ব্রায়ান ডি পালমা ইন্টারভিউজ

মনি শামিম এর ছবি
লিখেছেন মনি শামিম [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৪/০৫/২০১৮ - ১১:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুইন্টিন টরেন্টিনো: আমাদের দেখা হবার আগে, আপনাকে চেনেন এমন কারোর সাথে আমার কথা হচ্ছিল, উনি বললেন আপনি আমার রিজেরভয়ের ডগস দেখতে যাচ্ছেন। আর আমি বললাম, ‘ কি! উনি এটা একেবারেই পছন্দ করবেন না।’ ‘কিভাবে বুঝলেন?’ ’উনি সেইসব মুভি পছন্দ করেন না যেখানে মানুষ শুধু কথা বলে একে অন্যের সাথে, আর আমার এই মুভি তো সেটি নিয়েই, লোকজন কেবল কথা বলে চলেছে!’ এবং আপনি তা দেখলেন, পছন্দ করলেন ও আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। আসলে আপনি খুব মিষ্টি কিছু করতে চাইলেন, কেননা আপনি নিশ্চিত ছিলেন না তখনও যে আমি এই ছবির জন্য কোনো ডিস্ট্রিবিউটর পাবো কিনা, এবং আপনি তখন আমাকে বাস্তব পরামর্শ দিতে শুরু করলেন; যেমন তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে তুমি চলচ্চিত্র নির্মান নামক একটি ব্যাবসার মধ্যে আছো, তুমি যেমন খুশি তেমন সিনেমা নির্মান করতে তো পারবে, তবে মাঝে মাঝে তোমার একটি ‌‌ক্যারি-র দরকার হবে, যা তোমার ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ব্রায়ান ডি পালমা: ঠিক। তোমাকে এমন একটি মুভি নির্মান করতে হবে যেটা তোমাকে মূলধারায় হাজির করাবে, কেননা তুমি যতই অদ্ভুত, স্বকীয় ধরণের সিনেমা বানাও যেমন আমি অসংখ্য বানিয়েছি- গ্রিটিংস, দি ফ্যান্টম অফ দি প্যারাডাইস ও আরও অন্যান্য- কিন্তু তুমি যদি একের পর এক মুভি বানিয়ে যাও যেগুলি ব্যবসা না করে, তখন এক পর্যায়ে মুভির জন্য অর্থ সংগ্রহ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই মাঝে মাঝেই তোমাকে মূলধারায় ফিরতে হবে, তোমার স্বতন্ত্র সিনেমাটিক ক্ষমতা প্রদর্শণ করতে হবে, কোনো একটি বিশেষ শৈলীর কাজ করতে হবে এবং সবচাইতে প্রথমে আমি যেখানে সেটি করতে পেরেছিলাম এবং অত্যন্ত সফল হয়েছিলাম সেটি হচ্ছে ক্যারি। বইটি আমি পড়েছিলাম এবং বলেছিলাম, ‌‌‌এটি কিভাবে বানাতে হবে আমি জানি।’ এবং তখন যাঁরা এই বইয়ের স্বত্বাধিকারী তাঁদের খুঁজতে শুরু করলাম এবং সত্যি বলতে কি ভিক্ষে চাইলাম কাজটি করার জন্য।

ব্রায়ান ডি পালমা যখন পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন ছোট স্বাধীন চলচ্চিত্রে, গঁদারের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেননি। আঁভা গার্দ চলচ্চিত্রকার হিসেবে খানিক সুনাম কুড়িয়েছিলেন। চিনতে পেরেছিলেন রবার্ট ডি নিরোর প্রতিভা। গ্রিটিংস এ চাল চুলোহীন এক উচ্ছন্নে যাওয়া যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নিরো। মার্টিন স্করসেসি যখন মিন স্ট্রিট-এ সুদের কারবারির খপ্পরে পরা এক নেশাখোর যুবকের চরিত্রের জন্য এক তরুন অভিনেতার খোঁজ করছিলেন তখন ব্রায়ান সন্ধান দেন নিরোর। বাকিটা তো ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

