অনেকেই মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করেন, বিবর্তনের মাধ্যমে যদি নতুন জীবের উদ্ভব হয় তবে এখন আমরা চোখের সামনে নতুন কোন জীব হতে দেখি না কেন? বিশেষ করে সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বা ধার্মিকগণ এই প্রশ্নটি করে বিবর্তনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর চেষ্টা করেন। Speciation বা প্রজাতিভবন, অর্থাৎ বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব সাধারনতঃ এমন একটি ঘটনা যা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেনা, মানে দেখে দেখে বোঝা যায়না। নতুন কোন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য বহু বহু বংশধরের মাধ্যমে যেতে হয় যার ফলে কোন জীবের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমান পরিবর্তনগুলি জমা হয়ে হয়ে এমন একটা প্রজাতির উদ্ভব হয় যাকে 'নতুন প্রজাতি' বলা চলে, আর যার জন্য প্রচুর সময় প্রয়োজন।
কিন্তু, সম্প্রতি দুটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of California, San Diego এবং Michigan State University) কয়েকজন বিজ্ঞানী সম্ভবত বিবর্তন মানতে না চাওয়া প্রস্তরে আটকে থাকা মানুষগুলিকে একটা ভালো উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছেন। একটা অতিসরল ফ্লাস্কে তারা বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতি হওয়া দেখেছেন। গবেষণাটি সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।
তবে, তার আগে আমি একটু অন্য একটা বিষয় কথা বলি।
কয়েকমাস আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ভিডিও ইন্টারনেটে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন। হার্ভার্ডের কিশোনি গবেষণাগার দেখিয়েছেন যে কিভাবে চোখের সামনেই ব্যাকটেরিয়া ত্রমশ বিবর্তিত হয়ে কোন নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিকের প্রতি অধিকতর প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।
এখানে একটু ভেঙে বলছি। প্রথমে একটা প্লেটে ব্যাকটেরিয়ার খাবার (এগারযুক্ত এলবি নাম) ঢেলে দেয়া হলো যা অনেকটা জেলির মত। প্লেটটায় কয়েকটা ভাগ আছে। নিচের ছবি দেখুন। এখানে একেকটা ভাগের খাবারে (মিডিয়া বলে) একেক পরিমানে ট্রাইমিথোপ্রিম নামক এন্টিবায়োটিক দিয়ে দেয়া হল। আপনার জানেন যে এন্টিবায়োটিক হলো ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলার ঔষধ। প্লেটটির বাইরের দিক সবচেয়ে কম এন্টিবায়োটিক, এবং মাঝখানে সবচেয়ে বেশি এন্টিবায়োটিকযুক্ত মিডিয়া রাখা হয়েছে। মাঝখানে যার পরিমান প্রায় ১০০০ গুণ। যে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে তা এতো বেশি মাত্রায় প্রথম বাঁচতে পারার কথা নয়।
তারপর কিনারা জায়গাগুলিতে ব্যাকটেরিয়া যোগ করে দেয়া হলো ৩ টা বিন্দুতে। যদি পরিব্যক্তির মাধ্যমে বিবর্তন ঘটে তবে ব্যাকটেরিয়াগুলি ধীরে ধীরে কম এন্টিবায়োটিকের জায়গা থেকে বেশি এন্টিবায়োটিকের জায়গার দিকে ধাবিত হবে, ঠিক নিচের ছবির মত।
এবার নিচের ছবিতে দেখুন। সাদা অংশগুলি ছড়ানো মানে ব্যাকটেরিয়ার বর্ধন হচ্ছে সংখ্যায় এবং বিস্তার ঘটছে। ক্রমশ কম এন্টিবায়োটিকের স্থান থেকে বেশির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আসলে পরিধির দিকের কম এন্টিবায়োটিকের জায়গা থেকে ছড়িয়ে নিজেদের ডিএনএ তে মিউটেশান বা পরিব্যক্তি ঘটিয়ে তারা নতুন গুণলাভ করছে যার ফলে ক্রমশ অধিক এন্টিবায়োটিকের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছে। নিচের ছবিটি দেখুন। কিভাবে নতুন গুন অর্জনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি এন্টিবায়োটিকে এসে (লাল রেখা) কিছু ব্যাকটেরিয়া বিবর্তিত হয়েছে বুঝতে পারছেন। রেখাগুলি দিয়ে এই একহাজার গুণ বেশি মাত্রার এন্টিবায়োটিকের প্রতিরোধী হতে ব্যাকটেরিয়াগুলির কতটি নতুন গুণসম্পন্ন বংশধরের প্রয়োজন পরেছে সেটা বোঝা যেতে পারে।
যদিও উপরের পরক্ষাটি দিয়ে ঠিক নতুন প্রজাতির উদ্ভব বোঝায় না, তবুও আপনার হয়তো বুঝতে পারছেন পরিব্যক্তির ফলে নতুন গুণের আগমন কিভাবে হয়। আর ডারউনিয় মতবাদে ধারণা করা হয় এভাবে অনেকগুলি নতুন বৈশিষ্ট্যের সম্মিলনে একটা জীব থেকে আরেকটা জীবের উদ্ভব ঘটতে পারে।
এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কথা যেহেতু এসেই গেল সেহেতু আমি একটা নিজের কাজের ব্যাপারে গল্প ঝাড়ার সুযোগ হারাই কেন বলুন?
বাংলাদেশে আমার অণুজীব বিজ্ঞান গবেষণার অংশ ছিল হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাওয়া বর্জ্যে কিপরিমান এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া আছে, যা পরিবেশ ছড়াচ্ছে তা খুঁজে বের করা। চট্টগ্রামের সরকারী হাসপাতাল, CMC, থেকে কী পরিমাণ এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পরছে তা খুঁজে বের করা ছিল আমার কাজ। ব্যাকটেরিয়া ছিল সেই চীরচেনা ই. কলাই।
হাসপাতালের বিভিন্ন অংশ থেকে এইসব ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ করেছিলাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে কী কী এন্টিবায়োটিক ঔষধের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়াগুলি প্রতিরোধী হয়ে গিয়েছে! সাদা চাক্তিগুলির চারপাশে স্বচ্ছ জায়গা মানে হল এসব এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ই. কলাই ব্যাক্টেরিয়াগুলি প্রতিরোধী হতে পারেনি। ছয়টির মধ্যে মাত্র দুইটিতে এমনটা দেখা গিয়েছে! (B = Bacitracin, TE = Tetracycline, PG = Penicillin G, CL= Ciprofloxacin, IMP = Imipenem, GM = Gentamicin)
দেখা যাচ্ছে জেন্টামাইসিন এবং আইমিপেনেম নামক এন্টিবায়োটিকগুলি ছাড়া অন্য কোন এন্টিবায়োটিক এদের বিরুদ্ধে কাজ করছেনা। বিশেষ করে সিপ্রোপ্লোক্সাসিন এন্টিবায়োটিকটি অনুসরণ করতে পারেন। এমনকি এনথ্রাক্স রোগের বিরুদ্ধেও এই এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়! যেকসব ডিস্ক (সাদা রঙের গোল চাক্তি) এর চারপাশে বেশ স্বচ্ছ অংশ দেখা যাচ্ছে তার অর্থ হল ব্যাকটেরিয়ে এদের চারপাশে বংশবৃদ্ধি করতে পারেনি।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ এন্টিবায়োটিক ঔষধ যখন কাজ করেনা তখন একসময় সিপ্রোফ্লোক্সাসিন (CL) ব্যবহার করা হতো বাংলাদেশে। এখন এই ই. কলাই ব্যাকটেরিয়ার মত খুব সাধারন ব্যাকটেরিয়া যখন এই এন্টিবায়োটিকের প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন সেটা খুবই শংকাজনক বৈকি!
এবার আসি নতুন গবেষণাটায় (মেয়ার, লেনস্কি এবং তাদের দল; গবেষণাটি সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত), যেখানে নতুন প্রজাতি উদ্ভবের মত ব্যাপার বিজ্ঞানীর দেখেছেন। মাসব্যাপী ল্যাম্বডা ফেইজ নামক একধরনের ভাইরাসকে নিয়ে একটা পরীক্ষায় দুইটি ভিন্ন জীবের উদ্ভবকে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন। আগেই বলেছি, কিভাবে নতুন জীবের উদ্ভব ঘটে সেটা পর্যবেক্ষণ খুবই কঠিন, আর ব্যাপারটা খুবই ধীরগতির। কিন্তু, মাত্র একমাসের মধ্যেই এই নতুন পরীক্ষাটিতে এমন ঘটনা ঘটায় গবেষকগণ নিজেরাই বিস্মিত হয়ে পড়েছেন!
পরীক্ষাটিতে ব্যবহৃত ভাইরাসটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, কিন্তু ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। আমাদের সবার পরিচিত ব্যাকটেরিয়া ই. কলাইকে এরা আক্রমণ করে। আর পরীক্ষাতে ই. কলাইয় ব্যাকটেরিয়াকে ভাইরাস দিয়ে আক্রমণ করতে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষাটিতে দুইধরনের ই. কলাই কোষ ব্যবহার করা হয়েছে, যাদেরকে আক্রমণ করার জন্য দুইধরণের যন্ত্র দরকার ভাইরাসটির। একটু ব্যাখ্যা করছি।
নিচের ছবিটি দেখুন। ছবিতে ই. কলাই কোষ নীলবর্ণের, ভাইরাস সবুজ এবং কমলা বর্ণের। ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণের জন্য প্রথমে ভাইরাসের ব্যাকটেরিয়াটিকে চিনতে হয়। চেনাজানার ব্যাপারটা হয় ব্যাকটেরিয়ার পৃষ্ঠদেশে থাকা বিভিন্ন আকৃতির অণুর গায়ে নিজের অণুকে খাপে খাপে লাগানোতে। যেমন, ছবিটিতে দেখতে পাচ্ছেন ব্যাকটেরিয়ার একধরণের আকৃতির অণূতে ভাইরাসের দুইধরণের অণু সংযোগ তৈরির চেষ্টা করছে, বামদিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। যাদেরটা ভালো মিলছে তারা অধিক তৎপরতায় ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করছে।
ছবিসূত্র: নেচার মাইক্রোবায়োলজি
কিন্তু আলোচ্য পরীক্ষাটি ব্যাকটেরিয়ার গ্রাহক অণুগুলি দুইধরনের, মানে দুইধরনের কোষ ব্যবহৃত। কিছুদিন ভাইরাসগুলিকে দুইধরনের ব্যাকটেরিয়ার সাথে বংশবৃদ্ধির সুযোগ দিয়ে দেখা গেলো সম্পূর্ণ দুইধরনের ভাইরাস তৈরি হয়েছে যাদের দুইধরনের আকৃতির সংযোগ অণু আছে। একধরনের ভাইরাস একধরণের ব্যাকটেরিয়ার গ্রাহককে পছন্দ করছে। এভাবে সম্পূর্ণ দুইধরনের ভাইরাসের প্রজাতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, প্রথমে যেখানে একটাই ভাইরাসের গায়ে দুইধরনের সংযোগ অণু ছিল, সেখানে এখন দুইটা আলাদা সংযোগঅণু সহ আলাদা দুইটা প্রজাতি তৈরি হয়েছে। ঘটনাটা ঘটেছে কারন ভাইরাস মনে করেছে 'সকল কাজের কাজী' হওয়াটা এক্ষেত্রে সুবিধাজনক নয়, বরং যেকোন একধরনের হলে আরও বেশি সুচারু আর কার্যক্ষমভাবে ব্যাকটেরিয়ার যেকোন একটা গ্রাহককে ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
যদিও এখানে অনেকে দার্শনিক প্রশ্ন তুলতে পারেন, 'ভাইরাসকে কি জীববিবর্তনের আদর্শ মডেল হিসেবে ব্যবহার করা চলে?' ব্যাপার হলো, ভাইরাসে যেহেতু খুব দ্রুত পরিব্যক্তি ঘটে সেহেতু এইধরনের পরীক্ষার জন্য ভাইরাস খুবই ভালো মডেল। আর ভাইরাসের যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানে পরীক্ষা করা হয়েছে, যেমন বৃদ্ধি, ডিএনএর পরিবর্তন, মিলন, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলি জীবেরই বৈশিষ্ট্য।
এটা একটা অসাধারণ পরীক্ষা, যা জীবের প্রজাতিভবন (স্পেসিয়েশান) কে চোখের সামনেই দেখাচ্ছে, যার কথা ডারউইন বলে গিয়েছেন ১০০ বছরের বেশি আগে।
১। কেন সবারই বিবর্তনতত্ত্ব শেখা উচিত
২। বিবর্তন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার তথ্যচিত্র
৩। কিভাবে মানুষ হলাম?
পরের পর্বগুলা এখনো ঠিক করিনাই। আর এই সিরিজের ক্রমগুলিও প্রায় নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তিত হবে। আপডেট করে দেবো।
সূত্র:
১। প্রচ্ছদ এনিমেশান: ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটাবেইজ থেকে (জিপফি)
২। http://www.mnn.com/green-tech/research-innovations/stories/scientists-watch-new-species-evolves-their-eyes?utm_source=Facebook&utm_medium=Branded%2BContent&utm_campaign=ScienceDump
৩। http://phys.org/news/2016-11-biologists-speciation-laboratory-flask.html
৪। Harvard University
মন্তব্য
বাহ! অনেক সহজবোধ্য আর আকর্ষনীয় এই উপস্থাপন। চলতে থাকুক এই সিরিজ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বাহ ইন্টারেস্টিং তো! আচ্ছা, এখন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার কাজে কি ভাইরাস ব্যবহার করা হয়?
আমার এক বন্ধু ভারতের এক বায়োটেক কোম্পানিতে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করে। তাদের কাজ হলো বিভিন্ন সমস্যার জৈবপ্রযুক্তিগত সমাধান দেয়া। তাদের কাছে একবার কিছু মাছ ব্যবসায়ী এসে জানালো যে তাদের মাছ সব নষ্ট হয়ে যাচ্চে। বন্ধুর ল্যাব খুঁজে পেলো যে একধরনের ব্যাকটেরিয়া দায়ী। তারা শুধু প্রতিকার হিসেবে একধরনের ভাইরাসের দ্রবণ দিয়ে দিলো মাছ ব্যবসায়ীদের। সমস্যার সমাধান!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন