জানেন হয়তো, প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য সাধারণ মানুষে করোনাটিকা কার্যক্রম শুরু করেছে। সুখের খবর। তবে টিকাবিরোধী বহুধরনের আলোচনা পশ্চিমাবিশ্বগুলোতে যেমন আছে তেমন আমাদের এলাকায়ও প্রচলিত। হুজুরেরা প্রায়ই বয়ান দেন যে টিকা দিলে, তা যে টিকাই হোক, সন্তানোৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাবে বা চলে যাবে। তেমন কোন প্রমাণ যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে কেউ পেশ করতে পারেন নাই। আরেকটা তর্ক আমাদের মুসলিম বিশ্বে সবসময় থাকে, নতুন কোন কিছু আসলেই এই তর্কের উৎপত্তি হয়। করোনাটিকা কি হালাল না হারাম? সম্প্রতি খবরে বেরিয়েছে দেখলাম যে যুক্তরাজ্যের মুসলিমদের মধ্যে ইতিমধ্যেই এ নিয়ে বির্তক শুরু হয়েছে। এখানে একটা খবর। পশ্চিমা বিশ্বে আরও অদ্ভুত অদ্ভুত তর্ক চলে। যেমন, বিল গেটস নাকি করোনা ছড়িয়ে এখন টিকা দিচ্ছেন মানুষের দেহে মাইক্রোচিপ ঢোকানোর জন্য। আরেকটা গুজব হলো এই টিকাটি দিলে সবাই অটিজমে ভুগবে। সবচেয়ে অদ্ভুত যে গুজব তা হলো এই টিকায় জোনাকিপোকার আলোজ্বলা উপাদান লুসিফারেজ উৎসেচক দেয়া আছে, মানুষকে দিলে মানুষ শয়তানের মতো জ্বলজ্বল করবে! পাশাপাশি আমাদের দেশের মজহারবাদি কর্মিগণ ইতিমধ্যেই জৈবপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গুজব ছড়ান।
তাই ভাবলাম একটু জেনে নেই ফাইজারের করোনাটিকায় কী কী উপাদান আছে। তাহলে মানুষ হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী এমআইটি টেকনোলজি রিভিউতে প্রকাশিত একটি লেখাকে ভিত্তি করে এখানে তথ্যগুলো দিচ্ছি। মূল লেখার সূত্র নিচে দেয়া আছে। তবে আমি লেখাটায় বেশ কিছু পরিবর্তন করেছি। এটা হুবহু অনুবাদ নয়।
এখানে আমেরিকার ঔষধের মান নিয়ন্ত্রন এবং অনুমতি প্রদানকারী সংস্থা ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশান (FDA) এর দেয়া তথ্যানুযায়ী ফাইজারের টিকাতে কী কী আছে তার তালিকা। এফডিএকে দুনিয়ার সবাই ঔষধের ক্ষেত্রে অভিভাবকসম প্রতিষ্ঠান হিসেবে চেনে এবং বিশ্বাস করে। প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের নিয়ে এই সংগঠন তৈরি। তালিকা এখানে -
মূল কার্যকরি উপাদান
স্নেহপদার্থ
লবন
অন্যান্য
এই তালিকা দেখলে মনে হতে পারে এইখানে কয়েকটা উপাদান শুধুমাত্র ঘুটা দিলেই স্যালাইনের মতো টিকা তৈরি হয়ে যাবে। কিছুটা সত্যি, তবে এর পেছনে রসায়ন আছে। সেটা একটু ব্যাখ্যা করছি।
নামই বলে দিচ্ছে, তথ্য আরনএনএ বা মেসেঞ্জার আরএনএ হলো ডিএনএ থেকে তথ্য নিয়ে কোষকে দেয় এমনভাবে যে কোষ তখন সেটা পড়ে পড়ে প্রোটিন তৈরি করতে পারে। করোনাটিকার প্রোটিনটা হলো ভাইরাসের স্পাইক বা গজাল প্রোটিন যা আমাদের অক্রকে (ইমিউন সিস্টেম) কার্যকরী করতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, এখানে পুরো ভাইরাসের জেনেটিক তথ্য আমরা টিকাতে দিচ্ছিনা, শুধুমাত্র গজাল প্রোটিনেরটা দিচ্ছি। এতোটুকু দিলেই আমাদের দেহ পর্যাপ্ত অক্রক বা এন্টিবডি তৈরি করতে পারে।
আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করার বিষয় হলো এটা 'মডিফাইড এমআরএনএ', কারন যেকোন বাইরের এমআরএনএ দিলেই আমাদের কোষ সেটা গ্রহণ না করে বরং কেটে টুকরো করে ফেলবে। কিছুটা পরিবর্তন করে সেজন্য হুবহু ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরির অংশটুকু ব্যবহার না করে কিছুটা পরিবর্তন করে তৈরি করা হয়েছে। modified nucleosides নামটা সেকারনেই।
ফাইজার যদিও এর সম্পূর্ণ বিন্যাসটি উন্মুক্ত করে দেয়নাই, তারপরও আমরা বুঝতে পারছি বিন্যাসটা কেমন হতে পারে। এমআরএনএ বেশি স্পর্শকাতর যৌগ, ভেঙে যায় সহজেই। সেজন্য ফাইজারের টিকাকে -৭৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হয়। টিকাটার একটা ঝামেলা এইখানে, সবজায়গায় সহজে সংরক্ষণ করা যায়না। অন্যদিকে মডার্নার টিকায় এই সংরক্ষণের বিষয়টা আরেকটু সহজ। তাদের উপাদানগুলি নিয়ে পরে হয়তো আরেকটু বিস্তারিত লিখবো। তবে এইটা বলে রাখা উচিত কেন মডার্নাটা -২০ ডিগ্রীতে ৬ মাস রাখা সম্ভব। সেটা বুঝতে পরের উপাদানে চলে যাই চলুন।
ছবি: কিভাবে এমআরএনএ টিকা কাজ করে।
ছবিসূত্র: https://www.ft.com/content/74e41528-80c3-4b0f-b343-be43d90f0311
ডিএনএ বা আরএনএ যৌগগুলোকে টিকা হিসেবে ব্যবহারের জন্য এদের আমাদের অক্র তৈরি করা কোষগুলোর ভেতরে ঢোকাতে হবে। কিন্তু আরএনএকে সরাসরি আমাদের দেহে সুঁই দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিলেই কিন্তু তারা আমাদের কোষে ঢুকতে পারবেনা। প্রথমতঃ কোষে ঢোকার আগেই আমাদের দেহ এদের ভেঙে ফেলবে। সেখান থেকে যৌগগুলোকে টিকিয়ে রাখত হবে। দ্বিতীয়তঃ কোষে ঢোকার জন্য একধরনের স্নেহপদার্থ প্রয়োজন যারা কোষের স্নেহপদার্থের সাথে মিশে যাবে।
এইকারনে টিকাগুলিকে যদি আপনি ছবির মতো কল্পনা করতে চান তবে দেখতে হবে একটা বেলুনের মতো যারা ভেতরে কিছু আরএনএ থাকে। বেলুনের আবরণটা তৈরি স্নেহপদার্থ দিয়ে আর ভেতরে থাকে এমআরএনএ। উপরের ছবিটা লক্ষ্য করুন!
স্নেহপদার্থগুলোর বেলুনকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেল বলে, কারন এদের আকার অতিক্ষুদ্র। ব্যস প্রায় ১০০ ন্যানোমিটার হবে। ১০ লক্ষ ন্যানোমিটারে ১ মিলিমিটার হয়। বুঝতেই পারছেন, কত ছোট! তবে কৌতুহলকর বিষয় হলো এটা মোটামুটি করোনাভাইরাসের সমান আকারই!
ফাইজার বলছে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং মিশ্রণে স্নেহপদার্থগুলি দিয়ে টিকাটি তৈরি করা হয়েছে যেন সেটা গাঠনিকভাবে শক্তপোক্ত হয়। এমআরএনএ এর চার্জ বা আয়ন হলো ঋণাত্মক, স্নেহপদার্থগুলিকে ধনাত্মক আয়ন দেয়া যেতে পারে যেন এমআরএনএ এবং স্নেহপদার্থ একসাথে লেগে থাকে। এই স্নেহপদার্থ মূলতঃ এলার্জির জন্য দায়ি, মানে যাদের এলার্জির সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে এলার্জি তৈরি করতে পারে, তবে সেটা খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। স্নেহপদার্থগুলির মধ্যে থাকা কোলেস্টরল ন্যানোপার্টিকেলগুলোকে গাঠনিক স্থায়িত্ব দেয়। টিকা তৈরি সময় স্নেহপদার্থ আর আরএনএকে ঝাঁকানো হয় যাতে বুদবুদসহ মিশ্রণ তৈরি হয়। এর ফলে আরএনএগুলো স্নেহপদার্থাবৃত হয়ে যায়। এফডিএ এই সাদা মিশ্রণকে বলে - “white to off-white” হিম তরল।
কয়েকধরনের লবনের মিশ্রণ আছে টিকাটায়। একটা হলো আমাদের সাধারণ খাবার লবন - সোডিয়াম ক্লোরাইড। আসলে এটা করা হয় টিকার মিশ্রণকে আমাদের রক্তের সাথে ভালোভাবে মিশে যাওয়ার জন্য প্রায় রক্তের তরলের মতো বানানোর চেষ্টা থেকে। এই লবণগুলি মিলে একটা মিশ্রণ তৈরি করে যার নাম হলো পিবিএস, আমাদের রক্তমিশ্রণের পিএইচ বা অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব যেমন ঠিক তেমনভাবে টিকার মিশ্রণের অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব নিধারণের জন্য। খুব একদিকে অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব বেশি থাকলে সেটা আমাদের কোষকে আহত করতে পারে। কাটাস্থানে লেবুর রস চেপে দিলে যেমন লাগে সেরকম অনুভূতির মতো ব্যাপার অনেকটা।
সুক্রোজ হলো একেবারেই আমাদের খাবার চিনি। চিনিকে ঘণ করে কোন মিশ্রণে দিয়ে দিলে সেটা সেই মিশ্রণকে অনেক ঠান্ডায় জমে গিয়ে নষ্ট করা থেকে বিরত রাখে। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করা প্রয়োজন। টিকাটাকে আমাদের অনেক ঠান্ডায় রাখতে হয়, যেখানে পানি বরফে জমাট বাঁধে। পানি যখন বরফ হয় তখন পানির স্ফটিক তৈরি হয় যেটা মিশ্রণে থাকা জৈব উপাদানকে নষ্ট করতে পারে। এই মিশ্রণে সুক্রোজ বা অন্যান্য উপদান, যাদের ক্রায়োপ্রোটেক্ট্যান্ট বলে, দিয়ে দিলে সেই বরফের স্ফটিক থেকে জৈব উপাদানকে অনেকখানি সুরক্ষা দেয়া সম্ভব। আরেকটা সুবিধা সুক্রোজ করে যা হলো হিমশীতল অবস্থায় স্নেহপদার্থগুলোকে একটার সাথে আরেকটা লেগে যাওয়া থেকে বিরত রাখে।
সুঁই ফোটানোর আগে টিকাকে খাবার লবণের দ্রবণে মিশিয়ে দেহে প্রবেশ করানো হয়। এখানেও রক্তের লবণত্বের সমান পরিমান লবনত্ব তৈরি করাটাই উদ্দেশ্য।
ফাইজার বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে যে এই টিকায় কোন সংরক্ষণকারী উপাদান, ইংরেজিতে যাকে প্রিজারভেটিভ বলে, তা নেই। এর বিশেষ কারন আছে। আগেই উল্লেখ করেছি, পশ্চিমা বিশ্বে ছড়ানো হয়েছে যে টিক দিলে অটিজম রোগ হয়। যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। তারপরও, ছড়ানো যেহেতু হয়েছে সেহেতু মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য ফাইজার এই বিশেষ ধাপটি নিয়েছে। অটিজমের জন্য বিশেষ করে একটা সংরক্ষণকারী উপাদান - thimerosal কে দায়ি করেন কতিপয় লোক; আবারও বলছি যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। কিন্তু কিছু টিকায় এই উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে বলে লোকে সন্দেহ করে বলে ফাইজার বিশেষ ভাবে তাদের টিকাকে 'preservative-free' বলেছে।
টিকাটায় কোন মাইক্রোচিপও নাই।
আর মুসলিমবিশ্বের যে সমস্যা, পশুর চর্বি, সেটাও আলাদাভাবে আছে কিনা সেটা উল্লেখ করেনাই এফডিএ বা ফাইজার। যে স্নেহপদার্থগুলি ব্যবহার করা হয় তাদেরকে ধারণা করি সংশ্লেষিত করা হয়। তারপরও আপনার যদি সন্দেহ হয় তবে আমি আমার পরবর্তী যুক্তি দিচ্ছি।
মনে করলাম কোন প্রাণীর দেহ থেকে চর্বি নিয়ে সেটা দিয়ে স্নেহপদার্থগুলি তৈরি করলো টিকা কোম্পানি। এখন এই স্নেহপদার্থগুলিকে যদি দেখি তবে তারা একেবারেই চর্বির ভেঙে যাওয়া মূল উপাদান যা আপনার আমার দেহেই পাবেন। এমন আণবিক পর্যায়ে এই স্নেহপদার্থের আর প্রাণীর উৎসের কোন খোঁজ থাকেনা। মানুষের কাছ থেকে বা মুরুগির কাছ থেকে চর্বি নিয়েও একই মূল উপাদানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। সেজন্য, আপনাকে যে স্নেহপদার্থ দেয়া হচ্চে সেটার সাথে প্রাণীটা কী ছিলো, তা খাওয়া আমাদের জন্য হারাম কিনা তার কোন সম্পর্ক নাই। ব্যাপারটাকে ভাবতে পারেন এভাবে, একটা মুরগি কেঁচো খায়। কেঁচো খাওয়া আমাদের জন্য হারাম। কিন্তু মুরগি খাওয়া নয়। মুরগীর যে মাংস কেঁচো খেয়ে তৈরি সেটার সাথে কেঁচোর সম্পর্ক টানার কোন মানে নাই। কেঁচোর প্রোটিন ভেঙেচুরে মূল উপাদানে তৈরি হয়ে সেটা মুরগীর মাংস হয়েছে!
আশা করছি আপনারা আশ্বস্ত হবেন। যখন সুযোগ আসবে তখন টিকা গ্রহণ করতে উৎসাহ দিচ্ছি। যাদের অনেক এলার্জি সমস্যা আছে তাদেরকে নিয়ে একটু সতর্ক থাকতে বলছেন ডাক্তাররা এখন। এলার্জির সমস্যা আমাদের দেশের মানুষের সম্ভবতঃ ততোটা নাই। তবে যাদের আছে তাদের জন্য বললাম। ধীরে সুস্থে আমরা আরও জানতে পারবো এই টিকার ব্যাপারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছুই বেশ চমৎকার মনে হলো।
টিকা নিন। সুস্থ থাকুন।
মন্তব্য
যাক, অনেক অনেক বিশেষজ্ঞ(!) মতের ভীড়ে একটা বস্তুনিষ্ঠ লেখা পাওয়া গেল। একটানে পড়ে ফেললাম।
কন্সপিরেসি থিওরি আউড়ে 'মাঠ গরম' করা আর ঠান্ডা মাথায় 'তথ্যভিত্তিক আলোচনা' আলাদা জিনিস।
আর সেইসাথে বিজ্ঞানের খটোমটো টার্মগুলো সহজভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেজন্যে ধন্যবাদ।
স্বরূপ-সন্ধানী
-------------------------
অন্ধকারে সবচেয়ে সে শরণ ভালো,
যে প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো
অনেক ধন্যবাদ স্বরূপ-সন্ধানী। আপনার রূপ আপনি তাড়াতাড়ি খুঁজে পান এই প্রত্যাশা রইলো।
নতুন মন্তব্য করুন