• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

হিন্দি চলচ্চিত্রের আকাশে মান্না দে

মনি শামিম এর ছবি
লিখেছেন মনি শামিম [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ৩০/১০/২০১৩ - ১:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

mannadey-lastalbum

চলচ্চিত্রের সংগীত রচনার সাফল্যের মূলে হল অত্যন্ত সহজ ও সরল সুর দেয়া। সাধারণ শ্রোতারা যাতে সহজে নিজের গলায় গানটি তুলতে পারে। ছবিতে হিট গান মানেই সহজ গান। আমার মতে, নানা রকম রঙ ফলিয়ে কেরামতি দেখিয়ে সুর-যোজনা করা অতি সহজ। কিন্তু অত্যন্ত সোজা সরল সুর সবার প্রাণ স্পর্শ করবে, এমনকি শিশুও গাইতে পারবে, তা রচনা করাই সবচেয়ে দুরূহ।

তাই বলে আমি যে কঠিন ও জটিল সুর বা উচ্চাঙ্গসংগীতের ভিত্তিতে প্রয়োজনমত সুরারোপ করিনি, তা নয়। এবং এসব গানের জন্য আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী হল অনুজপ্রতিম শ্রী মান্না দে। কলকাতায় আমার গান শেখার সর্বপ্রথম গুরু স্বর্গত শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দের ভ্রাতুষ্পুত্র। মান্না বহু দিন বোম্বে আছে। আমি ১৯৪৮ সালে বোম্বে টকিজের দ্বারা প্রযোজিত বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের 'রজনী' অবলম্বনে বাংলা ও হিন্দি দুটি ছবির সংগীত পরিচালক ছিলাম। রজনীর বাংলা ছবির নাম রাখা হয়েছিল 'সমর' এবং হিন্দি ছবির 'মশাল।' এই দুটি ছবির পরিচালক ছিলেন নিতীনদা। দুটোরই নায়ক অশোক কুমার। সংগীত পরিচালক রূপে মান্না ছিল আমার সহকারী। বড়ো অমায়িক, নিরহংকার ও মিষ্টভাষী এই মান্না। বোম্বের হিন্দি ছবির গান আজকাল অনেক মেকানিকাল হয়ে গেছে, শিল্পীরা রোজই রেকর্ডিঙে ব্যাস্ত, অভ্যাস বা রেওয়াজ করার সময় কোথায়। মান্না কিন্তু এর একমাত্র ব্যাতিক্রম। জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতির শীর্ষে এখনো এই শিল্পী রোজ সকালে তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ করে, পারতপক্ষে কখনো বাদ পরেনা এই অভ্যাস। সংগীতের ওপর এই নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ জন্য সে আমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। মান্না আমার ছবিতে বহু গান করেছে ও এখনো করছে। সব গানেই সে প্রান প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

উচ্চাঙ্গ সংগীতের ভিত্তিতে কোনও গানের যখন সুর রচনা করি, তখন আমি তা মান্নার গলায় গাওয়ানো পছন্দ করি। যখনই ছবির গল্পের সিচুয়েশন অনুযায়ী উচ্চাঙ্গসংগীতের সুর রচনা করার সুযোগ পেয়েছি, তখনই আমি তা গ্রহন করেছি। ১৯৬১ সালে 'মেরি সুরত তেরি আঁখে' ছবির এরকম একটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। বাংলা ছবি 'রিক্তা'-র ওপর ভিত্তি করে এই ছবি নির্মিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। জিপি ফিল্মসের প্রযোজক পুরনো দিনের অভিজ্ঞ পরিচালক শ্রী রাখান আর নায়ক শ্রী অশোক কুমার। অশোক কুমার নিজে আমাকে অনুরোধ করেন ছবির সংগীত পরিচালনার ভার নিতে। ছবিতে ছিল এক ক্লাসিকাল সংগীতশিল্পী ওস্তাদের চরিত্র। ওস্তাদ তার ছেলেকে একটি গানের তালিম দেয় বাল্যকালে। বড় হয়ে সেই ছেলে (অশোক কুমার) বাবার তালিমের সেই গান গায়। সময় ছিল ভোর রাত্রি। আমি সময় উপযোগী আহিরি ভৈরব রাগে একটি গান রচনা করলাম, শৈলেন্দ্র গীতিকার। গানটি হল, 'পুছোনা ক্যায়সে ম্যায়নে র‍্যায়েন বিতায়ি।' গানটি ছবিতে গেয়েছিলেন মান্না দে। মান্নার গলায় গানটি যে কি প্রাণবন্ত হয়েছিল, যারা তা শুনেছেন, তাঁরাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। গানটি মোটেই চটুল নয়, ঢিমালয়ে গম্ভীর প্রকৃতির। এখনো গানটির জনপ্রিয়তা বর্তমান, এমনই আমেজ ও শিল্পী জনিত মেজাজে মান্না গেয়েছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আরও বহুকাল এই গানটি সমাদৃত হবে রসিকদের নিকট।

-শচীন দেববর্মণ (সরগমের নিখাদ)

সেই ছেলেবেলা থেকেই আমরা মান্না দে-র গান প্রায় নিয়ম করে শুনছি। সেটা অবশ্য আমার রসিক পিতার কল্যানে। আমাদের টু-ইন-ওয়ান ক্যাসেট প্লেয়ারে ঘুরে ফিরে সেই সাগর সেন আর মান্নার গান প্রায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাজানো হত। তবে কণ্ঠে তাঁর গুন গুনিয়ে সাগর সেন নন, কেবল মান্না দে আর মান্না দে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গানের অনুষ্ঠানে তাঁর গান মানেই ওই মান্না। ছেলেবেলায় বিরক্ত ভরা কণ্ঠে যখন বলতাম, 'কি তুমি খালি ওই এক শিল্পীর গান গাও,' বাবা বলতেন, 'ও তোমরা কি বুঝবে?' ইদানিং শুনছিলাম এই বয়েসেও তাঁকে মান্নার গান যেন আরও বেশী করে পেয়ে বসেছে! গান গাইবার অনুরোধ করা হলে নাকি একবার সেই যে শুরু করবেন, দর্শকরা না থামতে বলা পর্যন্ত নাকি উনি চালাতেই থাকেন। শুনে আমরা হো হো করে হাসি। এমন মান্না ভক্ত মানুষ আমাদের বাসাতেই আছেন, আর আমরা তাঁর প্রসাদ মুক্ত থাকবো তা কি আর হয়! আমরাও দেখেছি কিভাবে আমাদের অজান্তেই মান্না দে ঘণ্টা-ধ্বনি বাজিয়েছেন আমাদের গানের মন্দিরে। এমনকি তাঁর গাওয়া বাংলা গানের সংখ্যা এত বেশী যে আমরা একের অর এক কেবল আবিষ্কার করার চেষ্টাই করে গেছি, শেষ করতে পারিনি। মান্নার যাদু মনে হয় এখানেই। উনার কণ্ঠভরা যে হাহাকার, বেদনা, আনন্দ, উনার কণ্ঠের যে নানামুখী ব্যাপ্তি-সেটা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে অনেক। যেভাবে কিশোর কুমার খুব সহজে আমাদের মন জয় করেছেন, মান্না তা করেছেন ধীরে কিন্তু অবধারিতভাবে।

