এসেছে আগে, যারা এখনো প্রাণভয়ে পালিয়ে রয়েছেন ঘর-বাড়ি ছেড়ে। আর এখানেই চলে আসে বিচারের একটি অপূর্ণতা! রাষ্ট্র একজন ভয়ানক অপরাধীর বিচার করতে সক্ষম হলেও সেই বিচারকে সম্ভব করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে!
পোস্টটি তুলে দিয়ে খুব সময়োপযোগী একটা কাজ করেছেন, সজীব ভাই। আজ বিচার উদযাপনের আনন্দে ভেসে আমরা যেন অনিলদের ভুলে না যাই, ওদের জন্য আমরাও যেন সবাই মিলে নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরী করি, না হলে বিচারের আনন্দ যে অপূর্ণ থেকে যাবে!
।।।।।।।।।।।
অনিত্র
হুমম। খুবই জরুরী এই নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করাটা। আমার আরেকজন পরিচিত জন, শ্রদ্ধেয়, সাক্ষ্য দিয়েছেন সাকার বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকার যদি কোনদিন না থাকে ক্ষমতায় (সেটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল), তবে পরবর্তীতে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। যদিও এই অসীম সাহসী মানুষেরা তার তোয়াক্কা করেন না। তবুও তাদের নিরাপত্তা দেয়াটা খুবই জরুরী। আর এই সরকারই যদি তা না দেয়, তবে কে দেবে?
কার্তিকের জন্য।
কার্তিকেরা জেগে থাকুন, জাগিয়ে রাখুন!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
জাগিয়ে রাখুন
প্রতিটি রাজাকারের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোতে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত স্বাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একসময় আর কেউ স্বাক্ষ দিতে আসবে না।
কার্তিকদের মতোই আরো অনেকেই আছেন যারা প্রতিটি রায়ের দিনই নির্ঘুম রাত কাটান। একেকটা রাত, একেকটা সপ্তাহ যেন একেকটা যুগের চেয়েও দীর্ঘ মনে হয় তাঁদের কাছে। তবুও রাষ্ট্র এই বিষয়ে উদাসীন।
কিন্তু চিহ্নিত রাজাকারের চিকিৎসা সেবা দিতে তাঁরা আবার বদ্ধপরিকর।
আমরা রায় শুনে মিষ্টি, কাচ্চি কতোকিছুই খাই। কিন্তু ভুলে যাই কার্তিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। আমার মনে হয়, এখন সময় এসেছে স্বাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করার।
রাষ্ট্র নয়, সরকার। রাষ্ট্র ও সরকার দু'টো দুই জিনিস। আপনি যা বলতে চাইছেন তাতে সরকার শব্দটা মানানসই।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হুমম।
কার্তিকের গ্রাম জেগে থাকুক অনন্তকাল, উৎসবে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আমিন
নিরাপদ দূরত্বে থেকে এঁদের সাথে গলা মিলিয়ে জয় বাংলা বলতে নিজেকে ঊনমানুষ মনে হয়। সবাই ভালো থাকুক, রাজাকারমুক্ত হোক বাংলাদেশ। জয় বাংলা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
হুমম।
জয় বাংলা
পঁচাত্তুর পরবর্তী সময়ে আমাদের এলাকায় খুব ডাকাতের প্রকোপ ছিল। তখন আমি সবে হাই স্কুলে উঠেছি। তখন বড়দের দেখেছি পালা করে প্রতি রাতে গ্রাম পাহাড়া দিতে। স্বনির্ভর কার্তিকদের গ্রাম পাহাড়া দেবার কথা শুনে সে দুঃসহ স্মৃতি মনে বেজে উঠল। যে কার্তিকরা জীবন বাজি রেখে স্বাক্ষী দিয়ে জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করছে। তাদের সামান্য নিরাপত্তা পর্যন্ত আমরা দিতে পারছি না, এমনকি সে চেষ্টা পর্যন্ত করছি না। দেশে দেশে সরকারগুলো বুঝি এমনই হয়। তাদেরকে গণদাবীর গুতা দিতে না পারলে তারা সক্রিয় হয় না। তাদের কানে পানি যায় না। এই সেদিন রাজন ইস্যূতে একটি গুতার মত গুতা দিয়ে আমরা যেমন সরকারকে কিছুটা হলেও সক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিলাম ঠিক তেমনি ভাবে মিডিয়া এবং আমরা মিলে সরকারকে স্বাক্ষী সুরক্ষার বিষয়ে সক্রিয় করতে পারলে জাতির কলঙ্ক মোচনের পথ আরও সুগম হতো।
শুধু সরকারের অপেক্ষায় না থেকে আমরা কার্তিকদের আশেপাশের গ্রামে যারা আছি তারা যেন তাদের সাথে রাত জেগে পাহাড়া দিয়ে তাদেরকে বুঝাতে পারি যে তারা একা নন, আমরাও তাদের পাশে আছি তবে সেটা হবে প্রকৃত সুরক্ষা। যেটা হবে পুলিশ দিয়ে সুরক্ষা দেয়ার চেয়ে অধিক টেকসই/লাগসই।
তোমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতা ক্ষমা করো কার্তিক। ক্ষমা করবেন যুদ্ধে হাত হারানো বীর অনিল বরণ ধর। জানি না আমরা আপনাকে সসম্মানে, পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে, আপনারই অঙ্গমূল্যে অর্জিত স্বাধীন দেশে আপনার বাপ-দাদার ভিটায় ফিরিয়ে এনে আমাদের এ নূতন কলঙ্ক ঘোচাতে পারব কি না।
- পামাআলে
কী একেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন - আসছেন কার্তিকেরা।
নিরাপত্তার চাদর গায়ে জড়িয়ে আমরা একটা স্ট্যাটাস দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করি।
আশা করি একদিন এই অন্ধকারের শেষ হবে।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
কার্তিকদের লড়াই চলতেই থাকে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
শ্রদ্ধা জানিয়ে গেলাম!
খুব ইচ্ছে করে কিছু করি। কিন্তু দিনশেষে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস বা বড়জোর ব্লগে একটা লেখা - এর বেশি আর কিছু হয়ে ওঠে না! এই অসীম সাহসী মানুষগুলোর কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে, আর নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয়। শুভকামনা জানানো ছাড়া আর কিছু করার নেই, তাই শ্রদ্ধা আর শুভকামনাই জানিয়ে যাই।
____________________________
ফেসবুক স্ট্যাটাস আর ব্লগে পোস্ট দেওয়ার বাইরে আর কিছুই করবার সামর্থ্য নেই। কার্তিক দা'র প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। যার আপনজন হারায় কেবল সেই বুঝতে পারে আপনজন হারানোর বেদনা।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন