বোলোনিয়া শহরের একজন নাম না জানা শাসকের মোজাইক দিয়ে নির্মিত পোর্ট্রেট। ছবিটি বোলোনিয়ার সিভিক মিউজিয়াম থেকে তোলা হয়েছে।
বোলোনিয়া শহরের চারদিক পাহাড় ঘেরা। পো নদী আছে বটে এখানে তবে তা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একসময় পো নদীর জলের ধারা বিভিন্ন খালের মাধ্যমে কুলুকুলু ধ্বনিতে শহরের নানান পয়েন্টে বহমান থাকলেও এখন তাঁর ছিটেফোঁটার সন্ধান মেলে। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর পূর্বে বর্তমান বোলোনিয়া শহর ছেড়ে খানিক দূরে মনুষ্য বসতির নিদর্শন পাওয়া যায়। সেটা ছিল ব্রোঞ্জ যুগ। লৌহ যুগে এসে মনুষ্য ব্যাবহৃত উন্নতমানের কিছু উপকরণ যেমন থালা-বাসন ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই প্রাচীন সভ্যতার নামকরণ করা হয়েছে ভিলানোভিয়ান সভ্যতা। ভিলানোভিয়ান গ্রামগুলিতে দক্ষ কামার এবং কুমার সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বোলোনিয়া শহরের গোড়াপত্তন করে এত্রুস্কান নামক জনগোষ্ঠী, তাঁরা এই শহরের নাম দেন ফেলসিনা এবং এই ফেলসিনা কালক্রমে হয়ে ওঠে তাঁদের রাজধানী। এরপর গাউল সম্প্রদায় যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করে এখানে বসতি স্থাপন করে এবং এত্রুস্কানরা হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু। গাউলদের সময় এই এলাকার সমৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পরে ইটালি জুড়ে। এখানকার মাটির উর্বরতা এবং ফসলের প্রাচুর্য রোমানদের আকৃষ্ট করে এবং তাঁরা খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৬ সালে এই এলাকা দখল করে নিয়ে রাজ্যের নাম রাখেন বোনোনিয়া। বোনোনিয়া উপনিবেশ স্থাপন করে তারা এখানে ল্যাটিন আইন চালু করেন এবং স্বাধীন প্রশাসন গড়ে তোলেন রোমান সাম্রাজ্য পতনের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ ৪৭৬ সাল। রোমানদের পতনের পর এই শহর শাসিত হয় বাইজেন্টাইন সহ আরও অন্যান্য শাসক দ্বারা। ত্রয়োদশ শতক থেকেই পোপদের আগ্রাসন ক্রমশ শক্তিশালি হতে থাকে এখানে এবং এখানকার সামন্ত প্রভুরা তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করতে থাকেন। তবে সেই সময় পোপ এবং বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা তাঁদের ক্ষমতা বলয় ছাড়তে চাইতেন না বিধায় বোলোনিয়া শহরের সামন্ত প্রভুরাও নানান শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
এত্রুস্কানদের ব্যবহারকৃত নানান সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই শহরের নানান জাদুঘরে। তাঁরা কিংবা গাউলরা মুলত পো নদীর তীরে তাঁদের নিবাস গড়ে তোলে। তবে শহর হিসেবে বোলোনিয়ার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে রোমান শাসনামলে। তাঁরা নগর পরিকল্পনা তৈয়ার করেন এবং সেই মাফিক নগর হিসেবে বোলোনিয়া প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, এমনকি এই নগরের চারপাশে নগর ফটক গড়ে তুলে রোমানরা শহরকে একটি সুরক্ষিত এলাকায় পরিণত করে।এই ফটক এবং তার চারপাশের দেয়ালের ভগ্ন নিদর্শন ছড়িয়ে আছে গোটা শহর জুড়ে। ১৫০৬ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এই শহর পোপ দ্বারা শাসিত হয়। পাপাল স্টেট কর্তৃক শাসিত হবার সময় বোলোনিয়া শহরে অনেকগুলি গির্জা নির্মিত হয়। শহরকেন্দ্রে যে গির্জাটি দেখা যায় তা বিশ্বের পঞ্চদশতম সর্ববৃহৎ গির্জা। এই গির্জাগুলির অভ্যন্তরে শিল্পকলার অভাব নেই কোনও। অনেকগুলি গির্জার মাঝে ১২৯০ সালে নিরমিত সান ফ্রাঞ্চেসকো গির্জাটি মতান্তরে ইটালির সর্বপ্রাচীন গথিক স্টাইলে নির্মিত গির্জা। অনেকগুলি গির্জার মাঝে সবচাইতে আকর্ষণীয় বোধ করি সানদোমেনিকো গির্জাটি। এখানেই রয়েছে গুইদো রেনি অঙ্কিত একটি মাস্টারপিস এবং মিকেল এঞ্জেলো কৃত তিনটি ক্ষুদ্র ভাস্কর্য।
সামন্ত প্রভুদের আধিপত্যের সময় ত্রয়োদশ শতকেই বোলোনিয়া শহরে গড়ে ওঠে ছোট বড় ১০০ টি টাওয়ার যদিও এদের সিংহ ভাগেরই কোনই অস্তিত্ব নেই। শত্রুর গতিবিধি নজরদারি এবং আত্মরক্ষার নিমিত্তে টাওয়ারগুলি নির্মিত হয়। ভুমিকম্পে বিলীন হবার আশংকায় অনেক টাওয়ারের মালিক নিজেরা সেগুলি ধ্বংস করেন। এখন মোটে কুড়িখানেক টাওয়ার স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সামন্ত প্রভুরা বংশ পরম্পরায় এক একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার রূপে পরিচিতি লাভ করেছিল আর তাদের মাঝে জন্ম নিয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং ক্ষেত্র বিশেষে রক্তক্ষয়ী শত্রুতা। শত্রুতা জন্ম দেয় রোমিও জুলিয়েটের আখ্যানের মতই একটি সত্য ঘটনার। ত্রয়োদশ শতকে বোলোনিয়া শহরে সামন্ত পরিবারগুলি দুইটি শিবিরে বিভক্ত ছিল। একটি শিবির পোপের বশ্যতা স্বীকার করেছিল আরেকটি শিবির রাজার কর্তৃত্বকেই মেনে নিতে পছন্দ করতেন। গালুজ্জি পরিবারের আদরের কন্যা ভার্জিনিয়া প্রেমে পরেন কারবোনেজি পরিবারের আলবেরতো কারবোনেজির সাথে। দুই পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিবাদ এই ঘটনায় জন্ম দেয় চরম শত্রুতার। ১২৫৪ সালে কন্যার বাবা জানপিয়েত্রো যখন জানতে পারেন যে তাঁর কন্যা গোপনে বিয়ে করেছে তার শত্রু পুত্রকে তখন তিনি এবং তার পুত্ররা একে একে হত্যা করেন প্রেমিক আলবেরতো সহ তাঁর সাহায্যকারী সকল বন্ধুবরকে আর এই ঘটনার জের ধরে ভার্জিনিয়া তাঁদের প্রাসাদের এক ব্যাল্কনিতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
চতুর্দশ শতকে বোলোনিয়ার পরিচিতি ইউরোপে ছড়িয়ে পরে এর বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে। বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম ১০৮৮ সালে। শুরু থেকেই এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বোলোনিয়া শহরবাসীর গর্বের ধন। এই শহরের প্রাণচাঞ্চল্য থেকে শুরু করে ব্যাবসা বানিজ্যের সিংহভাগই পরিচালিত হয় ফি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহনের কারণে। এই শহরের বাসস্থান শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক ভাবে নির্মান করা হয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীরা যাতে নিরুপদ্রবে চলাচল করতে পারে এইজন্য প্রত্যেকটি ভবনের সামনে আইন করে বাধ্যতামুলক ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে পোরতিকো, রোদ-ঝড়- বৃষ্টির হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করার