আজকে বিশ্ব ভূ দিবস। এই দিবস পালনের ৫০ বছর পূর্তি। আজকের দিনে সেজন্য আমাদের অতি আদরের পৃথিবীটা নিয়ে দুটো চিন্তা ব্যয় করতে পারেন আপনার ব্যস্ত দিনের মধ্য থেকে। বিশেষ করে আধুনিক পৃথিবীকে যখন আমরা গত ২০০ বছর ধরে অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে পরিবর্তন করে ফেলেছি সেজন্য একে নিয়ে চিন্তার দায়টাও আমাদের। নিজেদের চিন্তাশক্তি অন্য উদ্ভিদ বা প্রাণীদের চেয়ে বেশি এবং আমরা বুনো-স্বভাবকে আমরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখি বিধায় দায়টা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও মনে রাখতে পারি।
চেরনোবিল নামের একটা জায়গা আছে, ইউক্রেন-রুশ সীমান্তে, মূলতঃ ইউক্রেনের দিকেই মূল অংশ। ১৯৮৬ সালের পারমাণবিক চুল্লীর দূর্ঘটনার কারনে সেখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পরে। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য দূর্ঘটনা। ব্যাপারটা এতোই ভয়াবহ যে সিজিয়াম-১৩৭ নামের এক ভারী ধাতুর তেজস্ক্রিয়তা কয়েকশমাইল জুড়ে তীব্র মাত্রাতেই পাওয়া যায়। এই তেজস্ক্রিয়তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর বিধায় দূর্ঘনার ১৬২২ বর্গমাইল অঞ্চলকে মানুষের বসবাস, কর্ম এবং যাতায়াতের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছিলো।
কিন্তু, তেজস্ক্রিয়তা তো আর শুধু মানুষকে বেছে বেছেই ক্ষতি করেনা। বরং বেশিরভাগ জীবের জন্যই ক্ষতিকর, কারন আমাদের সবার মধ্যেই ডিএনএ বিদ্যমান। তেজস্ক্রিয়তা কয়েকভাবে ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। একটা প্রধান উপায় হলো ডিএনএ ভেঙে ফেলা। সেটাকে মেরামত করতে কোষ চেষ্টা করে, কিন্তু ভুল হয়ে যাওয়ার কারনে ডিএনএতে পরিবর্তন ঘটে। পরিব্যক্তির আনয়ন হয়, যা জীবের ওপর সার্বিকভাবে প্রভাব ফেলে। উদ্ভিদ, ছত্রাক, প্রাণী - সবাই বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছে। কত অদ্ভুত জীব তৈরি হয়েছে সেটা অন্তর্জাল ঘেঁটে একটু দেখে নিতে পারেন।
আশার কথা হলো, ধীর হলেও ক্রমেই বুনোরা তাদের পরিবেশে ফিরে যাচ্ছে। নতুন পদের বা প্রকারণের জীব যদিও কিছু তৈরি হচ্ছে, কিন্তু ধীরে ধীরে আগের প্রজাতিগুলিই এই পরিবেশে ফিরে এসেছে। হারিয়ে যাওয়া কিছু প্রাণীও যার মধ্যে রয়েছে। নেকড়ের সবচেয়ে বড় দলটিকে এখন এখানে দেখতে পাওয়া যায়; হারিয়ে যাওয়া Przewalski ঘোড়ারা দল বাঁধছে; শুকর, রেকুন আর বুনোহাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হতে পারে তেজস্ক্রিয়তা আসলে তাদের জন্য উপকারী হয়েছে। কারন তার চেয়ে বড় হুমকি মানুষ সেখানে প্রবেশ করেনা। মানুষ নাই, সেটা বুনোজীবের জন্য ভালো, প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা চলে।
উপরের কাহিনী বললাম এটা বোঝাতে যে পৃথিবীর মানুষ এই গ্রহের অন্যান্য জীবের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা প্রকৃতিকে গণবিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছি।
এখন যে জীবের ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি চলছে সেটা তো সবাই জানেন। যেমন, পরিবেশ থেকে পোকারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। পোকাকে যতই ঘৃণা করুন, এদের নাই হয়ে যাওয়া মানে পৃথিবীর প্রায় সকল স্তন্যপায়ীরও বিলীন হয়ে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যার ফলাফল; এর প্রভাব পরবে পৃথিবীর প্রতিটা জীবের ওপর। আর যে হারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হচ্ছে তার সাথে পূর্বের কোন ঘটনারই তুলনা চলেনা।
বিবর্তনের ইতিহাসে জীবের সবচেয়ে বড় গণবিলুপ্তি ঘটে ২৫ কোটি বছর আগে। সাইবেরিয়ার এক মহাগ্নুৎপাতের কারনে ১০ লাখ বছর ধরে পৃথিবী মেঘে ঢাকা ছিলো। প্রাথমিক যেই উষ্ণায়ন ঘটে তার ফলে জীবের বিপাককর্ম বেড়ে যাওয়ায় বেশি অক্সিজেন প্রয়োজন পরে, অন্যদিকে পরিবেশ থেকে অক্সিজেন উধাও হয়ে যাচ্ছিলো। ফলাফল ৯০ শতাংশ জলজ আর ৭০ শতাংশ স্থলজ জীব পৃথিবী থেকে চীরতরে উধাও।
এখন একটা কৌতুহলি ভাবনা বন্টন করি। প্রতিটা গণবিলুপ্তির পরে আগের জীববৈচিত্র থেকে ভিন্ন নতুন জীববৈচিত্র তৈরি হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। বলা চলে ২৫ কোটি বছর আগের গণবিলুপ্তি না ঘটলে পরবর্তীতে ডাইনোসরের রাজত্ব আসতো না। আবার সাড়ে ৬ কোটি বছর আগের ডাইনোসর বিলুপ্তির মতো গণবিলুপ্তি না ঘটলে আধুনিক স্তন্যপায়ী আসতো না। অর্থাৎ মানুষের আবির্ভাব ঘটতো না। বলা চলে জীবের বিবর্তনের ইতিহাসে বিলুপ্তি মোটামুটি স্বাভাবিক ঘটনা। বসন্তে নতুন পাতা গজানোর আগে যেমন শীতে সকল পাতা ঝরে যায় সেরকম অনেকটা।
সেজন্য প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা চলে আমাদের এই সময়ের গণবিলুপ্তিই জীবের ইতিহাসের শেষ কথা নয়। ঝামেলা হলো দুইটা - এক. এই প্রাকৃতিক বিলুপ্তি আর নবজাগরণের ধরণটা খুব অনুমান অযোগ্য। বিলুপ্তির পরে আবার কখন স্ফূরণ ঘটবে, কতটুকু ঘটবে, কিরকম ঘটবে সেটা কেউ বলতে পারেনা তেমন সূক্ষ্মভাবে। দুই. এই বিলুপ্তিকে পাশ কাটিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার ভালো সম্ভাবনা আছে। আর মানুষের যেই ইতিহাস সেটা খুব সুবিধার নয়। ফলে নবস্ফূরণকে তার প্রভাবিত করার ব্যাপারও আছে। মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী, আমরা নিজেরা নিজেদের বিবর্তনকে চরমভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম, এবং করছিও। আধুনিক মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স) দুই লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে বিরাজমান। আরও কয়েক লক্ষ বছর আমাদের টিকে থাকাটা (হয়তো আধুনিক চেহারায় নয়) অসম্ভব কিছু নাও হতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বিলুপ্তি জীবের বিবর্তনিক ইতিহাসে যখন সাধারণ ঘটনাই সেহেতু একে থামানোর চেষ্টা করে লাভ কী? এই ধারার চিন্তায় প্রথম প্রশ্নটা আসে এই আধুনিক বিলুপ্তি কেন হচ্ছে। বিজ্ঞানীর কথা মানতে চেষ্টা করলে (এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটকে অগ্রাহ্য করতে পারলে) প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা চলে একটাই উত্তর - মানুষের কর্মকান্ড। সেজন্য যে বিলুপ্তির জন্য আমাদের কর্মকান্ড দায়ী তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করার ব্যাপার আছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা আমাদের চেনাজানা পৃথিবীর প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে চাইনা এদের প্রতি মায়ার কারনে। আর বুদ্ধিমান প্রাণী হওয়ার কারনে পৃথিবীর জীবজগতের উপর আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তাকে অবহেলা করা চলেনা।
সবচেয়ে কাছাকাছি যে সময়ে মানুষের গণ-বিলুপ্তি হয়েছিল সেটা ছিল ৭০,০০০ বছর আগে। সুপার-ভল্কানো বা দানবাকারের অগ্নুৎপাতের কারনে। অর্ধেকেরও বেশি মানুষ পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান মানুষের জেনেটিক ভ্যারিয়েশান খুব কম হওয়ার কারনকে এই গণ-বিলুপ্তির ফসল হিসেবে দেখা হয়। সম্ভবত একটা বটলনেক তৈরি হয়েছিল। আবারও হয়তো এমন গণ-বিলুপ্তি হবে।
মানুষের বেশ বড় একটা গণ-বিলুপ্তি কিন্তু বিংশ শতাব্দীতেই হয়েছিল। ১৯১৮ এর শুরু থেকে ১৯২০ সাল এর শেষ পর্যন্ত একধরনের ভাইরাস পৃথিবীজুড়ে ৫০ কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছিল, যার মধ্যে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। এই সংখ্যাটা ছিল মোট মানুষের ৩ থেকে ৫ শতাংশ! যে ভাইরাসে আক্রমণ করেছিল তার নাম স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাস। আমাদের সময়ের (২০০৯ সালে প্যানডেমিক) বার্ড ফ্লু ভাইরাসের মত একই গোত্রের ভাইরাস। এইজন্যই ফ্লু আক্রমণকে এত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন বিজ্ঞানীরা। খুব সম্ভবত মানুষের পরবর্তী গণ-বিলুপ্তিও কোন ভাইরাস বা অণুজীব দিয়ে হবে যার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ঔষধ ভাল কাজ করবেনা।
এই সময় এরকম আরেকটা মহামারির সময়। স্প্যানিশ ফ্লুর সময় আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা আধুনিক কালের মতো উন্নত ছিলোনা। তবে এই আধুনিক সময়ে করোনার মতো মহামারির যেই প্রকোপ তা আসলে ভাইরাসটা কতোটা শক্তিশালী তার একটা ধারণা দেয়। এখন মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে গিয়েছে। তার কারনে এই অল্প সময়েই আমরা পরিবেশে বেশ কিছু পার্থক্য দেখছি। বন নিধন কমেছে, শব্দ এবং বায়ু দূষণ কমেছে, শিল্প কারখানা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান পরিবেশে যাওয়ার হার কমেছে, গাড়ি বা অন্যান্য বাহনের সংখ্যার কারনে অনেকগুলা দূষণ কমেছে।
ব্যাপার হলো, আমরা করোনা-পরবর্তী যুগে এসে কী করবো সেটা। এইরকম মহামারি নতুন যুগের সূচনা করে। প্রকৃতিতে একটা বড়সড় মহামারির পরে যেমন নতুন ধারার জীবেদের স্ফূরণ ঘটে ঠিক সেরকম না হলেও মানুষের কর্মকান্ডকে পরিবর্তন করে দিতে পারে করোনা। বিশেষ করে এই ভাইরাস বহুদিন ধরেই পৃথিবীতে থাকতে এসেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন জলবায়ুর উষ্ণতার সময় এরকম ভাইরাস বা অন্য জীবাণুর মহামারি পৃথিবীতে খুব সাধারন ঘটনা হবে, অর্থাৎ কিছুদিন পরপরই নতুন উপদ্রব আসার সম্ভাবনা প্রচুর। আমরা নিজেদের পরিবর্তন করতে তৈরিতো?
পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়।
মন্তব্য
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
স্থির হয়ে পড়লাম--
আহা, মানুষেরা যদি সেটা জানতো...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মানুষের মত মানুষ হওয়ার লাইন পুরাপুরি বাদ দিয়ে প্রাণীর মত মানুষ হতে হবে। আর কোন বিকল্প নাই।
অজ্ঞাতবাস
নতুন মন্তব্য করুন