একটা সময়ে এসে ব্রায়ান বুঝেছিলেন এইসব ছোটখাটো চলচ্চিত্রে নির্দেশনার কাজ করে পেটও ভরবেনা, তাঁর লক্ষ্যও অর্জন হবেনা। মূলধারার চলচ্চিত্রে তাঁকে আসতে হবে একদিন না একদিন। ক্যারি নামক উপন্যাসটি পড়ামাত্রই তিনি বুঝতে পারেন, এটির চলচ্চিত্রায়ন তিনি করতে পারবেন। বরাবরই আত্মবিশ্বাসী তিনি। কিন্তু এটিও ছোট চলচ্চিত্র, সেভাবে ফান্ড ম্যানেজ করতে পারেননি। ক্যারি মুক্তি পাবার পর খুব জনপ্রিয় হল, সমালোচকদের প্রশংসা জুটলো, স্বীকৃতিও পেলেন। মূলধারার চলচ্চিত্রে কাজ করার সার্টিফিকেট পেলেন। তাঁকে মার্টিন স্করসেসি, জর্জ লুকাস, স্টিভেন স্পিলবার্গ-দের কাতারে টেনে আনলেন কেউ কেউ।

কিন্তু তাঁর কাজকে স্বতন্ত্র বলে স্বীকৃতি দেয়া কঠিণ। তাঁর থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্রে হিচককের প্রভাব রয়েছে ব্যাপক। তাঁর সিস্টারস, দি ফিউরি, ড্রেসড টু কিল, ব্লো আউট, অবসেশন, বডি ডাবল, রেইজিং কেইন, স্নেক আইজ, ফেমি ফ্যাটালে- চলচ্চিত্রের অনেক এলিমেন্ট ভীষণ রকম হিচককিয়ান। আধিভৌতিক, রহস্যময়, হত্যা ও যৌনতানির্ভর, রক্তবিধৌত আর ভায়োলেন্ট। কিন্তু এগুলিই তাঁর ট্রেডমার্ক চলচ্চিত্র। তাঁর কনটেন্ট যেমনই হোক, যতই হিচককের থেকে ধার করা হোক, ভিন্নধর্মী ট্রিটমেন্টের কারণে তিনি বিশ্বসেরাদের কাতারে চলে এসেছেন। ব্রায়ান স্বীকার করেছেন যে তিনি আসলে একজন ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট। ড্রেসড টু কিল চলচ্চিত্রে মহিলা চরিত্রটি খুন হবার আগে যখন আর্ট গ্যালারিতে যান তখন দীর্ঘক্ষণ যে লং শটটি নেয়া হয় সেটি দেখলে যে কেউ তা বুঝতে পারবেন। এইসব আর্ট সৃষ্টির জন্যই মূলধারার চলচ্চিত্রে খাপ খাওয়ানো তাঁর জন্য কঠিণ হয়েছে। আর্থিক সাফল্য ধারাবাহিক হয়নি কোনোদিন। তাঁর চলচ্চিত্রের ডার্ক কনটেন্ট, নারীকে ভিক্টিম হিসেবে চিত্রায়ন, শুভর বিরুদ্ধে অশুভর বিজয় তাঁকে একটানা কোথাও থিতু হতে দেয়নি।

আবার যখনই তিনি চেনা জগতের বাইরে পা ফেলতে গেছেন সেখানেও মিলেছে ব্যার্থতার স্বাদ। কমেডি হিসেবে বড়ো বাজেটের বনফায়ার অফ দি ভ্যনিটিজ বক্স অফিসে এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল যে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো তাঁর জন্য কঠিণ ছিল। যুদ্ধের ছবি ক্যাজুয়ালটিজ অফ ওয়ার ব্যর্থ হয়েছে, সমালোচিত হয়েছে সাইন্স ফিকশন মিশন টু মার্স। কাজেই প্রযোজকদের একটানা আস্থা তিনি পাননি। তাঁর নিজের ভাষায়, চলচ্চিত্র পাবার জন্য তাঁকে ভিক্ষে করতে হয়েছে।

কিন্তু এই ভিক্ষের ফল তাঁকে দিয়েছে সেরার মর্যাদা। অনেক সমালোচক ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আল পাচিনো অভিনীত স্কারফেস চলচ্চিত্রটিকে সেরা ক্রাইম মুভি কিংবা সেরা গ্যাংস্টার মুভির মর্যাদা দিয়েছেন। এখন এটি একটি কাল্ট ক্লাসিক মুভি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। সম্ভবত ব্রায়ান ডি পালমার অদ্যাবধি সেরা কাজ এটিই। মনে রাখা দরকার এটি কোনো স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র নয় বরং রিমেক, তারপরেও বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্কারফেস এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায়না। পরে আল পাচিনোকে দিয়ে ব্রায়ান আরেকটি গ্যাংস্টার চলচ্চিত্র নির্মান করেন, কার্লিটো’জ ওয়ে। এটিও খুব সফল হয়। এ পর্যন্ত তাঁর নির্দেশিত সবচাইতে ব্যাবসাসফল দুটি চলচ্চিত্রের একটি ক্রাইম ড্রামা দি আনটাচেবলস এবং স্পাই মুভি মিশন ইমপসিবল। দুটি মূলধারার চলচ্চিত্রই দর্শক সমালোচক সবার প্রশংসা পেয়েছে। তবে এইসব চলচ্চিত্রের থিম কিন্তু ওই অপরাধজগতেই ঘুরপাক খেয়েছে। বোঝা যায় মানুষের অন্ধকার মনকে তিনি চিত্রায়ন করেছেন মাত্র তাতে আলো ঢালবার সাহস করেননি।

আলোচ্য বইটি “ব্রায়ান ডি পালমা ইন্টারভিউজ”, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় নেয়া ব্রায়ান ডি পালমা-র সাক্ষাৎকারের একটি সংকলন। এই সাক্ষাৎকারগুলি পড়লে ব্রায়ান ডি পালমা-র নির্দেশক হিসেবে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়। সেইসঙ্গে তাঁর নির্দেশনার স্টাইল, স্টুডিয়োকেন্দ্রিক সিনেমার সমস্যা, অভিনয়শিল্পীর সাথে নির্দেশকের সম্পর্ক- এইসব ব্যাপারে তাঁর ধারণার ‘কিছুটা’ পরিচয় পাওয়া যায়। ব্রায়ান ডি পালমা চলচ্চিত্র নির্মান করে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাত, ভায়োলেন্স ও নারীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেকে অমানবিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। বইতে সেটি নিয়েও খোলামেলা আলোচনা আছে।

তবে আমি খুব নিশ্চিত নই এই বইটি পড়ে চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীরা কিভাবে উপকৃত হবেন। ব্রায়ানের সাফল্যের পেছনে আছে তাঁর ঠাসবুনোট চিত্রনাট্য, বিচিত্র ক্যামেরা মুভমেন্ট এবং ভিন্নধর্মী ট্রিটমেন্ট। এই বিষয়গুলি নিয়ে তেমন গভীর কোনো প্রশ্ন তাঁকে করা হয়নি। বইতে আমরা হতাশ, ক্ষুব্ধ, উল্লসিত ব্রায়ান ডি পালমাকে পাই কেননা সাক্ষাৎকারের অনেকগুলি এক একটি ফিল্ম রিলিজের পরপর নেয়া। কাজেই অনেক সময় একটি একক ফিল্ম নিয়েই প্রশ্নগুলি আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ব্রায়ান ডি পালমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের সংগ্রাম, বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর অনুভব, ফিল্মলাইনে তাঁর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সরস কোনো বক্তব্য এই বইতে নেই। কাজেই ব্যক্তি ব্রায়ান ডি পালমা এই বইতে সেভাবে উন্মোচিত হননা। মনে হয় এই বই পড়ে, তাঁর কিছু সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে জানা তো হল কিন্তু ব্যক্তি ব্রায়ান ডি পালমা আমাদের হাতের নাগালের বাইরেই থেকে গেলেন। তারপরেও যেটুকু কপালে জুটলো, তাঁকে ফেলে দেবার জো নেই।

মনি শামিম


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

বইটা পড়তে ইচ্ছে করছে মনিভাই। অনেক দিন পর আপনার লেখা পেলাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মনি শামিম এর ছবি

দুই বছর পর প্রিয় সচলায়তনে লিখলাম। আগে সচলায়তনে আমার লেখা দেখলে জিল্লুর ভাই খুশী হতেন খুব, চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠতো। অভিজিৎদার মৃত্যু আমাদের মনে দীর্ঘেমেয়াদে ক্ষতর জন্ম দিয়েছে। তাই ব্লগে লেখা নিয়ে যে উচ্ছাস ছিল শুরুর দিকে সেটি সেটি আগের মতন নেই আর। তারপরেও কোনোকিছু লিখতে বসলে সচলায়তনের কথাই মনে হয় আগে। সেই ঝকঝকে লেখার পাতা, প্রকাশ হবে কিনা সে নিয়ে মৃদু হৃৎকম্পন, প্রকাশ হলে আনন্দের রোশনাই। নজরুল ভাই, ষষ্ট পান্ডব, হিমু-এরা সবাই তো লিখছেন এখনও। আমরাই কি পিছিয়ে গেলাম তবে?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যারা আঘাত হানে - কথা দিয়ে, লেখা দিয়ে, ছুরি-চাপাতি দিয়ে, গুলি-বোমা দিয়ে, অমুক ধারা তমুক ধারা দিয়ে - তারা চায় আপনি লেখা বন্ধ করে দিন, আপনি চুপ করে থাকুন, আপনি সবকিছু মেনে নেয়া শুরু করুন, এবং এক সময় ওদের তালে তাল দিতে থাকুন। আপনি লেখার মাধ্যমে আপনার মুক্ত চিন্তার প্রকাশ করছিলেন বলেই তো আঘাতটা তো আসছিল। লেখালেখিটা শুরু করেছিলেন তো নিজের ইচ্ছায়, কখনো যদি এটা ছাড়তে হয় তাহলে নিজের ইচ্ছাতেই ছাড়বেন। কারো হুমকি-ধমকিতে লেখা ছাড়লে নিজের কাছে নিজের মর্যাদাটা কি থাকে? বৈরী পরিস্থিতিতে কখনো পিছু হটতে হয় বটে, কিন্তু লড়াইটা কি ছেড়ে আসা উচিত?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মনি শামিম এর ছবি

সেটাই ষষ্ঠ পান্ডব। ভাবতেই অবাক লাগে গেল দুই বছরে কোনো লেখাই দেয়া হয়নি সচলে। আগে যাঁরা লিখতেন, তাঁদের অনেকেই সচলে আর নিয়মিত নন। এমনকি লেখা না দিয়েও যাঁরা মন্তব্য করতেন, তাঁদেরকেও দেখিনা তেমন। হঠাৎ মনে হল, দেখি আবার শুরু করে। আমি নিজেও অনেকদিন সচলায়তন থেকে দুরে ছিলাম, যদিও ফেসবুকে সরব ছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ঠিক করিনি আসলে। আপনারা আছেন, ভরসা আছে।

এক লহমা এর ছবি

কতকাল বাদে আপনার লেখা পড়লাম।

লেখা পড়ে মজা লাগল। যে বইয়ের রিভিউ সে বই আমার পড়া নেই। কিন্তু রিভিউয়ের মধ্য দিয়ে যে পালমা-কে আপনি তুলে ধরেছেন তা আমার যথার্থ মনে হয়েছে। আবার সেই কারণেই মনে হচ্ছে, পালমাকে নিয়ে আপনার নিজেরই একটা বিস্তারিত লেখা আসলে বেশ হত।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।