কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অভূতপূর্ব গবেষণার ফলাফল হিসেবে মানুষের দ্বারা সংশ্লেষিত সম্পূর্ণ কৃত্রিম ডিএনএ বা কৌলি দিয়ে ই. কলাই ব্যাকটেরিয়াকে প্রাণ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই ব্যাকটেরিয়াকে আপনি প্রকৃতিতে খুঁজে পাবেন না। কথা হলো এই কৃত্রিমতাকে এখানে নতুন প্রাণ সৃষ্টির উপায় বলবো কিনা।
প্রথমে বলে নেই ই. কলাই কী। এটা একটা ব্যাকটেরিয়ার নাম, প্রায় সকল বহুকোষী উষ্ঞরক্তের প্রাণীর পাকস্থলীতেই পাওয়া যায়। তবে মূল বিষয় সেটা নয়। এই ব্যাকটেরিয়া হলো জীববিজ্ঞান গবেষণায় সর্বাধিক ব্যবহৃত জীব। যুগান্তকারী সব আবিষ্কার এই ব্যাকটেরিয়াকে ঘিরে হয়েছে, নোবেলজয় তো হয়েছেই। এককোষী এই জীবকে আমরা সবচেয়ে ভালোভাবে চিনি বলে এর উপর গবেষণা করাটা আমাদের জন্য সহজ যেমন হয়, তেমনি কার্যকরী ফলাফলও বুঝতে পারা যায় সহজে। এদের দেখতে 'রড' এর মতো। নিচের ছবিতে কিছু ই. কলাইকে দেখতে পাচ্ছেন গুচ্ছ বেঁধে আছে।
এবার আসি কৃত্রিম ডিএনএ তৈরির মাহাত্ম্যে! আমরা জানি প্রতিটি জীবই নিউক্লিয়িক এসিড নামের একধরণের তথ্যভান্ডার দিয়ে তৈরি আর এর দ্বারাই নিজের দেহকে 'প্রোগ্রাম' করে চলে। মানে দেহের কার্যকারিতা বা জীবের বেঁচে থাকার যে প্রোগ্রাম সেটা লেখা থাকে নিউক্লিয়িক এসিডে, বেশিরভাগ জীবেই যেটা ডিএনএ নামে পরিচিত। এই ডিএনএ বিভিন্ন জীবে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের হয়। ডিএনএ তৈরি হয় চার ধরণের ক্ষারের সন্নিবিশনে। তো এই চারটা ক্ষার তিনটা অক্ষর বা ডিজিটে সাজানো অবস্থায় কোষের কার্যকারী সংস্থা চিনতে পারে। যেমন, ক্ষারগুলি হলো A, T, G এবং C। তো তিন অক্ষর বা ডিজিটে এদেরকে বিভিন্নভাবে সাজানো চলে। যেমন, ATG বা GTC বা CTT ইত্যাদি। এভাবে ৬৪ টা বিভিন্ন বিন্যাস পাওয়া চলে যাদেরকে কোডন বলে। ব্যাপার হলো এই ৬৪ টা বিন্যাসকে কোষ চিহ্নিত করতে পেরে আলাদা আলাদা এমিনো এসিড তৈরি করে। এমিনো এসিড হলো কোষের শ্রমিক প্রোটিনের একক এবং প্রোটিনও বিভিন্ন বিন্যাসের এমিনো এসিড দিয়ে তৈরি। বুঝতেই পারছেন, এই বিন্যাস নির্ধারিত হয় ডিএনএর ক্ষারের কোডন বিন্যাস দিয়ে। তিনটা ক্ষারের একটা কোডন একটা নির্দিষ্ট এমিনো এসিডকে বোনার বার্তা দেয়। কিভাবে জিনিসটা কাজ করে দেখে নিন -
তো বিভিন্ন বিন্যাসে প্রোটিন তৈরি হলেও কোষে এমিনো এসিড আছে মূলতঃ ২০ টি। কিন্তু কোডন আছে ৬৪ টি। অর্থাৎ, একাধিক কোডন একটি নির্দিষ্ট এমিনো এসিডকে কোড করতে বা বুনতে পারে। একে রিডানডেন্সি বলে। কেন এতোগুলি কোডন দরকার তা এখনও কেউ বলতে পারেনা সঠিকভাবে। নিচে ৬৪ কোডনে ২০ এমিনো এসিড আর থেমে যাওয়ার সংকেত। তিনটি ক্ষারের অবস্থান উল্লেখ করা আছে নিউক্লিওটাইড নাম দিয়ে। এমিনো এসিডগুলো দেখানো হয়েছে বলের মতো করে।
যেমন, সেরিন নামের একটা এমিনো এসিড তৈরি হতে পারে ৬ টি কোডন দিয়ে! আর কোন জিন সংশ্লেষের শেষ হয় স্টপ কোডন দিয়ে, যেগুলি আছে ৩ টি। তো কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাদলটির প্রধাণ ড. চিন মনে করলেন এতোগুলি কোডনের কি আসলেই দরকার আছে সরল জীব ব্যাকটেরিয়ার? সেটা পরীক্ষা করলেন এই গবেষণায়। এর জন্য প্রয়োজন ছিলো পুরো ব্যাকটেরিয়ার জেনোমকে নতুনভাবে সাজানো। সেটা তারা প্রথমে করলেন কম্পিউটারে। চারটি বর্ণের বিন্যাস হিসেবে প্রাণ বা জীব সাজানো বলে একে কম্পিউটারেই বেশ ডিজাইন বা নকশা করা চলে। তো একটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম ডিএনএ'র নকশা করলেন যেখানে সেরিনের কোডন ৬ টি থেকে ৪টিতে নামিয়ে আনলেন। স্টপ কোডন ৩ টি থেকে ২ টিতে নামিয়ে আনলেন। এবার ডিএনএ টিকে কম্পিউটারের মডেল থেকে মেশিনে তৈরি করা শুরু করলেন। তার পরের কাজ ডিএনএর টুকরো গুলোকে ব্যাকটেরিয়াতে ঢোকানো। একটা ই. কলাই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে সেখান থেকে তার নিজের ডিএনএকে বের করে ফেলে এই নতুন ডিএনএ ঢোকাতে থাকলেন। যখন সম্পূর্ণ ডিএনএ অদলবদল করা শেষ তখন একটা সম্পূর্ণ নতুন ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো। এই আবিষ্কারের একটা মাইলস্টোনের ব্যাপার আছে। আগে পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যেই জেনোম কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছিলো সেটা হলো প্রায় ১০ লক্ষ নিউক্লিওটাইড সমষ্টির আর্কিয়া। এবারেরটা প্রায় ৪০ লক্ষ নিউক্লিওটাইড সমষ্টির ব্যাকটেরিয়া কৌলি!
এভাবে সেরিনের কোডন দুটি মুছে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা -
যে কৃত্রিম ডিএনএ বা কৌলিটা তৈরি হলো সেটা দেখতে জ্যামিতিক ছবিতে দেখতে এরকম -
এবার একে বাঁচানো আর বৃদ্ধির পালা। দেখা গেলো এই নতুন সংশ্লেষিত ব্যাকটেরিয়াটি বেশ বেঁচে বর্তে থাকতে পারে। তবে মূল প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে শ্লথ গতিতে বৃদ্ধি পায়। সেটা হতেই পারে, বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন হারে বৃদ্ধি পায় যদি একটা পরিবেশে রেখে দিন। আর এই নবসৃষ্ট ব্যাকটেরিয়াটি আদি ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে লম্বাও হয় গড়নে!
তো এই ব্যাপারটা করে বিজ্ঞানীদের লাভটা কী হলো? কয়েকটা লাভ দেখতে পারেন। প্রথমতঃ এরকম বিশাল আকারের সম্পূর্ণ কৃত্রিম কৌলি যে কম্পিউটারে নকশা করে সেখান থেকে বৃদ্ধিকারক মিডিয়ায় নিয়ে এসে সম্পূর্ণ নতুনভাবে একটা জীবনকে তৈরি করা চলে সেটা জানা হলো। দ্বিতীয়তঃ একটা জেনোম থেকে পুরোপুরি কিছু কার্যকরী কোডনকে যে বাদ দিয়ে দেয়া যায় সেটাও খুঁজে পাওয়া গেলো। আর তৃতীয় যেই লাভটা হলো সেটা হলো সংশ্লেষ জীববিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহারোপযোগী একটা দুয়ার উন্মুক্ত করা। এখন নিজেদের ইচ্ছামতো কৃত্রিম জেনোম তৈরি করে এমন ব্যাকটেরিয়া তৈরি সম্ভব যাদেরকে কোন ভাইরাস (ফেইজ বলে) আক্রমণ করতে পারবেনা। বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তি বানিজ্যে বেশ বড় ভূমিকা রাখবে এই আবিষ্কার।
এবার কৃত্রিম প্রাণ বলবেন কিনা তার একটা ভাবনা ঢুকাই আপনাদের মাথায়। একটা ব্যাকটেরিয়া থেকে তার জীবনের প্রোগ্রামিংয়ের সূত্র বা কোড, মানে প্রাণভোমরাকে তুলে নিলে সে রীতিমতো জড় পদার্থে পরিণত হয়। তারপর তার মধ্যে যদি আবার মেশিনে তৈরি করা ডিএনএ ঢুকিয়ে দেন তবে সে আবার জীবিত হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা কি প্রাণ সৃষ্টির সাথে তুলনা করা চলে?
সূ্ত্র:
মূল আবিষ্কার নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়: https://www.nature.com/articles/s41586-019-1192-5
কিছু সহলেখা পাবেন এখান থেকে -
১. https://www.theguardian.com/science/2019/may/15/cambridge-scientists-create-worlds-first-living-organism-with-fully-redesigned-dna
২. https://www.nytimes.com/2019/05/15/science/synthetic-genome-bacteria.html
মন্তব্য
অসাধারণ। খবরটা পড়ার পর থেকে খালি চিন্তা করছি এর অদূর ভবিষ্যতের প্রভাব কিরকম সুদূরপ্রসারী হটে পারে। রে-প্রোগ্রামেবল লাইফ নিয়ে একটা লেকচার ছিল গত বছরের নিউরোইপস কনভারেন্সে , কিভাবে নিম্নস্তরের প্রাণীদের দেহে কোডিং পরিবর্তনের মধ্যমে নতুন অংগ সৃষ্টি করা যায়। এই গবেষণাগুলো কোনদিকে মানবজাতীকে নিয়ে যাচ্ছে তা কল্পনার বাইরে।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আসলেই। এই সময়ে বাস করার বহু অভিযোগ মনে থাকলেও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতিগুলি দেখার সুযোগতো হচ্ছে!
এ ধরনের অভিক্রিয়া (experiment) নিশ্চয়ই খুব নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হয়? কৃত্রিম-জিনবাহী ব্যাকটিরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে তো সমস্যা দেখা দিতে পারে?
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন