উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থা এবং অর্থনৈতিক প্রভাব

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০১/২০১৬ - ৯:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যেকোন দেশের জন্য বিজ্ঞান গবেষণার উৎকর্ষ কেন প্রয়োজন সেটা বোধকরি খুব ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নাই। দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত উন্নতিতে, নিজস্ব পণ্য উৎপাদনে, দেশের সমস্যা সমাধানে নিজেদেরই অবদান রাখার জন্য, সর্বোপরি সার্বিক উন্নতি সাধন এবং বিশ্বে মর্যাদাবান অবস্থান প্রাপ্তির জন্য উন্নত মানের বিজ্ঞান গবেষণার উৎকর্ষের প্রয়োজন আছে। এই উন্নতি না ঘটিয়ে একটি দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। সেজন্য আমাদের দেশের উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণার হাল বোঝাটা অত্যন্ত জরুরী।

বাংলাদেশে উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণার হাল

বিজ্ঞান গবেষণার মান বোঝার অন্যতম সঠিক এবং কার্যকর পদ্ধতি হল গবেষণাগুলি থেকে প্রকাশিত নিবন্ধের মান পর্যবেক্ষন। বিখ্যাত প্রকাশণা সংস্থা নেচার (Nature) প্রতিবছর তাদের একটি ওয়েবসাইটে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞান গবেষণার হাল প্রকাশ করে (সূত্র ১)। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞান পত্রিকাগুলোতে প্রকাশণার সংখ্যা এবং সেসব গবেষনায় বিভিন্ন দেশের সংস্থাগুলির অবদানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এই তথ্যভান্ডার যা নেচার ইনডেক্স নামে পরিচিত। গবেষণাগুলিকে মোট ৪টি বিভাগে ফেলা হয়েছে: রসায়ন, ভূ- এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং ভৌত বা পদার্থবিজ্ঞান। একটি দেশে কী কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে, তাদের মান কেমন, কাদের সঙ্গে সমন্বিত গবেষণা হচ্ছে সেসব বুঝতে সাহায্য করে এই তথ্যভান্ডার। একটি দেশের গবেষণার অগ্রগতি কেমন, অন্যান্য দেশের তুলনায় কী অবস্থায় আছে সেসব বুঝতেও সাহায্য করে।

www.natureindex.com নামক এই সাইটে বাংলাদেশের হাল খুঁজতে গিয়ে হতাশাজনক ফলাফল পেলাম সম্প্রতি। সচলায়তন ব্লগে ফলাফলটি প্রকাশ করেছি কিছুদিন আগে 'বাংলাদেশে উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণার হাল: নেচার ইনডেক্স ২০১৪ - ২০১৫' শিরোনামে (সূত্র ২)। প্রথমে ফলাফলগুলির একটি সারাংশ এখানে উল্লেখ করে নেই।

২০১৪ - ১৫ সালে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উচ্চমানের গবেষণায় ১৮টি প্রকাশিত নিবন্ধে বাংলাদেশের গবেষকগণ জড়িত যারা বাংলাদেশে থেকে গবেষণাকর্ম করেছেন। জীববিজ্ঞান বিভাগে গবেষণাগুলি সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে যার মধ্যে নেচার, সায়েন্স, নেচার জেনেটিক্স এর মত পত্রিকাগুলিও আছে। সবগুলি গবেষণাই সমন্বিত, অর্থাৎ বিভিন্ন গবেষণাগারের যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত। কিন্তু এর মধ্যে কোন গবেষণাতেই বাংলাদেশ পরিচালকের ভূমিকায় নেই। অর্থাৎ, অন্য কোন দেশের কোন প্রতিষ্ঠানের মূল গবেষণার সঙ্গে অংশ নিয়েছে বা তাতে সাহায্য করেছে মাত্র বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলি। এই বছরের প্রথম দশটি দেশীয় গবেষণাগারের মধ্যে বেশিরভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৭টি গবেষণার সাথে জড়িত)।

আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে তুলনা করতে গেলে সবচেয়ে বেশি হতাশ হতে হয়। উন্নত এবং ধনী দেশগুলির কথা বিবেচনায় আনাটাই মূর্খামি এখানে। এমনকি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাই চলেনা, তাদের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ, বৃহৎ এবং বিস্তৃত গবেষনার ক্ষেত্রের কারনে। কিন্তু সেজন্য, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছাকাছি পাকিস্তানের সাথে তুলনা করতে গেলে চরম হতাশ হতে হয়। দেখা যাবে ২০১৪-১৫ বছরে পাকিস্তান ৬৮ টি উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে জড়িত। তার মধ্যে ১৮টি জীববিজ্ঞান এবং ৩৮ টি ভৌত বা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রকাশিত। যেখানে, বাংলাদেশের মোট প্রকাশণাই মাত্র ১৮টি। পাকিস্তানের উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণার ধরনও বাংলাদেশের চেয়ে বিস্তৃত।

এইসব পর্যবেক্ষণ থেকেই আমার এই প্রবন্ধের সূত্রপাত। এখানে বাংলাদেশের এই শোচনীয় গবেষণার হালের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করছি।

তুলনামূলক আলোচনা যেকোন দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে পারষ্পরিকভাবে দেখতে এবং উন্নয়নের রূপরেখা তৈরিতে সহায়তা করে। আমি এখানে বাংলাদেশকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করছি কয়েকটি কারনে। আমাদের জিডিপি এবং এর প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য এবং একসময় একই দেশ হিসেবে বিরাজমান ছিলাম, যদিও প্রাক ৭১ সালে আমাদেরকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক অর্থনৈতিক শোষনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেজন্য স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে সবসময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে নেয়াটা মন্দ নয়।

অর্থনৈতিক তুলনা এবং গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ

প্রথমেই বলে নেই, আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। সেজন্য অর্থনীতির গুঢ় বিষয়গুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সাহস করছিনা এখানে। শুধু কিছু সাধারন মানদন্ড দিয়ে তুলনামূলকভাবে বোঝার চেষ্টা করছি বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা। যেমন, জনপ্রতি জিডিপি'র মান দিয়ে তুলনাটা করা চলে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের জনপ্রতি জিডিপি যথাক্রমে ১০৯৩, ১৩৩৪ এবং ১৫৯৬ মার্কিন ডলার (সূত্র ৩)। গত ৫ দশকের ট্রেন্ড বা লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে জিডিপি'র উর্ধ্বগতি অক্ষুন্ন থাকবে বাংলাদেশে, যদিনা কোন বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটে।

এখন দেখা যাক গবেষণাখাতে অর্থ বরাদ্দ বা ব্যয়ের অবস্থা কী। ইউনেস্কো সায়েন্স রিপোর্ট ২০১৫ (সূত্র ৪) বলছে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারত বাদে বাকি সব দেশ উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণায় জিডিপি'র মাত্র ০.৩ থেকে ০.৬ শতাংশ ব্যয় করে। যা ভারতের তুলনায় অর্ধেক বা তারচেয়ে কম। শিক্ষাখাতে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে জিডিপি'র ২.২৩ শতাংশ ব্যয় করেছে, যার মধ্যে মাত্র ১৩.৫ শতাংশ উচ্চতর শিক্ষায় ব্যয় করা হয়। অন্যদিকে ভারত মোট শিক্ষাখাতে ব্যয়ের ৩৭.৫৫ শতাংশ উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণায় ব্যয় করে ২০০৯ সালে (সূত্র ৪)। ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্লস ওয়ান বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে যে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ মোট জিডিপি'র মাত্র ০.০৮ শতাংশ গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে ব্যয় করেছে (সূত্র ৫)। যেখানে, পাকিস্তান তার জিডিপি'র ০.৬ শতাংশ ব্যয় করেছে। এই অবস্থার উন্নতির খুব বেশি সম্ভাবনা নেই, কারন, আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে এবছরের বাজেটে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের শিক্ষা এবং গবেষণা খাতে ব্যয় আরও কর্তন করে ধার্য্য করেছেন (সূত্র ৬)।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ এবং প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নেচার ইনডেক্স অনুযায়ী দেশ থেকে উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। এখন দেখা যাক বিশ্ববিদ্যালয়টির বাজেট থেকে গবেষণায় অর্থবরাদ্দের অবস্থা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মোট ২ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে গবেষণাখাতে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ। তাহলে একটি উন্নত দেশের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে গবেষণাখাতে ব্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন অবস্থানে আছে? তুলনা করতে পারি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে, যার বিজ্ঞান গবেষণার মান এবং ব্যাপ্তি উচ্চপর্যায়ের এবং যেখানে আমি বর্তমানে বিজ্ঞান গবেষণায় রত আছি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির বাজেট হল মোট ২ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার (সূত্র ৮), কিন্তু তার গবেষণা ফান্ড হল মোট ১.১ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ মোট বাজেটের ৫০ শতাংশের চেয়েও বেশি! যদিও ফান্ডটি আসে বিভিন্ন স্থান থেকে যার ৩১ শতাংশ বরাদ্দ হয় সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা শোচনীয় এদিক দিয়ে, তাইনা?

অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে গবেষণায় উৎকর্ষের সম্পর্ক

আগেই বলেছি, বাংলাদেশের উন্নতি সরাসরি বিজ্ঞান এবং অন্যান্য মানবিক/সামাজিক গবেষণার মানের উপর নির্ভর করছে। আর শিক্ষাখাত এবং গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রসার এবং গবেষণার মানে সরাসরি প্রভাব ফেলে। কিছুটা ব্যাখ্যা করছি।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগে বাংলাদেশ থেকে নিবন্ধ প্রকাশের সংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে ৩ গুণ কম (সূত্র ৫)। যদিও ইউনেস্কো সায়েন্স রিপোর্ট (সূত্র ৪) আমাদের জানাতে পারেনি কতটুকু ব্যয় পাকিস্তান করছে উচ্চতর গবেষণায়, তবুও আমরা প্লস ওয়ানে প্রকাশিত (সূত্র ৫) গবেষণা থেকে জানি যে গবেষণা এবং উন্নয়নে পাকিস্তানের ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে দশগুনেরও বেশি। গবেষণার মান নির্ধারনকারী এইচ-ইনডেক্স (H-index) এর মাণও বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের বেশি। এমনকি দুই দেশের মধ্যে স্নাতক এবং মাস্টার্স পর্যায়ে প্রায় সমপরিমান ছাত্রছাত্রী ভর্তি হলেও পিএইচডি পর্যায়ে বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেশি ছাত্র ভর্তি হয় পাকিস্তানে। ২০০৯ সালের সংখ্যাটা বাংলাদেশে ছিল ৭০৯০, যা পাকিস্তানে ২৩০০২। এই সংখ্যার তুলনাটা কৌতুহলকর এই কারনে যে স্নাতক/মাস্টার্স পর্যায়ের পরে বাংলাদেশে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন কমে যাচ্ছে আশংকাজনকভাবে, যেখানে পাকিস্তানে সেটা ইর্ষনীয়রকম ভাল। এখানে মূলতঃ উচ্চতর গবেষণায় আমাদের খামতি প্রকট। কারন, দেখা যাচ্ছে স্নাতক/মাস্টার্স পড়াশোনা শেষ করে (যে পর্যায়ে গবেষণাটা মূলতঃ হয়ই না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই) খুব কম পরিমান শিক্ষার্থী গবেষণায় প্রবেশ করছেন এবং পিএইচডি ডিগ্রী নিচ্ছেন।

এর কারন কী? কয়েকটি সম্ভাব্য কারন থাকতে পারে। তবে আমি প্রতিষ্ঠানগুলির অর্থনৈতিকভাবে উচ্চতর গবেষণায় মনযোগ না দেয়াটা এই সমস্যার মূল কারন বলে মনে করি। প্রথমতঃ গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ না থাকলে উচ্চাভিলাষী শিক্ষার্থীগণ উন্নতমানের গবেষণার স্বপ্ন দেখতে পারেন না, বা তাদের স্বপ্ন অঙ্কুরেই মরে যায়। দ্বিতীয়ঃ পিএইচডি করাকালীন বেতন বা ফেলোশিপের অপর্যাপ্ততা। ৪ বছরের স্নাতক ৬ বছরে শেষ করে কেই বা আবার কোন অর্থপ্রাপ্তি ছাড়া ৩ থেকে ৬ বছর ধরে গবেষণা করবেন? উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে বিজ্ঞান গবেষণায়।

উচ্চমানের গবেষণার করুণ দশার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অনেকেই হয়তো বলবেন যে দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীগণ গবেষণায় মনযোগ দেন না। কিন্তু সেটা সত্যি হলেও তার সমাধান অর্থনৈতিকভাবে করতে হবে বলে মনে করি। যেমন, যদি এমন বাধ্যবাধকতা থাকে যে উচ্চমানের গবেষণা না করতে পারলে কারও পদন্নোতি হবেনা, তবে সেই গবেষণা করার জন্যও তো পর্যাপ্ত সুবিধা চাই। শুধু বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে সমন্বিত গবেষণার দিকে তাকিয়ে থাকলে হবেনা, সেই সুযোগও বেশি পাওয়া যায়না।

ফলে উচ্চতর গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে এর উৎকর্ষের সম্পর্ক অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। পরিসংখ্যান বলছে কোন দেশের মোট জিডিপি'র কত শতাংশ গবেষণায় ব্যয় হল সেই সংখ্যার চেয়ে মোট কত অর্থ ব্যয় হল সেটাই গবেষণার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখে। মানোন্নয়নটা বোঝা যেতে পারে গবেষণালব্ধ ফলাফলের প্রকাশের সংখ্যা থেকে। আমি লেখা শেষ করছি একটা ছবি দিয়ে।

ছবি ১: এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গবেষণা এবং উন্নয়নে জিডিপি'র শতাংশে ব্যয় এবং সে তুলনায় গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের সংখ্যা। (ছবিসূত্র: প্লস ওয়ান)

ছবিটা লক্ষ্য করলে দেখবেন যে যদিও জিডিপি'র বেশ বড় শতাংশই কোন কোন দেশ বরাদ্দ করছেন গবেষণা এবং উন্নয়নে তারপরও সেসব দেশে গবেষণার প্রকাশনা তেমন হচ্ছেনা। ব্যাপারটা আসলে নির্ভর করছে কত পরিমান অর্থ ব্যয় বা বরাদ্দ হচ্ছে সেটার উপর। যেমন, চীন বা ভারত তুচ্ছ পরিমান জিডিপি'র শতাংশে ব্যয় করলেও জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় মোট অর্থের পরিমান বিশাল হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের ক্ষেত্রে যা ২০১১ সালে ছিল ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! আবার জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া ধনী দেশ বিধায় নমিনাল জিডিপি বেশি, ফলে ব্যয়কৃত অর্থের পরিমানও বেশি। এসব দেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি পরিমান গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছেন।

সেজন্য দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য এই খাতে অর্থ বরাদ্দের বিকল্প নাই। গবেষণাবিহীন দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেইজন্য আমাদের দেশের সরকারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে একটি কাঠামোয় এনে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন বলে মনে করি। সরকারকে যেমন দেশের বাজেটের আরেকটু বেশি অংশ গবেষণায় বরাদ্দ করতে হবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও নির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে হবে এর গবেষণাখাতে অর্থব্যয়ের কাঠামো তৈরিতে।

তথ্যসূত্র:
১. নেচার ইনডেক্স (www.natureindex.com)
২. বাংলাদেশে উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণার হাল: নেচার ইনডেক্স ২০১৪ - ২০১৫ (http://www.sachalayatan.com/shajib_osman/55332)
৩. ওয়ার্ল্ডব্যাংক ওয়েবসাইট (http://data.worldbank.org/indicator/NY.GDP.PCAP.CD)
৪. ইউনেস্কো সায়েন্স রিপোর্ট ২০১৫ (https://en.unesco.org/sites/default/files/usr15_south_asia.pdf)
৫. Impact of GDP, Spending on R&D, Number of Universities and Scientific Journals on Research Publications among Asian Countries, প্লস ওয়ান (http://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371/journal.pone.0066449)
৬. খবর (http://www.scidev.net/global/communication/news/bangladesh-cuts-funds-for-science-research-education.html)
৭. খবর (http://www.bonikbarta.com/news/details/45094.html)
৮. টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় (https://www.utoronto.ca/about-uoft/quickfacts)


মন্তব্য

আরিফিনসন্ধি এর ছবি

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন গবেষণা প্রকল্পে পরিচালক পদে আসীন হতে পারে না, কারন তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ গবেষনা করার মত না আছে অবকাঠামো, না আছে দক্ষ জনবল। যার কারণে, দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ সময়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে থাকে। আর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা যে প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি পালন করবে তার নাম আগে থাকবে সেটা তো বলাই বাহল্য

এবার আসি আপনার কথায়, আপনি দেশে গবেষণা না হওায়র মূল কারণ হিসাবে বলেছেন গবেষনা প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ অপ্রতুলতা। আপনাকে একটা বাস্তব ঘটনা বলি, আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে থেকে আমার নিজের ভার্সিটিতে অনেক পাকিস্তানী স্কলারের ছড়াছড়ি দেখছিলাম, এখন অবশ্য নেই। সেই সময় কারন জিজ্ঞেস করতে যেয়ে জানলাম, পাকিস্থানের সাবেক রাষ্ট্র নায়ক জেনারেল মোশারর‍ফ বিভিন্ন দেশের শিক্ষা মন্ত্রানলয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তি করেছেন যেন তার নিজের দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পিএইচডি করে দেশকে উন্নত করতে পারে। নিজের বিভাগে এই রকম এক পাকিশ্তানি পিএইচডি একদিন বললো, সে দেশের শিক্ষা মন্ত্রানালয় থেকে চনিয়ে এখানে পড়ছে। পড়া শেষ করে বৃত্তির শর্ত অনুযায়ী সে দেশের কোন পাব্লিক ভার্সিটিতে তাকে নূ্যনতম পাঁচ বছরের জন্য কাজ করতে হবে। তারপর সে ইচ্ছে করলে আবার পোস্ট ডকের জন্য বাইরে আস্তে পারবে। ৩ বছর আগে সে ফিরে গিয়েছে, পিএইচডি শেষ করে। তারপর গত বছর আবার তার সাথে দেখা বিভাগে, বললো, সে এখন তার নিজের গবেষণা গ্রুপ খুলেছে, মাস্টার্স এবং এম ফিল ছাত্র ছাত্রী নিয়ে তার দলে লোক সংখ্যা এখন ১৩ জন। খুব উচ্চমানের impact factor কোন জার্নালে প্রকাশনা না থাকলে, মোটামুটি মানের জার্নালে তার গ্রুপের প্রকাশনা নিয়মিত বের হচ্ছে।

এবার দেখুন বাংলাদেশের একটি গবেষনা প্রতিষ্ঠানের অন্য এক চিত্র। সঙ্গত কারণে প্রতিষ্ঠানটির নাম আমি বলছি না। কিন্তু আন্তজাতিক মহলে এই একমাত্র গবেষনা প্রতিস্থানটি নাম বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছে দীর্ঘ সময় ধরে। এখান থেকে বিদেশে কলাবরেশন প্রকল্পে এসেছেন বাংলাদেশের একজন গবেষক। অনেক বেশি বয়সী, ৫০ বছর বয়েসে পিএইচডি করতে এসেছেন। খুবই সাধারণ মানের গবেষণা কাজ করেছেন দির্ঘ সময় ধরে। পিএইচডি শেষ করার পর এখানে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করেছেন এবং দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছেন। দেখুন কিভাবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্থ হল। ও দিকে, তারও কিন্তু পিএইচডি শেষ করে দেশে ব্যাক করার কথা এবং প্রতিষ্ঠানকে মানোন্নয়নে সহয়তা করার কথা। অপরদিকে সেই পাকিশ্তানিটি স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েও নিজের দেশে ফিরে গিয়ে গবেষণা করছে।

এবার বলুন, দুটি দেশের গবেষণা পরিকল্পনাতে তেমন বড় কোন ফারাক নেই। ফারাক শুধু আমাদের সুযোগ সন্ধানী চিন্তা চেতনায়। এখানে কিন্তু দুই জনের দেশে ফিরে গিয়ে গবেষণা করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কেউ কাজে লাগিয়েছেন, আর কেউ নিজের আখের গুছিয়েছেন।

আমার নিজে চোখে দেখা উপমহাদেশের গবেষণা করার মানসিকতার দিক থেকে বিচার করলে, আমাদের নিজের দেশের লোকজনদের মাঝে বেশ কম, মাথা হেঁট হয়ে গেলেও এটা নির্মম সত্য কথা। কারণ, আপনি যদি ভারতের দিকে চোখ ফেরান, সেখানে অজ পাড়াগাঁয়ের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে বিদেশে পষ্ট ডক করতে কিন্তু মানুষ এই পশিমা বিশ্বে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের এক চিকিৎসকের সাথে কথা হল, যিনি শীর্ষ স্থানীয় একটি বেসরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। কথায় কথায় জানালেন, দেশে আজকাল টাকা দিলে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে কোন কাজ না করেই First Author হওয়া যায়। এবার বলুন, যেখানে মানুষ এভাবে চিন্তা করে, নিবন্ধ প্রকাশ করে পিএইচডি করে পরের পদোন্নতি পাওয়ার, সেই দেশে আর যাই হোক টাকা বরাদ্দ দিলে গবেষণা হবে সেটা বিশ্বাস করা একটু কঠিন নয় কি অথবা গবেষণা প্রবন্ধ থাকলে পদোন্নতি, কি রকম ঘটনা ঘটছে অনুমান করতে পারছেন আশা করি।

আমাদের শুরু করা উচিত গবেষণার জন্য নিবেদিত মানুষ গুলোকে খুঁজে বের করা, দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেদিন সত্যিকারের ত্যাগী, বিজ্ঞান সাধকদের জায়গা হবে, সেই দিনই গবেষণা হবে। চাটুকারের কিংবা তল্পিবাহক দিয়ে আর যাই হোক, গবেষণা হয় না হাসি

........................................................
গোল্ড ফিসের মেমোরি থেকে মুক্তি পেতে চাই
শুধু আমি না, আমার সাথে পুরো জাতি

সজীব ওসমান এর ছবি

আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলির বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু এটা মূল কারণ হিসেবে আমি দেখিনা। অর্থবরাদ্দ না দিলে কেমন গবেষণা হয় সেটা আমি পরিসংখ্যানে দেখিয়েছি। এটা নিজের মতামত নয়, বরং গবেষণালব্ধ প্রকাশনা থেকে উদ্ধৃত।

মনে করুন আপনি দেশের চান দেশের মানুষ বিজ্ঞান গবেষণায় উৎসাহী হবে, তবেই হবে গবেষণা। এখন যারা গবেষণা করবে তাদেরকে অর্থপ্রদান না করলে কি আপনি মনে করেন যে গবেষণার এই উৎসাহ বেশিদিন থাকবে? দেশে পিএইচডি কালীন গবেষণার ফান্ড বলতে কোনকিছুর অস্তিত্ব বলতে গেলে প্রায় নেই, অতি সামান্য দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া। যার গবেষণায় আগ্রহ আছে সে কি এখন কোন বেতন ছাড়া ৪-৫ বছর ধরে পিএইচডি করবে? যতই আগ্রহ থাকুক?

গবেষণায় আগ্রহী করতে হলে মানুষকে অর্থপ্রাপ্তির লোভও দেখাতে হয়। সেটা না করে শুধু আগ্রহ থেকে গবেষণা করার চিন্তা করা বৃহৎক্ষেত্রে বাস্তব কথা নয়। সেটা বাংলাদেশের জন্য যেমন খাটে, তেমনি কানাডার জন্যও খাটে। এখানে পিএইচডি'র ফান্ড বন্ধ করে দিলে সারা বিশ্ব থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তো পড়তে আসবেই না, কানাডিয় ছাত্রছাত্রীরাও গবেষণা ছেড়ে দেবে।

আরিফিনসন্ধি এর ছবি

দেশে পিএইচডি কালীন গবেষণার ফান্ড বলতে কোনকিছুর অস্তিত্ব বলতে গেলে প্রায় নেই, অতি সামান্য দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া। যার গবেষণায় আগ্রহ আছে সে কি এখন কোন বেতন ছাড়া ৪-৫ বছর ধরে পিএইচডি করবে? যতই আগ্রহ থাকুক?

ঠিক আছে আপনার কথা মানলাম, দেশে কোন ফান্ড নেই, তাই পিএইচডি গবেষণা করতে চাই না। কিন্তু বিদেশ থেকে পিএইচডি করে নিয়ে আসলে, দেশী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়। তখন কেন দেশে না আসার প্লান করি, কিংবা দেশ আসলে হাত গুটিয়ে বসে থাকি কেন ভাই ?
আপনি নিজেই নিচে উত্তর দিয়ে দিয়ে দিয়েছেন,

ভুলে গেলে চলবেনা, গবেষণায় ফান্ডিং বা অর্থবরাদ্দে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ব কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়েন, যারা গবেষণা করতে চান, বিশ্ববিদ্যালয় এদেরই।

........................................................
গোল্ড ফিসের মেমোরি থেকে মুক্তি পেতে চাই
শুধু আমি না, আমার সাথে পুরো জাতি

সজীব ওসমান এর ছবি

আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি উল্লেখ করা অংশে দেইনাই। দিয়েছি অন্য প্রসঙ্গে।

দেশে না আসার প্ল্যান করাটাও আগ্রহের কারনে নয়। অর্থনৈতিক, গবেষণার সুযোগ পাওয়া, এবং অন্যান্য সামাজিক কারনে।

অর্থ প্রদানে অন্যপ্রতিষ্ঠানগুলিকে আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ব গবেষকদেরই, বলেইছি। কিন্তু তা না হলেই সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। কারন ব্যাপারটা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, শুধু গবেষকদের দায় এটা নয়।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আরেকটি বিষয় হল, দেশে গবেষকদের জনয় যথেষ্ঠ কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা। ধরি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ‌্যালয়গুলো বছরে ১০০০ পিএইচডি ডিগ্রি র সমপরিমাণ গবেষণা শুরু করল, কিন্তু তাদের মূল্যায়ন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। শিক্ষকতা পেশায় সবাই যাবেন না। কাজেই, এই গবেষণার দিকে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হলে পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবা দরকার। পেশাগত সুযোগ কম বলে দেশে গবেষণায় আগ্রহী কম, যারা আগ্রহী তাদের বড় একটা অংশ বাইরের দিকে ঝুঁকছেন। আবার, দেশে দক্ষ গবেষকর সংখ্যা খুব বেশি না (জনসংখ্যার বিচারে) বলে গবেষণাকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। অনেকটা দুষ্টচক্রের মত বিষয়।

আপনার লেখাটা জরুরী ছিল। আমরা ঠিক কোথায় আছি তার একটা ধারণা পাওয়া গেল মন খারাপ

ভাল থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

সজীব ওসমান এর ছবি

অবশ্যই। ভাল কথা বলেছেন। সার্বিকভাবে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে হয়। তবে সেটা বাস্তবায়িত করা একদিনের কাজ নয়।

কয়দিন আগে একজায়গায় লিখেছিলাম যে গবেষণার জন্য পরিবেশ শুধু গবেষণাগারেই দরকার না, পুরো সমাজের মধ্যে দরকার। যেমন, গবেষণায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবসাও গড়ে ওঠে যেসব দেশে প্রচুর পরিমান গবেষণা হয়। এই গবেষকগণ পরবর্তিতে এসব ব্যবসায় যোগ দিতে পারেন, বা চাকুরি নিতে পারেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই পোস্টের সাথে হয়তো পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তবু প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় কিছু পর্যবেক্ষণ আর ভাবনা এখানে বলে রাখি।

গবেষণা করতে গেলে টাকা লাগবে। লাগবেই। বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে গবেষণার জন্য সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম অথবা নেই। যে সব দেশে গবেষণার জন্য প্রচুর বরাদ্দ পাওয়া যায় সে সব দেশে খোঁজ নিলে দেখা যায় সে সব বরাদ্দের বড় অংশের উৎস বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার জন্য প্রতি বছর কতো টাকা বরাদ্দ রাখে? আসলে গবেষণা করাটা যে একটা অত্যাবশকীয় ব্যাপার এটা সম্ভবত বেশিরভাগ বাংলাদেশীর বোধগম্য নয়। তাই এখানে কোন পরিকল্পনা প্রণয়নকালে সাধারণত গবেষণার কোন স্কোপ রাখা হয় না। আর রাখলেও সেখানে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয় নামে মাত্র। গবেষণার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সরকারী বেসরকারী নীতি নির্ধারকদের মনোভাব পরিবর্তিত না হলে এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না।

যে কোন পর্যায়ের গবেষণা করতে গেলে টাকা লাগবে, উন্নত ও সর্বশেষ যন্ত্রপাতি লাগবে, সে সব যন্ত্রপাতি চালানো-রক্ষণাবেক্ষন-মেরামতের জন্য দক্ষ জনশক্তি লাগবে এটা সবাই জানেন। কিন্তু বিদ্যমান যা বরাদ্দ, যন্ত্রপাতি ও জনশক্তি আছে তা দিয়ে কিছুই করা যায় না এমনটা নয়। বড় মাপের না হলেও কোন ক্ষেত্রে মাঝারী আর কোন ক্ষেত্রে ছোট মাপের এক-আধটা কাজ করা যায়। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়? যে কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকবে, কিন্তু সেগুলোই যে সব নয় সেই সত্যটা আমরা জানি। বাংলাদেশের গবেষণার ক্ষেত্রেও অমন কিছু ব্যতিক্রম আছে বটে তবে সেগুলোই সব নয়। বাকি সকল গবেষণা আসলে ‘বরাদ্দ হালাল করার’ গবেষণা। বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে, বাংলাদেশের গবেষণার পরিচয়ও তার আউটকামে।

একটা উদাহরণ দেই। ঢাকা মহানগরে বিশাল ক্যাম্পাস, বড় বিল্ডিং, বিপুল জনবল নিয়ে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলা একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। এই লম্বা সময়ে সেখান থেকে আউটকাম হাতেগোনা। বলতে পারেন, গবেষণা তো আর তেলেসমাতি কারবার না যে ফুঁ দিলেই আউটকাম পাওয়া যাবে। সেই সত্য জানি। একশ’ বছরেও কোন গবেষণায় সফলতা না আসতে পারে। কিন্তু কেউ যদি সফলতা দাবী করে তাহলে সেই আউটকামের কোয়ালিটি ও বাজারগ্রহনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। সেই বিবেচনায় এই প্রতিষ্ঠানটির আউটকামগুলোর বেশির ভাগ কোন অর্থ বহন করে না। প্রতিষ্ঠানটিতে কারো যাবার সুযোগ হলে দেখতে পাবেন সেখানকার গবেষকদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের সাথে বাংলাদেশের যে কোন দফতরের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডের কোন পার্থক্য নেই। অবশ্য এই চিত্র এই প্রতিষ্ঠানটির বাইরে আরও অনেক বাংলাদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দেখেছি। ধারণা করা যায়, এটি বাংলাদেশী গবেষণার সংস্কৃতি।

ঢাকা মহানগরে অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা (মানে তাদের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা) নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের গরিমায় প্রতি মুহূর্তে বেলুনের মতো ফোলেন, হাউয়ের মতো ওড়েন, আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হন। ঐ দুই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার খোঁজ নিলে অনুসন্ধানকারী নিজেই লজ্জায় পড়ে যাবেন। ওসব জায়গা থেকে নিয়মিত কয়টা জার্নাল প্রকাশিত হয়, সে সব জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কতো, সে সব জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধগুলোর মান কেমন – এমন সব প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যাবে তাতে প্রশ্নকারী নিজে বিব্রত হবেন। তবু তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এদের শিক্ষার্থীদের অনেকে দেশের বাইরে ভালো গবেষণা করেছেন বটে তবে তাদের মধ্যে যারা আবার পূর্বতন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছেন তারা অচিরেই তাদের অগ্রজ সহকর্মীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। এটা একটা ভাববার বিষয়, আতঙ্কের বিষয়।

অনেক সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র সেখানকার আর দশটা সাধারণ সরকারী প্রতিষ্ঠানের মতো হয়। সেখানে বিশেষ সুরে সুর মেলাতে না পারলে বিশেষ মহল খুশি হয় না। আর বিশেষ মহল খুশি না হলে গবেষণা করে দুনিয়া উলটে ফেললেও নিজের নসীব বদলায় না। ২০১৫ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে কেমন ‘দুনিয়া ভুলাকে, নিকলি হ্যায় দিলসে ইয়ে দু’আ, রাং দে মোহে গেরুয়া’ অবস্থা হয়েছিল সেটা আমরা জানি।

আমরা ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পরিণতির কথা জানি, রমাপদ চৌধুরীর ‘অভিমন্যু’ উপন্যাসটি আমাদের পড়া আছে, তপন সিনহার ‘এক ডাক্‌টর কি মৌত’ (পঙ্কজ কাপুর, শাবানা আযমী, অনীল চ্যাটার্জী, ইরফান খান অভিনীত) মুভিটিও আমাদের দেখা আছে। তাই গবেষণা না করেই আমরা ভালো আছি। গবেষণার জন্য বরাদ্দ দিয়ে টাকা নষ্ট না করে গবেষণা দেখতে যাবার জন্য বছরে দুই-তিনটা ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। তাতে বহুত ফায়দা হবে।

সজীব ওসমান এর ছবি

হুমম। ভাল বলেছেন।

ভুলে গেলে চলবেনা, গবেষণায় ফান্ডিং বা অর্থবরাদ্দে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ব কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়েন, যারা গবেষণা করতে চান, বিশ্ববিদ্যালয় এদেরই।

হিমু এর ছবি

গবেষণার ফলন না বাড়লে গোড়ায় সারপানি পড়বে না। বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে পুরোপুরি আমদানি-করা-প্রযুক্তিনির্ভর। যাবতীয় সলিউশন প্যাকেজ আকারে আমদানি করা হয়। ইন্ডাস্ট্রির সাথে যোগসূত্র তৈরি না হলে গবেষণার হাওয়াই কল ঘুরবে না।

একটা উচ্চাশাজনিত সিনারিও ভাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রো রেল যাচ্ছে। শিক্ষকেরা মানববন্ধনে নেমে পড়েছেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা, এর কারণে কম্পন আর শব্দে ঢাবির জ্ঞানতপস্যা পয়মাল হবে। তাঁরা কিন্তু তাঁদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে এই আপদের প্রতিকার উদ্ভাবনের জন্য এই প্রকল্পের সাথে যোগাযোগ করতে বলছেন না। চাপ দিয়ে বলছেন না যে এই সমস্যার নিজস্ব সমাধান আমরা প্রযুক্তি আকারে উদ্ভাবন ও উৎপাদন করবো, গবেষণার খরচ আমাদের দিতে হবে। যদি করতেন, তাহলে সেই আবিষ্কারটিকে ঘিরে হয়তো একটি দেশীয় পণ্য বা পরিষেবা গড়ে উঠতো, যা হয়তো আরো অনেক ভবনব্যবস্থায় সাউন্ডপ্রুফিঙে প্রয়োগ করা যেতো, এবং যার পেটেন্ট থেকে গবেষকেরাও লাভ করতেন।

ওনারা মানববন্ধন করেই খালাস।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আরিফিনসন্ধি এর ছবি

সহমত

........................................................
গোল্ড ফিসের মেমোরি থেকে মুক্তি পেতে চাই
শুধু আমি না, আমার সাথে পুরো জাতি

সজীব ওসমান এর ছবি

সেটা তো ঠিকই। অর্থপ্রদানে আগ্রহী করানোর দায়িত্বটা প্রধাণত গবেষকদেরই।

আমি আসলে এটাকে এক হতাশাজনক চক্র হিসেবে দেখি। অর্থবরাদ্দ ছাড়া যেমন অনেক ফলন বাড়ানো সম্ভব না, তেমনি গবেষকদের উদ্যোগ ছাড়া অর্থ আনাও সম্ভব না।

শেহাব এর ছবি

সরকার যদি দেশীয় মার্কেট থেকে উচ্চপ্রযুক্তির পণ্য কেনা বাড়ায় তাহলে মনে হয় কিছু ভাল প্রভাব পড়বে।

অতিথি লেখক এর ছবি

শেহাব, দয়া করে আপনার পরামর্শটা একটু ব্যাখ্যা করবেন কি? দেশীয় মার্কেটে পাওয়া যায় এমন উচ্চপ্রযুক্তির পণ্যের কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বুঝতে আরও সুবিধা হয়।

শেহাব এর ছবি

ধরুন এই মুহুর্তে সরকার চিন্তা করছে বাচ্চাদের সবার হাতে পাঠ্যবই ট্যাবের মাধ্যমে দিবে। সরকার একাধিক দেশী প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তাব দিতে পারে যে তোমাদের আমরা গবেষণা করার টাকা দিব। তিন বছরের মধ্যে যে সবচেয়ে ভাল সিস্টেম তৈরি করতে পারবে তাদের ডিজাইনটি আমরা কমার্শিয়াল প্রোডাকশনের জন্য নিব। আপনার প্রশ্ন হতে পারে যে এরকম দেশী প্রতিষ্ঠান এই মুহুর্তে না থাকলে কি হবে? সে ক্ষেত্রে সরকার প্রণোদনা দিবে যেন মানুষ এই খাতে ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী হয়।

সজীব ওসমান এর ছবি

পুরা ব্যাপারটাই আসলে সমাজে একটা সংস্কৃতির মত তৈরি হতে হয়। গবেষণার সংস্কৃতি। যেই সমাজে বহু গবেষণাগারের পাশাপাশি গবেষণাসংক্রান্ত ব্যবসাবানিজ্য জড়ে উঠে। নতুন নতুন গবেষণা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন পণ্যও তৈরি হবে। একে অপরকে সহযোগিতমূলকভাবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।