চতুর্থ পর্বে বলেছিলাম, প্রথম প্রাণ তৈরির প্রধান অণুগুলির একটা হতে পারতো আরএনএ অণু। আরএনএ একটা শক্তিশালী অণু, সে নিজে যেমন পরবর্তী বংশধরদের জন্য তথ্য বহন করতে পারে, তেমনি অনুঘটনক্রিয়াও ঘটাতে পারে। কিন্তু, প্রথম জীবের জন্য যেই বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই স্বানুলিপিকরণ (self-replication) বা নিজের প্রতিলিপি নিজে তৈরি করতে পারার মত ক্ষমতা কি আদি আরএনএ'র ছিল? আজকে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার গল্প।
আরএনএ'র অনুঘটনক্রিয়া সম্বন্ধে আগে একটু বলে নেই। আরএনএ হলো একধরনের নিউক্লিয়িক এসিড যাতে ডিএনএর মতোই চার ধরনের ক্ষার (A, U, G, C) শর্করা এবং ফসফেট অণুর সংযোগে লম্বা শিকলের মতো গঠন তৈরি করে। এরা ডিএনএ'র মতো দ্বিসূত্রক গঠন তৈরি করেনা সাধারণত। তবে একসূত্রক হওয়ার কারণে এরা বিভিন্নভাবে নিজেদেরকে মুড়িয়ে বা গুটিয়ে ত্রিমাত্রিক গঠন তৈরি করতে পারে, অনেকটা প্রোটিনে এমিনো এসিডের সূত্রকের ত্রিমাত্রিক গঠন তৈরির মতোই। এইরকম গঠনের সুবিধাটা হলো তারা এভাবে বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে। যেমন নিজেকে বা অন্য নিউক্লিয়িক এসিডকে কেটে ফেলা ইত্যাদি। একেই আরএনএ'র অনুঘটনক্রিয়া বলা চলে। আর যেসব আরএনএ জৈবরাসায়নিক ক্রিয়া ঘটাতে পারে তাদেরকে রাইবোজাইম বলে। নিচের সরলীকৃত ছবিটি দেখুন -
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জ্যাক শসট্যাক (Jack Szostak) ছোটবেলা থেকেই রসায়নের পাগল ছিলেন, নিজের বাসার বেইজমেন্টে তার একটা গবেষণাগারও ছিল! পরবর্তীতে বড় হয়ে তিনি নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন, ডিএনএ কিভাবে বয়স্ক হওয়াকে প্রতিহত করে তার কার্যপ্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য।
কিন্তু পরবর্তীতে শসট্যাক অন্য একটা বিষয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হন। বিজ্ঞানী থমাস চেক (Thomas Cech) প্রথমবারের মত দেখিয়েছিলেন যে আরএনএ'র অনুঘটনগুণ আছে, যাদেরকে রাইবোজাইম বলে, যার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। চেক একধরনের আরএনএ ও আবিষ্কার করেছিলেন যা দশটি নিউক্লিওটাইড এককের আরেকই আরএনএ অণু তৈরি করতে পারে। মানে স্বানুলিপিকরণ করতে পারে, কিন্তু মাত্র ১০ টি একক দৈর্ঘ্যের। তো শসট্যাক চেকের এই আরএনএ উৎসেচককে আরেকটু উন্নত করার গবেষণায় মনযোগ দিলেন।
চেকের আরএনএ টিকে নিয়ে শসট্যাকের দল গবেষণাগারে অনেকগুলি এলোমেলো আরএনএ'র বিন্যাস তৈরি করে তাদেরকে একে একে পরীক্ষা করে দেখতে থাকলেন তাদের অনুঘটন ক্ষমতা (স্বানুলিপিকরণ ক্ষমতা নয়) কতটুকু। সবচেয়ে ক্ষমতাবান বিন্যাসের অণুকে নিয়ে বেছে বেছে আরও বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটাতে ঘটাতে এরকম ১০ বারে এসে এমন একটি আরএনএ তে এসে পৌঁছালেন যেটা প্রকৃতিতে প্রাপ্ত আরএনএ'র থেকে ১০ লাখ গুন বেশি অনুঘটনক্ষমতা সম্পন্ন! কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এই আরএনএ নিজের প্রতিলিপি নিজে তৈরি, বা স্বানুলিপিকরণে সক্ষম নয়। শসট্যাক হতাশ হলেন।
কিন্তু, এবিষয়ে পরবর্তী বড় আবিষ্কারটা করলেন শসট্যাকের প্রাক্তন ছাত্র MIT'র গবেষক ডেভিড বার্টেল (David Bartel)। তিনি R18 নামক এক নতুন আরএনএ এনজাইম তৈরি করলেন যা অন্য আরএনএ'র সঙ্গে গাঠনিক একক নিউক্লিওটাইড যুক্ত করতে পারে, অনুলিপি বিন্যাস অনুসরণ করে। মানে, গুরুত্বপূর্ণ যেই আবিষ্কারটা হলো - R18 নামক আরএনএ টি নতুন আরএনএ তৈরি করতে পারে আরেকটি আরএনএ'র বিন্যাসকে হুবহু নকল করে!
যদিও এই অণুটি স্বানুলিপিকারক নয়, তারপরও আবিষ্কারটির ফলে আমরা স্বানুলিপিকারক আবিষ্কারের পথে আরেকধাপ এগুলাম।
কিন্তু ঝামেলাটা হলো আরএনএ প্রকৃতিতে তৈরি করাটা দূর্দান্ত কঠিন একটা কাজ। বিশেষ করে নিউক্লিওটাইড ক্ষার বা বেইসগুলির সাথে শর্করা বা সুগার অণুর বন্ধন করানোটা সম্ভব হলেও তারা একটির সঙ্গে আরকটি লেগে (ফসফোডাইয়েস্টার বন্ধন) একটা শিকলের মতো হওয়াটা খুবই দূরহ কাজ (নিচের ছবির আরএনএ'র গঠন দেখুন)।
১৯৯০ এর দিকেই বিজ্ঞানীরা এটা বুঝেছিলেন এবং ধারণা করতে শুরু করলেন তাহলে আরএনএ বা ডিএনএ'র চেয়ে আরও সহজ কোন অণু নিশ্চয়ই ছিলো যে নিজেই নিজের সংবন্ধন ঘটাতে পারতো এবং স্বাণুলিপিকারক বা নিজের অনুলিপি তৈরি করতে সক্ষম।
১৯৯১ এ কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার নিয়েলসেন এরকম একটি আদিম অনুলিপিকারী প্রার্থীকে সামনে নিয়ে আসেন। এটি মূলত ডিএনএর একটি অতি-সংশোধিত সংস্করণ। এটা বানাতে গিয়ে নিয়েলসেন মূলতঃ ডিএনএর'র ক্ষারগুলিকে অপরিবর্তিত রাখলেন - A, T, C এবং G; কিন্তু এদেরকে একটার সাথে আরেকটার সংযোগকারী বন্ধন তৈরি করে মেরুদন্ড তৈরির একক হিসেবে ডিএনএ তে থাকা শর্করার পরিবর্তে polyamides নামক অণুগুলি ব্যবহার করেন। তিনি এই নতুন অণুর নাম দিলেন পলিমাইড নিউক্লিক এসিড, বা PNA। নিচের ছবিতে দেখুন কিভাবে দুইটি ক্ষার বা বেইজের মধ্যে সংযোগের পার্থক্য তৈরি হয়েছে ডিএনএ এবং পিএনএ'র মধ্যে (B দিয়ে ক্ষার বা বেইজ বোঝাচ্ছে)।
ঝামেলা হলো PNA প্রকৃতিতে কখনও পাওয়া যায় নি। কিন্তু এটি অনেকটা ডিএনএ মত অনেক আচরণ করে। পিএনএ এমনকি ডিএনএর একটি সূত্রককে প্রতিস্থাপিতও করতে পারে, পরিপূরক ক্ষারগুলির সাথে স্বাভাবিকের মতই সংযুক্ত হয়ে। তার উপর, পিএনএ নিজে একটি ডাবল হেলিক্স বা দ্বিসূত্রকের মতো গঠনও নিতে পারে। ঠিক যেমনটি একটা ডিএনএ অণুতে দেখা যায়।
ডিএনএ'র দ্বিসূত্রক গঠনের পরিপূরক ক্ষারগুলিতে বন্ধন তৈরি করে সংকর দ্বিসূত্রক গঠন তৈরি করেছে -
মিলার-উরে পরীক্ষার কথা তো জানেনই যেখানে দুজন বিজ্ঞানী আদিম পৃথিবীর মতো পরিবেশ গবেষণাগারে তৈরি করে জৈব উপাদান বা অণুর সংশ্লেষ করেছিলেন। মনে করার জন্য তৃতীয় পর্বটি দেখে নিন।
তো সেই পরীক্ষার সেই পিএইচডিরত ছাত্রটি, স্ট্যানলি মিলার, ২০০০ সালে তার বয়স তখন হয়েছে ৭০ বছর। তিনি পিএনএ'র আবিষ্কার নিয়ে এতোটাই উত্তেজিত হয়েছিলেন যে অসুস্থ শরীরেই আবার মিলার-উরে পরীক্ষাটি করলেন। এবারে methane, nitrogen, ammonia and water ইত্যাদি উপাদান দিয়ে। অসাধারণ ব্যাপার হলো এই পরীক্ষাতে তিনি উৎপাদিত অণুগুলির মধ্যে ডিএনএ সদৃশ পিএনএ'র সন্ধান পেলেন!
এর অর্থ দাঁড়ালো আদি পৃথিবীতে সম্ভবত পিএনএ নিজে থেকেই রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছিলো। যেখানে আরএনএ তৈরির কোন সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে অন্যান্য রসায়নবিদগণ পিএনএ'র মতো আরও কিছু ডিএনএ সদৃশ অণু খুঁজে পেলেন বা তৈরি করলেন। যার একটি হচ্ছে টিএনএ বা threose nucleic acid (TNA)।
এটি মূলতঃ একধরণের ডিএনএ ই, কিন্তু এর মেরুদন্ডে একটি ভিন্ন শর্করা রয়েছে - থ্রিওজ, ডিএনএ তে থাকে রাইবোজ। TNA এর সূত্রকগুলি জোড়া বেঁধে দ্বিসূত্রক গঠন তৈরি করতে পারে এবং RNA এবং TNA মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান হতে পারে। এমন কি, TNA গুটিয়ে গিয়ে জটিল আকৃতিও ধারণ করতে পারে আরএনএর মতো, এবং তার উপর প্রোটিনের সাথেও আবদ্ধ হতে পারে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে টিএনএ একটি এনজাইম বা উৎসেচক হিসাবে কাজ করতে পারে, ঠিক যেমন আরএনএ করে।
বিভিন্ন ধরনের নিউক্লিয়িক এসিডের মেরুদন্ড -
যেহেতু এরকম কয়েক ধরনের অণু পাওয়া গিয়েছে এদের প্রত্যেকেরই পেছনেই আলাদা বিজ্ঞানীদের পছন্দ কাজ করে। সেজন্য আদিমতম স্বানুলিপিকারকের কয়েকটি প্রার্থীর কথা আমরা জানি এবং অনেকগুলিই বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা প্রদানযোগ্য।
তবে এখন পর্যন্ত আদিম পরিবেশে বা প্রিমোরডিয়াল স্যুপে নিজেই অনুলিপি তৈরি করতে পারা কোন আরএনএ অণুর সন্ধান পাওয়া যায়নি। যা বিজ্ঞানীদের ভিন্ন দিক থেকে প্রাণকে চিন্তা করতে অবকাশ দিচ্ছে। কিছু বিজ্ঞানী সম্পূর্ণ অন্যভাবে প্রাণের শুরুকে দেখছেন যেখানে কোন আরএনএ, ডিএনএ বা স্বানুলিপিকারক নেই। আছে শক্তির তৈরি এবং আদানপ্রদানের ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত।
আগের পর্বের শ্রোডিঙ্গারের প্রাণতত্ত্ব নিয়ে তো পড়েছেনই। তার সঙ্গেই মেলবন্ধন করে পরের পর্বে প্রাণের শুরু সাথে শক্তির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছি। সাথে থাকুন।
পরবর্তী পর্বগুলি -
১। জীবনের সংজ্ঞা
২। আত্মাহীন রসায়ন
৩। বিশ্বভরা প্রাণ!
৪। আরএনএ পৃথিবীর আড়ালে
৫। শ্রোডিঙ্গারের প্রাণ!
৬। প্রথম স্বানুলিপিকারকের খোঁজে
৭। প্রাণের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞার পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে
৮। ত্বকের কোষ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করবেন
৯। গবেষণাগারে কিভাবে প্রাণ তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা
১০। সম্পূর্ণ সংশ্লেষিত জেনোম দিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি: এ কি কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো?
সূত্র-
http://www.sciencealert.com/scientists-might-have-discovered-what-allowed-life-to-evolve
http://www.bbc.com/earth/story/20161026-the-secret-of-how-life-on-earth-began?ocid=fbert
মন্তব্য
সাথেই আছি
এই প্রিমোরডিয়াল স্যুপ এর ধারণাটা আমরা পেলাম কোথা থেকে? আপনার লেখার আগের কোন পর্বে এ সম্পর্কে কিছু জানা যাবেকি?
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এইটাকে আসলে প্রিবায়োটিক স্যুপও বলে। তৃতীয় পর্বে পাবেন। মিলার-উরে পরীক্ষা দেখুন।
পড়লাম। প্রফেসর শঙ্কুর এরকমই একটা গল্প ছিলো সেখানে জীব থেকে প্রাণি শেষকালে মিনি সাইজের একটা প্রফেসর শঙ্কুও দেখা দিয়েছিলো। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিকে ছুঁয়ে ফেলছে বিজ্ঞান।
অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন