মাঝখানে কয়দিন মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিনের সাথে ডারউইনের সম্পর্ক খুঁজছিলাম। এ সংক্রান্ত আরেকটা আগের লেখা নিচে দিয়ে দিলাম (১)। যদিও বেশ কয়েকদিন আগেই হবে - এঙ্গেলসের একটা বই আছে - বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা, সেটা পড়ে ফেললাম। অনুবাদ কে করেছেন সেটা ভুলে গিয়েছি, কিন্তু সেটা ইংরেজি থেকে না একেবারে জর্মান থেকে সেটা আমি জানিনা। এটা মনে হওয়ার কারনটা হলো 'বানর' শব্দটাকে ব্যবহার করা। জর্মানে এঙ্গেলস লিখেছেন 'এফফেন' (Affen, একক Affe) যা গুগল ট্রান্সলেটে দেখলাম (জর্মান আমি জানিনা) বানরই হয়। বইটার ইংরেজী অনুবাদে ব্যবহার করা হয়েছে এইপ - The Part Played by Labour in the Transition from Ape to Man। যাকে আমরা বাংলায় বলছি বিনর। এসব গ্যাঁজাচ্ছি এই কারনে যে যদি তিনি বানর অর্থে এফফে ব্যবহার করেন তবে ভুল করেছেন, বাংলাতেও বানর বললে ভুল বোঝায়। শ্রম দিয়ে কেন, জিন দিয়েও বানর থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নাই। হয়েছে বিনর থেকে।
যাই হোক, এঙ্গেলস যদি বানর লিখে ভুল করেন তবে অবাক হবোনা, বইটার ধারণায় কিছু ভুল আছে। ডারউইন যা বলেন নাই সেটা নিয়ে কারবার করেছেন। শ্রমকে মানুষের বিবর্তনের একমাত্র উৎসেচক ধরেছেন যা অনেকগুলা দিক থেকে সম্পূর্ণ ভুল। বইটার মূল কথা হইলো মানুষের মস্তিষ্কের সাথে অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্কের তেমন কোন পার্থক্য নাই। তবুও আমরা মানুষ কারন মানুষের দেহের সাথে তার মস্তিষ্কের একটা দ্বান্দিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের যে দেহ তা তৈরি হয়েছে শ্রমের ধরনের ফলে এবং তার কারনে মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি যার ফলে আমরা মনুষ্য ক্ষমতাধারী। বুঝতেই পারছেন, ভুল ধারণা।
পড়ে মনে হয়েছিলো ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের চিন্তাভাবনা যতটা না ডারউইনীয়, তার চেয়ে বেশি ল্যামার্কীয়। অর্থাৎ, পরিবর্তনের পরে পরিবেশ অনুযায়ী নির্বাচিত হওয়ার যায়গায় এরা ভাবছেন প্রাণী কোন একটা আচরণ করছে এবং সেটা তার জীববিজ্ঞানকে সরাসরি প্রভাবিত করছে অল্প কয়েক প্রজন্মতেই বিবর্তিত হয়ে নতুন গুণ অর্জনের জন্য। এই প্রভাব অপবিজ্ঞানের আনয়ন ঘটায়। যেমন ঘটিয়েছিলো স্ট্যালিনের শিষ্য লাইসেঙ্কোর অপবৈজ্ঞানিক কাজকর্মে। এঙ্গেলসের এন্টি ডুরিং বইয়ের প্রাকৃতিক জগৎ অধ্যায়ে (সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদ) এবং বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা প্রবন্ধে স্পষ্টতঃ ল্যামার্কীয় চিন্তাভাবনার প্রকাশ।
মার্ক্সবাদীগণ মনে করেন যে ডারউইন এর তত্ত্ব মার্ক্স এর দ্বান্দিকতত্ত্ব এর সাথে খুব ভালভাবে খাপ খায়। তারা কয়েকটা যুক্তি দেখান এখানে, একটা হল - সরল থেকে জটিল জীবে অধিগমন। মার্ক্সবাদী দ্বান্দিকতা বলে যে কোন প্রক্রিয়া সবসময় উন্নততর অবস্থার দিকে ধাবিত হয় - the synthesis is always a more advanced stage than the previous thesis। ডারউইন এর তত্ত্বকে সাধারণীকরণ করলে মনে হতে পারে এটা বেশ মিলে যাচ্ছে, সরল থেকে জটিল জীবে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া। প্রকৃতি ভাল কে রাখে এবং খারাপকে ফেলে দেয়।
