১৯৪২ সাল, তখনও ডিএনএ'র গঠন আবিষ্কার হয়নি, এমনকি ডিএনএতে যে আমাদের জিনেটিক তথ্য সঞ্চিত থাকে সেটাও আমরা জানতাম না। আর সেই সময়েই ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে এক অস্ট্রিয় পদার্থবিদ টানা তিনটি লেকচার দিলেন সাধারণের সামনে। ভদ্রলোকের নাম ছিলো এরভিন শ্রোডিঙ্গার, নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী; আর তাঁর লেকচার ছিলো প্রাণের সংজ্ঞার শুলুক সন্ধান করতে! ছাপ্পান্ন বছর বয়সী শ্রোডিঙ্গার ছিলেন সুদর্শন, প্রাণবন্ত এবং মানুষকে চিন্তায় বেঁধে ফেলতে পারা বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষ। তার লেকচার সিরিজ দারুণ হিট ছিল! বিজ্ঞানের লেকচার হয়েও এই প্রচন্ড জনপ্রিয়তায় শ্রোডিঙ্গার নিজেই অবাক হয়েছিলেন। সে বক্তৃতায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মন্ত্রী, রাজনীতিক, সমাজতাত্ত্বিক, এমনকি আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতিও উপস্থিত ছিলেন!
১৯৪৪ সালে শ্রোডিঙ্গার তাঁর বক্তৃতাগুলি নিয়ে একটি বই বের করেন, অনন্ত জলিলের - 'হট ইজ লাব?' ধরনেরই নাম - 'What is Life?' যাই হোক, একশ পৃষ্ঠারও কম এই ছোট্ট বইটাকে বিংশ শতাব্দীর জীববিজ্ঞানের কিংবদন্তিতুল্য বই হিসেবে দেখা হয়। পরবর্তী বহু জীববিজ্ঞানীর বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা ছিলো এই কাজ। এমনকি ডিএনএ'র গঠন আবিষ্কার করা তিন বিজ্ঞানী ক্রিক, ওয়াটসন এবং উইলকিন্সও এই তালিকায় আছেন! অদূর ভবিষ্যতেই যে জীববিজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে রসায়ন আর পদার্থবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে - শ্রোডিঙ্গারের এই অসাধারণ ধারণায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তারা।
তরঙ্গতত্ত্বের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান ১৯৩৩ সালে। যেসময়টাতে পেয়েছেন তখন জীববিজ্ঞানে জিনেটিক্সের গবেষণার পালে মাত্র হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। তখনও আমরা জানতাম না 'জিন' বলে যাকে এখন জানি তার অস্তিত্ব। মেন্ডেল মশাই বেশ কিছুদিন আগেই বংশগতির ধারার কিছু পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু জিন বলে জিনিসটার ব্যাপারে তিনি এবং আমরা সবাই প্রায় অন্ধকারেই ছিলাম। শ্রোডিঙ্গারের নোবেল পাওয়ার প্রায় দশ বছর পরেও আাসলে বিজ্ঞানীরা জিন কি দিয়ে গঠিত সেটা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। একদল বলছেন এটা একধরনের প্রোটিন হতে পারে, আরেকদল বলছেন নিউক্লিয়িক এসিড। কিন্তু মাত্র চার ধরনের রাসায়নিক দিয়ে তৈরি কোন বস্তু মানুষের বংশগতির বাহক কিভাবে হতে পারে সেটা নিয়ে সংশয় ছিলো।
এসব সমস্যা চিন্তা করেই তুমুল প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিদ হয়েও শ্রোডিঙ্গার জীববিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ দেখাতে শুরু করলেন। তবে এই কৌতুহল তৈরির পেছনে কোন একটা সময়কে চিহ্নিত করতে গেলে বলতে হয় জার্মান পদার্থবিদ বন্ধু পল এওয়াল্ডের দেয়া একটা বই উপহার হিসেবে পাওয়াকে। বইটা তিনজন লেখকের লেখা, নাম The Nature of Genetic Mutations and the Structure of the Gene", প্রকাশের সন ১৯৩৫। সেখানে মূল ধারণা যেটা তিন বিজ্ঞানী দিতে চেয়েছিলেন তা হলো - জিন আসলে তৈরি তুলনামূলকভাবে অল্পসংখ্যক অণু দিয়ে, এবং যখন এই আণবিক গঠনগুলির রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন আসে তার মানে মিউটেশান বা পরিব্যক্তি হয়েছে। কিন্তু জিন একটি একক না বহুমাত্রিক সত্তা এবং কিভাবে জীব থেকে জীবে পরিবাহিত হয়, তারা কি কোন বৃহৎ গঠনের অংশ না একক সত্তা, অথবা ক্রোমোজমে কি ক্রমান্বয়ে মুক্তার মালার মতো সাজানো থাকে - সেই প্রশ্ন রেখেই তারা বই শেষ করেছেন।
এখন প্রশ্নগুলার উত্তর আমরা জানি, কিন্তু শ্রোডিঙ্গারের কাছে প্রশ্নগুলি ছিলো প্রচন্ড কৌতুহল জাগানিয়া। এই যে জিনগুলি অল্পসংখ্যক অণুর দল নিয়ে গঠিত, যেসব দল একটা কার্যকরী একক হিসেবে কাজ করে - এটা আসলে দারুণ অস্বাভাবিক, অনন্য অবস্থা। শ্রোডিঙ্গার বলছেন -
In biology we are faced with an entirely different situation. The arrangements of atoms in the most vital part of an organism differ in a fundamental way from all those arrangements of atoms which physicists and chemists have hitherto made the object of their experimental and theoretical research. The situation is unprecendented, it is unknown anywhere else except in living matter.
অর্থাৎ, জীবদেহের মধ্যে অণুগুলি বাহ্যিক ভৌত পৃথিবীর চেয়ে সম্পূর্ণভাবে অন্যরকম আচরণ করে! প্রাণ এবং তার প্রক্রিয়াগুলি সেহেতু এদিক দিয়ে পৃথিবীতে অনন্য! একজন কোয়ান্টাম পদার্থবিদ হওয়ার কারণে তিনি সম্ভবত পৃথিবীর সবার চেয়ে ভালোভাবে বুঝতেন যে ভৌত পৃথিবীতে প্রত্যেকটা অণু পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে, গুঁতোগুতি, ধাক্কাধাক্কিতে ব্যস্ত। কারন প্রতিটা অণুই ডুবে থাকে এক অণুর সাগরে। অণুর এই সদাচলমান অবস্থাকে বলে ব্রাউনিয়ান মোশান, অণুর এটাই ধর্ম। কিন্তু জিন কিভাবে এই নিয়মের তোয়াক্কা করছেনা?! একটা অণুর সংগ্রহ এইরকম সাংঘর্ষিক দুনিয়াতে স্থিতাবস্থায় আছে, এমনকি কয়েক প্রজন্মান্তরে!
ব্যাপারটা বোঝাতে তিনি উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন হাবসবুর্গার লিপ বলে একটা ঘটনাকে। প্রজন্মান্তরে এই হাবসবুর্গার পরিবারের মানুষগুলির নিচের ঠোঁটটা ঝুলে থাকতো। কয়েক শতক ধরে এই পরিবারে এই জিনেটিক চল! তাপগতির সূত্র এলোমেলো করে দিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মের মাঝেও এই জিনের টিকে থাকা নিয়ে শ্রোডিঙ্গার বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন -
How are we to understand that (the habsburg lip gene) has remained unperturbed by the disordering tendency of the heat motion for centuries?
হাবসবুর্গারদের ঠোঁট ঝুলে থাকা বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় চলে আসছিলো
তার মানে, আরও সাধারণভাবে বলতে গেলে, যদি জিন নিখুঁত আণবিক পরিমাপের অণুর সমষ্টি হতো, এবং তাপবিচলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সকল ধরনের বাধার সম্মুখীন হতো তবে জীবের বৈশিষ্ট্যগুলি কিভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়িত্ব লাভ করে, এবং সাফল্যের সাথে কিভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তর হচ্ছে? এটাকে তো সম্ভবপর কোন ঘটনা হিসেবে মনে হচ্ছেনা।
কিন্তু অন্য একটা তৃতীয় উপায়েও প্রাণ এবং তার প্রক্রিয়া প্রকৃতির বিস্তৃত জড় বস্তুদের চেয়ে আলাদা। শ্রোডিঙ্গারের মতে প্রাণের সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর 'সদা বিচলন' এবং কাজকর্ম করা। একটা জিনিসকে তখনই জীবিত বলা যেতে পারে যখন সেটা 'কিছু করে', সঞ্চরমান, পরিবেশের সাথে পদার্থ আদানপ্রদানক্ষম ইত্যাদি, এবং এটা তারা করে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে, যে চলমান অবস্থাটা আমরা কোন জড় বস্তুর কাছ থেকে একইরকম পরিবেশে সাধারণত আশা করতে পারিনা।
প্রাণ নামক এই অবস্থাটার মধ্যে যা অনন্য তা হলো এরকম একটা স্বয়ম্ভর প্রক্রিয়া আপাতভাবে দেখা যায় তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অগ্রাহ্য করছে, যে সূত্র আমাদের জানায় এরকম ব্যবস্থার আসলে কয়েকদিন পরে জ্বালানী শেষ হয়ে, ধীরগতির হয়ে, বিশৃঙ্খল হয়ে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষয় হয়ে তাদের বর্জ্যতাপকে পরিবেশে বিলিয়ে দিতো! শ্রোডিঙ্গার তার বক্তৃতায় বলছেন -
When a system that is not alive is isolated and placed in a uniform environment, all motion usually comes to standstill very soon as a result of various kinds of friction. The whole system fades away into a dead, inert lump of matter. A permanent state is reached, in which no observable events occur.
পদার্থবিজ্ঞানে এটাকে বলে তাপগতির সাম্যাবস্থা বা thermodynamic equilibrium, অথবা কোন অবস্থায় সর্বোচ্চ এন্ট্রপি থাকা দিয়ে যা বুঝি তাই। কিন্তু, জীবিত বস্তু প্রায় সবদিক দিয়েই এই সকল প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত, অন্ততঃ যতক্ষণ তারা জীবিত থাকে বা তাদেরকে প্রাণ বলা চলে!
দেখা যাচ্ছে, ক্ষয়ে না গিয়ে, নিঃশেষ না হয়ে, বিশৃঙ্খলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাণ বরং বহু বছর ধরে নিজেদেরকে আরও উন্নত করেছে, আরও শৃঙ্খলতার দিকে এগিয়েছে, আরও মজবুত হয়েছে! বিশৃঙ্খলার দিকে অবনমনের কোন চিহ্নই প্রাণ দেখায়নি। পুরোপুরি উল্টো: মালায় গাঁথা মুক্তোর মতো সমন্বয়, বৃদ্ধি এবং স্বনিয়ন্ত্রিত চলন দেখায় প্রাণ যা অন্যথায় মোটামুটি ন্যাড়া শুষ্ক পৃথিবীতে একেবারেই দেখা যায় না।
তাহলে শ্রোডিঙ্গার প্রশ্ন করছেন - প্রাণ কিভাবে পৃথিবীর নিয়মতান্ত্রিক ক্ষয়কে এড়াতে পেরেছে?