মান্না দে সম্পর্কে নতুন করে আর কি লিখব, তাঁর ভক্ত সংখ্যা এত বেশী দুই বাংলায়, যাই লিখি তাই পুরনো মনে হবে। প্রফেসর হিজিবিজ এই সচলেই চমৎকার একটা রচনা লিখেছেন। আবার অনিকেতের একটি ট্রিবিউট পড়ার জন্যেও উন্মুখ হয়ে আছি। সত্যি বলতে কি মান্না দের বাংলা গান শুনে আমাদের বড় হয়ে ওঠা। বাংলা গানে মান্না যেন রাজাধিরাজ। তাঁর জনপ্রিয় বাংলা গানের ভাণ্ডার যেন অফুরন্ত। আর বাংলা গানের জগতে তিনি যে হীরক খণ্ড রেখে গেলেন, তা আগামী কয়েক শতক পর্যন্ত চেটেপুটে খাবার মতন যথেষ্ট। তবে, আমি বাংলা গানের জগত নয়, খানিকটা আলোকপাত করতে চাই হিন্দি চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে।

মান্নার হিন্দি প্লেব্যাক গানে তাঁর অবদান কিংবা স্বীকৃতি সম্পর্কে আমরা সবাই হয়ত খুব বেশী জানিনা। বাংলা গানকেই তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যে অন্য ভাষায় তিনি কি অর্জন করেছেন, তা সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ সীমিত আর এইটা স্বাভাবিকও বটে। আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা, হিন্দি গানের জগতে তাঁর অবস্থান এক্কেবারে প্রথম সারিতে। ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯১ পর্যন্ত প্রায় চার যুগ তাঁর হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের সফর। বোম্বেতে চাচার সংগীত সহকারী হিসেবে এসেছিলেন, স্বপ্ন বুনেছিলেন বড় মাপের সংগীত পরিচালক হবার কিন্তু প্লে ব্যাক গানে পেয়ে গেলেন অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। মান্না দে, মুকেশ, মোহাম্মদ রফি এবং কিশোর কুমার- এই চার জন হলেন হিন্দি গানের চার পিলার। মান্না দের মৃত্যু মানে হচ্ছে হিন্দি গানের শেষ নক্ষত্র পতন। হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতে জনপ্রিয়তার নিরিখে রফি এবং কিশোর অনেক এগিয়ে থাকলেও মানের বিচারে মান্না কখনোই তাঁদের চাইতে পিছিয়ে থাকেননি। বরং কিছু বিশেষ ঢঙের গানে মান্না ছিলেন অপরিহার্য। কাওয়ালী, ভজন আর যত রকম রাগধর্মী গান আছে তা মান্না ছাড়া সঙ্গীত পরিচালকরা সুরারোপের কথা ভাবতেই পারতেন না। মান্নার ডেট পাবার জন্য তাঁরা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতেন। মান্না নিজেও বলেছেন, তিনি কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন নি, হিন্দি গানে সুরকাররা যে যখন তাঁর কাছে এসেছেন, সে রোমান্টিক গান হোক চাই যে কোনও ঢঙের গান, তিনি গেয়ে দিয়েছেন। আজ তাঁর মৃত্যুর পর অনেকে এটাও বলছেন, সমস্ত গুনাবলি থাকা সত্ত্বেও মান্না কখনোই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছাতে পারেন নি। এইটার নাকি অন্যতম কারণ তাঁর অতি বিনয়। তিনি একজন খাঁটি শিল্পী ছিলেন। কোনোদিন কাউকে অসম্মান করেন নি, কারোর সাফল্যে তাঁর ভ্রুকুচি হয়নি, এমনকি শীর্ষে পৌঁছানোর চিন্তাও করেননি কখনো। তাঁর চোখের সামনে দিয়ে রফি এবং কিশোর ভারতের সবচাইতে আকাংখিত কণ্ঠশিল্পী হবার পরেও তিনি এতটুকু হতোদ্যম হননি। তিনি গেয়ে গেছেন তাঁর মতন করে। নৌশাদ বলেছিলেন, মান্না দের কণ্ঠ নাকি সেনসিটিভ নায়কদের জন্য একটু বেশি রকম 'নীরস।' দাদা বর্মণ বলেছেন টেম্পারমেন্ট হিসেবে ধরলে মান্নার কণ্ঠ ক্লাসিকাল সংগীতের জন্য বেশী লাগসই। এইসব সমালোচনাকে মান্না ফেলে দেননি বরং আশীর্বাদ স্বরূপ মাথা পেতে নিয়েছেন।