এই চিন্তার ঝামেলাটা হইলো প্রকৃতিতে যেটা টিকে থাকে সেটা সবসময় 'উন্নত' হতে হয় না। হ্যাঁ, উন্নত জীবেরা বহুদিনের বিবর্তনে তৈরি হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই বহু বছর ধরে অনুন্নত জীবেরও বেঁচে আছে, যদি তারা টিকে থাকার মত যোগ্য হয়। এখানে বিবর্তন সরলরৈখিকভাবে চলেনা। সমাজ বিবর্তন এবং দ্বান্দিক বস্তুবাদের ক্ষেত্রে মার্ক্স যেই সরলরৈখিক মডেল চিন্তা করেছিলেন তার চেয়ে ভিন্ন।
কিন্তু লেনিন এঙ্গেলসের এই চিন্তার কিছু ঝামেলা ধরতে পেরেছিলেন। তবে আমার ধারণা তিনি উল্টা ভাবছিলেন। তার একটা লেখা থেকে পাই “Still, this idea, as formulated by Marx and Engels on the basis of Hegel’s philosophy, is far more comprehensive and far richer in content than the current idea of [Darwinian] evolution is.” উনি ডারউইনের কথাবার্তা বোঝেন নাই সম্ভবত, আর হেগেলের তত্ত্ব যে বেশি খাটছেনা আধুনিক জীববিজ্ঞানে সেটা আমরা জানি, ডারউইন সেদিক দিয়ে দূরদর্শী ছিলেন। তবে এখান থেকে ভালো যে অংশটুকু নিতে পারেন সেটা হলো লেনিন বুদ্ধিদীপ্তভাবেই ডারউইন এবং মার্ক্স এর তত্ত্বগুলির মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। এটা বলছি এই কারনে যে অনেকে ডারউইনবাদের সাথে সমাজকে মিশিয়ে ইউজেনিক্সের চিন্তাভাবনার আনয়ন ঘটান যার সাথে হিটলারের কাজকর্মের মিল আছে। সোশ্যাল ডারউইনিজমের মতো গালভরা নামও আছে যার সাথে আসলে ডারউইনের কোন সম্পর্কও নাই, আছে তার কিছু 'পথভ্রষ্ট' শিষ্যের। রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতাদের হাত এই মতবাদের পক্ষে তাত্ত্বিক ধারণা প্রতিষ্ঠায় খুবই সক্রিয় ছিলো, সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ দুই ধারাতেই। আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজেনিক্সের ধারনাগুলার ওপর চর্চা হওয়ার সংঘ ছিলো যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে বিলুপ্ত করা হয়।
যাই হোক, মূল কথা হইলো কার্ল মার্ক্স ভেবেছিলেন যে ডারউইন এর বিবর্তনতত্ত্ব মানবসমাজকেও স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা যায়। তিনি ভাবলেন, সমাজও এভাবে বিবর্তিত হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে এবং এই বিবর্তন ততদিন চলবে যতদিন না একটা শ্রেণীহীন সামাজ গড়ে উঠবে। মানে এরপরে সমাজ বিবর্তন বন্ধ হয়ে যাবে। এইখানেই প্যাঁচটা লাগিয়ে ফেলেছেন।
কিন্তু এইটাকেই এঙ্গেলস বলণছেন, "“Just as Darwin discovered the law of evolution in organic nature, so Marx discovered the law of evolution in human history." অতীব ভুল ধারণা। এখন আমি সমাজ পরিবর্তনে শ্রেণীহীন সমাজ তৈরির পরে সেটা বন্ধ হবে কিনা তাই নিয়ে তর্কে যাচ্ছিনা। জীববিজ্ঞানে এরকম বন্ধের তেমন কোন ব্যাপার নাই। জীব যতদিন থাকবে এবং মানুষের নিয়ন্ত্রন যতদিন পর্যন্ত না সম্পূর্ণভাবে জীবজগৎকে প্রভাবিত করতে পারবে ততোদিন তো চলবেই বিবর্তন।
এবার আসি এঙ্গেলসের এই চমৎকার লেখাটার ভালো বিষয়ে। তার ল্যামার্কিয় চিন্তার প্রভাব ভুলে যান। কিন্তু জিন এবং সংস্কৃতি যে একে অপরের সম্পূরক হতে পারে তার প্রথম সবচেয়ে সম্পূর্ণ লেখা হইলো এঙ্গেলসের এই বিনর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা রচনাটি। আমরা আধুনিক জীববিজ্ঞানে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছি কিভাবে আমাদের আচরণকে জিন এবং আমাদের সংস্কৃতি কিভাবে প্রভাবিত করছে। এটাকে Dual inheritance theory বা দ্বৈত বংশগতি তত্ত্ব বলা চলে। মানে হইলো মানুষের আচরণ হইলো দুইটা জিনিসের সমন্বয়ে তৈরি - সাংস্কৃতিক আচরণ এবং জিন। এর কিছু উদাহরন দেয়া চলে যেগুলা আমি দিচ্ছিনা (নিচে অন্য জায়গার দুটো লেখা দিয়ে দিলাম, ২, ৩)। সেজন্য জিন-সংস্কৃতি সহবিবর্তনের ধারণা পোক্ত করতে এঙ্গেলসকে আমরা বাহবা দিতেই পারি।
আরেকটা বিষয় হলো বইটার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে চেনা। যে সমাজে থেকে তিনি এটা লিখছেন সেখানে ধর্মের কারনে হোক বা অন্যকোন ধারণার কারনে হোক, মানুষকে সবসময় উন্নত, প্রকৃতি থেকে পৃথক এবং সবার চেয়ে আলাদা প্রাণী হিসেবে দেখা হতো। অন্যান্য ধর্মগুলির বক্তব্যও আছে তাই, শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। এমনকি বড় বড় চিকিৎসাবিদরাও মানুষের অসুখ নিরুপন শুকর কেটে পরীক্ষা করলেও (আগে মানুষে কাটাছিড়া নিষিদ্ধ ছিলো) মানুষ যে ভীষণরকম ভিন্নপ্রাণী সেটা মনে করতেন। পৃথিবীর প্রকৃতিতে প্রায় এলিয়েন বলতে পারেন। এই ধারণার সমস্যা হলো তখন জীববিজ্ঞানকে বুঝতে যেমন ঝামেলা হয়েছে আমাদের তেমনি প্রকৃতিতে মানুষের আসলে জায়গা কোথায় এবং প্রকৃতির সাথে আমরা কেমন ব্যবহার করবো সেটা বুঝতেও কষ্ট হয়েছে। এঙ্গেলস সেই ধারণায় আঘাত হেনেছেন। জৈববিবর্তনকে বোঝার অন্যতম পরাকাষ্ঠাই হলো এইটা বোঝা যে আমরা প্রকৃতির অংশ এবং প্রকৃতির জিনিসপাতি দিয়েই তৈরি এবং প্রকৃতি দিয়ে প্রভাবিত।
বইটাতে এঙ্গেলস মানুষকে প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বলা চলে। আমরা আমাদের পোষা গরুটার মতোই।
১। মার্ক্স-এঙ্গেলস-ডারউইন; বউ-বই-চিঠি
মন্তব্য
সর্দার সাহেবের অনুবাদটা পড়ব তবে, আগ্রহ উস্কে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার লেখা আরেকটু নিয়মিত পড়তে চাই।
facebook
এন্টি ড্যুরিং সরদার ফজলুল করিমের। অন্যটা কার অনুবাদ সেটা ভুলে গেসি, পিডিএফ পড়েছি এবং পিডিএফ এখন আর নাই। তবে আমি ধারণা করি অনেক আগের এবং ভারতীয় কেউ অনুবাদক হবেন।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। লেখালেখি করা হয়না আসলে। চেষ্টা করবো।
লেখাটা ভালো লাগলো। মন দিয়ে পড়লাম।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আমি আপনার লেখাটি অনেক গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লাম আর বোঝার চেষ্টা করলাম।
আপনার লেখাটি অনেক সুন্দর হয়েছে
বিষয়টা তো আসলেই কৌতুহলোদ্দীপক ! ধন্যবাদ লেখককে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন