বিকেল সাড়ে পাঁচটায় হারমোনিয়ামে বসে গেছেন রবিনদা। আমি, বাঁধন আর অথৈ পৌঁছেছি খানিক পরে। দেরী করিনি বেশী। শুভময় এসেছে সাথে তীরথ, ডাল্টন আসি আসি করছে। তীরথ তবলা ধরেছে আর হারমোনিয়ামটা কখনও রবিনদা আর কখনও শুভময়ের হাতে ঘুরপাক খাচ্ছে। গান এরা কমবেশি সবাই গাইবে। বাঁধন যেহেতু বেশ কিছুদিন পর ঢাকা থেকে রাজশাহী গিয়েছে, কাজেই শুরুর দিকে কাকীর অনুরোধে গানের শুরুটা বাঁধনকে দিয়ে হবে। আর চঞ্চলমতি অথৈ আনমনা হয়ে গান শুনবে আর মাঝে মাঝে একটু বিরক্তির দৃষ্টি দেবে। তবে অথৈয়ের এই বিরক্তিকে আনন্দে রূপান্তরিত করার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখবেন না আমাদের দীপিকা কাকী। তো গান শুরু হয়ে গেছে। দীপিকা কাকী আমাদের জন্য চা বানাতে গেছেন। গানের এই একেবারেই অনানুষ্ঠানিক আসর বসেছে কাকীদের বাসাতেই। সুব্রত কাকু আজ বাসায় নেই, ইউনিভার্সিটিতে গেছেন কি একটা কাজে, তবে চলে আসবেন এখুনি। কাকু ছাড়া তো গান জমতে পারেনা। উনি কখন বেহালাটা ধরবেন সেই অপেক্ষা করছি। তবে গান থেমে নেই, গান চলছে। আজ তানপুরাটা ধরেনি কেউ। আমি মনোযোগী ক্যামেরায়। আসলে গান গাওয়া তো নয়, এসেছি কাকীকে দেখতে, এদিকে রবিনদারাও এসে হাজির। তো এই কয়েকজন মানুষ এসেছে যখন, গান না গেয়ে তো আর কাকীর হাত থেকে রক্ষে নেই! আর মনে মনে আসলে সবাই গান করতেই চায়। কাকুদের বাসাটাই এমন, এই বাসায় গান যেন একটা লিভিং থিং। সুর যেন ভেসে বেড়ায় এই বাড়ির সদরে অন্দরে! যাই হোক, এরই মাঝে হঠাৎ করে চলে এল উদয়। আর উদয়ের আগমন মানেই সবার মুখে এক প্রসন্ন ভাব চলে আসা। ও আসবে, পাশে বসবে, গাইবে তো না, তবে কাকীর চোখ মুখের ইশারা দেখে গান গাইবার ভেক ধরবে, আর সুযোগ পেলেই একটু পেপার, একটু বই নাড়াচাড়া করবে। এটা আমরা জানি।
ঠিক কবে কখন কাকীদের এই বাড়ি আমাদের অন্তরে সুরের আগুণ লাগিয়ে দিয়েছে, আমরা জানিনা। রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে কাকীদের বাড়ি বদল হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু আমাদের সুরের ঠিকানা ওই একটিই। এমন এই সুরের আকর্ষণ, যে বলা নেই কওয়া নেই, যখন তখন হাজির হয়ে একটু গান শোনা চাই, একটু গান গাওয়া চাই। গান যেন আমাদের প্রাণের দাবী। আর যারা গানের জগতে ক-অক্ষর গোমাংস মানে আমার মতন আরকি, তারাও কোথা থেকে কিভাবে ভিড় করে আসেন তাঁদের বাড়ি! একদিন দুই দিন তো নয়, কুড়ি কুড়ি বছর ধরে গানের এই দেয়া নেয়ার সাথে যুক্ত হয়ে আছি! পূজা পার্বণে, নানান মৌসুমে, জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে ঐ বাড়িটায় না গেলে নয়, ওই হারমোনিয়ামের পাশে না বসলে নয়। ওই সুরে সুর, ওই তালে তাল না মেলালে নয়। সুরের এ কেমন আকর্ষণ, এ কেমন নিরন্তর গানের ভেতর ডুব মেরে থাকা, এ আমার জানা ছিলনা, এখনও কি জানি?
আর সবার ওপর রবীন্দ্রনাথ। সুব্রত কাকু মানে সুব্রত মজুমদার উনার সদা প্রসন্ন চিত্তের মধ্য দিয়ে আমাদের এই বধির সত্ত্বায় রবীন্দ্রনাথের গান ঢুকিয়ে দিলেন। আর তা তিনি করলেন কোনরকম বাড়তি চেষ্টা না করেই। আর তারপর প্রকৃতির সহজ সরল নিয়মের মতন রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের কর্ণ কুহরে সেই যে প্রবেশ করল, আর বের হবার নামগন্ধ নেই। আর তারপর রইলেন আমাদের মাতৃসম দীপিকা কাকি। না, সুব্রত কাকু আর দীপিকা কাকি শুধুই পিতৃসম কিংবা মাতৃপ্রতিমই নন, তাঁরা আমাদের বন্ধুবর। তাঁদের সুরের পরিবারে শ্রেণী নেই, নেই বয়সের ভেদ বিভেদ।এখানে সবার উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার। আর আছে তীব্র এক মায়া আর মমতার টান। মনে আছে, একবার উদীচী থেকে গান গাইতে এসেছেন কয়েকজন। আনন্দ আপা গাইছিলেন, ও আমার দেশের মাটি। উনি যেই ধরেছেন 'ও মা অনেক তোমার খেয়েছি গো অনেক নিয়েছি মা, তবু জানিনে যে কি বা তোমায় দিয়েছি মা-' মনে আছে আমি কেঁদেছিলাম শিশুর মতন। পাগল পারা হয়ে বুক থেকে কান্না যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। এভাবেই কান্না আর হাসির দোলায় দুলিয়ে রেখেছেন আজও কাকুদের বাসা। এখনও ঢাকা থেকে রাজশাহী গেলে ছুটে যাই তাঁদের বাড়ি। প্রতিবেশী বলে কখনও লুঙ্গি পড়েই হাজির হয়ে পড়ি। কখনও স্যান্ডো গেঞ্জি। বাঁধন রাগ করে, বকাঝকা দেয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমায় যে যেতে হবে কাকুদের বাসায়, এক্ষুনি। আমায় যে গান শুনতে হবে। গান।
কাকুরা এখনও ভীষণ ভাবে বর্তমান। কাকুদের বাড়িতে এখনও সময়ে অসময়ে পুরনো নতুন মানুষের ভিড় জমে থাকে। আমাদের রাজশাহী কাকীদের উপস্থিতিতে যেন আরও উজ্জ্বল, আরও জীবন্ত। কিন্তু এই কাছে থেকে, পাশে থেকে আমরা কি শিখলাম কাকুদের কাছ থেকে? একটা শিক্ষা যেটা আমরা পেয়েছি, তা হল গানটাকে ধরে রাখা, সুরের যাত্রাকে সামনে এগিয়ে নেয়া। কিন্তু কাকুদের এই ব্যাটন কে আমরা কি ঠিকঠাক ধরতে পেরেছি? আমরা কি নিজেদের বাড়িতেও একটা অনুপম গানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি? এর উত্তর হচ্ছে না। আমরা পারিনি। আমরা এখনও গানের জন্য তাঁদের দিকেই চেয়ে থাকি। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা ছিলনা। বরং এটাই তো স্বাভাবিক ছিল যে ঢাকায় থেকেও আমাদের বাসাতে আমরা নিয়মিত সঙ্গীতের আসর বসাবো। সেখানে সবাই আসবেন, গান গাইবেন, গান হবে অনানুষ্ঠানিক কিন্তু নিয়মিত। আর শুধু আমিই তো নই, কাকুদের সঙ্গীতের প্রসাদ নিয়েছেন কত কত গুণীজন, কিন্তু আমরা কেন পারিনি তাঁদের সঙ্গীত শিক্ষাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে?
আমরা বড় বড় আলোচনা সভায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা শুনি। অনেকে বলেন আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আশু প্রয়োজনের কথা। কিন্তু কি তাঁর আকার, কেমন তাঁর রূপ? আমরা যখন কাকুদের বাসায় গান গাইতাম, অনেক শিক্ষকদের বলতে শুনেছি, এগুলো হল বৈঠকি গান আর এটাই নাকি মধ্যবিত্তদের গান চর্চা। নিজেদের খোলসের ভেতরে ঢুকে থেকে সংস্কৃতিকে নিজেদের মত করে চর্চা। এর ব্যাপ্তি সীমিত, এর উদ্দেশ্য অস্পষ্ট। তাঁদের কথা শুনতাম মনোযোগ দিয়ে আর ভাবতাম, তাই যদি হয়, তাহলে মনি নামের একটি ছেলে, যে কিনা মাঠে ঘাটে দাপিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আত্মপর এক মানুষ, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় উচ্ছল প্রাণবন্ত একটি যুবক, এর মাঝে গান নামক বস্তু তো অধরাই থাকত যদি না সুব্রত কাকুর মতন একজন মানুষ হাত ধরে তাঁকে তাঁর বাসায় যাবার কথা না বলতেন। এই যে সুরের চর্চা, এই যে গানের আবেদন, হোক তা সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ, এর কি কোনও মুল্য নেই? কেমন হত যদি কাকুর মতন করে মফস্বল শহরগুলিতে, থানায়, উপজেলায়, গ্রামে এভাবে এক একটি সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ নক্ষত্রালোকের মতন বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, শচিন কর্তার গান গাওয়া হত আর তা শুনে অনেকের মনে সুরের আগুন জ্বলে উঠত! গান কি কেবল বড় বড় আসরে, বড় বড় সভায় হবার বস্তু? গান কি শুধুই মঞ্চ ভিত্তিক, দিন তারিখের নিয়মে বাঁধা?
নজরুল ভাইয়ের সাথে গেলবার দেখা হল ঢাকায়, প্রথম বারের মতন। সুরঞ্জনার গানের খুব প্রশংসা করছিলাম। নজরুল ভাই বললেন আনিস ভাইয়ের কথা। বাঁধন গান গায়। আর গুন গুন করার মতন কত মানুষ আমাদের আশেপাশে। সচলায়তনের হিমু ভাই। কি অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠ তাঁর। শুধু গান কে কেন্দ্র করেই তো নিয়মিত বসা যায়। সচল আড্ডা তো শুধু গানকে ভিত্তি করে নিয়মিত আয়োজিত হতে পারে। এক এক দিন একেক জনের বাসায়। মনি, বাঁধন, খেয়া, তানিম, তৃষিয়া, সাইকি, বর্ষা, নুপুর, মেঘা, ফাহিম, হিল্লোল, সায়কা- আমরা সবাই, সব্বাই নিয়ম করে শুধু গান শুনতে আর গাইতে আসব। আমাদের দেখাদেখি আমাদের বন্ধুরাও এসে ভিড় জমাবে একেক আসরে। এমন আসর কখনও ঢাকায়, কখনও নারায়ণগঞ্জে, কখনও গাজীপুরে কখনও দোহারে কখনও শ্রীপুরে হবে। গান মানুষকে মিলিয়ে দেয়। বিশ্বাস করুন, এ আমার সাঁইত্রিশ বছরের জীবনের এক প্রধানতম শিক্ষা, যা আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন সুব্রত কাকু, দীপিকা কাকী আর আনন্দ আপা।
আর আমরা কেই বা না জানি, যে সুরের আগুন একবার জ্বলে ওঠে, সে আগুন ছড়িয়ে যায়। সবখানে তাঁর অনুরণন ওঠে। আমরা যদি গানের সুর কে সর্বসাধারণের মাঝে না নিয়ে যেতে পারি, নিজেদের ভেতর যদি না চলে তাঁর নিরন্তর চর্চা, তবে শুধু যে আমরাই হারিয়ে যাব তাই নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকেও আমরা কোনভাবেই মোকাবেলা করতে পারবোনা। এই যে আমাদের ওয়াহিদুল কাকু নাওয়া খাওয়া ভুলে গ্রামে গঞ্জে, মফস্বলে ছুটে ছুটে যেতেন কিশোর কিশোরী দের গান শেখানোর জন্য, সে কি এমনি এমনি? কাকু জানতেন, গানকে সর্বসাধারণের মাঝে পৌঁছে না দিলে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ডাক কখনোই পূর্ণতা পাবেনা। আর এই আন্দোলন নিজে থেকে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে দেবে, কোনও আনুষ্ঠানিক বিপ্লবের জন্য তা অপেক্ষা করবেনা। যে কাজগুলি ওয়াহিদুল কাকু কিংবা সুব্রত কাকুরা দিনের পর দিন নিরলস ভাবে করে গেছেন এবং যাচ্ছেন, এখনই সময় তাকে অনুসরণের। নইলে আমরা যে বড় পিছিয়ে পড়ব, ছোট ছোট মুক্ত মন গানের বদলে কুপমুন্ডুকতার মাঝে আত্মসমর্পণ করবে আর আমরা তা চেয়ে চেয়ে দেখব। এইটা কি আমরা হতে দিতে পারি?
সুব্রত মজুমদার কে নিয়ে আমাদের অণুর পূর্ববর্তী একটি চমৎকার রচনার লিঙ্ক এখানে দিয়ে দিলাম।
মন্তব্য
বাহ, অনেক কথা মনে হয়ে গেল মণি ভাই ! দাঁড়ান, আবাড় গানের আসর হবে রাজশাহীতে।
আর কাকুকে নিয়ে লেখাটা ট্যাগ করে দিতে পারেন, তাহলে অন্যরা পড়ে ওনার সম্পর্কে আরেকটু জানতে পারত।
facebook
হ্যাঁ রে। তবে গানের আসর এবার শুধু রাজশাহীতেই হবে তা নয়, তুই আয়, এইবার আমরা পালা করে ঢাকায় গানের আসর বসাবো। গানের আসর ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। তোর কাকুকে নিয়ে লেখাটার একটা লিংক যুক্ত করে দিব এই লেখার শেষে? এমনটিই কি বলতে চাইছিস?
মনিদা বানানের দিকে এট্টু কড়া করে নজর দেন। শিরোনামেই লিখেছেন আগুণ। তারপর আগের লেখায় মীরা'কে বারবার মিরা লিখেছেন, কত্তামা'র নাম অপভ্রংশ করা তো মহা অপরাধ!
হ।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এইরে তিথিডোর, আমার যে ভারী এক ভুল হয়ে গেছে। আমি গানের আড্ডায় তোমার নাম দিতেই যে ভুলে গেছি! ক্ষমা কর আপু। আর বানান ভুল কড়ার জন্য খুব খুব দুঃখিত। লেখা কেমন হয়েছে তিথি?
আমার নামের বানান তিথী।
লেখা চলুক। পাঠক হিসেবে সঙ্গে থাকছি-ই তো।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথী, তিথী, তিথী। তিথীডোর!
ঠিক। এত বানান ভুল হলে চলে? এতবার বলছ, তাও ঠিক হচ্ছেনা। তবে প্রুফ রিডার আসছে এই ষোলোতে।অথৈ আসছে। সাথে অভিধান। দেখি, এইবার কোথায় ভুল হয়! এরপরে তোমাকে আর অনুযোগের সুযোগ দেবনা।
আসল গাতক সচলের কথাই লেখেন নাই, চরম উদাস। বিরাট হালাল শিল্পী, উনার মিহি গলায় চাপা আর্তনাদের ঢঙে গাওয়া হামদ "দে পানা দে ইয়া এলাহী" শুনে সকলেরই চক্ষে পানি আসে। কাউকে কাউকে আবেগে কানও চেপে ধরে রাখতে দেখা যায়।
..................................................................
#Banshibir.
বাদ অনেকেই পড়েছে, আফসুস! চরম উদাস কুতায়???
কাঁদিয়ে দিলেন রে ভাই, কাঁদিয়ে দিলেন। বেশী তো বলার সাধ্য নাই। শুধু এইটুকুই বলি - আপনারা পারবেন। যে যত্নে, মমতায়, সাহসে এই সচলায়তন সচল রেখেছেন, আপনার আকাঙ্খিত গানের আসরের পথে সেইভাবে আগাইলেই হবে। আর, তা হইলেই হবে সেই দুরন্ত কাজটা - সচলায়তন মিশবে, ছড়িয়ে যাবে দেশের অন্তরতম অংশে, যেটা দরকার, ভীষণভাবে দরকার। তবে, মাইর কিন্তু আসবে। বিশ্বাস করতে মন চায় যে সেইটা আপনারা সামলাইতে পারবেন।
- একলহমা
একলহমা, চমৎকার বলেছেন। আমার মতেও সচলায়তন একটা দারুণ প্ল্যাটফর্ম যাকে ধরে আমরা অনেক দূর এগুতে পারি। ইতিমধ্যে বেতারায়তন নামক চমৎকার একটা উদ্যোগ দেখেছি। সচলায়তন আসলেই আমাদের সবাইকে কেমন মিলিয়ে দিয়েছে। গানের আসর আমরা করব একলহমা। আপনি আমাদের আশীর্বাদ করবেন।
শামিম ভাই, সেই পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে পরে গেল। আমার এলাকাতেও গানের আড্ডাটার হাতে খড়ি হয়েছিল রুহিদাস বাবু নামের সেই সাদা মনের মানুষটির হাত ধরে। তাঁর বাসাতেই সন্ধ্যের পর শুরু হতো হারমোনিয়াম, তবলার সুরের ঝঙ্কার। আমার সাথে তাঁর পরিচয়ই হয়েছিল তাঁদের গানের আসরগুলোতে, কখনো মন্দিরে, কখনও তাঁর বাসাতেই গিয়ে বসে গান শুনতাম। এভাবে শুনতে শুনতে কখন যে নিজেই গাইতে শুরু করে দিলাম, অবশ্য এটার কৃতিত্বও তাঁরই প্রাপ্য, এরপর রুহিদাস বাবু, রানা এবং আমি কত সন্ধ্যা নাট্যবিন্দু আর তাঁর বাসায় গানে গানে পার করেছি। যাই হোক, গান যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বড় হাতিয়ার সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমি গত জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতেও দেশে ছুটিতে গিয়েছিলাম, সেই সময়গুলোর অনেক মধুর স্মৃতি আছে। আমাদের সংগঠন নাট্যবিন্দুতে সারা দিন বাচ্চাদের নিয়ে নাটক রিহার্সাল আর সন্ধ্যায় গানের আসর এবং নাট্যবিন্দুর ছেলেদের নিয়ে শাহবাগের আন্দোলনে যোগদান, সে এক দারুণ অনুভূতি। অবশ্য ইতালিতেও কয়েকটি সন্ধ্যা ভাল কেটেছে, বিশেষ করে রানা, রিংকন আর রাসেল যখন আমার এখানে ছিল। আর গানের ক্ষুদা মিটানোর জন্য এই গত মাসেও ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম আরেচ্ছো শহরে, কারণ রানা, রিংকন যে এখন ঐ শহরে আছে।
জিল্লুর ভাই, আপনার কাছ থেকে এই কথা গুলি আরও শুনতে চাই। আপনারা কিভাবে আপনাদের সংগঠন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছেন, আমরা শহরে বসে তা পারছিনা,সেগুলি থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আপনি,আমি মিলে এই বোলোনিয়া শহরে গানের যে বীজ বপন করার কথা ভাবছি, সেটাতে হেলা ফেলা করলে চলবে না। দেখছেন তো কিভাবে ছাগুরা মিলাদ মহফিল আর ওয়াজের নাম করে তরুণদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প ছড়াতে শুরু করেছে এই এখানেও। এটাকে কাউন্টার করতে গেলে গান ছাড়া আর কি অস্ত্র আছে বলুন? ওরা ওয়াজ করবে, আমরা গান করব। মুক্তির গান! যুদ্ধ তো একদম দোরগোড়ায়, এই যুদ্ধে আমরা হারবোনা।
আমিও এই সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে এটাই শিখেছি যে 'গান ছাড়া জীবনে কিছু নাই'। গানেই মুক্তি। ঢাকায় মাঝে মধ্যেই গানের আসর হয়। বিশেষ করে আনিস ভাইকে কেন্দ্র করে। আমাদের অফিসে একটা দারুণ গানের চর্চা আছে। যখন তখন আমরা কাজ কাম বাদ্দিয়ে একবেলা স্রেফ গান গেয়ে কাটিয়ে দেই প্রায়ই। এমনকি একটা গানের দল গড়ার প্ল্যানও করছি। যারা ছুটির দিনগুলোতে অচেনা অজানা এলাকায় গিয়ে গান গাইবে মানুষের মধ্যে।
আনন্দদীর গানের তো আমি মুগ্ধ ভক্ত। দুর্ভাগ্য দিদি দেশে আসার পরও আমি রাজশাহী যাওয়ার সময় করতে পারিনি। আপনি, অনু, আনন্দদী একযোগে একবার দেশে এলে দারুণ হবে। রাজশাহীতে এক সপ্তাহ এক নাগাড়ে থাকবো আর গান শুনবো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনি, অনু, আনন্দদী একযোগে একবার দেশে এলে দারুণ হবে।
ধন্যবাদ তানিম ভাই। আমরা একবার একযোগে দেশে আসার প্ল্যান করছিলাম। কিন্তু নানান কারণে একবার বিদেশে গেলে একসাথে হবার প্ল্যান প্ল্যানই থেকে যায়। তারপরেও দেখি। আমরা শুধু ঢাকাতে বসেই আপনাদের সাথে গানের আসর বসাতে পারি। নজরুল ভাইয়ের সাথে কথা হয়ে আছে। আমি এলে আপনাদের নিয়ে একটা আসর হবে।
আচ্ছা, আপনার দীপিকা কাকী কি একসময় "রাজশাহী ইউনিভার্সিটি নার্সারী স্কুলে" বাংলা/ইংরেজি পড়াতেন?
একদম ঠিক। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন। জানাবেন একটু? আমি কি আপনাকে চিনি মশাই?
১। আমি সেই পাঠশালার ছাত্র ছিলাম।
২। এই মন্তব্যের সময় চিনতেন না। ২০১৭-এ দেখা হয়েছে শাহবাগে রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে, তিথীডোর সকাশে!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ নজরুল ভাই। গান ছাড়া আসলেই কিছু নেই। গান নিজে শোনার পাশাপাশি সবাই মিলে শোনার একটা ব্যাপক অর্থবহ ব্যাপার আছে। দেখুন, ইটালির এই মেট্রোপলিটন বোলোনিয়া শহরে ১০,০০০ বাঙালি মানে বাংলাদেশী মানুষ বাস করে। মাঝে মাঝে দেখি এরা বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আর হ্যান ত্যান নিয়ে ওয়াজ টোয়াজ করে। প্রায় প্রায় মিলাদ মহফিলের আয়োজন করে। গান যে হয়না তা নয়, তবে তা একেবারেই অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক, মানে ওই পয়লা বৈশাখ-কে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে "তারকা কণ্ঠশিল্পী"-দের নিয়ে এসে গান গাওয়া। কিন্তু তাঁর মানে কিন্তু এই নয় যে এখানে গানপাগল মানুষ নেই। আছে। কিন্তু সবাই মিলে একটু বসে মাঝে মাঝে যে গান করবে তেমন উদ্যোগ দেখিনা কারোর। তো এর ফলে হয় কি, নতুন নতুন যারা আসে এই শহরে, কিংবা যেসব তরুণ তরুণীরা আছে তাঁরা ধর্মকর্মের একটা বাহ্যিক আবরণ নিয়ে মেতে থাকে। ওয়াজ এর আয়োজন হলে সেখানে ছুটে ছুটে যায়! গানের চর্চা যদি ধরে রাখা যায় তাহলে এরাই হয়ত গানের আসরগুলিতে আসত!
আপনার কথাগুলি চমৎকার লাগলো। গান নিয়ে আপনার আগ্রহের কথা আমি জানি। আপনারা যে গানের গ্রুপ কড়ার কথা ভাবছেন তার জন্য আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখছি। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ প্রতি এক বছর পর পর ঢাকার বাইরে অন্য জেলা শহরগুলিতে বড় আকারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুই দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশে থাকার সময় বাঁধনের সূত্রে একবার জয়পুরহাটে এমন একটি অনুষ্ঠানে যাবার সুযোগ হয়েছিল। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা নজরুল ভাই, গ্রাম গঞ্জ থেকে আসা মানুষের যে ভিড় সেদিন দেখেছি, মনে হয়েছিল আরে, আমাদের প্রাণে তো গানের মেলা আছে। শুধু চাই একটু পরিচর্যা।
কিন্তু এই কাজটা তো আমাদেরই করতে হবে। এইসব অনুষ্ঠানে তো আমাদের যেতে হবে। আর ছোট ছোট গানের আসর তো আমরা সহজেই, সামান্য উদ্যোগেই করে ফেলতে পারি। এমন একটা কাজ আমরা দিনের পর দিন ফেলে রাখলে তাতে তো ধুলো জমবে। মাছি আসবে। সাম্প্রদায়িকতার মাছি! আর তাঁকে আজই মারার বন্দোবস্ত না করলে তো সে ভোঁভোঁ করে ঘুরতেই থাকবে!
রাজশাহীতে আপনারা এক সপ্তাহই থাকবেন। বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু আনন্দ আপা আবার চায়না চলে গেলেন যে! আরে, অসুবিধে কি, আমরা আছি না? অণুটা থাকলে খুব ভালো হত!
ইয়ে, আমার নাম পড়লাম নাকি লেখার মধ্যে?
আলবৎ! আরও তো অনেকের নাম বাদ পড়েছে। সকলের নাম যুক্ত করতে পারলে ভালো হতো।
লেখা চলুক সাথে গানও চলুক।
লেখা চলবে কিনা জানিনা, গানকে চলতে হবে, গান থামলে শেষ! ধন্যবাদ।
অনেক দেরিতে পরলাম, খুব ভাল লাগলো।
ইসরাত
ইসরাত, এইবার কিন্তু আপনার লেখার পালা। আপনি শুরু করুন প্লিজ। আর ধন্যবাদ। আপনাদের উৎসাহ আমাদের প্রেরণা। তবে ভুল ত্রুটি গুলিও ধরিয়ে দিন। তাহলে লেখার ধার আরও বাড়ে।
কিছুদিন আগে আমাদের পুরো পরিবার গ্রামে গেলাম মেলা উপলক্ষে। প্রায় ৬৫ বছর ধরে চলে আসা মেলা। আমি গেলাম সবার শেষে, হাজির হলাম রাত ১২:৩০টার দিকে। মেলায় পোঁছালাম রাত দুইটার দিকে, মানুষে সয়লাব, এবং এর মূল কারণ হচ্ছে গান। চারিদিকে ছোট ছোট দল, সেখানে গান গাইছেন বিভিন্ন মানুষ, নারী-পুরুষ, গান গাইছেন টুপি পড়া মানুষ প্রায় বৃদ্ধ, গান গাইছেন গ্রামের সবচাইতে মুখচোরা মানুষটা; আমি গান পাগল মানুষ, জুটে গেলাম পুরো দলবল সহ; এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই গান শুনছেন, মানুষের আসা-যাওয়ায় বিরাম নেই; কিন্তু কোনরকম অঘটন আজ পর্যন্ত ঘটেনি, ঘটার সুযোগ-ও নেই। সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে পরদিন যাব সকাল সকাল কিন্তু যেতে পারলাম-না, কারণ কি? কারণ তিনদিনের মেলায় একটা দিন শুধুমাত্র নারী এবং শিশুদের জন্য বরাদ্দ, তাঁরা যাতে একদম মনের মত করে ঘুরতে পারেন, গান শুনতে পারেন তার জন্য ৬৫ বছর আগে থেকে এই নিয়ম করে রাখা হয়েছে। বাকি দুইদিন-ও তাঁরা আসেন কিন্তু শুধুমাত্র এই একটা বিশেষ দিনের জন্য দূরের এলাকা থেকে সব নারী’রা আসেন, কেনাকাটা করেন, গান শোনেন, এই একটা দিনে নারী বাউল’দের আনাগোনা থাকে বেশি। আমাদের হাওর এলাকায় আজও মৌলবাদের আগ্রাসন বিপন্ন যে-সব কারণে তার ভেতর মানুষের সহজিয়া গান নির্ভরতা একটি বড় কারণ। পুরো’টা ভিডিও করে এনেছিলাম যতটুকু পারা যায়, ইচ্ছে ছিল সচলে দিব এডিট করে। কিন্তু বাড়ী’র পিচ্চিগ্রুপের এক সদস্যদের কেরামতি’তে সেই ভিডিও ক্লিপগুলো হাওয়া!
এখনো বাংলার ঘরে ঘরে বাউল গানের যে কদর তাকে ভয় পায় সব ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। বাঙালী’র গান মানে তার পাললিক বোধে’র প্রস্রবণ, এর কোন বিকল্প নেই। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্রোত আজ স্তিমিত, মৌলবাদী দলগুলো এই একটা জায়গায় সার্থক -- তারা সংস্কৃতি’র রাশ টেনে ধরতে পেরেছে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে। একের পর এক হামলা হয়েছে কিন্তু মানুষের গহন গহীনে তাঁর যে ইতিহাসের শেকড় তাকে রাশ টেনে ধরা এতটা সহজ নয়। মানবতাবাদের প্রবক্তা যে পবিত্র ভূমি তাতে আমাদের নিজস্ব সহজিয়া গান ছাড়া মুক্তি নেই, মুক্তি নেই কৃষক-কৈবর্ত-কামার-কুমোর-শ্রমিকের সম্পৃক্ততায় যূথবদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া রাজনৈতিক ডামাডোলে মানবিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
আপনি গুছিয়ে লিখতে পারেন, আমি একদম-ই পারি না, আপনি পারেন। গান নিয়ে লিখতে থাকুন, সময় কম আমাদের হাতে।
ei bar giye Shubhomoyer Baba Babul kakuder okhane joypurhaaTe giyechhilam. Shekhane Kakuder moddheo ei ek paglami dekhlam. Kaku khub shohoj bhabe school porjaye gaan niye kaaj korchhen, ar shonge niyechhen Robin da ke. Bachcha der ki bhokti ar bhalobasha. Kakima jokhon tokhon gaan dhoren gun gun kore, shob kaajer moddhe.
Ar ei proshonge Dokkhindihir Aronyok er manush gulo na ele to onek kichhu baad jabe.
নতুন মন্তব্য করুন