ক্লাসিকাল সঙ্গীতে মান্না দের অভিজ্ঞতা, চর্চা এবং দখল এত বেশী পরিমানে ছিল যে হিন্দি গানের চলচ্চিত্র সুরকারগন তাঁকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতেন। এই শ্রদ্ধাটুকু তিনি তাঁর নিজ যোগ্যতায় অর্জন করলেও এটিই অনেকে মনে করেন তাঁকে হিন্দি সিনেমার গানের জগতে শীর্ষে পৌছাতে সহায়ক হয়নি। যখনই সুরকাররা গানের অনুরোধ নিয়ে এসেছেন, হয় ক্লাসিকাল সঙ্গীত, নয়তো সেই ভজন কিংবা কাওয়ালি কিংবা দেশাত্মবোধক গান। তাই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নায়কের কণ্ঠে রোম্যান্টিক গান গাইবার সুযোগ তিনি পান নি। গেয়েছেন ভিক্ষুকের গান,সংগীত ওস্তাদের গান, মাঝির গান, বৃদ্ধের গান ইত্যাদি। এক সময় এইসব গান গাইতে গাইতে তিনি বিরক্ত হয়েছেন, হিন্দি প্লেব্যাক সম্পর্কে অনীহাও জেগেছে তাঁর। আর যতবার তিনি কষ্ট পেয়েছেন ততবার তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন ক্লাসিকাল সঙ্গীতের কাছে, হার মানেন নি।

তবে এইসব পাওয়া না পাওয়ার দ্বিধা দ্বন্দ্বের মাঝে হঠাৎ পেয়ে গেছেন আলোর সন্ধান। রাজ কাপুর এবং সংগীত পরিচালক শঙ্কর-জয়কিশন জুটির শঙ্কর মনে হয় প্রথম মান্না কে নিয়ে একটু ভিন্ন ভাবে ভেবেছিলেন। আর যার ফলাফল স্বরূপ পাওয়া গেল, 'চোরি চোরি' চলচ্চিত্রের 'ইয়ে রাত ভিগি ভিগি' এবং 'আজা সানাম মাধুর চাঁদনী মে হাম।' এরপরে পাওয়া গেলো 'আওয়ারা' চলচ্চিত্রের অবিস্মরণীয় 'পিয়ার হুয়া ইকরার হুয়া।' এই তিনটি গান মান্না দে কে হিন্দি গানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। অথচ এরপরেও তিনি রাজ কাপুরের কণ্ঠ হতে পারেন নি।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে গানের জগত আলো করে রেখেছিলেন অনিল বিশ্বাস, নউশাদ, ও পি নাইয়ার, শচীন কর্তা, সলিল চৌধুরী, শঙ্কর জয়কিশন, সি রামচন্দ্রন, রবি প্রমুখের মতন উঁচু মানের সংগীত পরিচালক। এছাড়াও ছিলেন মদন মোহন, রৌশন এবং বসন্ত দেশাই। আর এদের সকলের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তখন রোম্যান্টিক গান বলতে ছিল উর্দু গজল। পঞ্চাশের দশকে এইসব রোম্যান্টিক গান গাইবার একমাত্র অধিকার ছিল যেন তালাত মাহমুদ, হেমন্ত , মুকেশ আর রফি সাহেবের। তখন প্রত্যেকটি নায়কের সাথে একজন গায়কের কণ্ঠ একাকার হয়ে থাকতো। একবার কোন গায়ক-নায়ক-সংগীত পরিচালকের জুটি হিট হয়ে গেলে এই ধরনের যুগলবন্দী কেউ আর ভাঙতে চাইতেন না। আবার প্রয়োজকরাও এই ধরনের জুটির জন্য টাকা ঢালতে দ্বিধা করতেন না। তাইতো রাজ কাপুরের জন্য যেমন ছিলেন মুকেশ, দেব আনন্দের জন্য রফি, দিলিপ কুমারের জন্য ছিলেন রফি কিংবা মহেন্দ্র কাপুর আর ষাটের দশকে শাম্মি কাপুর মানেই রফি সাহেব। সত্তরের দশকে শুরুর দিকে কিশোরের আগমনে দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভের কণ্ঠ যেন কিশোরের জন্য বাঁধা থাকতো। এইরকম জামানায় মান্নার নিজের জন্য জায়গা করে নেয়াটা কঠিন ছিল। তারপরেও চলচ্চিত্র যদি হত ঐতিহাসিক কিংবা, পুরাণ নির্ভর কিংবা ক্লাসিকাল সঙ্গীত নির্ভর, ডাক পরত মান্নারই। তাই আর ডি বর্মণ যখন নতুন গান নিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতে প্রবেশ করলেন তখন পপ গানেও মান্না জনপ্রিয় হলেন। মান্না হয়ে উঠলেন মেহমুদের কণ্ঠস্বর। পার্শ্বচরিত্রের কণ্ঠস্বর। আবার একই ভাবে তিনি যেহেতু কোনও নায়কের স্থায়ী কণ্ঠস্বরে পরিণত হননি কাজেই হিন্দি গানের জগতে তাঁর মতন বিচিত্র গানে আর কেউই কণ্ঠ দেন নি এটা হলফ করে বলা যায়। আমরা যদি মান্না দের সবচাইতে জনপ্রিয় হিন্দি গানের একটি তালিকা করি, তাহলে এই বৈচিত্রের খানিকটা আভাস পেরে পারি,