জন্য। মধ্যযুগে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছিল "ক্যানন ল" পাঠদানের ক্ষেত্রে। এই আইন শিক্ষার মাধ্যমে তখন গির্জার প্রশাসন সংক্রান্ত আইন কানুন শেখানো হত। এই আইন পড়ার জন্যই এখানে নিকোলাস কোপার্নিকাসের পদধুলি পড়েছিল। জীবনের দীর্ঘ তিন বছর তিনি আলো হয়ে থেকেছেন এই শহরে। এখানে অধ্যাপনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন এই শহরেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান পদার্থবিদ এবং ডাক্তার লুইজি গ্যাল্ভানি। ইউরোপের প্রথম মহিলা অধ্যপক পদার্থবিদ লাউরা বাসি এই শহরেরই আরেক উজ্জ্বল সন্তান।
এইবার একটু জিরিয়ে নেই। কথা অনেক হল, এইবার চাক্ষুষ কিছু ছবি বর্ণনাসহ দেয়া যাক।
১) আসিনেল্লি টাওয়ার থেকে দেখা বোলোনিয়া শহর।
২) আসিনেল্লি টাওয়ার হচ্ছে বোলোনিয়ার সবচাইতে উঁচু টাওয়ার যার উচ্চতা প্রায় ৯৭ মিটার। ৪৯২ টি সিঁড়িযুক্ত এই টাওয়ার ১১০৯-১১১৯ পর্যন্ত ১০ বছর ধরে নির্মাণ করেছিল বোলোনিয়ার সম্ভ্রান্ত আসিনেল্লি পরিবার। আসিনেল্লি টাওয়ারের পাশেই রয়েছে গারিসেন্দা টাওয়ার যার উচ্চতা ৪৭ মিটার। এই দুইটি টাওয়ারের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে বোলোনিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান পিয়াজ্জা দুয়ে তোররি। দুয়ে তোররি মানে হচ্ছে দুই টাওয়ার। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই দুইটি টাওয়ারই সময়ের ব্যাবধানে হেলে গিয়েছে বেশ খানিকটা।
৩) প্রার্থনার শহর বোলোনিয়া। বিশেষ করে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের পীঠস্থান হিসেবে একসময় ইটালিতে রোমের পরপরই বোলোনিয়ার স্থান ছিল। আজও এই মর্যাদার তেমন একটা তারতম্য দেখিনা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যাথলিক প্রার্থনাকারীরা এখানে ভিড় জমান নানান উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। একবার দেখলাম পেরু থেকে আগত এক বিশাল দল যিশুর ছবি সম্বলিত একটি কাঠের স্তম্ভ পিঠে বহন করে শহর প্রদক্ষিন করছে। তাদের হাতে ধুপ ধুনো আর সাথে ব্যাপক ব্যান্ড বাদ্য। সে এক বিশাল আয়োজন।
৪) বিশ্বের পনেরো তম সর্ববৃহৎ গির্জা বাসিলিকা সান পেত্রোনিয়ো। এই গির্জাটি নির্মান করতে সময় লেগেছে প্রায় ছয়শ বছর (ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ১৩৯০ এবং আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ১৯৫৪), তাও পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মান করা সম্ভব হয়নি। পুরো গির্জার বাইরের আবরণটি মোজাইক দিয়ে আবৃত করার কথা থাকলেও নানান কারণে এই নির্মাণ কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এই গির্জার সিলিং ও উপরিভাগের পুরো অংশটাই ইঁট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন ইটালির কেন্দ্রীয় গির্জাগুলি ছিল এক একটি শহরের মর্যাদা এবং সমৃদ্ধির প্রতীক। তাই বিভিন্ন শহরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত কে কার চাইতে বেশী বড় এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদে ভরপুর কেন্দ্রীয় গির্জা নির্মান করতে পারে!
৫) শহর বোলোনিয়ার কেন্দ্র পিয়াজ্জা মাজ্জোরে। এই শুন্য স্থানটির চারপাশ জুড়ে নানান সুউচ্চ ভবন বোলোনিয়া শহরের সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার বছর। এই ভবঙ্গুলির সব কটিই নির্মাণকাল চতুর্দশ শতক। এটি বোলোনিয়া বাসীর মিলন কেন্দ্র, সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু।
৬) বোলোনিয়ার একটি প্রাচীন গতানুগতিক ভবনের সম্মুখভাগের ডিটেইলস।
৭) পালাজ্জো সাঙ্গুইনেত্তি অথবা সাঙ্গুইনেত্তি প্রাসাদ। এখানে বোলোনিয়া শহরের একমাত্র সঙ্গীত জাদুঘরের অবস্থান। এই প্রাসাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অপূর্ব সিঁড়িঘর। এত চমৎকার আর্ট করা সিঁড়িঘর আমার চোখে আর দেখা হয়ে ওঠেনি।
৮) বোলোনিয়া শহরের রাত্রি জীবন আনন্দ কোলাহলে ভরপুর। ছুটির দিনগুলিতে রাস্তায় থাকে উপচে পরা ভিড়। আর বার কিংবা পাব গুলি ভরে ওঠে তরুন তরুণীদের উদ্দাম ধ্বনিতে।
৯।১৪৯৪ সালের প্রায় পুরোটা সময় ইটালিয়ান রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তান মিকেলএঞ্জেলো বোলোনিয়া শহরে কাটিয়েছিলেন। তৎকালীন ফ্লোরেন্স শহরের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁকে ফ্লোরেন্স ত্যাগে বাধ্য করেছিল। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মিকেল বোলোনিয়া শহরে এসে কাজের সন্ধান করেছিলেন বিভিন্ন গির্জায়। তখন শিল্পীদের প্রধান কাজই ছিল গির্জার কমিশন প্রাপ্তির মাধ্যমে শিল্পকলার ভেতর দিয়ে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার সন্নিবেশ করা। কাজ পেতে বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে, সান দোমেনিকো গির্জায় উনি তিনটি ভাস্কর্য নির্মাণের দায়িত্ব পান এবং ঠিক এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করেন। এই তিনটি ভাস্কর্যের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আলোকবর্তিকা হাতে একজন নবীন সন্ত।
১০) লুইজি গালভানির জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছে বোলোনিয়া শহরে। তিনি ছিলেন একাধারে ক্ষুরধার পদার্থবিদ, স্বনামধন্য ডাক্তার এবং দার্শনিক। ১৭৭১ সালে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ এবং প্রাণীজগতের ওপর গবেষণাকালীন সময়ে তিনি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন যে ব্যাঙের শরীরে বিদ্যুৎ প্রবেশ করলে ব্যাঙের পায়ের পেশী সংকুচিত হয়। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় বায়ো ইলেক্ট্রিসিটি নামক বিজ্ঞানের নতুন এক শাখা এবং পঠন-পাঠন। গালভানির স্মরণে বোলোনিয়া শহরে একটি উন্মুক্ত কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে যার নাম পিয়াজ্জা গালভানি।
১১) নিকোলাস কোপার্নিকাস ১৪৯৬ থেকে ১৫০১ এর মধ্যবর্তী কালীন তিন বছর বাবার আগ্রহে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে "ক্যানন ল" পড়তে এসেছিলেন। এই ক্যানন মানে আবার সেই কামান নয় কিন্তু। ক্যানন ল এর মাধ্যমে সেই সময় গির্জার প্রশাসনিক আইন কানুন শেখানো হত আর এই পাঠ দানের ক্ষেত্রে বোলোনিয়া তৎকালীন ইউরোপে অগ্রগামী ছিল, যদিও বোলোনিয়ায় এই আইন শিক্ষা উনি শেষ করতে পারেন নি। পারবেন কিভাবে, উনার ভাবনা চিন্তা জুড়ে ছিল মহাজগত, সৌরজগত আর তার গতি প্রকৃতি। বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আজন্ম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব শ্রেণীর ক্লাস এখানে অবারিত, উন্মুক্ত। আইন নয়, তরুণ নিকোলাসকে আইনের বদলে মানবিক বিদ্যা আর অ্যাস্ট্রোনমির ক্লাসেই দেখা যেত বেশি। বোলোনিয়ায় এই সময়েই তখনকার স্বনামধন্য অ্যাস্ট্রোনোমার ডোমেনিকো মারিয়া নোভারার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং সাক্ষাতের পরপরই নিকোলাস তাঁর গুণমুগ্ধ চ্যালা এবং সহকারী হিসেবে পরিণত হন। থাকা- খাওয়া সবই চলে গুরুর বাসায়। তাঁর আইন শিক্ষা চুলোয় গেলেও পরবর্তীতে তিনি তা ঠিকই শেষ করেন তবে বোলোনিয়ায় নয়, ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫০৩ সালে, সেখান থেকে তিনি আইন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।
১২) অষ্টাদশ শতকে বলনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান অ্যানাটমি বিভাগে শিক্ষার্থীদের মাতৃগর্ভ থেকে একটি শিশুর বেড়ে ওঠা এবং জন্মদানের পুরো প্রক্রিয়াটি লাইফ সাইজ মডেলের মাধ্যমে দেখানো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে নিম্নোক্ত ছবিটির মত গোটা পঞ্চাশেক ওয়াক্স সুন্দর করে সাজানো গোছানো রয়েছে। আলোচ্য ওয়াক্সটি মাতৃ জঠরে যমজ শিশু কিভাবে থাকে তারই একটি চাক্ষুষ প্রমান হিসেবে রাখা রয়েছে শিক্ষার্থীদের সামনে।
১৩) বোলোনিয়া শহরের চারধার মনোরম পাহাড়ে ঘেরা। পাহাড়ের ওপর চাষবাস হয়, বসতি রয়েছে সেখানেও।
১৪) বোলোনিয়া হচ্ছে ইটালির খাদ্য রাজধানী, এই শহরের আরেক নাম হচ্ছে "দি ফ্যাট ওয়ান।" নানান পদের দুগ্ধজাত খাবার, শুকরের মাংসের হরেক পদ আর অসাধারণ সব পাস্তার দেখা মেলে এখানে। বোলোনিয়ার খাদ্য সংস্কৃতি মূলত শুকরের মাংস এবং পনির নির্ভর। নানান রকমের পাস্তার মাঝে একটি পাস্তার নাম তোরতেলিনি আল ব্রথ। ব্রথ মানে হচ্ছে সুপ। সেই সুপ হতে পারে সব্জির অথবা মাংসের। আর তোরতেলিনি ময়দা দিয়ে তৈয়ার করা নাভি আকৃতির ছোট ছোট পুঁটুলি।। এই পুঁটুলির ভেতর শুকরের মাংসের পেস্ট থাকে অথবা থাকে সব্জি।
১৫) বোলোনিয়া শহরের কেন্দ্রটি অত্যন্ত মনোরম। এখানে গির্জা, ভাস্কর্য, রাজকীয় প্রাসাদ, অমুপম সব ভবনের সৌন্দর্য সত্যিই মন মাতানো। এইসব চিত্তাকর্ষক স্থাপনার বাইরে যেটা সবচাইতে বেশী চোখ কেড়ে নেয় আর মনকে অশ্রু সজল করে, তা হল এখানে টাঙ্গিয়ে রাখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের ছবিগুলি। গোটা বছর জুড়েই নানান উৎসব ও আয়োজনে বোলোনিয়া শহরের অধিবাসীরা তাঁদের শহরের শ্রেষ্ঠ সন্তান এইসব শহীদদের স্মরণ করেন ফুল অর্পণের মাধ্যমে।
১৬) বাসিলিকা সান ফ্রান্সেসকো টাওয়ার। টাওয়ারটির সাথে লাগোয়া সান ফ্রান্সেসকো গির্জাটি ইটালির প্রথম গথিক স্টাইলে নির্মিত গির্জা। এই গির্জা ইতালির সর্বপ্রথম গথিক স্টাইলে নির্মিত। এই গির্জার যাত্রা শুরু হয় ১২৩৪ সালে।
১৭) ১৯৬৪ সাল থেকে বোলোনিয়া শহরে প্রত্যেক বছর আন্তর্জাতিক শিশু বই মেলা উদযাপন করা হয়। এটি মূলত প্রকাশকের মেলা হলেও দর্শনার্থীদের উপচে পরা ভিড় দেখেছি প্রত্যেকবার। বিশেশ করে শিশুদের ভিড় দেখেছি বেশী। শিশুতোষ বইয়ের বিকি-কিনি, প্রচ্ছদ অঙ্কন, সেরা শিশুসাহিত্যিক কে পুরস্কৃত করা, প্রকাশক এবং পাঠকদের মত বিনিময় এবং প্রকাশকদের পন্যের প্রচারের ব্যাবস্থা করাই এই মেলার উদ্দেশ্য। পাশের দেশ ইন্ডিয়া এবং শ্রীলঙ্কার প্রকাশকদের স্টল দেখলেও এখন পর্যন্ত আমাদের দেশেরই কোনও স্টল চোখে পরেনি কখনও।
১৮) পোরতিকো এর সঠিক বঙ্গানুবাদ কি হতে পারে জানিনা। বোলোনিয়া শহরের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই পোরতিকো। পোরতিকো হচ্ছে ভবনের সম্মুখে দণ্ডায়মান শুন্যস্থান। গোটা ইউরোপজুড়েই এই পোরতিকোর সন্ধান মেলে। তবে বোলোনিয়া এক্ষেত্রে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। কারণ এখানে রয়েছে চার কিলোমিটার ব্যাপী দীর্ঘ অবিচ্ছেদ্য পোরতিকো যার আকার প্রায় চার কিলোমিটার (বোলোনিয়া শহরকেন্দ্র থেকে সান লুকা গির্জা), এটা ছাড়াও মোট আটত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ পোরতিকো রয়েছে বোলোনিয়া শহর জুড়ে। ত্রয়োদশ শতকে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগে ছাত্র ছাত্রীদের আবাস এবং চলাচলের সুবিধার্থে নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রত্যেকটি ভবনের সামনে পোরতিকো নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এই সব পোরিতকোর আকারও এমনভাবে করা হয়েছে যেন একজন অশ্বারোহী নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারেন এর ভেতর দিয়ে। গত আটশো বছর ধরে এই পোরতিকো বোলোনিয়া বাসীকে রোদ-ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে যাচ্ছে। নিম্নোক্ত ছবিটি সান লুকার পোরতিকো থেকে তোলা হয়েছে।
১৯) এই পোরতিকোর সিলিং জুড়ে রয়েছে নানান আকারের নানান রূপের বাতি। এই বাতিগুলি এই শহরের বাড়তি শোভার জোগানদার এবং অন্ধকারে পথিকের পথ চলার সঙ্গী। তবে পোরতিকো ছাড়াও অনেক আকর্ষণীয় বাতি দেখেছি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভবনের অভ্যন্তরে। নিম্নোক্ত ছবিটি নেয়া হয়েছে বোলোনিয়ার বানিজ্য সমিতির ভবনের ভেতর থেকে।
২০)সুরসম্রাট মোজার্ট মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ১৭৭০ সালে বোলোনিয়া এসেছিলেন সঙ্গীতের ওপর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য। সেই সময় বোলোনিয়া সঙ্গীতের জগতে ইউরোপে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল মূলত সঙ্গীত শিক্ষক ফাদার মারতিনির কারণে। এই শিক্ষকের সঙ্গীত বিষয়ক জ্ঞান এবং দক্ষতার কথা সারা ইউরোপে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হত। মোজার্টের সঙ্গীত প্রতিভায় মুগ্ধ ফাদার মারতিনি মোজার্টকে হাতে ধরে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। মোজার্ট উক্ত প্রবেশিকা পরীক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুল করে ফেলেন। কিন্তু এই পরীক্ষায় পাস না করলে তো বড় বড় শহরে কেউ মোজার্টকে পাত্তা দেবেনা এবং তার অমিত প্রতিভা অচিরেই অন্ধকারে তলিয়ে যাবে! এই দুশ্চিন্তা থেকে ফাদার মারতিনি মোজার্টের পরীক্ষার খাতা নিজের হাতে সংশোধন করে তাঁকে পাশ করে দেয়ার ব্যাবস্থা করেন। ফাদার মারতিনির এই উপকারের কথা মোজার্ট কখনো ভুলতে পারেন নি। তিনি ভিয়েনা থেকে ১৭৭৬ সালে মারতিনিকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন যা বোলোনিয়ার সঙ্গীত জাদুঘরে রয়েছে। আর নীচের ছবিটিতে পরিক্ষার দুটি খাতাই তুলে ধরা হল যা বোলোনিয়ার জেনুস বোনোনিয়া জাদুঘরে রক্ষিত আছে।
মন্তব্য
পিনাক পাণি
অসাধারণ ! সেরা পোস্ট আপনার ! ইতিহাস ব্লেন্ডিং ভাল লেগেছে
facebook
ধন্যবাদ রে, ভালো থাকিস।
চমৎকার৷
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ সত্যপীর। আপনার ইতিহাসের অস্থির সব কথকতা কই গেল রে ভাই? আবার শুরু করুন।
আমি বোলোনিয়া শহরে আছি প্রায় ৫ বছর হলো। এখানে আসার পর যে বিষয়গুলো দেখে আমি অভিভূত হয়েছি তা হলো প্রাচীন শহররক্ষা প্রাচীরের পর্তাগুলো দেখে (শহরে প্রবেশ করার দর্জা), প্রাচীন গির্জাগুলো এবং ভাস্কর্যগুলো। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে হাজারও প্রশ্ন ছিল মনে, সে প্রশ্ন অনেকটা প্রশমিত হচ্ছে মনি শামিম ভাইয়ের এই "বোলোনিয়া প্যাঁচালী" নামক ধারাবাহিক পর্ব লেখার বদৌলতে। তবে এই শহর রক্ষা প্রাচীর সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার কৌতুহলটা রয়ে গেল, আশা করি আগামী পর্বগুলোতে জানতে পারবো। এতো সুন্দর করে বোলোনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ মনি শামিম ভাইকে। আর ছবিগুলোও অসাধারণ হয়েছে।
facebook
জিল্লুর ভাই, শহরে প্রবেশ করার দরোজা কিংবা পোরতার ছবি আগামী পর্বে আসবে। বর্ণনাও থাকবে। শুধু আপনার আগ্রহের কারণে জানিয়ে রাখি যে পোরতা এবং তৎসংলগ্ন প্রাচীরগুলি রোমানরা শুরু করলেও এই কাজ শেষ করেছে মূলত বোলোনিয়ার অধিবাসীরা। রোমানদের পতনের পরে বিভিন্ন সময় নানান শাসকরা অরক্ষিত বোলোনিয়াকে আক্রমন করেছে। এতে করে স্থানীয় জনসাধারণের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বছরের পর বছর। তারাই এখানকার স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ দিয়ে পুরো শহরকে প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করেছে। এই বিষয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে পরবর্তীতে লেখা আসুক। ধন্যবাদ।
শেষ ফেব্রুয়ারীতে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম মানে ঠিক ঘোরা নয় কাজের ফাঁকে একটু দেখা - যদিও সে সময় মাথায় বাঁজ পরেছিল শাহবাগ ছেড়ে যেতে হবে বলে - কিন্তু সত্যিই দম বন্ধ লাগে কয়েকদিন না বের হতে পারলে - সচলায়তন এর ভ্রমণ ক্যাটাগরীটা মাঝে মাঝে একটু সহ্য করার রসদ যোগায় - অণুদার সাথে গুরেছি অনেক জায়গায় - মনিদার সাথে ঘুরতেও ভাল লাগছে।
ধন্যবাদ স্যাম। জানেন আমার কি হয়? একটার পর একটা ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় মনটা বিষণ্ণ থাকে এবং ঠিক বুঝে পাইনা যে এই শহরের বর্ণনা, ছবি- এগুলো যুক্ত করার উপযুক্ত সময় কি এখন কিনা। আত্মবিশ্বাস পাইনা, স্বস্তি পাইনা। তারপরেও মনে হয় যে দিয়ে দিই। দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে আমার নিজেরও তো মুক্তি দরকার। সত্যি বলতে কি, সচলায়তনকে ভালবেসে এখানে লেখার যোগান দিই। আমি ঘুরতে পছন্দ করি বটে তবে ঘরকুনো স্বভাব থেকে সহসাই বের হতেও পারিনা। আর তাছাড়া তিন মাস পর চলে যাচ্ছি দেশে। তাই ভাবছি, লেখাগুলি ছেড়ে দিই, পরে যদি আর না পারি। আরও লেখা জমা আছে। সেগুলি ঘসা মাজা করতে হবে। ধন্যবাদ স্যাম।
খুব ভাল লাগল পোস্ট। অনেক ইতিহাস জানলাম। ছবির কথা আর নতুন করে কিছু বলার নাই, বরাবরের মত দারূন, এবার প্রতিটা ছবির বর্ণনা ভাল হয়েছে।
ভাইয়া আগের পোস্ট এর লিংকটা দিয়েন।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ধন্যবাদ শাব্দিক।
লিঙ্ক দিতে গেলেই এরর আসছে যে! কি মুশকিল!
চমৎকার মণি ভাই!
৬ নং ছবিতে ভবনের ডিটেইলসের ছবিটা দারুণ।
৪-এ বাসিলিকা সান পেত্রোনিয়ো গির্জার ছবিটা একটু কেমন যেন, মনে হচ্ছে যেন গির্জার সামনে একটা বড় বিলবোর্ড রাখা, তাতে গির্জারই ছবি, আর দরজার/প্রবেশপথের জায়গায় বিলবোর্ডে ফুটো করা, সেখান দিয়ে ঢুকতে হবে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ধন্যবাদ যাযাবর বুবু।
বাসিলিকা সান পেত্রোনিয় এর সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। বিশেষ করে এই গির্জার সম্মুখভাগের মোজাইক দিয়ে ঘেরা অংশটুকু এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য। এর মাঝে রয়েছে আলফন্সো লোম্বারদির একটি অসাধারণ কাজ।
এই সংস্কারের কাজ কবে শেষ হবে, জানিনা। তবে বাইরের অংশে সংস্কারের কাজ চললেও ভেতরে প্রবেশ করা যাবে। দরজা উন্মুক্ত রয়েছে। ভেতরটা দারুণ, সামনের পর্বে ছবি দেব।
আচ্ছা আচ্ছা, বিলবোর্ড দিয়ে সংস্কারের কাজ আড়াল করে রেখেছে। বাহ!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
খুব ভালো লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন