তখন প্রবাসে আমার প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে দ্বিতীয় সেমিস্টার চলছে। ভয়াবহ দুর্দিনের মাঝে দিন কাটাচ্ছি। প্রথম সেমিস্টার পার করলাম হোমসিকনেস আর নস্টালজিয়া নিয়ে। দ্বিতীয় সেমিস্টারে তার সাথে যোগ হয়েছে অর্থকষ্ট। দেশ থেকে আসার সময় এক সেমিস্টার চলার জন্য টাকা পয়সা যা দরকার ছিলো তা নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম দ্বিতীয় সেমিস্টার শুরু হওয়ার আগেই গ্র্যাজুয়েট এ্যাসিস্ট্যান্টশিপ জুটিয়ে ফেলবো। ব্যাস, আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
আর্থিক অবস্থা তখন এত খারাপ যে স্কুলের বেতন দেয়ার টাকাতো নেইই, বাজার করারও ব্যাবস্থা নেই। চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। কয়েকদিন ধরে স্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে সেই চেনা কাজ ডিসি অর্থাৎ ডিশ ক্লিনার হিসেবে কাজ করছি। অল্প কিছু ডলার সেখান থেকে আসার কথা। কিন্তু বেতন হতে আরও দুইদিন বাকী। বলা বাহুল্য তা দিয়ে স্কুলের বেতন দেয়া সম্ভব নয়, তবে বাজার চালিয়ে নেয়া যাবে।
কিন্তু সে তো দুইদিন পর। এই দুইদিন চলার ব্যবস্থা কী? চাল শেষ হয়েছে গতরাতে। রান্না করার মত কিছুই নেই ঘরে। সকালে গতরাতের কিছু উচ্ছিষ্ট দিয়ে নাস্তা হয়েছে। বেতন পাওয়ার আগে পর্যন্ত বাকী আছে আজ দুপুর ও রাত, কাল সকাল, দুপুর ও রাত এবং পরশু সকালের খাবার। তার মানে মোট ছয় বেলার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। পকেটে আছে বারো ডলারের মতো। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে এবং অনেক সময় নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে বাসার কাছের একটি গ্রোসারি স্টোরে গিয়ে ছয়টি ইনস্ট্যান্ট নুডুলস কিনে ফেললাম। বাকী টাকায় গ্রোসারি স্টোরের পাশের লিকার স্টোর থেকে কিনলাম সবচেয়ে সস্তা দামের বারোটি বিয়ার। একেকটি ইনস্ট্যান্ট নুডুলস একেক বেলার খাবার আর চিন্তায় যাতে রাতে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য ঘুমের অষুধ ছয়টি করে বিয়ার।
বাজার করে ঘরে ফিরে একটি ইনস্ট্যান্ট নুডুলস পেটে চাপিয়ে এবার টিভি ছেড়ে ভাবতে বসলাম। ভবিষ্যতের লক্ষন খুব খারাপ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে না পারলে আমার ক্লাসগুলো ড্রপ করে দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক ছাত্রের স্ট্যাটাস হারাবো। স্ট্যাটাস হারানো মানে গ্র্যাজুয়েট এ্যাসিস্ট্যান্টশিপ দুরে থাক, সামনের সেমিস্টার থেকে ক্লাসও নিতে পারবো না। ক্লাস নিতে হলেও নিয়ম অনুযায়ী আমাকে বৈধ আন্তর্জাতিক ছাত্র হতে হবে। শেষ পর্যন্ত বুঝি তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশেই ফিরে যেতে হবে।
চিন্তায় মাথা যখন আর কাজ করছে না, তখন দরজায় টোকা পড়লো। এই ভর দুপুরে আমার কাছে কেউ আসার কথা নয়। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দেখি অপরিচিত এক শেতাঙ্গ ও এক শেতাঙ্গিনী হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই পুরুষটি বললো, 'আপনার জন্য একটি সুসংবাদ আছে!'
এমন দুঃসময়ে এমন একটি অপ্রত্যাশিত খবরে বিশ্মিত যেমন হলাম তেমনি মনের মধ্যে কেমন যেনো এক ধরণের উত্তেজনাও টের পেলাম। সুসংবাদটি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও মনে হলো অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে যা আমার ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবে। আমি কিছু বলার আগেই মহিলাটি বললো, 'জিসাস লাভ্'স ইউ।'
প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উপলব্ধি করলাম এরা মিশনারী এবং যীশু আমাকে ভালোবাসেন সেটিই তাদের বিশেষ সুসংবাদ। এমন দুঃসময়ে এমন একটি ঘটনাকে নির্দয় রসিকতার মতই মনে হলো। হতাশার সাথে প্রচন্ড রাগও হলো। কিন্তু যাথাসম্ভব স্বাভাবিকতা বজায় রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। লোকটি বললো, 'যাদের এখনো যীশুর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়নি, আমরা তাদের কাছে তাদের প্রতি যীশুর ভালোবাসার সুসংবাদ পৌঁছে দিচ্ছি।'
আমার যে যীশুর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়নি তা তারা কী করে জানলো ভেবে অবাক হলাম। যে এলাকায় থাকতাম সেখানে অবশ্য অনেক আন্তর্জাতিক ছাত্রের বাস ছিলো। তারা বোধহয় ধরে নিয়েছিলো যে আন্তর্জাতিকদের সাথে যীশুর দেখা সাক্ষাত হয় না। আমি রাগ সামলে নিলাম ঠিকই, কিন্তু মজা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কোনো রকম ভূমিকা ছাড়া সরাসরি বললাম, 'আজ ভাত খাইনি।'
মহিলাটি ভাবলো আমি বুঝি বলতে চেয়েছি এখন আমার ভাত খাবার সময়, তাদের জন্য খেতে বসতে পারছি না। কিন্তু ইংরেজী ভালো জানি না বলে হয়তো ঠিক করে বলতে পারিনি। সে বললো, 'কোনো অসুবিধা নেই, আপনি খেয়ে নিন, আমরা আধা ঘন্টা পরে আবার আসছি।'
আমি তার ভুল ধরিয়ে দিতে বললাম, 'না, ঠিক তা নয়। ঘরে চাল নেই তাই ভাত খাইনি। চাল কেনার টাকা নেই।'
এবার দুইজন অবাক হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো না তারা। লোকটি নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, 'আমি খুব দুঃখিত। আশা করি আপনার এই অবস্থা বেশীদিন থাকবেনা। যীশুর উপর আস্থা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।'
আমি হাসি মুখে বললাম, 'স্কুলের বেতন দেয়ার টাকাও নেই। যীশুর যখন আমার জন্য এতই ভালোবাসা তখন যীশুর কাছ থেকে আমাকে কিছু টাকা যোগাড় করে দিন।'
এবার তারা বুঝতে পারলো আমি রসিকতা করার চেষ্টা করছি। দুইজনের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। লোকটি খুব গম্ভীর মুখে বললো, 'যীশুর ভালোবাসা সেরকম নয়। তাঁর ভালোবাসা বুঝতে হলে আপনাকে আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।'
আমি অত্যন্ত বিনয়ের সংগে বললাম, 'আমার মাথায় এখন অনেক চিন্তা, যীশুর ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। দুঃখিত।' তারপর দড়াম করে তাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলাম।
মন্তব্য
এই লেখাটি সচল হওয়ার পর আমার প্রথম লেখা।
আমাকে সচল হয়ে সচলায়তনে লেখালেখি করার সুযোগ করে দিয়েছেন যারা তাদের প্রতি কৃতঞ্জতা ও ধন্যবাদ। সেই সাথে সচলের সকল লেখক-পাঠকের জন্য রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা।
স্বাগতম।
জিসাস লাভ্'স ইউ ভেরী মাচ
আপনাকেও স্বাগতম!
আশা করি, জিসাস আপনাকেও ভালোবাসবেন।
সচলে স্বাগতম।
প্রবাসে খৃষ্টীয় তাবলীগের পাল্লায় পড়তে হয় প্রায়ই। ইদানিং তাদের দেখলে হাতজোড় করি। তারা হেসে সরে যায়।
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
ধন্যবাদ।
ইদানিং আমিও তাই করি, দুঃখিত বলে ক্ষমা চাওয়ার একটি ভাব করি।
Welcome to sachalayatan
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ধন্যবাদ পরিবর্তনশীল।
সচলে স্বাগতম!
যীশু কি শেষ পর্যন্ত সত্যিই আপনাকে ভালোবেসেছিলো?
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ধন্যবাদ।
যীশুর ভালোবাসা লাভের সুযোগ আরও কয়েকবার এসেছিলো। কিন্তু এই অধম প্রতিবারই হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলেছে।
তাবলিগ জামাত বা এই জাতীয় পাবলিকদের সাথে মজাক করার মজাই আলাদা
সচলায়তনে স্বাগতম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
তাবলিগ জামাতের সাথে মজাক করার ব্যাপারে আপনার সাথে একমত। তবে, সন্ন্যাসীর সাথে মজা করা ঠিক না।
সচলে স্বাগতম।
আপনার লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল। এর কারণ বোধহয় আমি নিজেও এই রকম একটা সময় পার করছি। টাকা পয়সার সমস্যা না। অন্য রকম সমস্যা যেখানে যীশু সাহায্যের কথা শুনলে আপনার মতো দু:খ পাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা।
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...