আপনি কাহানি ছোড় যা- দো বিঘা জামিন- সলিল চৌধুরী
অ্যায়ে মেরে পিয়ারে ওয়াতান- কাবুলিওয়ালা-সলিল চৌধুরী
কাসমে ওয়াদে পিয়ার ওয়াফা- উপকার- কল্যানজি-আনন্দজি
জিন্দেগি ক্যাইসি হ্যায় প্যাহেলি হায়- -সলিল চৌধুরী
ইয়ে রাত ভিগি ভিগি- চোরি চোরি- শঙ্কর-জয়কিশন
আজা সানাম মাধুর চাঁদনী মে হাম- চোরি চোরি- শঙ্কর-জয়কিশন
পিয়ার হুয়া ইকরার হুয়া- আওয়ারা- শঙ্কর-জয়কিশন
অ্যায়ে মেরি যোহরা জাবিন- ওয়াক্ত- রবি
আও টুইস্ট কারে- ভুত বাংলা- আর ডি বর্মণ
লাগা চুনরি মে দাগ- দিল হি তো হ্যায়- রৌশন
ঝানাক ঝানাক তোরি বাজে পায়ালিয়া- মেরে হুজুর- রৌশন
দাইয়ারে দাইয়ারে চাড় গায়ো - মধুমতি- সলিল চৌধুরী
চুনরি সামহাল গোরি- বাহারোঁ কে সাপ্নে- আর ডি বর্মণ
এ ভাই, জারা দেখকে চালো- মেরা নাম জোকার- শঙ্কর-জয়কিশন
ইয়ে দোস্তি- শোলে- আর ডি বর্মণ
ইয়ে হাওয়া ইয়ে নাদি কা কিনারা- ঘর সংসার- রবি
গোরি তেরি পায়জানিয়া- মেহবুবা- আর ডি বর্মণ
ইয়ারি হ্যাঁয় ইমান মেরা- জাঞ্জির- কল্যানজি-আনন্দজি
আয়ো কাহা সে ঘানশ্যাম- বুঢ্ঢা মিল গায়া- আর ডি বর্মণ
পুছোনা ক্যায়সে ম্যায়নে র‍্যায়েন- মেরি সুরত তেরি আঁখে- এস ডি বর্মণ
তেরে নায়না তালাশ কারে জিসে- তালাশ- এস ডি বর্মণ
চালাত মুসাফির মোহ লিয়ারে- তিসরি কাসাম- শঙ্কর-জয়কিশন
মুড় মুড় কে না দেখ- শ্রী ৪২০- শঙ্কর-জয়কিশন
দিল কা হাল সুনে দিলওয়ালা- শ্রী ৪২০- শঙ্কর-জয়কিশন
ও নাদিয়া চালে চালে রে ধারা- সাফার- কল্যানজি-আনন্দজি
দূর হ্যায় কিনারা- সাওদাগর- রবীন্দ্র জৈন
কিসি কি মুস্কারাহাটো পে- আনারি- শঙ্কর-জয়কিশন
এক দিন অউর গায়া- দূর কা রাহি- কিশোর কুমার
এক চাতুর নার- পাড়োসান- আর ডি বর্মণ
হার তারাফ আভ ইয়েহি আফসানে- হিন্দুস্তান কি কাসাম- মদন মোহন

ওপরের তালিকা থেকেই মান্নার সাংগীতিক অর্জন সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়। বোঝা যায় যে কেন একটি বিশেষ কোনও ছকে মান্নাকে বাঁধা সম্ভব নয়। তিনি জনপ্রিয় ধারার সব ধনের সঙ্গীতে নিজেকে ঢেলে দিয়েছেন। ক্লাসিকাল, আধুনিক, রোম্যান্টিক, প্রার্থনা সঙ্গীত, ভাটিয়ালি, কাওয়ালী, পপ সব ধরনের গান মান্না গেয়েছেন এবং তা পুরো উপমহাদেশে সমাদৃত হয়েছে। মান্না দীর্ঘ সময় ভারতীয় চলচ্চিত্র সংগীতকে আলোকিত করেছেন। রাগনির্ভর সংগীতকে তিনি এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন যার কাছাকাছি আসা সম্ভব হয়নি আর কারোর। কিন্তু এই যাত্রা মোটেই সহজ হয়নি নিশ্চয়ই। 'চোরি চোরি' এবং 'আওয়ারা' চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় রোমান্টিক গান উপহার দেয়ার পরেও সেভাবে রোম্যান্টিক গান গাইবার সুযোগ তিনি পান নি।

কিন্তু রোম্যান্টিক গান গাইবার সুযোগ না পাওয়া নিয়ে তিনি কি উদাসীন ছিলেন? তিনি কি তাঁর সক্ষমতার শীর্ষে থাকা অবস্থায় নিজের অবস্থান নিয়ে বিচলিত হননি কখনো? মেহমুদ নিজে বলেছেন যে 'এক চতুর নার' গানটিতে চলচ্চিত্রে কাহিনীর প্রয়োজনে কিশোরের সাথে তাঁর যে সাংগীতিক লড়াই হয়েছিল সেখানে তাঁর চরিত্রের পরাজয় নাকি মেনে নিতে পারেন নি তিনি। উনি বলেছিলেন যে একজন নন-ট্রেইন্ড কণ্ঠশিল্পীর কাছে তিনি হারতে পারেন না! এনিয়ে তাঁর ক্ষোভের কথা মেহমুদকে জানিয়েছিলেন তিনি। অনেক কষ্টে তাঁকে বাগে আনা গেছে। যাই হোক, নানান সাক্ষাৎকারে তিনি রফি এবং কিশোরের যে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, তাতে তাঁর অতুলনীয় বিনয়ী চিত্তের সন্ধান পাই আমরা। তিনি বলেছেন কিশোর এবং রফির যে প্রতিভা ছিল সেগুলি ছিল তার চাইতে ভিন্ন, তিনি যদি সেই প্রতিভাগুলি পেতেন তাহলে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ হতেন না। তিনি বলেছেন চলচ্চিত্র সঙ্গীতে সুরকাররাই সব। তাঁরা যদি গান গাইবার জন্য তাঁকে মনোনীত করেন তাহলে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গাইবেন, আবার তাঁরা যদি অন্য কাউকে দিয়ে গান করাতে চান তাহলে তাই সই। তিনি শুধু সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করেছেন, কিন্তু সেটাও যে সবসময় সফল হয়েছে, এমন তো নয়।

ভারতের আইবিএন চ্যনেলের একটি চমৎকার সাক্ষাৎকারে অনুরাধা সেনগুপ্ত তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'এমনকি বাংলাতেও আপনি প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন (এন্টোনি ফিরিঙ্গি), কিন্তু মনে হয়েছিল একটা পর্যায়ের পর উত্তম কুমার চান নি আপনার সাথে গান গাইতে। তারকা কণ্ঠ আপনার ভাগ্যে জোটেনি কখনোই, কেন এমন?' উত্তরে মান্না বলেছিলেন, 'এটা এইজন্যই যে অন্যান্য শিল্পীরা অসাধারণ ছিলেন। তারকা কণ্ঠ নির্ভর করে দর্শকের চাহিদা এবং ব্যাবসার গতি প্রকৃতির ওপর। দেখুন, এই শিল্পীরা দীর্ঘদিন একই চিত্রতারকার কণ্ঠে গান গেয়েছেন। ঊত্তমের কণ্ঠই ছিল হেমন্ত কুমারের। হঠাৎ করে তাঁরা সেটি পরিবর্তন করতে যাবেন কেন? কেউ যখন একটি চলচ্চিত্রে অর্থলগ্নি করে তখন যেটা খুশী সেটা করা সম্ভব হয়না। যা ইতিমধ্যে পরীক্ষিত সেটারই প্রয়োগ চলে। নইলে তাঁরা কেন এত অর্থ বিনিয়োগ করতে যাবেন, বলুন? আমি এটি প্রথম থেকেই বুঝে গেছি। এইজন্যই কারো প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই।'

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, 'আমি আমার গানে সবসময় সৎ থাকতে চেয়েছি। যখনই আমি কোথাও গান গেয়েছি, আমি আমার সেরাটি দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমিই বোধ করি একমাত্র শিল্পী যিনি রেকর্ডিঙের পূর্বে রিহার্সেলের জন্য সবসময় চেষ্টা চালিয়ে গেছি। একটি গানের টেক্সট নিয়ে আমি সবসময় খুব সচেতন ছিলাম- সে যে গানই হোক না কেন। বাঙালি হবার কারণে হিন্দুস্তানি সংগীতে এবং উর্দু গানে কণ্ঠ দেয়াটা সবসময় খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। যখনই একটি গান গাওয়া হয় সেটিতো আসলে কিছু শব্দের এক্সপ্রেশন। গীতিকার যাই লিখুন না কেন, আমাকে তো তাঁকে একটা রূপ দিতে হবে। তাই আমি সেগুলি খুব সাবধানে বাছতাম। অবশ্য আমি যা বলছি তা শুধু আমার ব্যাক্তিগত গানগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, চলচ্চিত্র সংগীতের নয়। আমি চলচ্চিত্রে যার যা পছন্দমতন গেয়ে দিয়েছি। মেহমুদের কণ্ঠে আমি অসংখ্য গান গেয়েছি, যে যেভাবে চেয়েছে, আমি সেভাবেই গেয়েছি।'

উনি বলেছেন, 'সেই সময় যারা প্লেব্যাক গাইতেন, তাঁরা আমার চাইতে বেশী ভালো ছিলেন, নিঃসন্দেহে। আর হ্যাঁ, তাঁরা আমার চাইতেও ভালো গাইতেন। সাফল্যের শীর্ষে যখন ছিলাম তখনও রফি সাহেব আমার চাইতে ভালো গায়ক ছিলেন। তিনি এমন মহান শিল্পী ছিলেন যে যখনই তাঁর গান শুনতাম আমার কণ্ঠরোধ হয়ে যেত। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর গায়ন ক্ষমতা আমার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব ছিলনা। সত্যি বলছি দেখুন, এটা বিনয় নয়। আমি যা বলছি সব খাঁটি সত্য। লতার শ্রেষ্ঠ সময়ে যখন তাঁর সাথে গাইতাম আমি মাঝে মাঝে গানের লাইনই ভুলে যেতাম। তাঁর কণ্ঠের মাধুর্যে বিস্মিত হতাম। কিভাবে তিনি গাইতেন, এও কি সম্ভব? আশা- কি বৈচিত্র্যপূর্ণ এক শিল্পী, কত অসাধারণ তাঁর গান! আগের যুগের কণ্ঠশিল্পী যারা আমার সহশিল্পি ছিলেন তাঁদের প্রতি আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রয়েছে। এমনকি কিশোর কুমার- কি মহান শিল্পী ছিলেন তিনি!'

'এক চাতুর নার' গানটি কিভাবে নির্মিত হল এমন প্রশ্নের উত্তরে মান্না বলেন, আমার মনে পড়ে, একদিন পঞ্চমের ফোন এল, 'দাদা, গান তো রেডি, চলে আসুন।' আমি তখন পঞ্চমের মিউজিক রুমে ঢুকলাম, জিজ্ঞেস করলাম কিশোর কোথায়? কেউ যেন বলল, 'দাদা কেউ একজন আপনাকে ফোন করেছেন, ফোনটা ধরলাম, 'মান্নাদা, আমি কিশোর।' আমি বললাম, 'তুমি ওখানে কি করছ, তোমার না এখানে থাকার কথা? আমি যে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।' সে বলল, 'না, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি, মা আপনার সাথে কথা বলতে চান, এইযে নিন।' কিশোরের মা বললেন, 'মান্না, তুমি কেমন আছো বাবা? কতদিন আসোনা আমাদের বাসায়। কেন আসোনা বাবা? আমি তোমার জন্য লুচি আর আলুর দম বানিয়ে রেখেছি, রসগোল্লাও। এসো।' তাই আমাদেরও তখন পঞ্চমের ওখান থেকে কিশোরের বাসায় যেতেই হল। সেখানে ছয় ঘণ্টা ধরে গানের রিহার্সেল চলল। কতবার যে গানটা রিহার্স করতে হল, ঈশ্বর জানেন। রেকর্ডিং শেষে যে গান জন্ম নিল তা ছিল অচিন্তনীয়। রেকর্ডিঙের আগে কে জানতো গানটি এত এত মজার হবে! কিন্তু তা হয়েছে শুধুমাত্র কিশোরের জন্যই। কি মহান আর্টিস্ট ছিল সে!
অনুরাধা জিজ্ঞেস করেন, 'আপনার খারাপ লাগেনা যে সারাজীবন আপনি এত কষ্ট করলেন আর অন্য কেউ সহজেই তা পেয়ে গেল?'
মান্না বলেন, 'না, আমি এটা মেনে নিয়েছি যে তাঁরা আমার চাইতে বেশী প্রতিভাধর ছিল। কিশোর এবং রফির ভিন্ন ধরণের প্রতিভা ছিল যেটা আমি পাইনি।'

এমন বিনয়ী শিল্পী আমরা কি দেখেছি আর কখনো? গান সে চাই হিন্দি হোক কি বাংলা, মান্না তাঁর কণ্ঠ দিয়ে আমাদের জয় করে নিয়েছেন। গান গেয়েছেন তাঁর মত করে, কখনও প্রতিযোগিতার ধারে কাছেও যাননি। কুড়ি বছর বয়েসে প্লে ব্যাক করতে গিয়ে ৭০ বছর বয়েসের বৃদ্ধের গান গাইতে হয়েছে, হতাশ হয়েছেন ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কিন্তু হাল ছাড়েন নি। নায়ক নয়, পার্শ্বচরিত্রের কণ্ঠস্বর হিসেবে হিন্দি চলচ্চিত্রে জায়গা মিলেছে, তারপরেও ব্যাথিত হয়ে হারিয়ে যান নি। সবচাইতে কঠিন গানগুলি সবচাইতে সহজ করে গেয়েছেন, রাগ সংগীতের আকাশে নিজেকে মেলে ধরেছেন যেন অবধারিতভাবে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর হিন্দি প্লে ব্যাক গানের আসরে দাপটের সাথে বিরাজ করেছেন। সবসময় তিনি নিজের জন্য সংগীতের একটা মান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেখান থেকে কখনো পা পিছলে যায়নি তাঁর। আর এইসব নিয়েই আমাদের অতি আপন, আমাদের হার না মানা, আমাদের গর্বের মান্না দে। আমাদের প্রিয় ভজহরি মান্না!

মনি শামিম


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

অসাধারণ লেখা হয়েছে মনি ভাই। কত অজানা তথ্য যে জানলাম। আর আবার একবার "এক চাতুর নার" দেখে শুনে বিমোহিত হয়ে গেলাম। সঙ্গীতের রূপ রস বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন না করে সহজ সাবলীলভাবে এই গানে যে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া আছে, তা আজকাল বড়ই দুর্লভ - আবারও উপলব্ধি করলাম।

মান্না দের আটপৌরে অথচ দুর্দম রূপটা চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখায় পাঁচতারা।

____________________________

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ প্রফেসর। আসলে কি জানেন, হিন্দি গানের মানচিত্রে মান্নার অর্জন এত বেশি যা ছোট ফ্রেমে তুলে ধরা অসম্ভব। আমি শুধু কিছু গান উপস্থাপন করে তাঁর বিচিত্র গান গাইবার ক্ষমতাকে নির্দেশ করেছি আর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাঁর যে অসম্ভব বিনয় লক্ষ্য করছি, তাঁর ছিটেফোঁটার সন্ধান দিতে চেয়েছি। আপনাদের ভাল লাগাটা আমার জন্য আশীর্বাদ। আপনার ছোট্ট লেখাটুকুও চমৎকার লেগেছে। ভালো থাকুন। সচল থাকুন।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

(Y) (Y)

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই। ভালো থাকবেন। নতুন লেখা কই?

তিথীডোর এর ছবি

অতীব চমৎকার লেখা।

আই রিপিট, অতীব চমৎকার লেখা।
(Y) (Y) (Y)

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীমণি। তোমাদের ভালো লাগলে এই পরিশ্রমটুকু সার্থক মনে হয়। আসলে ভারতীয় চলচ্চিত্রে পুরুষ কণ্ঠে গান বলতে আমরা শুধু কিশোর এবং রফিকেই বুঝে থাকি। এর মাঝে মান্নার অবস্থান ঠিক কোথায় তাই জানতে সচেষ্ট হয়েছি উনার মৃত্যুর পর। এমনকি আমি নিজেই জানতাম না এর মাঝে অনেক গান মান্না গেয়েছিলেন। আসলে বাংলা গানে উনি আমাদের যেভাবে আনন্দ বেদনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন, আর কিছু কখনও মাথাতেই আসেনি। যখন এলো তখন ইতিহাস, বই পুস্তক, সাক্ষাৎকার এসব ঘাঁটতেই হল। এই সুযোগে অনেক গান শোনাও হল, আবার শোনানোও হল।

স্পর্শ এর ছবি

চতুর নার গানটা দারুণ লাগলো।

দারুণ পোস্ট! (জাঝা)


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ স্পর্শ। চতুর নার গানটি আসলেও খুবই চমৎকার। মান্না আরেকটি সাক্ষাৎকারে এই গানটির উচ্চ প্রশংসা করে বলেছিলেন যে, এই গান সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। হয়েছেও তাই। কোনও সন্দেহ নেই! এই গানটি নিয়ে মেহমুদের নিজের মুখে শুনুন।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আহ্, এমনই একটি লেখার প্রতীক্ষায় ছিলাম। মন ভরে গেল। মনি শামিম, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। আপনার পোষ্টটিতে পাঁচতারা দাগিয়ে গেলাম।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ রোমেল। অশেষ ধন্যবাদ। একবার ভাবুন , পাঁচতারা আমার এই নগন্য স্মৃতি চারণের জন্য অর্পণ করলে মান্না দের জন্য আমরা কতগুলি তারা নির্ধারণ করবো? আশা ভোঁসলের কথা ধার করে বলতে হয়, 'এই মাপের শিল্পী ঈশ্বর হাজার বছরে একবার সৃষ্টি করেন।'

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

পড়োসান যখন প্রথম দেখি তখন চতুর নার গানে এসে ভাবছিলাম, মেহমুদের লিপে যাকে শোনা যাচ্ছে তার গলা এতো পরিচিত লাগে কেন? তাছাড়া হিন্দি গান মোটামুটি শোনা হয়েছে, এতো ভালো গায়ক আর তার গান আগে কখনো শুনিনি, এটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না। ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে মনে হলো, গায়ককে আমি চিনতে পেরেছি :)

মান্না দে'র গলায় একটা হিন্দি গান খুব ভালো লেগেছিলো, আপনার লিস্টে সেটা নেই। যদিও আমি নিশ্চিত, আপনি এটা শুনেছেন। আমার মনে হয়েছে, এই ধরণের গান চেতনাকে উজ্জীবিত আর প্রত্যয়ী করে।

http://youtu.be/qNUOnWw2HI4

মনি শামিম এর ছবি

জানেন ইয়াসির, এই লেখাটি লিখবার আগে আমি জানতামইনা যে 'ইয়ে রাত ভিগি ভিগি' গানটি মান্না গেয়েছেন। এই লেখাটি লিখতে লিখতে মান্না কে নতুন করে যেন আবিষ্কার করেছি হিন্দি চলচ্চিত্রের মানচিত্রে। আপনি তো নিজেও মানবেন, মান্না দে মানে হল আমাদের কাছে তাঁর অবিস্মরণীয় বাংলা গানগুলি যা ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি। লেখার সূত্রে অনেক পড়াও হল, জানাও হল। তবে আফসোস, 'জীবনের জলসাঘরে' বইটি থাকলে তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে আরও অনেক কিছু লিখতে পারতাম। তবে ইচ্ছে আছে উনাকে নিয়ে আরেকটি লেখা সচলে দেবার।

খেয়াল করে দেখবেন, আমি মান্নার যে গানগুলি দিয়েছি তা মূলত তাঁর বৈচিত্র্য নির্দেশক। এখানে অনেক গান বাদ পড়েছে। এইটা আমার অসাবধানতা বশত হয়েছে তা কিন্তু নয়। আমি উনার অনেক গান তো এখনও শুনিইনি। এইযে যে গানটির লিঙ্ক আপনি দিলেন, সেই গানটি আমি এই প্রথম শুনছি। আর কি অদ্ভুত দেখুন, শোনার পর থেকে শুনতেই আছি, শুনতেই আছি।

মান্না দে অসম্ভব বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তাঁর এই বিনয়ের খানিকটা যদি আমরা অর্জন করতে পারতাম!

নির্ঝর অলয় এর ছবি

লেখাটা খুবই ভালো লেগেছে যদিও কিছু বানান মানা যায় না! যেমন গানগুলোর বানানঃ

অ্যায়ে মেরে পিয়ারে ওয়াতান, ঝানাক ঝানাক, নাদিয়া চালে, তেরে নায়না, আ যা সানাম, ইয়ে নাদি কা কিনারা ইত্যাদি "ক্ল্যাসিকাল" বানানটাও কানে কেমন ঠেকে! হিন্দি ও সংস্কৃতে 'অ'কারান্ত স্বরধ্বনিগুলোর উচ্চারণ একটু "আ" ঘেঁষা বটে, কিন্তু কখনোই আ-কারান্ত নয়। নদী শব্দটি বাংলায় বহুল প্রচলিত একে নাদি বললে অর্থও পালটে যায় যায় কিন্তু। আপনি যদি খেয়াল বা খ্যাল গানে বন্দিশগুলো ( আমাদের দেশে অনেক টি,ভি চ্যানেলেই একে "বান্দিশ" বলে, নকীব খান নিয়াজ মোঃ চৌধুরীর অনুষ্ঠানে বলেছিলেন!) খেয়াল করলেই বুঝবেন। ওয়াতান টা আসলে সংস্কৃত বর্ণমালার 'পেটকাটা' ব, ওকে ওয়াতন বা বত্ন- দুইভাবে লেখার চল আছে।

এমনকি আমির খাঁ সাহেবের আসল বানান অমীর খান!! বুঝুন ঠ্যালা! কিন্তু বাংলায় আমির উচ্চারণটি প্রচলিত, নাদি নয়।

মান্না দে সত্যিকার অর্থে ছিলেন সব রকম গানে পারদর্শী একমাত্র শিল্পী। কিশোর রাগের ওপর কিছু অসাধারণ গান গাইলেও একেবারে খেয়াল বা ঠুমরীর অঙ্গে গাইবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না, তালিমের অভাবে যার দায় সম্পূর্ণ ওঁর পিতার যিনি তাঁকে গান শিখতে দেন নি। রফিসাহেবেরও ক্ল্যাসিক্যাল গানের পাক্কা তালিম পাননি। পণ্ডিত জীবনলাল মাতোর কাছে চলনসই তালিম পেয়েছিলেন।

আপনার তালিকায় মান্না দের সবচেয়ে স্মরণীয় প্লেব্যাক গানটি নেই যেখানে তাঁকে পণ্ডিত ভীমসেনজিকে পরাজিত করবার অসম্ভব মিশনে নামতে হয়েছিল। বসন্ত রাগের দ্রূত খেয়াল ভাঙা গানটি "কেতকী গুলাব জুহি চম্পক বনফুলে"- এই গানটি আসলে মান্না দে ছাড়া আর কোন প্লেব্যাক শিল্পীই গাইতে পারতেন না। ভীমসেনজি ছিলেন মান্না দের চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু সম্মানে বড়। তাই তিনি মান্না বাবুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন যে কেন তিনি রাগসঙ্গীত শিল্পী হননি? মান্না বাবু অত্যন্ত সততার সাথে রাগসঙ্গীৎ শিল্পীর কঠোর জীবনব্যাপী শ্রম ও দীর্ঘদিন অখ্যাত থাকার কারণটি দেখিয়েছিলেন।

মান্না দে'র মতে "কিশোরের মত আর্টিস্ট আমাদের ভারত বর্ষে জন্মে নি ওরকম গলাও ভারতবর্ষে হয়নি- অত ভালো গলা।" (এই সাক্ষাৎকারটি ইউটিউবে আছে)।

গলার দিক থেকে কিশোর এবং হেমন্তকেই সেরা মেনেছেন বোদ্ধারা -যদিও এই দুই মহান শিল্পীর কারোরই প্রথাগত রাগসঙ্গীতের তালিম ছিল না। হেমন্ত মোট এক-দেড় বছর শিখেছিলেন। অনেকে একে তাদের গলার অনন্যতা ও সরলতার কারণ হিসেবে গণ্য করলেও আমি মনে করি তালিমের অভাব এই দুই হীরককণ্ঠকে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ করেছিল। আমি হেমন্ত-কিশোরের বিশাল ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও বলব একমাত্র মান্না দে-ই সত্যিকারের ভার্সেটাইল সিঙ্গার। কারণ খেয়াল গাইবার ক্ষমতা প্লেব্যাক শিল্পীদের মধ্যে শুধু তারই ছিল। রফি সাহেবের "মধুবন মে রাধিকা" আমি ভুলিনি- কিন্তু মান্না দের গানে সত্যিকারের খেয়ালের ছোঁওয়া থাকত ফিল্মী গানা মনে হোত না।

আমি কাউকেই ছোট করছি না বরং এটা বলছি যে বৈচিত্র্যে মান্না বাবুই সেরা তাঁর শিক্ষার কারণে যার সূচনা কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে, পরবর্তীতে দবীর খাঁ সাহেব, পাতিয়ালার আমানত আলী খান সাহেব (ইনি কিন্তু ফতে আলীর ভাই ও শাফকাতের পিতা নন, এর গানও পাওয়া যায় না) এবং সহসওয়ানের গুলাম মুস্তফা খাঁ সাহেবের কাছে যা সুসম্পন্ন হয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর মননশীল রুচি ও সাধারণ শিক্ষা। আর মান্না দের গলাও যৌবনে দুরন্ত ছিল। বৃদ্ধ বয়সে কম্পন তো আসবেই! ওর বাংলা সুপারহিট গানগুলোর অধিকাংশই ঊনসত্তর বছর বয়সের পড়ে গাওয়া। এ মুহূর্তে হাতের কাছে বই নেই বলে বিশদ উদাহরণ দিতে পারলাম না।

লেখাটি উচ্চমানের, বানান রীতিসিদ্ধ নয় বলে বললাম- তাই বলে রাগ করে বসবেন না যেন! :) আরো লিখুন।

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ নির্ঝর। আসলে শুধু ধন্যবাদ নয়, আমার কৃতজ্ঞতা নিন। অনেক কিছু জানলাম আপনার মন্তব্য থেকে। আসলে কি জানেন, হিন্দি ভিন ভাষা হবার কারণে শুধু উচ্চারণের ওপর ভরসা রেখে লিখে গেছি। আমি নিজে হিন্দি চলচ্চিত্রের একজন উৎসুক দর্শক- পাঠক- শ্রোতা। এর আগেও সচলে আমি গুলজার সম্পর্কে লিখেছি। আবার শশী কাপুরের ওপর একটি লেখা প্রস্তুত করে রেখেছি প্রায় বছর খানেক হল। কিন্তু আপনার মন্তব্যের আগে কখনোই বানান নিয়ে সেভাবে সতর্ক থাকিনি। আপনি তো মশাই ভয় ঢুকিয়ে দিলেন! হিন্দি ভাষা যখন বাংলায় লিখছি তখন বানানে কোথায় গলদগুলি থেকে যাচ্ছে, তার জন্য তো অনেক জানা শোনা থাকা দরকার। আমি জানিনা আদৌ সেটা রপ্ত করতে পারবো কিনা।

আসলে আমি যে গানের তালিকাটি দিয়েছি সেটি অসম্পূর্ণ একেবারেই। আমার ইচ্ছে ছিল তালিকাটি হবে উনার হিন্দি গানে উনার কণ্ঠের বৈচিত্র্য নির্দেশক কিছু। কিন্তু আপনি যথার্থই বলেছেন যে, এই তালিকায় "কেতকী গুলাব জুহি চম্পক বনফুলে" গানটি অবশ্যই আসা দরকার ছিল। আমি অবশ্য গানটি যুক্ত করে দেব। গানটি মান্নার এক বিশাল সাংগীতিক অর্জন যেটি নিয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উনি গর্ব করে বলেছেন। উপরে একটি মন্তব্যে আমি একটি লিংক দিয়েছি যেখানে উনার মজার একটি ভাষ্য আছে গানটি সম্পর্কে।

'জীবনের জলসাঘরে' বইটি হাতের কাছে থাকলে আরও অনেক ছোট ছোট টিট বিটস দেয়ার ইচ্ছে ছিল। সেটি হলনা এই যাত্রায়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, মান্নাকে নিয়ে লেখার জন্য আপনি উদ্যোগ নিতে পারেন। আপনার গানের জগত নিয়ে জানা শোনার পরিধি অনেক বেশি বলে মনে হল। আর চমৎকার লেখার হাত আপনার। আপনার সূত্রে অনেক কিছু জানাও হয়ে যাবে। লিখুন না?

পুনরায় ধন্যবাদ জানাই। আর রাগ করার তো প্রশ্নই নেই। বরং এই সুযোগে কৃতজ্ঞতাটুকু আরেকবার জানিয়ে রাখলাম।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

দারুণ...

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ কড়িকাঠুরে। ভালো থাকবেন।

মনি শামিম এর ছবি

দিপু ভাই, ধন্যবাদ নিন। বাসা শিফট করা নিয়ে ঝামেলায় আছিরে ভাই। পাঁচ বছর পর এই প্রথম আমার পরিবার এলো ইটালিতে। তাই সচল থেকে লেখায় চার মাসের বিরতি নিয়েছিলাম। ওরা ফিরে যাবার পর আবার নিলাম লেখার খাতা। এমনকি সচলে কোনও লেখাও পড়া হয়নি চার মাস আমার দুই কন্যার জ্বালায়! আবার এলাম। সচল আমাকে লিখেছে, 'শুভ পুনরাগমন, মনি শামিম!' এখন ভালোয় ভালোয় তা শুভ হলেই হয়। অন্যের রচনায় আমার মিথস্ক্রিয়া বেশ কম। আপাতত সেই কাজটুকু বেশী করে করতে চাই। আপনার কি খবর দিপু ভাই? আপনার ভ্রমনের নতুন লেখা কই? জমিয়ে দিচ্ছেন তো!

ঈয়াসীন এর ছবি

চমৎকার। অনেক দিন পর আপনার লেখা পেলাম। ভাল লাগলো ভাই।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

এক লহমা এর ছবি

অসাধারণ মানুষকে নিয়ে অসাধারণ পোস্ট মণি-দাদা! বরাবর যেমন হয়!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা। আরও লেখা আসবে সামনে। আপনার লেখাও পড়ছি।

মনি শামিম এর ছবি

ধন্যবাদ জিপসি। গত চার মাস সচলের বাইরে ছিলাম। বেশ কিছু লেখার খসড়া মাথার ভেতর গুঁজে রেখেছি। সেগুলি সচলের পাতে একে একে তুলে দেব। এখন আপনাদের লেখা পড়ছি। শুভেচ্ছা নিন।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার তথ্যবহুল লেখা (Y)
আপনাকে বেশ কিছুদিন ধরেই খুঁজছিলাম, শুভ প্রত্যাবর্তন।

…… জিপসি

অতিথি লেখক এর ছবি

মুকুটটাতো পড়েই আছে
রাজাই শুধু নেই--------
খুব ভালো লেখা মণিদা।
মান্না দের বাংলাগান শুনেছি বেশী অন্যভাষার গানের চেয়ে। আপনার এই লেখার কল্যাণে খুব আগ্রহ হচ্ছে গানগুলো ভালোভাবে শোনার।
ভালো থাকবেন।

--------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।