প্রাণ কী ১১: উল্কাপিণ্ডে প্রথমবারের মতো প্রোটিনের উপস্থিতির প্রমাণ

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: রবি, ০১/০৩/২০২০ - ৭:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্তরীক্ষে কেরোসিন বা গ্রহাণুতে এমিনো এসিডের উপস্থিতি নিয়ে আগে লিখেছিলাম। এবার বিজ্ঞানীরা এক অভূতপূর্ব বিষয় দেখতে পেয়েছেন যা গত ২২ ফেব্রুয়ারি উন্মুক্ত প্রাক পিয়ার রিভিউ সাময়িকী আরকাইভে (ArXiv) প্রকাশিত হয়েছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে ছোট্ট করে বলছি আজকে।

এইসফার ০৮৬ এবং এলিন্ডে নামক দুইটি উল্কাপিণ্ডে এমিনো এসিডের পলিমার বা বড় যৌগ দেখতে পাওয়া গিয়েছিলো আগেই। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, PLEX Corporation এবং Bruker Scientific এর গবেষকদল মিলে সংঘটিত এই নতুন পরীক্ষায় তাদেরকে বিশ্লেষণ করা হলো। এবং একটা কার্যকরী প্রোটিন অণু প্রথমবারের মতো পৃথিবীর বাইরের কোন সূত্র থেকে পাওয়া গেলো। প্রোটিনটির নাম রাখা হয়েছে হিমোলিথিন। জানেন হয়তো, প্রোটিনে বিভিন্নধরনের যৌগ বা ধাতু বন্ধন তৈরি করে কার্যকর এককে পরিণত হতে পারে। সাধারণত, লৌহ-অক্সিজেন যৌগসহ প্রোটিনগুলিকে হিমো নাম দেয়া হয় আর লিথিয়াম নামের আরেকটি ধাতুর উপস্থিতিও এখানে পাওয়া গিয়েছে বলে এর নাম হিমোলিথিন। মূল গবেষণাপত্রে কয়েকটা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে যে এই প্রোটিন পৃথিবীর প্রোটিন নয়। আইসোটোপের আর প্রোটনের হিসাব কষে এটা বের করা সম্ভব।

ভর মাপা আর বিশ্লেষণের একটা পদ্ধতি মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি (মালডি নামের) দিয়ে প্রোটিনগুলিকে পরীক্ষা করে এই গঠন সম্বন্ধে জানা গিয়েছে। প্রোটিনটি গ্লাইসিন নামের একধরনের এমিনো এসিড, যা আমাদের দেহের প্রোটিনগুলোতে পাওয়া সবচেয়ে ক্ষুদ্র এমিনো এসিড, তার একটা পলিমার বা শিকল। প্রোটিনেরা সাধারণত এরকম অনেক ধরনের এমিনো এসিডের শিকল বিভিন্ন ত্রিমাত্রিক গঠনে ভাঁজ হয়ে থাকে। সেজন্য এই নতুন পাওয়া অণুকে প্রোটিন ডাকতে কোনই অসুবিধা নাই। প্রোটিনটির ভর প্রায় ২৩২০ ডাল্টন। আকার হিসেবে বেশ ছোট। মূল গবেষণাপত্র থেকে এখানে একটা ছবি তুলে দিচ্ছি। লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে এখানে গ্লাইসিনের দুইটি শিকল পরস্পরের সাথে যুথবন্ধ হিসেবে আছে। শিকলদুটির দুইপাশে বসে আছে লৌহ, অক্সিজেন এবং লিথিয়ামের এক সমষ্টি। বলা যায় দুইদিকে দুই টুপি পরানো আছে প্রোটিনটির। এই সমষ্টিকে নিচের ছবিটায় দেখানো হচ্ছে। অক্সিজেন লাল রঙের, লৌহ সবুজ রঙের আর লিথিয়াম কমলা রঙের।এই যৌগ ফোটনকে শুষে নেয়ার আর পানিকে বিশ্লেষিত করার ক্ষমতাধর বলে মনে করছেন গবেষকগণ। সেজন্য, নব্যআবিষ্কৃত হিমোলিথিন একটি কার্যক্ষম প্রোটিনও।

হিমোলিথিন প্রোটিনটির মডেল

এইটা আসলে অতি চমকপ্রদ একটা উদ্ভাবন। এর গুরুত্ব কয়েকদিক দিয়ে অসাধারণ -

১. প্রথমবারের মতো কোন বহির্পৃথিবীর উপাদানে প্রোটিন পাওয়া গেলো, একে এলিয়েন প্রোটিন বলা চলে। মানুষের জানা প্রথম এলিয়েন প্রোটিনের নাম তাই আপনারা জানলেন - হিমোলিথিন।
২. প্রাণের উদ্ভবের যেসব প্রপঞ্চগুলি আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে জোড়ালোগুলোর একটা হলো উল্কাপিণ্ড থেকে কোন জৈবাণু এসে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি করেছিলো পৃথিবীতে। সেই ধারণা বেশ বড় বেগ পেলো এখন।
৩. এই উল্কাপিণ্ডের কোন জৈবস্বত্ত্বা থেকে উদ্ভুত হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও সন্দিহান। সেজন্য এ নিয়ে জানার আগ্রহটা সবার থেকে গেলো।
৪. পৃথিবীর বাইরেও যে কার্যক্ষম জৈবাণু থাকতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।
৫. প্রোটিন হলো প্রাণের কেন্দ্রের একটা উপাদান বা যৌগ।প্রোটিন অণু ব্যতীত কোন প্রাণকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নাই। একে অজৈব পরিবেশে পাওয়া যাওয়াটা বেশ চমকপ্রদ ব্যাপার, তাও যদি একেবারে আকাশ থেকে ঝরে পরে। এ থেকে বোঝা যায়, জৈবাণুরা মহাকাশে একেবারে বিনষ্ট না হয়েও ছড়াতে পারে।
৬. এই প্রোটিনটি আমাদের পৃথিবীর কোন প্রোটিনের মতো নয়, অভিনব গঠন কয়েকদিক দিয়ে। তবে এর গোড়াতে যেই উপাদানগুলি আছে সেগুলি আমাদের দেহে পাওয়া উপাদানগুলিই।
৭. এই আবিষ্কার পৃথিবীর প্রাণের উৎসকে নিয়ে নতুন করে এবং নতুন উদ্যমে ভাবার প্রয়াস যোগায়।


মূল গবেষণাপত্র

https://arxiv.org/pdf/2002.11688.pdf


আগের পর্ব:
১। জীবনের সংজ্ঞা
২। আত্মাহীন রসায়ন
৩। বিশ্বভরা প্রাণ!
৪। আরএনএ পৃথিবীর আড়ালে
৫। শ্রোডিঙ্গারের প্রাণ!
৬। প্রথম স্বানুলিপিকারকের খোঁজে
৭। প্রাণের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞার পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে
৮। ত্বকের কোষ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করবেন
৯। গবেষণাগারে কিভাবে প্রাণ তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা
১০। সম্পূর্ণ সংশ্লেষিত জেনোম দিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি: এ কি কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো?


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

চমকপ্রদ চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সজীব ওসমান এর ছবি

চলুক

নৈষাদ এর ছবি

ইন্টারেস্টিং। জীব বিজ্ঞানের জ্ঞান প্রায় শূন্য, তাই খুব বেসিক একটা প্রশ্ন করতে হচ্ছে।

খাদ্যের উপাদান হিসাবে প্রাণিজ প্রোটিন এবং উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের বাইরে প্রোটিন নিয়ে খুব একটা কিছু জানিনা। বুঝলাম প্রোটিনকে প্রাণের একটা প্রধান উপাদান/যৌগ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রোটিনের উৎপত্তিও কি জৈব পরিবশেই হয়? মানে অজৈব পরিবেশে প্রোটিনের উৎপত্তি সম্ভব না।

হিমু এর ছবি

নিষ্প্রাণ বস্তু থেকে প্রাণের উদ্ভবপ্রক্রিয়ার জন্য একটা বিশেষায়িত শব্দ আছে, abiogenesis, আজ সেটার বাংলা পড়লাম একটা বইতে, অজীবজনি। আপনার মন্তব্যের সাথে বহুলাংশে প্রাসঙ্গিক বলে ভাবলাম জানিয়ে যাই; হয়তো আলাপ সামনে বাড়লে শব্দটারও প্রসার হবে।

সজীব ওসমান এর ছবি

জৈবজনি পড়েছিলাম আমরা। আসলে আমি একধাপ এগিয়ে গিয়ে আরেকটু বিশেষায়িত করতে পারি। তাহলে নৈষাদের প্রশ্নের উত্তরও কিছুটা দেয়া যাবে।

প্রোটিনকে শেকলের মতো মনে করলে শিকলের ছোট ছোট এককগুলির বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ভাবতে পারেন। দুইটা একক বা তিনটা একক মিলে যেই শেকলে ভগ্নাংশ সেটাকে পেপটাইড বলে। অর্থ্যাৎ পেপটাইড হলো ছোট প্রোটিন বা ভগ্নাংশ। এমন পেপটাইডকে অজৈব পরিবেশে তৈরি করা গিয়েছে। অজীবজনি হতে পারে, আবার অজৈবজনিও হতে পারে এই প্রক্রিয়া।

এখন আসি বড় কার্যক্ষম প্রোটিনে। কোন কোষের বাইরে এখনও সম্পূর্ণ বড় কার্যক্ষম প্রোটিন তৈরি করা হয়েছে বলে আমি জানিনা। তবে এইখানে একটা ফাঁকি আছে। যেমন, কোষের বাইরে জৈব পদার্থকে মিশিয়ে একটা যন্ত্রের মতো তৈরি করে প্রোটিন তৈরি করা হয় কোষের বাইরেই। একে সেলফ্রি বা কোষবিহীন প্রোটিন সংশ্লেষ বলে। এখন ঘটনা হইলো, একে আপনি জীবজনি বলতে পারবেন না, বলতে হবে জৈবজনি। সেরকম, যে জনি কোন জৈবজিনিসের সাথে সম্পর্কিত নয় তাকে অজৈবজনি বলা চলে। তাহলে একেবারে জীবের বা কোষের বাইরেও বলা হবে।

নৈষাদ এর ছবি

সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। প্রশ্নটা শিশুতোষ হলেও মূল ঘটনাটা বোঝার জন্য এটা জানা দরকার ছিল।

সজীব ওসমান, বিজ্ঞান নিয়ে আপনার সহজ এবং আগ্রহোদ্দীপক লেখা গুলি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। চমৎকৃত হই লেখাতে বাংলার ব্যবহারে। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে বাংলা অর্থ বুঝতে গিয়ে থমকে যেতে হয়। (যেমন ‘কেলাসীকৃত’ – আমি ধরে নিয়েছি স্ফটিকীভূত বা crystallised অর্থে ব্যবহার করেছেন।

বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। তখন উচ্চ মাধ্যমিকে সবে ভর্তি হয়েছি। এক ভদ্রলোক বাসায় বেড়াতে এলেন। তিনি ষাটের দশকে বাবার সাথে চা বাগানে ছিলেন, সেই দশকেই দেশ ছেড়ে চলে যান, অনেক বছর ধরে কেম্রিজে প্রত্মতত্ত্বের অধ্যাপক, ইংরেজিতে লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রচুর। ষাটের দশকে চা বাগানে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য, তারপর খোদ ইংরেজদের দেশে অধ্যাপনা।

কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ভদ্রলোক কথার মধ্যে কোন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন না। আমার কাছে একবার জানতে চাইলেন, ‘অমুকের’ খবর জান কিছু? আমি বললাম এই নামে তিনজনকে চিনি, কার কথা জানতে চাইছেন। ‘ঐ যে’, একটু অস্বস্তি নিয়ে বলেলেন, ‘তেজারতি করতেন’। আমাকে বলতেই হল, তেজারতি কী সেটাই জানিনা। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, ‘সুদে টাকা খাটাবার পেশা’। আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম।

নৈষাদ এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।