অন্যরকম সমস্যা আর যীশুর সাহায্যের কথা বলে আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন। ঘটনা লিখে ফেলুন না।
আমার কাহিনীও প্রায় একই রকম ছিল। তবে আমি ভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে এসিস্ট্যান্টশীপ পেয়েছি। প্রথম সেমিস্টারে দেশ থেকে আনা টাকায় টিউশন ফি দেবার পরে থাকা-খাওয়ার মত কোন টাকাই ছিল না আমার কাছে। কোথাও থেকে সাহায্য পাবারও কোন উপায় ছিল না। ওই পাঁচ মাস কিভাবে পার করেছি, ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে। তবে দ্বিধাহীনভাবে ওটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবন কাকে বলে ওই সময়ই চিনেছি আমি। এখন তাই কোনকিছুতেই আশাহত হই না।
সচলায়তনে স্বাগতম।
সেই সময়ের কথা মনে হলে আমারও গা শিউরে ওঠে এখন। ঠিকই বলেছেন, জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম তখন।
ওয়েলকাম। মর্মনদের খপ্পরে বোধ হয় সবাই পরছে কম আর বেশী! ঈস্ট লন্ডনে তো এখনো প্রতি উইকেন্ডে কালো খালাম্মারা যীশুর জয়জয়কার গাইতে আসে।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
কালো মরমন খালাম্মাদের হাত থেকে সাবধান থাকবেন প্লিজ।
sachalayatan loves u too
আপনাকে স্বনামে দেখতে পেয়ে অনেক ভাল লাগছে।
স্বাগতম
(আমিও গরিব পোলা।স্বাগতম ছাড়া ঘরে দেবার মত আর কিছু নাই )
=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
বুকের মধ্যে আস্ত একটা নদী নিয়ে ঘুরি
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
আপনিও গরীব নাকি? তাহলে আমি একা না।
আমারও ধন্যবাদ ছাড়া দেওয়ার কিছু নাই। কিন্তুক, গরীব বইলা কম দিমু না।
লেখাটি বেশ ভালো লাগলো। মন ছুঁয়ে যাওয়া আত্মকথন। আমি এতটা খারাপ সময় পার করিনি কিন্তু প্রতিটা ডলার গুনে খরচ করতে হতো। প্রথম সেমিষ্টার শেষে একদিন হাতে ছিলো ২ ডলার। বেতন পেতে আর একিদন দেরী হলেই ঝামেলায় হয়ে যেত। আর আমাদের ওখানেও একটা চার্চের সংগঠন ছিলো, আমি আর আমার রূমেমট (তাজাকিস্তান এর ছেলে, ধর্মপ্রান মুসলমান) ফ্রি খাওয়ার লোভে ওদের অনুষ্ঠানে যেতাম। প্রথমদিনেই আমার রূমমেট উল্টা পাদ্রী বেটাকে ইসলাম ধর্মের মাহাত্ব্য বোঝানো শুরু করল এবং আশেপাশের অন্যসব ষ্টুডেন্টেদরেকও জড়ো করে ফেলল। পাদ্রী বেটা পরে কখনো আর আমাদের জেসাস্ এর কথা বলতে আসেনি, মনে হয় ভয় পেয়েছে যে ওকে ধরে উল্টা আমার রূমমেট মুসলমান বানিয়ে দেবে।
ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের চার্চের ফ্রি খাওয়া, হুমম...
স্বাগতম।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ধন্যবাদ।
জেসাস লাভস ইউ , সেটা জেসাস ব্যাটার টাকা পয়সার টানাটানি আছে বলেই ।
ইফ য়্যূ হ্যাভ মানি , দ্যান ইউ ডোন্ট নিড জেসাস ; এন্ড ইফ য়্যূ হ্যাভ নো মানি , দ্যান জেসাস ডোন্ট নিডস ইয়্যূ ।
হ
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
আরিফ জেবতিক, সুমন চৌধুরী
কথা ঠিক। এই জন্যই হয়তো সেই মিশনারী ব্যাটা বলেছিলো যে যীশুর ভালোবাসা বুঝতে হলে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
নতুন মন্তব্য করুন