তাঁকে আসলে প্রাণের ৩ টি রহস্য ভাবিয়ে তুলেছিলো -
- অল্প সংখ্যক অণুর সমষ্টির উপর প্রাণ এবং তার প্রক্রিয়ার নির্ভরতা
- সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জিনের স্থায়িত্ব বজায় থাকা
- প্রকৃতির মূল নিয়মগুলিকে জীবিত বস্তুর বা প্রাণের না মানা
আর এই প্রশ্নগুলিরই তিনি উত্তর দিয়েছেন ধাপে ধাপে তার তিনটি বক্তৃতা সিরিজে।
প্রথমেই বলে নেই - তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটিকে এভাবে বলা চলে ‘একটি বদ্ধ প্রক্রিয়াতে এনট্রপি সবসময়ই বাড়বে।’
শ্রোডিঙ্গার বলছেন - আপাতভাবে মনে হলেও, প্রাণ আসলে কোনভাবেই তাপগতিবিদ্যার প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে অমান্য করছেনা। জীবেরা প্রকৃতিতে তাপ নিঃসরণ করছে তো বটেই, এবং সেই তাপ জীবটির কাছে কোন কাজ করতেই আর প্রাপ্য থাকছেনা। এই তাপ নিঃসরণ মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ এন্ট্রপিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে (বিশৃঙ্খল অবস্থা), একেবারেই যেটা আমাদেরকে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বলে। আর এভাবেই প্রাণ প্রকৃতি থেকে 'ঋণাত্মক এন্ট্রোপি' নিয়ে তার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
মেশিন কিভাবে কাজ করে চিন্তা করতে পারেন। বাইরে থেকে শক্তি দেয়ার ফলে তারা কোন কর্মসাধন করে। তেমনি বৃহৎ জীব, যেমন গরু হলো একটি অতিশয় জটিল, কিন্তু 'সুশৃঙ্খল' (order) প্রাণী। এরা আবার কোন সুশৃঙ্খল সূত্র থেকে খাবার গ্রহণ করে, অর্থাৎ যা খাচ্ছে তাও সুগঠিত। আর খাওয়াদাওয়া করে কিছু খাবার ভেঙে ফেলে বর্জ্য হিসেবে ত্যাগ করে।
তাহলে, প্রাণের স্থায়িত্ব বজায় আছে আসলে সুশৃঙ্খলতা থেকে সুশৃঙ্খলতায় পৌঁছানো: সুশৃঙ্খল জীব সুশৃঙ্খল পুষ্টি গ্রহণ করে, জীবিত বস্তু তারপর সেই সুশৃঙ্খলতার কিছু অংশ বিশৃঙ্খলতায় পরিবর্তন করে, যা তাপগতিবিদ্যার নিয়মকে একেবারে মেপে মেপে মানছে। ব্যস, রহস্যের সমাধান হয়ে গেল!
এর উত্তর দিতে গিয়ে শ্রোডিঙ্গার প্রথমে চিন্তা করছেন আসলে জিন কী দিয়ে গঠিত। তাঁর মতে জিন হলো একধরনের 'অবিন্যস্ত কঠিন পদার্থ' বা (aperiodic solid); কোন মুক্তোর মালার মতো গাঁথা বস্তু নয়।
The gene is most certainly not just a homogenous drop of liquid. It is probably a large protein molecule, in which every atom, every redical, every heterocyclic ring plays an individual role.
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে মানুষের ক্রোমোজমগুলিকে তখন দেখতে কেমন লাগে তা জানতেন বিজ্ঞানীরা। দেখতে অনেকটা ঝুলে থাকা সসেজের মতো লাগে, তাইনা? (নিচে ছবি)
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে মানুষের ক্রোমোজম
শ্রোডিঙ্গার ব্যাখ্যা করছেন - হাবসবুর্গার ঠোঁটের বৈশিষ্ট্যটি কয়েকশতক টিকে থাকার কারনটা নিহিত কিভাবে ক্রোমোজমের অভ্যন্তরে এরজন্য দায়ী জিনটি সজ্জিত ছিলো সেটার উপর। ঐ অণুগুলি একটার সাথে আরেকটা বেশ শক্তভাবেই জড়িয়ে থাকে, সসেজের মতো দেখতে থলিগুলির মধ্যে এলোমেলোভাবে ভাসাভাসি করেনা। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ক্রোমোজমগুলিকে খুব একটা আহামরি কিছু না দেখা গেলেও তার ভেতরের অণুগুলি খুবই সুসজ্জিত থাকে এবং পিরামিডের মতো অনড়!
এখন আমরা জানি কিভাবে ক্রোমোজমের ভেতরে ডিএনএ এবং তাতে জিনগুলি বিন্যস্ত থাকে। এখানে একটা সাধারনীকৃত ছবি।
শ্রোডিঙ্গারের প্রশ্নটা আসলে অসাধারণ ছিলো। ডিএনএ কী জিনিস সেসময় জানা ছিলোনা, এইটা চিন্তা করে পরবর্তী লেখাগুলি পড়ুন। অন্যভাবে বলতে গেলে প্রশ্নটা এভাবে করা যায় -
জীবের একেবারে ভেতরে অতিক্ষুদ্রাকায় অণুর অবস্থান এবং বিচ্ছিন্ন অণুর সজ্জা কিভাবে এতো বড় মাত্রায় এতো বড় ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
শ্রোডিঙ্গারের দেওয়া এই প্রশ্নের উত্তরটি পরবর্তীতে তাকে জগদ্বিখ্যাত করে তুলেছিলো! উত্তর দিতে গিয়ে তিনি এমন একটা জিনিসের আনয়ন ঘটিয়েছেন যার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং মূল চিন্তা বা ধারণাটি পরবর্তীতে মলিকুলার বায়োলজি নামক বিজ্ঞানের শাখাটির উদ্ভব ঘটিয়েছিলো! ধারণাটি হলো,
জিন হচ্ছে কোন কোডে লেখা একটি তথ্য।
তিনি বলছেন,
The genes contain in some kind of code-script the entire pattern of the individual's development and of its functioning in the mature state. Every complete set of chromosomes contain the full code.
চিন্তা করতে পারেন তিনি কখন এইসব কথা বলছেন? যখন ডিএনএ কে আমাদের বংশগতির ধারক অণু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারিনি, জিন কি প্রোটিন না অন্য কিছু সেটাই জানতাম না আর ডিএনএ'র গঠন তো আবিষ্কার হয়ও নি। কিন্তু সেই সময়ে বসে শ্রোডিঙ্গার প্রায় অহী বা প্রফেসির মতো বলে দিচ্ছেন আসলে জিন কিভাবে কাজ করে। নিচের ছবিটা দেখে নিন, ডিএনএ এবং জিন যে আসলে একধরনের কোড-স্ক্রিপ্ট সেবিষয়ে কোন সন্দেহ থাকবেনা। আর এই ধারণাটাই মলিকিউলার বায়োলজির মূল কথা!
এখন আমরা জানি ডিএনএ তে থাকা কোড গুলি কেমন-
আর সেই কোডে থাকা তথ্য দিয়ে তৈরি এমিনো এসিডের সজ্জা, যা দিয়ে নির্দিষ্ট ধরনের প্রোটিন তৈরি হয় -
আর সেই প্রোটিন এবং আরএনএগুলি নির্ধারণ করবে একটা জীবের ভবিষ্যৎ। শ্রোডিঙ্গারের নিজের ভাষায় -
The coded elements will determine whether the egg would develop, under suitable conditions, into a black cock or a speckled hen, into a fly or a maze plant, a rhododendron, a beetle, a mouse or a woman.
আমার মতে শ্রোডিঙ্গারের 'হোয়াট ইজ লাইফ?' পড়ে যেমন তাঁর ভক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে দারুণ সমালোচক হওয়ারও সুযোগ। কারণটা হলো, পরবর্তীতে তাঁর মন্তব্য, ধারণা এবং ভবিষ্যৎবাণীগুলির অনেক ভুল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। একটা বড় সমালোচনা হলো, তিনি আসলে বইটাতে 'প্রাণ কী' সেই উত্তরটা দেন নি। তিনি ছিলেন কিছুটা আধ্যাত্মিক চিন্তার মানুষ, যেখানে যুক্তিযুক্ত করার ব্যাপারগুলি ধোঁয়াটে ছিলো। বইটের প্রারম্ভিকে যেমন উপনিষদের জিনিসপাতি এনে খিচুড়ি পাকিয়েছেন। সেই সমালোচনাগুলো নিয়ে নাহয় আরেকদিন সম্পূর্ণ একটা লেখাই লিখবো। কিন্তু, শ্রোডিঙ্গারের এই বইটির মাহাত্ম্য অন্য জায়গায়।
বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই পদার্থবিদগণ জীববিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখতে শুরু করলেন। তারা হয়তো যেখানে জীববিজ্ঞানকে দ্বিতীয় শ্রেণীর বিষয় হিসেবে ভাবতেন সেখানে তাঁরা জীববিজ্ঞানকে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের আলোকে যে চিন্তা করা বা বিশ্লেষণা করা যায় তা বুঝতে শুরু করলেন এবং প্রাণকে বোঝার চেষ্টা শুরু করলেন।
শ্রোডিঙ্গারের জীবনী লেখক ওয়াল্টার মুর বলছেন -
There is no other instance in the history of science in which a short semipopular book catalyzed the future development of a great field of research.
পরবর্তী কোন একদিনে ডিএনএ'র গঠন আবিষ্কার করা বিজ্ঞানীদের ৩ জনই উল্লেখ করেছেন যে শ্রোডিঙ্গারের 'অবিন্যস্ত কঠিন পদার্থের' বিবরণই তাদেরকে বিখ্যাত গঠনটি আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে এবং বইটি তাদেরকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
তাঁদের একজন জেমস ওয়াটসন অসাধারণ বইটি সম্বন্ধে বলছেন -
From the moment I read Schrodinger's 'What is life?' I became polarized towards finding out the secret of the gene.
বইটি ৭ টি ভাষায় অনুদিত হয় এবং প্রায় ১ লাখ কপি বিক্রি হয়। 'হোয়াট ইজ লাইফ?' আধুনিক বিজ্ঞান সাহিত্যের একটি ক্লাসিক বলে সবসময়ই গণ্য হবে।
পরিশেষ -
'হোয়াট ইজ লাইফ?' পড়ার চেষ্টা করেছি স্নাতক তৃতীয় বর্ষ থেকে। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না। সেটা আমার জানার অপরিপক্কতা এবং শ্রোডিঙ্গারের চিন্তার অসাধারণত্ব এই দুইটা কারনে। পরে বহুবার একটু একটু করে চেষ্টা করেছি বুঝতে। এ নিয়ে বহু লেখা সাহায্য করেছে। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে যে বইটি সেটার নামও 'হোয়াট ইজ লাইফ?', লেখক এড রেগিস (Ed Regis)। সেখান থেকে বেশ কিছু অংশ আমি প্রায় অনুবাদ করেছি। আপনারাও সুযোগ পেলে পড়ে নিতে পারেন।
পরবর্তী পর্বগুলি -
১। জীবনের সংজ্ঞা
২। আত্মাহীন রসায়ন
৩। বিশ্বভরা প্রাণ!
৪। আরএনএ পৃথিবীর আড়ালে
৫। শ্রোডিঙ্গারের প্রাণ!
৬। প্রথম স্বানুলিপিকারকের খোঁজে
৭। প্রাণের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞার পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে
৮। ত্বকের কোষ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করবেন
৯। গবেষণাগারে কিভাবে প্রাণ তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা
১০। সম্পূর্ণ সংশ্লেষিত জেনোম দিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি: এ কি কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো?
মন্তব্য
বুঝলাম বলার দুঃসাহস নেই, কিন্তু আকর্ষণীয় একটা লেখার হদিস দিয়েছেন এই জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বইটা বুঝতে আমারও দারুণ কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু আমি আশা করছিলাম আমার লেখাটা একটা সহজ সারসংক্ষেপ হবে!
সুন্দর সারসংক্ষেপে হয়েছে, বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার আগ্রহ যতটা ততটা দখল নেই বলেই প্রায় বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখা পড়বার সময়ই মনের মধ্যে অনেক গুলো প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। আপনাদের লেখা গুলো পড়তে পড়তে এক একটা প্রশ্নচিহ্ন একটু একটু করে স্বচ্ছ হতে থাকে। লেখা চলুক।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলো ভালো লাগে। চলতে থাকুক।
শ্রোডিঙ্গারের এই দিকটা সম্পর্কে আসলেই জানা ছিল না। আমার কাছে তার নাম কেবল খটোমটো সমীকরণ এবং বিখ্যাত বিড়াল পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
শুভেচ্ছা
শুনে ভালো লাগলো। থ্যাংকু।
আয়হায়, এই বইটা আছে তো আমার কাছে! রাখি, পরে পড়ব!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন