বেঁধেছি আমার প্রাণ, ৪৭৩ জিনে

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: শনি, ১৬/০৪/২০১৬ - ১২:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাধারনভাবে, কোন জীবের কোষে থাকা ডিএনএ অণুর সবটুকুকে একসাথে সেই জীবের জেনোম বলা যায়। একেকটা জীবের জেনোম একেকরকম। তবে কাছাকাছি ধরনের জীবগুলির জেনোমের মধ্যে মিল রয়েছে। এভাবে জীবের সঙ্গে জীবের বিবতর্নিক সম্পর্ক নির্ধারন করা যায়। আর প্রতিটা জেনোমে আছে অনেকগুলি করে জিন, জিন মানে হল জেনোম যেই ডিএনএ দিয়ে গঠিত তার মধ্যে যেসব অংশ প্রোটিন তৈরি করতে পারে সে অংশগুলি। বিভিন্ন জীবের জিনের সংখ্যা বিভিন্ন, জানেন নিশ্চয়ই।

ডিএনএ কে ঢাকা-চট্টগ্রামের রেললাইনের মত চিন্তা করলে এর নির্দিষ্ট জায়গায় থাকা স্টেশানগুলিকে জিন হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারেন। স্টেশানগুলা কার্যকর অংশ, এখানে যাত্রী ওঠানাম হয়। কিন্তু রেললাইনগুলির অন্যান্য অংশও গুরুত্বপূর্ণ। লাইনটা স্টেশানগুলিকে একটি সুতায় বাঁধে যেমন তেমনি লাইনের এক জায়গায় সমস্যা হলে অন্য জায়গায় বা স্টেশানে যাত্রী ওঠানামায় ঝামেলা হয়। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সুস্থভাবে চলার জন্য রেললাইনের অনেকগুলি অংশই দরকার। কিন্তু কয়েকটি স্টেশান বাদ দিয়েও ঢাকা-চট্টগ্রামে যোগাযোগটা সম্ভব। জীবের জেনোেমের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

সাধারনভাবে, জটিল জীবগুলোতে জিনের সংখ্যা সরল জীবগুলির চেয়ে বেশি থাকে, দুয়েকটা ব্যতিক্রম যদিও আছে। বেশি থাকার কারনহল জটিল জীবের হরেকরকম কাজের জন্য হরেকরকম জিনের প্রয়োজন পরে। বিবর্তনের ধারায় ধীরে ধীরে সরল থেকে জটিল জীবের আরোহনের সময় বিভিন্ন জিন সংগৃহীত হয়ে জটিল জীবের জেনোমগুলি একেকটা জিনের সংগ্রাহারে পরিনত হয়েছে। তবে বিবর্তনের ধারায় আমরা অপ্রয়োজনীয় কিছু জিনকে ফেলেও দিয়েছি, ততটা কাজে লাগেনি বলে।

কিন্তু ঠিক কতগুলি জিন থাকলে একটি জীব তার জীবের প্রকাশগুলি ঘটাবে? মানে, একটি সরল ব্যাকটেরিয়া বা অন্য সরল জীব ঠিক কতটি নূন্যতম জিন নিয়ে তার সকল জৈবিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে পারবে? খেয়েদেয়ে, চলেফিরে, বংশবৃদ্ধি করতে পারবে? প্রশ্নটা জটিল ছিল, কিন্তু সম্প্রতি সেই রহস্যের সমাধান হয়েছে। তবে এই গবেষণায় সময় লেগেছে বহুদিন। ক্রেইগ ভেন্টার এবং ক্লাইড হাচিনসন নামের দুই মহারথী বিজ্ঞানী সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন তাদের গবেষণা। একটি প্রাণের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন ৪৭৩ টি জিন!

প্রকৃতিতে সবচেয়ে কম জিন যে জীবের পাওয়া যায় তার নাম হল Mycoplasma genitalium, জিনের সংখ্যা ৫২৫ টি। এই জেনোমের চেয়েও ছোট একটি কৃত্রিম জেনোম ক্রেইগ ভেন্টারের দল আবিষ্কার করেছেন যেখানে জিন আছে ৪৭৩ টি। আবিষ্কারটির জন্য লেগেছে ২০ টি বছর, যখন থেকে বিজ্ঞানীদলটি ভাবা শুরু করেছিলেন যে জীবের বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু জেনোম দরকার, কতটি জিন।। এর আগে, ২০১০ সালে ভেন্টারের দল আরেকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেসময় একটি ব্যাকটেরিয়ার সম্পূর্ণ জেনোম কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করে অন্যধরনের আরেকটি ব্যাকটেরিয়ার কোষে (তার ডিএনএ বের করে) ঢুকিয়ে দিয়ে দেখা গিয়েছিল যে নতুন ব্যাকটেরিয়াটি একেবারেই আগের ব্যাকটেরিয়ার মত হয়ে গিয়েছে! অন্য ব্যাকটেরিয়ার কৃত্রিম ডিএনএ হলেও প্রাণের সকল বৈশিষ্ট্যই দেখাচ্ছে!

তো, একই উপায়ে ভেন্টারের দলটি প্রথমে ভাবছিল সরল প্রাণের জন্য নূন্যতম প্রয়োজনীয় জিনগুলিকে কৃত্রিম উপায়ে খুঁজে বের করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জিন-সম্পাদনা পদ্ধতির (বিশেষ করে ক্রিস্পার-ক্যাস্নাইন পদ্ধতির) আবির্ভাব ঘটায় তারা মনে করলেন কেননা আমরা সবচেয়ে কম জিন যে ব্যাকটেরিয়ার আছে তার জেনোমকে কাটা শুরু করি। সম্পূর্ণ নতুন জেনোম কৃত্রিমভাবে তৈরি করার চেয়ে এই কর্তনপদ্ধতি সহজ। জিনগুলি কেটেকুটে দেখা হচ্ছিল কোন জিনটি প্রয়োজনীয়, কোনটি নয়। তবে যে ব্যাকটেরিয়াটি নিয়ে কাজ করলেন তার নাম Mycoplasma mycoides। বেশকিছু পদ্ধতিতে চেষ্টার পরে শেষে এই ব্যাকটেরিয়ার পুরো জেনোমকে ৮টি খন্ডে বিভক্ত করে বিভিন্ন সংমিশ্রণে ব্যাকটেরিয়ায় মধ্যে ঢুকিয়ে দেখতে চাইলেন কোন কোন জিনগুলি এবং জেনোমের অংশগুলি জীবটির বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়। বলে রাখা দরকার, একটি জেনোমের শুধু জিনগুলিকে একটার পর একটা গেঁধে দিলেই সেটা কোন জীবে প্রাণ এনে দিতে পারেনা। বরং জিন নয়, এমন ডিএনএর অংশগুলিও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে প্রয়োজনীয় অংশগুলিকে বেঁধে বিজ্ঞানীরা একটি ৫,৩১,০০০ টি বেইজ (ডিএনএ'র একক) আকারের, ৪৭৩ টি জিন সনাক্ত করলেন যারা নূন্যতম থাকা প্রয়োজন প্রাণের জন্য।

নতুন কৃত্রিম জীবটির নাম দেয়া হল JCVI-syn3.0। এই নতুন জীবটি প্রতি ৩ ঘন্টায় বিভাজিত হয়ে সংখ্যায় দ্বিগুন হয়, যেখানে মূল প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া M. mycoides 'র লাগে ১ ঘন্টা (৯৮৫ জিন), এবং সবচেয়ে ছোট জেনোমের অধিকারী ব্যাকটেরিয়া M. genitalium এর লাগে ১৮ ঘন্টা (৫২৫ জিন)।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কী জানেন? এই ৪৭৩টি জিনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ১৪৯টি জিনের কাজ কী সেটাই আমরা এখনও জানিনা। ১৪৯ টি জিন কী কাজ করে সেটা জানতে খুবই কৌতুহল হচ্ছে তাইনা? আমাদের মতই বিজ্ঞানীরাও ভাবছেন এবং তাঁরা বসে নেই, চেষ্টা শুরু করেছেন। বর্তমান জীববিজ্ঞান গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির একটা এখন এই জিনগুলির কাজ খুঁজে বের করা।

আবিষ্কারটির ফলে আমাদের লাভ কী হল? কয়েকটি লাভ হল - ১. এটা কী আশ্চর্য আবিষ্কার চিন্তা করুন! আমরা এখন জানি যে একটি বস্তুকে প্রাণ বলতে গেলে টিক কতটি জিনের এবং কতটুকু জেনোমের দরকার পরে। ২. সাধারণত জীবের জন্য একদম প্রয়োজনীয় জিনগুলি বিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে যায় না, তাদের ভিন্ন ভার্শন হয়তো পরবর্তী জিনগুলিতে দেখা যায়। তাই নূন্যতম জেনোম আবিষ্কার আমাদের প্রাচীন জৈব ইতিহাস নিয়ে ধারণা দেবে। ৩. কে ভেবেছিল যে বায়েমেডিকেল গবেষণায় গত ১৬ বছরে প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হওয়ার পরও প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় নূন্যতম জিনগুলির একতৃতীয়াংশ নিয়ে আমরা কিছুই জানবো না? গবেষণাপদ্ধতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি হল। ৪. সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম প্রাণ তৈরিতে আমরা আরও অনেকখানি অগ্রসর হলাম। সেই দিন বেশি দূরে নয় যখন নিজেরাই ক্ষুদে ক্ষুদে নতুন নতুন জীব তৈরি করতে পারবো জড় বস্তু থেকে।

অসাধারণ এই আবিষ্কারের জন্য গবেষকদলটিকে সাধুবাদ।

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটির আরও কিছু খুঁটিনাটি জানতে পড়ে আসুন -
১। সায়েন্টিফিক আমেরিকান
২। ওয়াশিংটন পোষ্ট, প্রচ্ছদ ছবি এখানে থেকে নেয়া।
৩। নেচার মতামত। ক্রেইগ ভেন্টারের, ২০১০ সালের।
৪। মূল নিবন্ধ। সায়েন্স।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক ইন্টারেস্টিং লেখা, তয় এত্ত ছুডু ক্যানে? আপনি কি ৪৭৩ শব্দে লেখা আঁটাতে চাচ্ছেন? খাইছে

মানবজমিনের শিরোনামঃ জ্বীন জাতির বিস্ময়কর ইতিহাসের স্বপক্ষে প্রমাণ পেলেন বিজ্ঞানীরা!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সজীব ওসমান এর ছবি

বড় লিখতে কষ্ট লাগে। হাসি

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ডিএনএ কী এবং জিন কী, এ বিষয়টা যদি আরেকটু পরিস্কার করতেন।

সজীব ওসমান এর ছবি

দিলাম একটা ছোট অংশ। ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি একবার বলেছিলেন ছোট লেখার মাধ্যমে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম বিষয় গুলো উপস্থাপন করবেন। এটা আমার বেশ ভালো লেগেছে। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলামনা তাই ছোট লেখা একটু মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যায়। এই লেখাটিও ভালো লেগেছে। তবে মাঝে সাঝেই বড় লেখাও দিয়েন। বিজ্ঞান বুঝতে কষ্ট হলেও জানতেতো হবেই।

সোহেল ইমাম

সজীব ওসমান এর ছবি

ধন্যবাদ। কিছু বিষয়ে আমি বড়সড়ই লিখি। খেয়াল রাখবো। হাসি

মৃষৎ এর ছবি

জড় বস্তু থেকে ক্ষুদ্র জীব সিন্থেসাইজ করা যাবে, সিন্থেটিক লাইফের জয়জয়কার দেখবো জীবদ্দশায়, স্বপ্ন ছিল!

সজীব ওসমান এর ছবি

এনশাল্লাহ।

কাকাতুয়া এর ছবি

ক্যাস্নাইন না, ক্যাস নাইন।

সজীব ওসমান এর ছবি

আমি ক্যাস্নাইন বলি। ইংরেজীতে cas9।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।